প্রাণের ভাষা বাংলাভাষা

প্রাণের ভাষা বাংলাভাষা

প্রচ্ছদ রচনা মামুন মাহফুজ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। কবি ফররুখ আহমদ যাকে বলেছেন খোদার সেরা দান। ‘ও আমার মাতৃভাষা বাংলাভাষা, খোদার সেরা দান, বিশ্বভাষার সবই তোমার, রূপ যে অনির্বাণ।’ শুধু বাংলাই যে মহান আল্লাহর দান তা কিন্তু কবি বলেননি, বরং বিশ্বের সকল ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি এবং তার সৌন্দর্য অনস্বীকার্য সে কথাও বলেছেন। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য ভাষার মাঝে বাংলাভাষার এক বিশেষ মর্যাদা এখন বিশ্বসভায় স্বীকৃত। আর সেটি হচ্ছে বাংলাভাষার গৌরবের দিনটি আজ সারা বিশ্বের মানুষের জন্য মাতৃভাষা দিবস। যে দিনটিতে বাংলাদেশের মানুষ তার মাতৃভাষা বাংলাভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। ঐতিহাসিক এই দিনটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য শোকের এবং গৌরবের।

আমরা ছোটোবেলা থেকেই যেসব কবিতা-ছড়া পড়ে বড়ো হই তা আমাদের মাতৃভাষায় রচিত। কিন্তু এর পাশাপাশি আমরা অন্যান্য ভাষাও শিখি; ইংরেজি, আরবি, হিন্দি, উর্দু ভাষাও আমাদের দেশের মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় এবং আদরণীয়। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী যখন জোর করে একটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করল এবং নানাভাবে বাংলাভাষা ব্যবহারের প্রতি অবজ্ঞা ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল তখন আমাদের দেশের বাংলাভাষী মানুষ তা মেনে নিতে পারল না। তাদের হৃদয়ের গহিনে ভেসে বেড়াতে লাগল হাহাকার। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সেই আর্তচিৎকার প্রকাশ করেন এভাবে- “মাগো, ওরা বলে, সবার কথা কেড়ে নেবে, তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না। বলো, মা, তাই কি হয়?”

না, তা হয় না। আর হয় না বলেই ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ এমন ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে তীব্র প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসে ছাত্র-জনতা। আর সেই প্রতিবাদী মানুষকে রুখতে গিয়ে, দমন পীড়ন, জেল-জুলুম হেন কোনো চেষ্টা নেই যা পুলিশ করেনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়েছে এবং পূর্ববাংলার মানুষ বুকের তাজা রক্ত দিয়েছে তবু ভাষার অধিকার ছাড়েনি। বাংলাদেশের মানুষের এই অকুতোভয় সংগ্রাম, ভাষার জন্য নিবেদিতপ্রাণ লড়াইকে শ্রদ্ধা জানিয়ে, স্মরণ করে আজ সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ তাদের মাতৃভাষা দিবস পালন করে। 


ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস


ভাষা আন্দোলন মূলত ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলার একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও এর শুরুটা হয়েছিল বহু আগে, আর এর পরিণতিও শুধু ভাষা অধিকারের মধ্য দিয়ে শেষ হয়নি বরং স্বাধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।

ভারত-পাকিস্তান আলাদা হওয়ার পর ১৯৪৭ সালের ১৭ই মে চৌধুরী খলীকুজ্জমান ও জুলাই মাসে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কেন তারা এমন প্রস্তাব দিলেন? কেবলই পাকিস্তান স্বাধীন হলো ধর্মের ভিত্তিতে, যাকে বলা হয় ঐতিহাসিক দ্বিজাতি তত্ত্ব। আর সেই দ্বিজাতি তত্ত্বের আলোকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের নিয়ে হলো পাকিস্তান আর সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের নিয়ে হলো ভারত। এতেও অনেকে গৃহহীন হয়েছে। অনেকে মাতৃভূমি ছেড়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি জমিয়েছে, উদ্বাস্তু হয়েছে। সেই ক্ষত ঢাকতে না ঢাকতেই আবার নতুন তত্ত্ব, নতুন প্রস্তাব পাকিস্তানি শাসক ও বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠে শোনা গেল। এবার একাধিক ভাষাগোষ্ঠীর ভাষাকেও জোর করে এক করে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হলো। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও ড. মুহম্মদ এনামুল হকসহ বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদ করেন। তা সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে করাচিতে এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। 

এরপর নানান ভাষা প্রস্তাবনা, বহু ভাষার সমন্বয় ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে আর ধীরে ধীরে পরিস্থিতিও কিছুটা শান্ত হয়। কিন্তু ১৯৫২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন খাজা নাজিমুদ্দিন ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় ভাষণে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারিত তার ভাষণে তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, কোনো জাতি দুটি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনি। তাই উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। মূলত এই ঘোষণাই আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। এরপর থেকে নিয়মিত চলতে থাকে ভাষা সংগ্রাম। তমদ্দুন মজলিসসহ বিভিন্ন সংগঠন, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, ছাত্র-জনতা, শ্রমিক সকলেই যোগ দেয় এসব কর্মসূচিতে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি (৮ই ফাল্গুন ১৩৫৮) ছাত্র সমাবেশের ওপর ১৪৪ ধারা আরোপ করে পুলিশ। এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও সাধারণ মানুষ, কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ শুরু করেন। তারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক, সালাম, এমএ ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ আরো কয়েকজন। এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হন। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনায় পূর্ব বাংলার সর্বত্র তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শোভাযাত্রাসহ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিকশাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামক এক কিশোর। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। কিন্তু এই নিপীড়ন কোনোভাবেই আন্দোলন দমাতে পারেনি। বরং আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে। অবশেষে তীব্র গণ আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলাভাষা প্রচলন আইন জারি করে। ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলাভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদ্যাপন করা হয়।


মহান একুশের চেতনা


যে ভাষার জন্য বাংলাদেশের মানুষ জীবন দিলো, এত নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করল সেই ভাষা কিন্তু আর নির্জীব হয়ে পড়ে রইল না। কবি-সাহিত্যিকদের কলমের ছোঁয়ায় বাংলাভাষা হয়ে উঠল আরো জীবন্ত ও প্রাণবন্ত। বাংলাদেশের এমন কোনো লেখক নেই যাদের লেখনীতে একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা দাগ কাটেনি, এমন কোনো কবি নেই যাদের কবিতায় একুশের মাহাত্ম্য তাৎপর্য ও চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি।

আজ বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা বলে এই ভাষাতেই আমরা স্বপ্ন দেখি, ছবি আঁকি, কবিতা লিখি, মনের সমস্ত ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করি। আর এই তৃপ্তিতে অনেক না পাওয়ার খেদ, ভাই হারানোর শোক ভুলে থাকি। যে ভাই আমার চলে গেছে পুলিশের গুলিতে, যে ভাই আমার জীবন দিয়েছে পিচঢালা রাজপথে.. সেই বরকত, জব্বার সালাম, শফিক আরো নাম না জানা কত ভাই কিন্তু আদৌ কি তাদের আমরা ভুলে থাকতে পারি? পারি না। 

অসংখ্য গল্প-কবিতায় আজ বাংলাভাষা-সাহিত্য ভরপুর। যে ভাষার জন্য মানুষ দীর্ঘ সংগ্রাম করেছে, জীবন দিয়েছে সেই ভাষা তো হারিয়ে যাবার নয়। আর তা হারিয়ে যেতেও দেননি আমাদের দেশের কবি-সাহিত্যিকেরা। 

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে আমাদের প্রিয় বাংলাভাষা আজ ভালো নেই। যেই চেতনার বহ্নিশিখা জ্বালিয়ে আমরা এই ভাষার অধিকার ফিরে পেয়েছি সেই ভাষাকে ঠিক ততটা যত্ন করে লালন করতে পারছি না। যতটা আবেগ দিয়ে স্মরণ করছি ঠিক ততটা ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ দিয়ে লালনপালন করছি না। কিন্তু কেন এই করুণ দশা? কারণ আমরা ক্রমাগত শিল্পবিপ্লবের স্রোতে, পুঁজিবাদের স্রোতে হাবুডুবু খাচ্ছি। আমাদের সকল কিছুর উদ্দেশ্য বদলে যাচ্ছে। মহত্ত্ব-মহানুভবতার শব্দগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে স্বার্থপরতা ও দাসত্বের মধ্য দিয়ে। অর্থলিপ্সা-বিলাসিতা-অন্য দেশের সংস্কৃতির অনুকরণ ইত্যাদি আমাদের একুশের চেতনায় ঘুণ ধরিয়ে দিচ্ছে। একে রুখতে হলে প্রথমত হীনম্মন্যতা কাটিয়ে উঠতে হবে, দ্বিতীয় জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। সাফল্য মানেই অর্থবিত্ত নয় বরং চিন্তার বিকাশ ও উন্নতি। শ্রদ্ধা করতে হবে নিজের অবস্থানকে, নিজের কাজকে, নিজের ঐতিহ্যকে। আজকের তরুণ সমাজ হয়তো কিছুটা ইতিহাস জানে, অনেকটা বিজ্ঞান জানে, জানে আধুনিকতার নিত্য নতুন পরিভাষা, কিন্তু এর মাঝে আড়াল হয়ে যাচ্ছে মিষ্টি মধুর মাতৃভাষা।

যেভাবেই হোক আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলাভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতেই হবে। এটাই মূলত একুশের চেতনা।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ