পবিত্র ঈদুল ফিতর

পবিত্র ঈদুল ফিতর

প্রবন্ধ নিবন্ধ মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ্ এপ্রিল ২০২৪

দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনা শেষে আনন্দের সওগাত নিয়ে এলো ঈদুল ফিতর। পশ্চিমাকাশে শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ উদিত হলে মুসলিম বিশ্বে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। তাকবির ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। এ এক মহা আনন্দের শুভক্ষণ।

আবহমান কাল ধরে এই জনপদে মহানন্দে ঈদ উদযাপিত হয়ে আসছে। শহর, নগর, গ্রাম-গঞ্জে এই ঈদ আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। নাড়ির টানে লক্ষ কোটি মানুষ ঈদ উপলক্ষ্যে নিজ নিজ আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফিরে যায়। ঈদ আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও ঐক্যকে সুদৃঢ় করে।

ঈদ মানে খুশি বা আনন্দ। ফিতর অর্থ ভঙ্গ। ঈদুল ফিতর অর্থ রোজা ভঙ্গের আনন্দ। আল্লাহর নির্দেশে বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিম নর-নারী, শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী পরম উৎসাহে উপবাসব্রত পালন করে। শাওয়ালের চাঁদ দেখে এই উপবাসের অবসান হয়। মানুষ নব-আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে।

ঈদ উপলক্ষ্যে সারা বিশ্বের দেড়শো কোটি মুসলমানের ঘরে ঘরে আনন্দ স্রােত বয়ে যায়। এটি রোজাদারদের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ হতে একটি বিশেষ পুরস্কার।

পুরো রমজান মু’মিন মুসলমানদের হৃদয়ে আল্লাহর করুণা লাভের পরম আকাক্সক্ষা পরিলক্ষিত হয়। রমজান যেন কুরআন পঠন-পাঠনের এক বসন্ত মাস। কেননা, এ মাসেই মহাগ্রন্থ আল কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। চারিদিকে কুরআনের কোকিলদের কলরবে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রতিটি জনপদ। পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে শুধু তারা রোজাই রাখে না, বিপুল উৎসাহে অংশগ্রহণ করে তারাবির নামাজেও। পরম তৃপ্তিতে অংশ নেয় ইফতারি ও সাহ্িরতে। এক এক করে কোনদিন যে রোজা শেষ হয়ে যায় মুত্তাকি বান্দারা টেরই পায় না। তার মনে আরও রোজা রাখার আকাক্সক্ষা তীব্রতর হয়।

রোজা শুধু নিজে উপবাস থাকা নয়। রোজা সহমর্মিতার এক উজ্জ্বল প্রদীপ। মানুষ মানুষের জন্য দরদে মন ভরে ওঠে। নিজের আত্মীয়-প্রতিবেশী ও দুস্থ মুসাফিরদের দুয়ারে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। এরপরই আসে মহানন্দের ঈদ। পৃথিবীর যে অঞ্চলেই মুসলমানদের বসবাস, সর্বত্রই এই উৎসব পালিত হয় মহা সমারোহে।


ঈদুল ফিতর বা রোজা শেষের উৎসব বিভিন্ন দেশের ভাষায় বিভিন্ন নামে পরিচিত। মজার আর বাহারি সেসব নাম। যেমন : বাংলাভাষায় রোজার ঈদ- ঈদুল ফিতরও বলা হয়; আরবি ভাষায় ঈদ-আল ফিতর; ইন্দোনেশিয় ভাষায় ঈদুল ফিতরি, হারি লেবারান; মালয় ভাষায় হারি রায়া আইদিল ফিতরি, হারি রায়া পুয়াসা, হারি লেবারান; ভারতের তামিল ভাষায় নোনবু পেরুনাল; জাভা ভাষায় নগাইদুল ফিতরি; সুদানি ভাষায় বোবোরান সিয়াম; আজারবাইজানে রামাজান বায়রামি, ওরুকুক বায়রামি; তাতার ভাষায় উরাজা বায়রাম; কিরগিজ ভাষায় ওরোজো মায়রাম; তুর্কি ভাষায় রামাজান বায়রামি; চীনের উইঘুর ভাষায় রোজি হেইত; সেনেগালের ভাষায় কোরিটে; ফারসি ভাষায় ঈদ-এ-সাঈদ-এ ফিতর; উর্দু ভাষায় ছোটি ঈদ, মিঠি ঈদ; সিন্ধি ভাষায় ঈদ নিমাজ; মালায়ালম ভাষায় চেরিয়া পেরুনাল; আলবেনীয় ভাষায় বাজরাম; সোমালি ভাষায় চিদ ইয়ার; বসনিয়ান ভাষায় রামাজানস্কি বাজরাম; স্প্যানিশ ভাষায় ফিয়েস্তা ডি লা রুপতুরা ডেল আইছুনো; ইথিওপিয়ান ভাষায় ঈদ আল-ফাতের; ডাচ ভাষায় সুইকারফিস্ট, চিনা ভাষায় কাইঝাই ডি শেনজিয়ান ইত্যাদি আরো কত কত নাম। তবে নাম ভিন্ন ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য অভিন্ন- আনন্দ আর খুশির বন্যায় ভেসে যাওয়া। সমাজের দুস্থ-দরিদ্র-অসহায়দের সেই আনন্দে শরিক করার চেষ্টা করা।

আমাদের দেশে কেউ কেউ একে ফিতরার ঈদও বলে। রোজাদারের জন্য ফিতরা প্রদান ওয়াজিব। পরিবারের প্রধান সব সদস্যের ফিতরা ঈদের নামাজের পূর্বেই গরিব-দুস্থদের মাঝে বিতরণ করেন। ফলে প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি মহল্লায়, প্রতিটি জনপদে গরিব-দুঃখীগণ ফিতরার সাহায্য পেয়ে অনেক খুশি হন। সাময়িকভাবে তাদের অভাব কিছুটা হলেও দূর হয়। তারাও সবার সাথে আনন্দে শরিক হন। ঈদুল ফিতরের এটি এক বিশেষ তাৎপর্য। সবার দুয়ারে আনন্দের অনুষঙ্গ পৌঁছে দেওয়া ইসলামের এটি এক মহান শিক্ষা।

ঈদ শুধু একার নয়। একে একে অনেকের। এটি এক যৌথ এবং সর্বজনীন উৎসব। আমাদের নবীজি এদিকে বেশি খেয়াল রাখতেন। কে না জানে সে গল্পটি! সেদিন মদিনার ঘরে ঘরে ঈদের আনন্দ। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে আতরের সুবাস। নবীজি ঈদগাহে যাচ্ছিলেন আর এক অসহায় এতিম বালক ঈদগাহের এক কোণে বসে কান্নাকাটি করছিল। তার মুখটি ছিল মলিন। পরনে ময়লা জামা-কাপড়। মদিনার অন্য শিশুরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে এদিক-সেদিক দলে দলে ঘোরাফেরা করছিল। কিন্তু এই অসহায় ছেলেটির প্রতি কেউ নজর দেয়নি। নবীজি ছেলেটির কাছে এগিয়ে গেলেন। জানতে চাইলেন তার অবস্থা। ছেলেটি নবীজিকে বললো, যুদ্ধে তার বাবা শহীদ হয়েছেন। কিন্তু অসহায় মা অন্যত্র বিয়ে করে পরের ঘরে উঠেছেন। তাকেও সে ঘরে সাথে রাখতেন। কিন্তু মায়ের স্বামী ছিল রগচটা। ঈদের দিন ভোরে তাকে বকাঝকা দিয়ে জোর করে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এখন তার মা-ও নেই বাবা-ও নেই। এ বলে সে আরও জোরে জোরে কান্না আরম্ভ করলো। নবীজি ঈদগাহে নামাজে না গিয়ে ছেলেটিকে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, ‘চলো, আমার সাথে ঘরে চলো।’ ঘরে গিয়ে প্রিয় স্ত্রী আয়েশা সিদ্দীকা (রা)-কে ডেকে বললেন, ‘দেখো তোমার জন্য এক ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে এসেছি।’ ছেলেটিকে বললেন, ‘আয়েশা তোমার মা, আমি তোমার বাবা।’

মা আয়েশা ছেলেটিকে খুব আদর করলেন। পেট পুরে খাওয়ালেন। নতুন জামা কাপড় পরিয়ে গায়ে সুগন্ধি মাখিয়ে নবীজির হাতে তুলে দিলেন। নবীজি ছেলেটিকে হাতে ধরে ঈদগাহে নিয়ে গেলেন। ক্ষণিকের মাঝেই ছেলেটি তার সকল ব্যথা ভুলে গেল।

নবীজির সুপবিত্র জীবনের এই ছোট্ট ঘটনাটিতে আমাদের জন্য রয়েছে বিশেষ শিক্ষা। তা হলো, আমরা শুধু নিজেরা সুন্দর সুন্দর ও দামি দামি জামা-পায়জামা-পাঞ্জাবি পরবো না। আমার দূরের ও কাছের কোনো অসহায় গরিব-দুঃখী আছে কি না সেদিকেও খেয়াল রাখবো। নিজের যতটুকু সামর্থ্য আছে তা নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবো। তবেই তো হবে ঈদ। অনুভূত হবে ঈদের পূর্ণ আনন্দ।

আমাদের অনেকের অতিরিক্ত জামা-কাপড় ঘরে এমনিতেই পড়ে থাকে। আবার ঈদের সময়ও বাবা-মা আত্মীয়-স্বজন আমাদের অনেক জামা-কাপড় উপহার দেন। অথচ আমার পাশেই একজনের একটি জামাও নেই। আমার অনেকগুলো জামা থেকে যদি তাকে একটি জামা উপহার দিই, তাতে তো আমার কমবেই না বরং ঐ একটি জামা পেয়ে ছেলেটি বা মেয়েটির মন আকাশ সমান আনন্দে ভরে উঠবে। আমাদের বাসায় যে ছেলেটি, মেয়েটি বা কাজের বুয়া কাজ করে তাদেরকেও ঈদের পোশাক কিনে দেওয়া উচিত।

ঈদ শুধু আনন্দের নয়। ঈদে নিজের বৃদ্ধা মা, বিয়ে দেওয়া বোন, ফুফু, খালা ও আত্মীয়-স্বজনের খবর নেওয়া একান্ত উচিত। তারা দীর্ঘ প্রতীক্ষায় চেয়ে থাকে, হাজার ব্যস্ততায় সারা বছর কাজে ডুবে থাকলেও অন্তত ঈদের সময় আমাদের দেখতে আসবে। সবচেয়ে বেশি অপেক্ষা করেন মা। তাদের বসবাস পল্লী গ্রামে। শহর থেকে অনেক দূরে।

ঈদ বাঙালি মুসলমানদের জীবনে আনন্দের এক বিশেষ অনুষঙ্গ। সংখ্যাগরিষ্ঠ রোজাদারগণ ধর্মানুভূতির সাথে ঈদ পালন করলেও নানা অপসংস্কৃতি আমাদের ঈদ উৎসবকে গ্রাস করে ফেলেছে। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার যে শিক্ষা আমরা পেয়েছি, ঈদের চাঁদ ওঠার সাথে সাথেই যেন তা বিলীন হয়ে যায়। সরকারি-বেসরকারি প্রচার মাধ্যমে ঈদের নামে যেসব আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, তার সাথে আমাদের ধর্মের ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ একমাসের রোজা পরবর্তী এগারো মাসে শরিয়ত সম্মতভাবে চলার এক বিশেষ প্রশিক্ষণ। আর ঈদের রাত তো পুণ্যময় পাঁচ রাতের একটি। এ রাতে বিশেষ নামাজ-কালাম ও দোয়া-মুনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহ মু’মিন বান্দাদের সকল আবেদন-নিবেদন পূরণ করেন।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঈদুল ফিতরের ওপর এমন এক অসাধারণ গান রচনা করে কিংবদন্তি হয়ে আছেন, যদি ঈদে সে গানটি না শোনা হয়, মনে হয় ঈদ-ই হয়নি। অপূর্ণতা থেকে যায় ঈদ উদ্যাপনে। আর তা হলো-

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে

এলো খুশির ঈদ।

তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে

শোন আসমানী তাকিদ ॥’

এ গানটির প্রতিটি স্তবকে ঈদুল ফিতরের শিক্ষা নিহিত।

ঈদগাহে ধনী-নির্ধন, আশরাফ-আতরাব, কালো-ধলো পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করে। অবশ্য মহামারি করোনার কারণে এ সময় আমাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সব নামাজ পড়তে হয়। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব একটি গুরুত্বপূর্ণ খুতবা পাঠ করেন। এরপর দোয়া মুনাজাত শেষে মুসলমানগণ একে অন্যের সাথে হাতে হাত, বুকে বুক মিলিয়ে কোলাকুলি করেন। ভুলে যান অতীতের সকল দুঃখ। সকল বিবাদ-বিসংবাদ। এই কোলাকুলিতে যে স্বর্গীয় সুখ নিহিত তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। ইসলাম যে সাম্যের ধর্ম, সহমর্মিতার ধর্ম, সহনশীলতার ধর্ম তা ফুটে ওঠে এই ঈদগাহে। ঈদ আমাদের জন্য এই অপার আনন্দ নিয়ে হাজির হয় প্রতি বছর। জাগরণের কবি ফররুখ আহমদ যথার্থই বলেছেন-

‘থোকায় থোকায় কুঁড়ি যেমন/একটা ডালে ফোটে তেমন/ঈদ জামাতে এক হ’ল মন/সব মানুষের এক সাথে।

 কেউ যাবে না কারেও ফেলে/কেউ যাবে না কারেও ঠেলে/অন্যে যদি দুঃখ পায়/খুশির কিছু নেই তাতে।

 জামাত ছেড়ে থাকবে যে/ঘরের কোণে রইবে সে/রইবে হয়ে একপেশে/একলা থাকায় দুঃখ তাই।’

ঈদগাহ ছেড়ে বাড়ির পথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়, কোলাকুলি হয় পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে। প্রতিটা ঘর হতে এদিন সেমাই, শিরনি, ফিরনি, কোরমা-পোলাওয়ের মৌ মৌ সুগন্ধ ভেসে আসে। যে যার সাধ্যমতো মেহমানদারি করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। এতে এক বেহেশতি আনন্দ ও ভালোবাসার গোলাপ ফোটে প্রতি হৃদয়ে।

ঈদের দিন যাদের মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, আত্মীয়-স্বজন দুনিয়া হতে বিদায় নিয়েছে, তারা পরম ভক্তিতে মুরব্বিদের কবর জিয়ারত করে। আত্মার মাগফিরাত কামনা করে। এই জিয়ারতের মাধ্যমে লাভ করা যায় সীমাহীন মানসিক প্রশান্তি।

আমরা মুসলমান। এক জাতি, এক বিশ্ব। আমরা বৃহৎ মুসলিম জাতিরই অংশ। বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় জন্মভূমি। এদেশের মাটিতে আমাদের জন্ম। এদেশের আলো-বাতাসে আমরা বেড়ে উঠেছি। আমরা আমাদের মাকে যেমন ভালোবাসি, আমাদের দেশকেও প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসি। পবিত্র ঈদুল ফিতরে আমরা আমাদের দেশের সকল মানুষের প্রতি প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। মহান আল্লাহ আমাদের দেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলুন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ