পানির নিচে বাহাদুরি

পানির নিচে বাহাদুরি

ফিচার মে ২০১৫

মৃত্যুঞ্জয় রায়#

পানির ওপরে কতজন কত কিছুই না করতে পারে। কিন্তু পানির নিচে? পানিরে নিচে তো এক মিনিট ডুবে থাকাই বিপজ্জনক। সেখানে পানির নিচে কে কত খেলা দেখাতে পারে সেটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার নয় কি? তোমাকে যদি বলা হয়, খুব তো সাইকেল চালাও, যাও তো সাগরের তলায় গিয়ে কতক্ষণ ও কাজটা করতে পারো একটু করে দেখাও তো। কিংবা দু-চারটা দড়িলাফ দিয়ে এসো তো ওখানে? কিংবা ডুব দিয়ে সাগরের কত নিচে যেতে পারো, একটু করে দেখাও তো। রাজি হবে? তুমি হয়তো হবে না। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা কেবল খ্যাতির লোভে জীবন বাজি রেখেও ওসব কাজ করতে ধ্যাড়ধ্যাড় করে নেমে পড়তে পারে পানির নিচে। নানা রকমের খেলা দেখিয়ে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। কেউ কিছু বললে বলে, আরে বাহাদুরির দেখেছটা কী? আরও কত্ত পারি? এরকমই এক মানুষের নাম আশ্রিতা ফারম্যান। পানির নিচে নানারকম বাহাদুরি করে বেশ কয়েকটি বিশ্বরেকর্ড সে করেছে! আছে আরও অনেকে। এমনকি রেকর্ড করা থেকে বিরত নেই প্রাণীরাও। উডস হোল ওশোনোগ্রাফিক ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা একটি বুল স্পার্ম তিমির ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন যে সে তিমিটা ডুবসাঁতার দিয়ে সাগরের প্রায় ২০০ মিটার পর্যন্ত নামতে পারে। আর ডুব বলে কথা? সাগরের অত গভীরে নেমেও তিমিটা সেখানে ১ ঘণ্টা ১৩ মিনিট সময় কাটায়। ডমিনিকা উপকূলের কাছে  ১৯৯১ সালে ক্যারিবীয় সাগরে সেই তিমির ডুবসাঁতারই এখন পর্যন্ত পানির সবচেয়ে গভীরে কোনো তিমির ডুবসাঁতার হিসেবে বিশ্বরেকর্ড হয়ে আছে। তবে তিমি তো পানিরই প্রাণী। পানিতে ডুব দেবে এ আর এমন বিচিত্র কী? তবে কোন পাখি যদি সে কাজ করে? পেঙ্গুইন পাখিরা সে কাজও করতে পারে। গবেষণা করে মাপা হয়েছে যে একটি এম্পারর পেঙ্গুইন সাগরের অনেক গভীর পর্যন্ত ডুব দিতে পারে। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের রস সি-তে এমনই এক পেঙ্গুইনের ৪৮৩ মিটার গভীরতায় ডুব দেয়া ছিলো একটা বিশ্বরেকর্ড। কোনো পাখি এ পর্যন্ত তার চেয়ে বেশি পানির নিচে নামতে পারেনি। আর শুধু ডুব দিয়ে উঠে আসাই নয়। সেখানে সে ১৮ মিনিট ছিলো। তবে পানির সবচেয়ে গভীরে নামতে পারে কচ্ছপ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভার্জিন আইল্যান্ডের কাছে একটি কচ্ছপের পিঠে একটি প্রেসার-সেনসিটিভ যন্ত্র বেঁধে তাকে সাগরে নামিয়ে দেয়া হয়। সেই যন্ত্রের সংকেত থেকে বুঝা যায়, কচ্ছপটি পানির তলে ১২০০ মিটার নেমে গেছে। সেটাই যে কোনো প্রাণীর পানির সবচেয়ে গভীরে নামার রেকর্ড। তবে তাই বলে ভেবো না এর চেয়েও গভীরে কোনো প্রাণী বাস করে না। সাগরের গভীরতম স্থানেও এক ধরনের মাছের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে সেটা তো আর ডুবসাঁতার নয়। তাই ওটাকে কেউ রেকর্ড হিসেবে নেয় না। এ তো গেলো প্রাণীদের কথা। কিন্তু মানুষ? কে সাগরের সবচেয়ে গভীরে ডুব দিতে পেরেছে? ইউএস নেভির ড. জ্যাকুয়াস পিকার্ড এবং লেফটেন্যান্ট ডোনাল্ড ওয়ালশ ১৯৬০ সালের ২৩ জানুয়ারি সাগরের তলে গভীরতম স্থান ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চে নেমে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। গুয়ামের ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের চ্যালেঞ্জার ডিপকেই পৃথিবীর বুকে গভীরতম স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৯৫ সালে জাপানের কাইকো এর গভীরতা মাপেন ১০৯১১ মিটার। ১৯৬০ সালের ২৩ জানুয়ারি ট্রিয়েস্ট নামে এক বিশেষ ধরনের সামুদ্রিক যানে চেপে জ্যাকুয়াস পিকার্ড ও নেভি লেফটেন্যান্ট ডোনাল্ড ওয়ালশ নামে দু’জন বিজ্ঞানী সাগরের সবচেয়ে গভীরতম অংশ মেরিয়ানা ট্রেঞ্চে নেমে এক আশ্চর্যজনক রেকর্ড তৈরি করেন। তারা ১০,৬১৫ মিটার নিচে পর্যন্ত নামতে সমর্থ হন। সাগরগর্ভের এ ফাটলটি প্রশান্ত মহাসাগরে ফিলিপিনস দ্বীপপুঞ্জের কাছে অবস্থিত। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সাগরের সেই অসীম অন্ধকারময় জগতের মধ্যেও তারা মাছের সন্ধান পেয়েছিলেন। সামুদ্রিক যানের পর্যবেক্ষণ কক্ষের স্বচ্ছ দেয়ালের ভেতর দিয়ে জোরালো সার্চলাইট মেরে তারা দেখলেন, প্রায় ফুট খানেক লম্বা একটি মাছ ধীরগতিতে সেখানে সাঁতরে চলেছে। এবার আসা যাক আশ্রিতা ফারম্যানের প্রসঙ্গে। তিনি সাগরের তলে দড়ি লাফ দিয়ে ২০০১ সালে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন। ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের এক উপকূলে পানির নিচে একনাগাড়ে তিনি ৭৩৮ বার দড়িলাফ দিতে সমর্থ হন। তবে দড়িটা ছিলো লোহার, একটা বাঁকানো লোহার শিক। আর এক রেকর্ড গড়েছেন পানির নিচে ভোজবাজি খেলা দেখিয়ে। তিনটে বল নিয়ে তিনি পানির নিচে ৪৮ মিনিট ৩৬ সেকেন্ড ধরে এক জাদুকরী খেলা দেখান। ২০০২ সালের ১৮ ডিসেম্বর নিউজিল্যান্ডে অকল্যান্ডের কেলি টার্লটনস আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ডে তিনি এ খেলা প্রদর্শন করেন। ইতালির ভিত্তোরিও ইনোসেন্টি পানির নিচে ২৩ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডে ১.২ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে এক রেকর্ড গড়েছেন। ২০০০ সালের ১২ এপ্রিল ইতালির চিয়াভেরায় একটি অলিম্পিক সাইজের সুইমিং পুলে তিনি এ কান্ড ঘটান। আর মার্ক গোত্তিলিয়েব পানির নিচে বাজান বেহালা। ওয়াশিংটন অলিম্পিয়ায় এভারগ্রিন স্টেট কলেজের সুইমিং পুলে ডুব মেরে তিনি সেই জলসঙ্গীত সৃষ্টি করেন। সাগরের তলে স্কুভা ডাইভিং এখন এক জনপ্রিয় খেলা। কিন্তু একসাথে ৫৯২ জনের এক জায়গা থেকে স্কুবা ডাইভিং এক বিরল ঘটনা বৈকি। দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান বিশ্ববিদ্যালয় একবার এ ধরনের প্রতিযোগিতার আহ্বান করে বিশ্বরেকর্ড গড়েছে। পানির নিচে হকি খেলাও হয়। সে খেলাকে বলে ওয়াটার হকি বা অক্টোপাস হকি। ১৯৫৪ সালে ইংল্যান্ডে এই খেলা শুরু হয়। সে দেশের সাউথ সি সাব-একোয়া ক্লাব এ খেলার প্রবর্তক। বর্তমানে এটি একটি আন্তর্জাতিক খেলা। বিশ্বের অনেক দেশেই এ খেলার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮০ সালে কানাডায় প্রথম এ খেলার আন্তর্জাতিক চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। শুধু কি খেলাধুলা? পানির নিচে সবচেয়ে বড়ো বিয়ের আয়োজন করে বাহাদুরি দেখিয়েছেন টনি উইলসন ও জন স্যান্টিনো। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিন আইল্যান্ডের রেইনবো বিচে তারা ১০৫ জন বরযাত্রী নিয়ে সাগরের তলে বিয়ে করেন। সাগরের প্রায় ১০ ফুট পানির নিচে একটা জায়গায় একটা টেবিল পাতা হয়। সে টেবিলের ওপর একটি লেমিনেটেড খাতায় পানিরোধী কলম দিয়ে বিয়ের রেজিস্ট্রি করা হয়। সবার পরনে ছিল ডুবুরির পোশাক। ২০০৩ সালের সে বিয়েটাই ছিলো পানির নিচে হওয়া সবচেয়ে বড় বিয়ে। পানির নিচে বৃহত্তম সংবাদ সম্মেলনও করা হয়েছে। স্প্যানিশ সংবাদপত্র ও টিভির ১২ জনের এক সাংবাদিক দল ক্যানারি দ্বীপের কাছে সাগরের ১৬ মিটার গভীরে বসে সেই সংবাদ সম্মেলন করেন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ