পশুপাখিদের অলৌকিক ক্ষমতা   -মঈনুল হক চৌধুরী

পশুপাখিদের অলৌকিক ক্ষমতা -মঈনুল হক চৌধুরী

ফিচার আগস্ট ২০১৫

পশুপাখিদের বুদ্ধিমত্তা কিংবা তাদের অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে মানুষ সন্দেহের দোলাচলে দুলছে সেই অতীতকাল থেকে। সেকালের দার্শনিকরা সবাই এক বাক্যে রায় দিয়েছিলেন, চিন্তা করা বা কথা বলার মতো উন্নত মানসিক ক্ষমতা রয়েছে শুধু মানুষের। আর এটাই তাকে আলাদা করেছে প্রাণী জগতের অন্যান্য সদস্য থেকে। ফলে বহুদিন ধরে মানুষের  চিন্তাচেতনা দখল করে রেখেছিল এই মানবীয় অহঙ্কার। শেষ পর্র্যন্ত তাতে বাদ সাধেন চার্লস ডারউইন। প্রায় এক শতাব্দীর বেশি আগে তিনি এক তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। যার মূল কথা মানুষ এবং পশুপাখি একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত। হয়ত এ কারণেই অন্যান্য মেরুদন্ডী প্রাণীর সঙ্গে রক্ত-মাংসের এত মিল রয়েছে মানুষের। কিন্তু তাই যদি হয়, তবে মগজের ব্যাপারে এত পার্থক্য কেন মানুষ আর পশুপাখিদের মধ্যে? নাকি পশুপাখির বুদ্ধিমত্তা ও অলৌকিক ক্ষমতা আমরা উপলব্ধি করতে পারি না? ব্যাপারটি স্বচ্ছ করার জন্য নানা জাতের পশুপাখির ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। দিনের পর দিন বিজ্ঞানসম্মত হচ্ছে এ সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধারা। আর পশুপাখির বুদ্ধিমত্তা ও তাদের অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে মানুষের তাচ্ছিল্যও কমেছে সেই সঙ্গে। তবে এ পরীক্ষাগুলোর কল্যাণে অন্তত একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, প্রাণিকুলের অন্যান্য প্রজাতির সদস্যদেরও বুদ্ধি ও অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, সেই বুদ্ধি ও অলৌকিক ক্ষমতার পরিমাণ মানুষের তুলনায় কম। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, একই উপাদানে গড়া মানুষ এবং অন্যান্য মেরুদন্ডী প্রাণীর মগজে এই বুদ্ধিমত্তা ও অলৌকিক ক্ষমতার এই তফাতটুকু হলো কেন? এর কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায়নি। একদল গবেষক বলেছেন, হাতিয়ার উদ্ভাবনের জন্য মানুষ যেভাবে দিনের পর দিন মাথা খাটিয়েছে, তাতেই তার কর্মক্ষমতা বেড়েছে। তবে আরেক দল গবেষক মনে করেন, পশুপাখির মধ্যে অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে প্রবলভাবে, যা আমরা সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে অনেক সময় উপলব্ধি করতে পারি না। বিখ্যাত সার্কাস ট্রেনার ভ­াাদিমির ডুরোভ তাঁর ‘মাই ফোর ফুটেড অ্যান্ড ফিদারড ফ্রেন্ডস’ বইতে পশুপাখি সম্পর্কে অবিশ্বাস্য ও অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। পিক্কি নামে একটি ফক্সটেরিয়ার কুকুরের অলৌকিক ক্ষমতার কথা তিনি সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করেছেন। ডুরোভ বিশ্বাস করতেন, পিক্কি বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী এবং মানসিক আদেশ-নির্দেশ বুঝতে পারে খুব ভালভাবে। a-p1

তাই তো তিনি বিচিত্র সব পশুপাখি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তবে ডুরোভের সবচেয়ে মজার গবেষণা হলো, পিক্কিকে দিয়ে একটি  নেকড়ের মূর্তিকে আক্রমণ করানো। উল্লেখ্য, কুকুররা সাধারণত নেকড়েদের খুব ভয় পায়। পারতপক্ষে তাদের ধারে কাছে ঘেঁষতে চায় না। গবেষণার খাতিরে ডুরোভ করলেন কি, অবিকল আসল নেকড়ের মতো একটা খেলনা নেকড়ে তৈরি করে ওটার ভেতরে তুলো পুরে দিলেন। তার পর মনে মনে পিক্কিকে আদেশ করলেন নেকড়েটাকে আক্রমণ করতে। সঙ্গে সঙ্গে পিক্কি ঝাঁপিয়ে পড়ল নেকড়ের প্রতিমূর্তিটার ওপর। ধারালো নখের থাবায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বারোটা বাজিয়ে দিল ওটার। ডুরোভ মুখ থেকে কোন শব্দ উচ্চারণ করেননি, অঙ্গভঙ্গি করেননি, অথচ তারপরও পিক্কি কি করে তার একটার পর একটা নীরব আদেশ বুঝতে পারল, এটা রীতিমতো রহস্যজনক। শুধু কুকুররাই যে এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী তা কিন্তু নয়। আরও অনেক প্রাণীর মধ্যেই এই অলৌকিক ক্ষমতাটি বিদ্যমান, যদিও তার কোন ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা আজ পর্যন্ত দিতে পারেননি। উল্লেখ্য, ঋতু পরিবর্তনের সময় পাখিরা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে যায়। ভারতপুরের কেওয়াল ডিওমানার পবিত্র মন্দিরে প্রতি শীতে রাশিয়া থেকে উড়ে আসে হাজার হাজার পাখি। এই কঠিন যাত্রাপথে কে তাদের পথ দেখিয়ে আনে? কিছু পাখির গলায় আংটি পরানো এবং দেখা গেছে এরা মন্দিরের যে স্থানে বাসা তৈরি করে, পরের বছর সেখানেই আবার উড়ে আসে। গরমের শুরুতে আবার তারা তাদের নিজ বাসভূমিতে ফিরে যায়। নির্ভুলভাবে এই যে হাজার হাজার মাইল পথ আসা-যাওয়া, এটা কি বিস্ময়কর নয়? কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, পশুপাখি ভবিষ্যৎ ঘটনা সম্পর্কে আগেভাবে টের পেয়ে যায়। গবেষণায় জানা গেছে, শিশুদের মতো পশুপাখিও ভাবমূর্তি উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। তাই সবাই চেষ্টা করেন, শিশু এবং পশু উভয়ের সঙ্গেই ছবি তুলে নিজের সুন্দর ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে। প্রত্যেক আমেরিকান প্রেসিডেন্টকেই দেখা গেছে তাঁর পোষা প্রাণীর দ্বারা নির্বাচনী আবেদন তুলে ধরতে। যদিও পশুপাখি সম্বন্ধে আমাদের অনেকেরই ধারণা নেতিবাচক। এর কারণও রয়েছে। জনস্বাস্থ্য কর্মীরা এ বিষয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন। তাদের মতে, কুকুর কামড়ায়, ঘুঘু ও তোতা পাখি ফুসফুসে রোগ সৃষ্টি করে। বিড়াল শ্বাসকষ্ট বাড়ায়। কিন্তু এসব ছাপিয়ে  পোষা প্রাণীর স্বাস্থ্য রক্ষায় জাদুকরী ক্ষমতা মানুষকে উজ্জীবিত করেছে। বেশ কয়েক বছর আগে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা আবিষ্কার করেন যে, যে সকল ব্রিটেনবাসী কয়েক মাস ধরে কুকুর-বিড়াল পুষছেন তাঁরা বিভিন্ন রোগ, যেমন মাথা ব্যথা, পিঠ ব্যথা এবং ফ্লুতে কম ভুগছেন। অস্ট্রেলিয়ায় এক গবেষণায় জানা গেছে, যে সকল অস্ট্রেলিয়ান পশুপাখি পোষে তাদের কম রক্তচাপ দেখা যায়, যাদের পোষা প্রাণী নেই তাদের থেকে। ফলে তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি কম। পশপাখিরা যে মানুষের জীবনকে দীর্ঘায়িত করে তা জানা যায় প্রায় বছর দশেক আগে। এরিক ফ্রেডম্যান যিনি ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন, তিনি বিরানব্বই ব্যক্তির ওপর অনুসন্ধান চালান।
a-p2
তাদের জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য নেন। এক বছর পর দেখা গেল, যারা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ছিলেন, তাঁদের মধ্যে থেকে চৌদ্দজন মারা যান।  অন্য দিকে যাঁরা পশুপাখির সংস্পর্শে ছিলেন, তাঁরা বেঁচে আছেন এবং সুস্থ আছেন। আরও গবেষণা দ্বারা তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হন, পশুপাখির সংস্পর্শে মানুষের মৃত্যু আশঙ্কা শতকরা তিন ভাগ কমানো যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, যাঁরা অ্যাকুরিয়ামে মাছ রাখেন বা পরিচর্যা করেন, তাঁদের রক্তচাপ অন্যান্য ব্যক্তি, যাঁদের দেয়াল ফাঁকা, তাদের থেকে কমে যায়। অনেক দিন আগে থেকেই জানা গেছে, যা আমাদের মনে আবিষ্ট অবস্থাকে দূর করতে পারে, তার একটা শুভ প্রভাব রয়েছে আমাদের দেহের ওপর। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই যে, ভিডিওতে মাছের ছবি দেখলে অ্যাকুরিয়ামের বাস্তব মাছের চেয়ে বেশি কার্যকর ফল পাওয়া যায় রক্তচাপের ক্ষেত্রে। উল্লেখ্য, পশুপাখি আমাদের আগন্তুকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তেও সাহায্য করে। ষাট দশকের শেষের দিকে একজন আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী উল্লেখ করেন, যে সকল শিশু মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে ভয় পায়, তারা খুব সহজেই পশুপাখির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। এক ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানী সারাদিন পার্কে ঘুরে দেখেন যাদের সঙ্গে পোষা প্রাণী আছে তারা খুব সহজেই অপরের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারে। তাই পশুপাখি পারস্পরিক আদান-প্রদানের একটা মাধ্যম হতে পারে।
প্রাচীনকাল থেকেই সবার ধারণা ছিল পশুপাখির চিন্তাভাবনার গন্ডি তেমন বিস্তৃত নয়। তাই তাদের নৈতিক অধিকারের ব্যাপারেও কখনও তেমন মাথা ঘামাননি কেউ। কিন্তু যদি হঠাৎ করে আবিষ্কৃত হয় যে, পশুপাখির বুদ্ধিমত্তা ও অলৌকিক ক্ষমতা মানুষের স্তরে এসে পৌঁছেছে, তবে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। পশুপাখির বুদ্ধিমত্তা কিংবা অলৌকিক ক্ষমতা পরিমাপের এসব উদ্যোগ কিন্তু ক’জন খেয়ালি বৈজ্ঞানিকের সাময়িক প্রচেষ্টা মাত্র নয়। বরং এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পশুপাখির অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে আরও চমকপ্রদ তথ্য উদঘাটিত হবে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ