ধ্রুবতারা

ধ্রুবতারা

উপন্যাস ফেব্রুয়ারি ২০১৩

হাসান মুহাম্মদ মিনহাজে আউয়াল

রাতের আঁধার ভেদ করে যখন আকাশে চাঁদ উকি দিল তখন রাত অনেক। কৃষ্ণপক্ষের শেষ পর্যায় তাই ক্ষয় হতে হতে খেজুর শাখার মত চিকন হয়ে যাওয়া  চাঁদ ওঠে দেরিতে। আলোও কম। সেই মৃদু আলোয় চারপাশ অস্পষ্ট দেখা যায়। পড়াশুনা শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মতিন। টেবিলের বইপত্র শেলফে গুছিয়ে রাখল। এত রাত ধরে পড়াশুনা করে না সে। পরীক্ষা নিকটবর্তী হওয়ায় পড়তে হচ্ছে। অনেক পড়া এখনো বাকি। ঘুমুতে যাওয়ার আগে দাঁত ব্রাশ করতে করতে এসে দাঁড়াল জানালার পাশে। জানালা দিয়ে ঝিরঝির বাতাস আসছে। বাইরে তাকালে দেখল আকাশে সাদা সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। নারকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা দেখল সরু চাঁদ। দাঁত ব্রাশ শেষে মুখ ধুতে বাথরুমে ঢোকার মুহূর্তে বাইরে ‘ধুপ’ করে শব্দ  হলে থমকে দাঁড়াল। কেউ যেন ওয়াল টপকে বাসার ভেতরে নামল। কান খাড়া করলে বাসার ভেতরে কারও পদধ্বনি, কারও উপস্থিতি স্পষ্ট বুঝতে পারল। কোনো ভদ্রলোক এতরাতে কারও বাসায় চুপিসারে ঢুকবে না। তাহলে কে এলো? চোর? এখন চুরি করতে এসেছে ? তাহলে ধরতে হবে। ভাগ্য ভালো যে সে টের পেয়েছে। নাকি ডাকাত? ডাকাতের কথা মনে হতেই ভয়ে কুঁকড়ে গেল সে। ডাকাত হলে বাসার সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে টাকা পয়সা, গহনাগাঁটি তো নেবেই, হতাহতের ঘটনাও ঘটতে পারে। ভয়ে, আতঙ্কে শরীর অবশ হয়ে এলো। মাথা কাজ না করায় কী করবে প্রথমে কিছুই ঠিক করতে পারল না। প্রাথমিক হতবুদ্ধি অবস্থা কাটিয়ে উঠলে দৌড়ে গেল মাস্টার বেডরুমের দিকে ওর আব্বা-আম্মাকে ডেকে তুলতে। থানায় ফোন করতে হবে। দৌড়ে রুম ছেড়ে যাওয়ার আগে দেখল জানালা খোলা। কলাপসিবল গেইট, দরজা বন্ধ থাকায় সহজে ভেতরে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু জানালা খোলা থাকায় জানালার গ্রিল কেটে সহজে ভেতরে ঢুকতে পারবে। কিংবা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে পিস্তলের নল বাড়িয়ে গুলি করে অঘটন ঘটাতে পারে। পদধ্বনি জানালার দিকেই এগিয়ে আসায় ভয় বাড়তে লাগল। হাত থেকে ব্রাশ কখন পড়ে গেছে খেয়াল করেনি। ভয়ে ভয়ে জানালা বন্ধ করতে জানালার কপাটে হাত দেয়ার আগে সামনে উঠে দাঁড়াল হানীফ। চমকে উঠে বিকট এক চিৎকার করতে গিয়েও চিৎকার করল না মতিন, হানীফকে চিনতে পেরে। চোর, ডাকাত নয় দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও রাতের বেলা এভাবে চুপিসারে এসে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘এতো রাতে এখানে কী করছিস? এভাবে কেউ আসে? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’ এভাবে এসে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য অনুতপ্ত হলো না হানীফ, দুঃখিতও হলো না। শান্ত গলায় বলল, ‘ভয় পাবি কেন? তুই না বিকেলে বললি আমরা বড়বাড়িতে গেলে তোকে যেন ডেকে নিয়ে যাই। তাই তো তোকে ডাকতে এসেছি। আমরা এখন যাচ্ছি চল।’ মতিন নড়ল না। প্রচণ্ড ভয়ের পর রাগে তখনও শরীর কাঁপছিল। রাগের দমকে বলল, ‘ডাকতে এসেছিস এতরাতে? কেন?’ ডাকতে এসে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে ভাবেনি হানীফ। ভেবেছিল হয়ত রেডি হয়েই থাকবে বলার সাথে সাথে চলে আসবে। বিকেলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য বলল, ‘বড়বাড়িতে যাওয়ার কথা এর মধ্যে ভুলে গেলি?’ মতিন রাগ মেশানো আশ্চর্যের সুরে বলল, ‘আমি বড়বাড়িতে যাব তোকে কে বলেছে?’ মতিনের কথা শুনে হানীফ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বলবে আবার কে? তুই আমার সাথে বলেছিলি।’ মতিন রাগে নাক দিয়ে শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আর গল্প খুঁজে পেলি না, রাত-দুপুরে যাব বড়বাড়িতে চুরি করতে? খেয়েদেয়ে আর কাজ নাই। তুই যা, আমি এখন ঘুমুব।’ শেষের কথায় রাগ হল হানীফের। এতো রাতে কষ্ট করে ডাকতে এসেছে না যেতে চাইলে না যাবে, সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করবে। তা না উল্টো ধমক? একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বেশ তাই হবে। আমি গেলাম, তুই ঘুমা। তবে কাজটা ঠিক করলি না।’ মতিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল। বাসার ওয়াল টপকাতে কোনো বেগ পেতে হয়নি ওর। ওয়াল টপকানোতে বেশ এক্সপার্ট।শুধু ওয়াল টপকানো নয় বড়বাড়ির ফলফলাদি চুরি করা থেকে শুরু করে এলাকার ছেলেদের জয়েন্ট ঢিল করে দেওয়া পর্যন্ত সব কাজেই এক্সপার্ট। ছবি আঁকার হাতও খুব ভালো। এমন ভালো ছবি আঁকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ভালো নয় শুধু পড়াশুনায়। নিচের ক্লাসগুলোতে ভালোই ছিল উপরের ক্লাসগুলোতে ক্রমাবনতি। হানীফ ফিরে এল বড়বাড়ির পেছনে। বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে হিজল গাছের নিচে অন্ধকারে বসে অপেক্ষা করছিল হাবলু, বাবু আর ইসহাক। হানীফকে বিষণœ মুখে ফিরতে দেখে বাবু বুঝল সমস্যা কিছু একটা হয়েছে। জিজ্ঞেস করল, ‘মতিন আসেনি?’ হানীফ রাগ চেপে বলল, ‘না।’ বাবু বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি আগেই জানতাম ও আসবে না।’ হানীফের রাগ চাপা রইল না। শক্ত গলায় বলল, ‘না এলে কি আমি জোর করে ধরে নিয়ে আসব? বিকেলে বলল, তোরা গেলে আমাকে ডেকে নিয়ে যাস। এখন ডাকতে গেছি। বলে, বলেনি।’ হাবলু পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মতিনের না আসার একটা কল্পিত কারণ দাঁড় করিয়ে বলল, ‘বিকেলে আমাদের কথা শুনে হয়ত মনে হয়েছিল আসলে খুব মজা হবে। কিন্তু এখন হয়ত আর ভালো লাগছে না, তাই আসেনি।’ হানীফের রাগ তাতে কমল না। বরং বাড়ল। তীক্ষè গলায় বলল, ‘না আসলে না আসুক, আমরা তো ওকে আসতে বলিনি, আসার জন্য জোরও করিনি। ও যে এতদিন আসেনি তাই বলে আমাদের কোনো কাজ বন্ধ ছিল? বিকেলে বলল কেন? এরপরও বললাম বড়বাড়ির পেছনের রাস্তায় চলে আসিস। ও বলল, আমাকে ডেকে নিয়ে যাস।’ বাবু থামানোর চেষ্টা করে বলল, ‘বাদ দে ওসব। আমাদের কাজ আমরা করি।’ বাউন্ডারি ওয়ালের উত্তর-পশ্চিম কোণে এসে একে একে উঠে গেল ওয়ালের উপর। অনেক পুরনো লাল ইটের  উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল। ঝকঝকে পরিষ্কার নয়। শ্যাওলা জমেছে, কোথাও আগাছা গজিয়েছে। তবে ইট খসে পড়েনি। কেমন মজবুত তা দেখে সহজেই অনুমান করা যায়। বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে বড় বড় সেগুন, মেহগনি, হরতকী গাছ। এসব গাছের নিচে ঘন লম্বা ঘাস জঙ্গলের মত হয়ে আছে। ওয়ালের উপর উঠে লাফ দিয়ে নিচে নামার প্রয়োজন পড়ে না সব জায়গায়। পাশের বড় গাছের ডাল বেয়ে অনায়াসে নামা যায়। বাসার ভেতরে আম কাঁঠাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফলফলাদির বাগান। মাঝখানে শান-বাঁধানো ঘাটের  পুকুর। পুকুরের দক্ষিণ পাশে পুরনো আমলের রাজকীয় বাড়ি। বাসার পুবদিকে বাড়ির মেইন গেট। হাসপাতাল রোড সে দিক দিয়েই। দক্ষিণদিকের ওয়ালের পাশ দিয়ে অন্য একটা রাস্তা চলে গেছে পোস্ট অফিসের দিকে। উত্তরপাশে নবাব মসজিদের বিস্তীর্ণ ফাঁকা জায়গা। শহরের মাঝে এতো বড় এরিয়া নিয়ে গাছগাছালিতে ভরা বাড়ি দ্বিতীয়টি নেই। গভীরভাবে খেয়াল না করলে মনে হবে  কয়েকটা বাড়ি এখানে।  উঁচু প্রাচীরের জন্যই বাড়ির পুরো এরিয়া অনুমান করা যায় না। বাড়ির মালিক ওয়ারেসুল হক সাহেব সপরিবারে থাকেন দেশের বাইরে। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন জমিদার। প্রচুর ধনসম্পদ, জমিজমা ছিল তাদের। সে সব বাসাবাড়ির একটি হচ্ছে এটি। বাড়ি দেখাশোনার জন্য কেয়ারটেকার রেখেছেন। বাগানের ফলফলাদির প্রতি লোভ অনেকের। কিন্তু উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল, কেয়ারটেকার, সাপখোপের ভয়ের কারণে সুবিধা করতে পারে না। তবে হানীফদের কোনো অসুবিধা নেই। তারা উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল পার হওয়ার সহজ রাস্তা বের করেছে। বাউন্ডারি ওয়ালের উপর উঠে গাছের ডাল বেয়ে নীচে নেমে যাওয়া, এক গাছ থেকে অন্য গাছে যাওয়া-আসা করে অনায়াসে। ঘাসের মাঝে লুকালে দূর থেকে বুঝার উপায় নেই এখানে কেউ আছে। ঘন ডালপাতায় ভরা গাছে উঠে পাতার আড়ালে লুকালেও খুঁজে বের করা কঠিন। গাছপালার জন্য পাখির আনাগোনা বেশি। হরেক রকম পাখি বাসা বেঁধেছে বিভিন্ন গাছে। ক্লান্ত দুপুরে শহরের এদিকটা নির্জন থাকলেও মুখরিত থাকে পাখির গুঞ্জরনে। দক্ষিণ দিকের নারকেল গাছের নিচে এসে বাবু জিজ্ঞেস করল, ‘গাছে কে উঠবে হানীফ?’ হানীফ হাবলুর দিকে চেয়ে বলল, ‘হাবলু।’ হাবলু পেটে হাত দিয়ে বলল, ‘আমার পেটটা ভালো না, ব্যথা করছে, গাছে চড়তে বলিস না। অন্য কাউকে বল।’ ‘ইসহাক?’ হানীফ ইসহাকের দিকে তাকাল। ইসহাক বলল, ‘আমি কি প্রতিদিন গাছে চড়ব নাকি?’ গতদিনও সে গাছে চড়েছিল। হানীফ বলল, ‘ঠিক আছে আমি গাছে চড়ছি।’ দা আর দড়ি নিয়ে উঠে গেল গাছে। একটা একটা করে ডাব ছিড়ে নিচে ফেলে। নিচে পড়ে ধুপধাপ শব্দ হলে কেয়ারটেকার টের পেয়ে ছুটে আসবে লাঠি হাতে। নারকেলের বাদা দড়ি দিয়ে বেঁধে দড়ির অন্য অংশ ডালে বাঁধল। দা দিয়ে বাদা কেটে আস্তে আস্তে দড়ি ছাড়তে লাগল। বাদা মাটিতে ঠেকলে দড়ির অন্য অংশ ডাল থেকে খুলে নিচে ফেলে দিয়ে গাছ থেকে নেমে এল। বড় ঘাসের মাঝে বসলে চারপাশের ঘন গাছপালার জন্য জায়গাটা জঙ্গলের মত লাগছিল। মৃদু বাতাসের দোলায় কয়েকটা ঘাস দুলে উঠলে চাঁদের হালকা আলোয় নিঝুম পরিবেশে অবাক করা সৌন্দর্য্য খুঁজে পেল হানীফ। দা দিয়ে ডাব কেটে খাওয়ার ফাঁকে বলল, ‘দেখেছিস কেমন সুন্দর লাগছে এই পরিবেশ! আমার মনে হচ্ছে গভীর কোনো জঙ্গলে বসে রাত কাটাচ্ছি। একটা অপার্থিব অনুভূতি হচ্ছে।’ ‘আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি।’ বলল হাবলু। ‘দু’চোখচাখ ভরে দেখছি।’ ইসহাক বলল। ‘আজকের পরিকল্পনা যথার্থ হয়েছে। আজকের রাতের কথা আমার মনে থাকবে অনেকদিন।’  ঘাসের উপর শুয়ে বলল, ‘এখন আমার কাব্য করতে ইচ্ছে করছে। আগে একটু চাঁদের আলো গায়ে মেখে নেই। চাঁদের চেয়ে সূর্য কত বড়, সূর্যের আলোতে পৃথিবী আলোকিত হয়। রাতের বেলা চাঁদ যে আলো দেয় তাও সূর্যের আলো। এরপরও চাঁদ নিয়ে যত কাব্য হয়েছে হয়নি সূর্য নিয়ে। কেমনে  বুঝব যার যত বেশি অবদান তার মূল্যায়ন তত বেশি? এই গোলমেলে বিষয় মাথায় ঢোকে না। চাঁদকে নিয়ে কাব্য সবার, মুগ্ধ চাঁদের আলোয়, উৎস কোথায় কেউ ভাবে না, কেউ দেখে না সূর্য কত ভালো।’ ‘পান্না ভাইয়ের আব্বা যদি খুঁজে বের করতে পারে তাদের জানালার গ্লাস কে ভেঙ্গেছে তাহলে কাব্যচর্চা ছুটে যাবে।’ তীব্র কটাক্ষ করে মন্তব্য করল বাবু। ইসহাক ওর কথার গুরুত্ব না দিয়ে বলল, ‘আমি ভাঙ্গিনি।’ হাবলুর দিকে নির্দেশ করে বলল, ‘ভেঙ্গেছে ওই হাবড়া।’ হাবলু আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলল, ‘আমি ইচ্ছে করে ভাঙ্গিনি। গুলতি ছুড়েছিলাম পাখির গায়ে। পাখির গায়ে না লেগে লাগল জানালার গ্লাসে।’ ইসহাক বলল, ‘এখন মজা বোঝ। এমনিতেই নালিশের অন্ত নাই। রায়হানদের গেটের কলিংবেল ভেঙ্গে ফেলেছিলাম বলে গত পরশুদিনও মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছি। আজ আবার বাসায় এই নালিশ গেলে ঘোরতর বিপদ হবে। সহজে ছাড়া পাব না।’ ওদের এই দোষারোপ আর সাজা পাওয়ার ভয় দেখে হানীফ শান্ত গলায় বলল, ‘এতো টেনশন করছিস কেন? ধর জানালার গ্লাস কে ভেঙ্গেছে পান্না ভাইয়ের আব্বা খুঁজে বের করে ফেলেছে। শাস্তি হিসেবে তোর আব্বা তোকে খুব মার দিবে। এজন্য টেনশন করে এই মুহূর্তটা নষ্ট করবি কেন? মার তো তুই খাবিই আবার টেনশন করে এই সময়টাও নষ্ট করবি। ডাবল শাস্তি হয়ে গেল না? নিজে নিজে ডাবল শাস্তি পেলে না করবে কে? একদিন চল ঘুরে আসি পানিহাটা বিল থেকে, যেখানে বালিহাঁস পাওয়া যায়, বক পাওয়া যায়, ঘুরে বেড়ায় আরও পাখি। শিকার করার প্রচুর সুযোগ পাবি। সারাদিনের জন্য একটা নৌকা ভাড়া করে নেব, বিলে সাঁতার কাটব, দুপুরে নৌকার ছইয়ের নিচে বসে বিলভোজন করব। খুব মজা হবে।’ বিলভোজন শব্দ শুনে বাবু বলল, ‘সেটা আবার কী?’ ‘বনে বসে যে ভোজন তা যদি বনভোজন হয় তাহলে বিলে নৌকায় পানির উপর বসে যে ভোজন তা বিলভোজন হবে না কেন?’ ব্যাখ্যা করল হানীফ। ‘একটা নতুন টার্ম আবিষ্কার করলি।’ ইসহাক বলল। ‘বোধহয় আগে কেউ এই টার্ম ব্যবহার করেনি। বিলভোজন, হা হা হা।’ বাবু খুব প্রসন্ন হলো না। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘কিন্তু স্কুল তো খোলা।’ হানীফ বলল, ‘স্কুল তো খোলা থাকবেই। আমরা বিলভোজনে যাচ্ছি বলে স্কুল বন্ধ থাকবে নাকি?’ বাবু যা বোঝাতে চেয়েছিল এরা তা না বুঝে অন্য একটা বোঝায় সে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমি তাই বলেছি নাকি? আমি বলেছি স্কুল খোলা, স্কুলে যেতে হবে না?’ হানীফ স্কুলে যাওয়ার বিষয়টা মোটেও পাত্তা দিল না। বলল, ‘দু’একদিন না গেলে কিছু হবে না। এই সময় স্কুলে গিয়ে ওরা আর কত বেশি শিখবে? ফাইনাল পরীক্ষা দিবে আমাদের সাথেই। ক্লাস টেনে তো আমাদের আগে উঠতে পারবে না।’ বাবু চুপ করে রইল। এদের বুঝানো কঠিন। কিছু বললে উল্টো যুক্তি দেখায়, যা সে খণ্ডন করতে পারে না। হানীফ বলল, ‘কাজের কথা বল। পানিহাটা বিলে কবে যাবি?’ ইসহাক বলল, ‘তুই পরিকল্পনা করে ফেল, আমরা চলে যাব।’ ‘শুক্রবার সকালে রওয়ানা হলে কেমন হয়? শুক্র, শনি দু’দিন কাটিয়ে চলে আসব শনিবার রাতে।’ বলে হানীফ তাকাল বাকিদের দিকে। বাবুর অনীহা লাগছিল। মুখে বলতে পারছিল না। শুধু বলল, ‘দূর তো অনেক।’ হানীফ ধমক দিয়ে বলল, ‘তুই কি হেঁটে যাবি? বাসে যাবি, বাসে আসবি। বাসে যেতে আর কতক্ষণ সময় লাগে? দু’চোখ ভরে বিলের পানি দেখব, ঠাণ্ডা হাওয়া খাব, নৌকা চালাব। মারো টান হেইয়ো হেইয়ো হেইয়ো, মার টান হেইয়ো।’ হাত দিয়ে নৌকা বাওয়ার ভঙ্গি করল। ইসহাককে লক্ষ্য করে বলল, ‘নৌকা চালাতে পারিস?’ ইসহাক বলল, ‘না।’ হানীফ বলল, ‘আমিও পারি না। শিখে নেব। কি থ্রিল হবে বুঝতে পারছিস?’ ‘হু’ বলে মাথা ঝাঁকাল ইসহাক। ‘আমার তো এখনই যেতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে এখনই ঘুরে আসি। তবে মনে থাকে যেন আগামী শুক্রবার পানিহাটা বিলে যাচ্ছি।’ কথা থামিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘চল পুকুর পাড়ে কতক্ষণ বসে থাকব। পানিহাটা বিলের আগে বড়বাড়ির পুকুরের পানি চাঁদের আলোয় কেমন দেখায় দেখব।’ উঠে দাঁড়াল সে। লম্বা লম্বা ঘাস সরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাবলু বলল, ‘পুকুর পাড়ের শিমুল গাছে নাকি ভূত থাকে। অমাবস্যার রাতে গাছে বসে  কাঁদে। পুকুর থেকে মাছ খায়। আরও কত কাহিনী শুনেছি!’ হানীফ হালকাভাবে বলল, ‘তাহলে চল ভূতের সাথে একটু দেখা করে আসি।’ হাবলু আবার বলল, ‘তোর কি ভয় করছে না?’ ‘না। ভূত যদি থাকে তাহলে আজ দেখা হয়ে যাবে। আমিও দেখে নেব ভূতকে।’ কথা থামিয়ে আবার হালকা গলায় বলল, ‘এসব বানানো কথা। ভূত বলতে কিছু আছে নাকি?’ ‘জানি না।’ ইসহাক বলল। ‘আমার ভূতের ব্যাপারে আগ্রহ নাই। ভূত থাকলেই কী, না থাকলেই কী?’ পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে শান-বাধানো ঘাট। ওদিকে যাওয়া উচিত হবে না। বাসা থেকে কেয়ারটেকার জিল্লু মিয়া দেখে ফেলতে পারে। উত্তর পাড়ে কামরাঙ্গা গাছের আড়ালে বসে থাকবে। হেঁটে যেতে যেতে পুকুরের পশ্চিম পাড়ের কাঁঠাল গাছের দিকে তাকিয়ে হানীফ বলল, ‘কাঁঠালগুলো দেখা দরকার পাকল কি না।’ ‘আগামী দিন যখন আসব তখন খাওয়া যাবে। যদি জিল্লু মিয়া পেড়ে না নিয়ে যায়।’ বলল হাবলু। ‘এটাই চিন্তার বিষয়।’ বলল হানীফ। ‘বাগানের উপর সে তীক্ষè নজর রাখে। একটা ফল অন্য কেউ পেড়ে নিয়ে যাক এটা সে হতে দেবে না। আচ্ছা জিল্লু মিয়াকে ভয় দেখানো যায় না? যাতে রাতের বেলা ঘর থেকে বেরই হতে না চায়। তাহলে আমরা আমাদের কাজ নির্বিঘেœ করতে পারব।’ ‘কিসের ভয়?’ প্রশ্ন করল হাবলু। কিছুক্ষণ আগে ভূতের কথা হচ্ছিল। সে কথাই বলল, ‘ভূতের ভয়।’ হাবলু বলল, ‘কিন্তু জিল্লু মিয়া তো ভয় পাওয়ার লোক না। ভূত সেজে ভয় দেখাতে গিয়ে উল্টো নিজেরাই ফেঁসে যাব। হয়ত দেখা যাবে যে নরকঙ্কাল দিয়ে ভূত সাজব, লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে নরকঙ্কালের মুন্ডু উড়িয়ে দেবে। তখন?’ হানীফ বলল, ‘আরে না, অত সহজ না। নরকঙ্কাল, মুন্ডু এসব কিছুই আনব না। একদম সাধারণ ভূত সাজব। সারা গায়ে থাকবে কালো পোশাক, কালি মেখে মুখ কিম্ভূতকিমাকার করে ফেলব। মুখ থেকে অনবরত ছুটাতে থাকব আগুন। ভয় পাবে না আবার? অন্ধকারে আগুন দেখে ওখানেই দাঁতে দাঁত লেগে ঠাস করে মাটিতে পড়ে যাবে।’ মুখ দিয়ে আগুন ছুটানোর কথা শুনে ইসহাক আগ্রহী হয়ে বলল, ‘মুখ দিয়ে আগুন বের করবি কিভাবে?’ হানীফ বলল, ‘জাদু দেখিসনি, মুখ দিয়ে আগুন বের করে?’ ‘দেখেছি কিন্তু টেকনিক তো জানি না।’ হানীফ বলল, ‘আমি জানি। শুধু ফসফরাস যোগাড় করতে হবে। ভয় না দেখালে জিল্লুমিয়া সব সময় ডিস্টার্ব করবে। গতবার দেখলি না গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। অল্পের জন্য লাঠিটা আমার  মাথায় লাগেনি।’ ভয়ের স্মৃতি মনে হলে হাবলু বলল, ‘দৌড়ে ওয়াল পার হতে পেরেছিলাম বলে ধরা পড়িনি। সে রাতের কথা মনে হলে এখনও শিউরে উঠি।’ পুকুরের উত্তর পাড়ে কামরাঙ্গা গাছের কাছে এলে বাসার সামনের খোলা জায়গার দিকে তাকিয়ে রইল হানীফ। ওকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বাবু বলল, ‘কী হল? ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? ভূত দেখেছিস নাকি?’ হানীফ সেদিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে বলল, ‘দেখত লোকগুলো কী করছে? ’ ‘কোথায়?’ বলে বাবু এগিয়ে এল। দেখে বলল, ‘হয়ত কোনো কাজ করছে। দেখছিস না ট্রাক থেকে জিনিসপত্র নামাচ্ছে।’ ‘এ বাসায় ট্রাক কেন? আগে কোনোদিন ট্রাক দেখেছিস?’ ‘এ বাসায় ট্রাক আসতে পারে না? কত কাজেই আসতে পারে।’ বাবু বলল। ‘ব্যাপারটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। এতো রাতে ট্রাকে করে জিনিসপত্র আনার মানে কী?’ কথাবার্তা শুনে হাবলু, ইসহাকও এগিয়ে এলো। ‘তাই তো!’ বলল হাবলু। হানীফ বলল, ‘দেখতে হয় তো একটু।’ পুকুরের পশ্চিম পাড় দিয়ে বাসার দিকে এগুলে বাবু বলল, ‘বাদ দে তো এসব, দরকার নেই ওদের কাজ দেখার। তারা হয়ত কোনো  জরুার কাজ করছে আমরা গিয়ে উল্টো ধরা পড়ব। আমাদের কাজ আমরা করি।’ হানীফ কথা মানল না। বলল, ‘তারা কী করছে দেখা জরুরি।’ ‘এতো রাতে চুরি করতে এসে এমনিতেই বিপদে আছি। আব্বা যদি টের পায় আমি ঘরে নাই কী হবে ভাবতে পারছিস? তার উপর উপযাচক হয়ে অন্য একটা বিপদে জড়ানো? ভাবা যায়?’ হানীফ বলল, ‘তোরা চাইলে চলে যেতে পারিস, আমি বিষয়টা দেখে আসি।’ হানীফের অনমনীয় ভাব দেখে হাবলু, ইসহাক কোনো কথা না বলে পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। বাবুও অনিচ্ছাসত্ত্বে এলো। ততক্ষণে চাঁদ ডুবে যাওয়ায় আবার অন্ধকার নেমে এসেছে। পুকুরের পশ্চিম পাড় দিয়ে হেঁটে এসে বাসার কাছাকাছি একটা রঙ্গন ফুলগাছের ঝোপের আড়ালে দাঁড়াল। কয়েকজন লোক ট্রাক থেকে কার্টুনগুলো নামাচ্ছে। বাকিরা মাথায় করে বাসার ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। কার্টুনভরে জিনিসপত্র এ বাসায় আনার কী প্রয়োজন পড়ল? তাও আবার রাতের বেলা? সন্দেহ ঘনীভূত হতে থাকে হানীফের মনে। হানীফ ফিসফিস করে বলল, ‘কিছু বুঝতে পারছিস?’ বাবু বলল, ‘না।’ হাবলু বলল, ‘ব্যাপারটা খটকা লাগছে।’ জিনিসপত্র নামানোর পর চলে যাওয়ার জন্য ট্রাক স্টার্ট নিলে, হেডলাইটের তীব্র আলোও জ্বলে উঠল। হেডলাইটের আলো এসে পড়ল পুকুরের দক্ষিণ পাশের রাস্তাসহ রঙ্গন ফুলগাছের উপরও। হানীফ দ্রুত রঙ্গন গাছের ঝোপের  আড়ালে সরে এসে বলল, ‘সরে আয় সবাই।’ হানীফ হাবলুর দিকে চেয়ে বলল, ‘কার্টুনগুলো চেক করতে হবে। চোরাচালানের জিনিসপত্র হলে থানায় জানাতে হবে। এরা মনে হচ্ছে বড় ধরনের চোরাকারবারি। কি একটা মিশন সামনে এসে গেছে বুঝতে পারছিস?’ ইসহাক সংশয় প্রকাশ করে বলল, ‘এরা আসলেই চোরাকারবারি?’ হানীফ বলল, ‘তাই তো মনে হচ্ছে। কোন কষ্ট ছাড়া একেবারে আস্তানার খোঁজ পেয়ে গেছি। এদের ধরতেই হবে।’ হাবলু বলল, ‘কার্টুন চেক করতে ঘরে ঢোকা কি সহজ হবে? যদি চোরাকারবারি হয়ে থাকে তবে কেমন জোরদার  পাহারা থাকবে এদের ভেবেছিস?’ ‘তা তো থাকবেই। এদের ফাঁকি দিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে।’ হানীফ বলল। ‘কাজটা সহজ হবে না।’ হাবলু আবার বলল। ‘সহজ তো নয়ই, কঠিন। কঠিন হলেও বুদ্ধি একটা বের করতেই হবে। পাহারায় কেউ থাকলে কৌশলে কুপোকাত করতে হবে।’ কিছু সময় চিন্তা করে হানীফ বলল, ‘লিকুইড মরফিন হলে এদের সহজেই অজ্ঞান করে ফেলা যাবে। সাবধানে নাকে-মুখে ছুড়লেই হবে। কিছু মেল্টিং কেমিক্যালস পেলে দরজা কিংবা জানালা ভেঙ্গে সহজে ঘরের ভেতর ঢোকা যাবে। ভিডিও ক্যামেরায় জিনিসপত্রের ভিডিও করে থানায় গিয়ে দেখালে অবিশ্বাস করতে পারবে না। ব্যস কেল্লাফতে, পুরো গ্যাং ধরা পড়ে যাবে। একটা ছারপোকা হলে ভালো হতো। রুমের মধ্যে রেখে আসতাম এদের কথাবার্তা রেকর্ড করার জন্য। চোরাকারবারিদের উৎস সম্পর্কে তথ্য উদ্ধার করতে পারলে সমূলে বিনাশ করা যেত।’ উত্তেজনা অনুভব করছিল হানীফ। বলল, ‘এখনি কি ঢুকবি বাড়িতে? একেবারে হাতেনাতে ধরে ফেলব।’ বাবু মোটেও সায় দিল না। বলল, ‘এখন কোনো প্রস্তুতি আছে তোর?’ প্রস্তুতির কথা বলাতে হানীফ বলল, ‘আজ আর হচ্ছে না, প্রস্তুতি নিয়ে কাল আসতে হবে। সবাই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নে, বড় একটা অপারেশনের। সফল হলে কী রকম বিখ্যাত হয়ে যাব ভাবতে পারছিস?’ ‘হু ।’ চিন্তিতভাবে শুধু মাথা নাড়ল হাবলু। ‘নামডাক পড়ে যাবে। রাতারাতি হিরো বনে যাব। পত্রিকায় ছবি ছাপা হবে, টিভিতে সাক্ষাৎকার প্রচার করা হবে। এতো বড় কাজ করায় প্রশংসার তুবড়ি ফুটবে সবার মুখে। স্কুলে স্যাররাও দেখবি কেমন আলাদা গুরুত্ব দেয়।’ হানীফ উৎসাহ দিয়ে চাঙ্গা করতে  বলল। ‘এখন অপারেশনের কৌশল ঠিক করতে হবে। আজ রাতে বাসায় ফিরে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে ঠিক করব। এখন আর এখানে সময় কাটানোর দরকার নেই।’ হানীফ বলল। ঘাসের মধ্যে দিয়ে হেঁটে উত্তর পশ্চিম কোণের বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে এলো। যেখানে কয়েকটা ইট কিছুটা বেরিয়ে আছে। যেখানে হাত দিয়ে ধরা যায়, পা রাখা যায়। বাড়ির বাইরে এলো সবাই। বাইরে এসেও তারা নিরাপদ না। কেউ দেখলেও সমস্যা হবে। এতো রাতে বাসার বাইরে দেখে কুমতলব আছে বলে সন্দেহ করবে। বাপ-মায়ের কাছে নালিশ করবে। পুলিশ দেখলে থানায় নিয়ে যাবে। রাতের অন্ধকার রাস্তা। ল্যাম্পপোস্টগুলোর সবক’টাতে লাইট জ্বলছে না। যানবাহন নাই। মানুষজনের চলাচলও নাই। দোকানপাট বন্ধ। একটা রিকসা দেখে রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াল। একটা মোটর সাইকেল শব্দ করে দ্রুত চলে গেল। এলাকার চৌকিদার বাঁশিতে ফুরুৎ ফুরুৎ করছে। কখনো মুখে হাইস হুইস করছে। ভাবটা এমন যেন সব চোর-ডাকাত পালিয়ে যা। এই চৌকিদারের সামনে না পড়লেই হল। অন্ধকারে পথ মাড়িয়ে বাসার আঙিনায় ফিরে এলো হানীফ। অন্য সবাই চলে গেছে যার যার বাসায়। ওর রুমের পুব দিকের দরজা দিয়ে বাইরে বের  হওয়া যায়, ভেতরের প্রধান দরজা ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না। কলাপসিবল গেটের চাবি থাকে ওর কাছে। খোলার সময় খেয়াল রাখতে হয় শব্দে কেউ যেন জেগে না ওঠে। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ল। কিভাবে অপারেশন সফল করা যায় সে চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। যদি সফল হয় তবে চারদিকে কেমন ধন্য ধন্য পড়ে যাবে সে দৃশ্য কল্পনা করে রোমাঞ্চিত হচ্ছিল। দুই. বিকেলে কলেজ মাঠে ফুটবল খেলা জমে ভালো। পাড়ার সব ছেলে এসে জড়ো হয়। আগ্রহী দর্শকেরও অভাব নেই। বড় ছোট সব বয়সী দর্শক মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখে। বিকেলের এই সময়টাতে একটা নির্ভেজাল বিনোদন ব্যবস্থা সবার জন্য। দুপুরের পর সামান্য বৃষ্টি হয়েছে। মাঠ ভেজা, এখনও শুকায়নি। তবে খেলা বন্ধ নেই। নবীন ভাইয়ের সাথে কথা বলা শেষ করে যখন মাঠে এলো হানীফ তখন খেলা বেশ খানিকক্ষণ হয়ে গেছে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মাঠে নামল না। কোন্ পক্ষে নামবে এসব নিয়ে ফ্যাসাদ হবে। দাঁড়িয়ে রইল মাঠের পাশে, যারা খেলা দেখছিল তাদের সাথে। সাত্তার সাহেব তার দেড় বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিলেন। হানীফকে দেখে বললেন, ‘আজ খেলতে নামলে না যে?’ হানীফ বলল, ‘আসতে দেরি হয়ে গেছে।’ ‘তোমার সঙ্গী-সাথীদের কাউকে তো দেখছি না।’ হানীফ খেয়াল করল তাইতো বাবু, ইসহাক এরাও তো নাই। শুধু হাবলু খেলছে। টানটান উত্তেজনায় খেলা চলছে। মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে দৌড়ে প্রায় ডি-বক্সের কাছে চলে এসেছে সবুর। ওখানে কাশেম, মোশারফ বাঁধা দিয়েও আটকাতে পারেনি। সামনে এখন শুধু গোলকিপার হাশমত। গোল হয় হয়। দর্শকরাও মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিলÑ ‘ডানে কাটো, সামনে আগাও’ ইত্যাদি। এর মধ্যে আরও কয়েক জন এসে উপস্থিত হয়েছে। গোলপোস্টের সামনে বল নিয়ে কাড়াকাড়ি। সাত্তার সাহেব সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। দাঁড়িয়ে ফুটবল খেলা দেখে লাভ নাই। তারচেয়ে বড়বাড়ি ঘুরে এলে অনেক বেশি লাভ। বড়বাড়ির আশেপাশে দাঁড়িয়ে খোঁজখবর নিতে হবে কে কে আসে ওখানে, কে কোথায় যায়। অপরাধী চিহ্নিত করতে পারলে ধরা সহজ হবে। ওয়ারেসুল হক সাহেব নেই সেই সুযোগে হয়ত এখানে চোরাকারবারীরা আখড়া খুলে বসেছে। অথবা তাকে জানিয়েই সব করা হচ্ছে। দর্শকসারি থেকে সরে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই দেখল জহির এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। খেয়াল করেনি হানীফ। অন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে যেন খুব গোপন কথা বলছে এমন ফিসফিস করে বলল, ‘হানীফ ভাই! ইসহাক ভাইয়ের খবর জানেন?’ হানীফ নিস্পৃহ স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খবর?’ ‘খুব খারাপ খবর আছে। ইসহাক ভাইকে তার আব্বা খুব মারধর করেছে।’ মারধরের কথায় চমকে গেল হানীফ। বলল, ‘কেন?’ ‘গতরাতে কোথায় যেন গিয়েছিল, ফিরেছে অনেক রাতে।’ হানীফের বুক ধক করে উঠল। এখন যদি বড়বাড়িতে যাওয়ার কথা, বাকিদের নাম বলে দেয় তাহলে আরও বিপদ হবে। বিপদের কথা মনে হতেই বুকের ধুকধুকানি বেড়ে গেল। বলল, ‘তুই জানলি কী করে?’ ‘ওদের বাসায় কাজ করে সখিনার মা, সে এসেছিল আমাদের বাসায়। আম্মার সাথে আলাপ করছিল আমি শুনেছি। ইসহাক ভাইয়ের কপালে আরো খারাবি আছে। তার আব্বা খুব ক্ষেপে আছে।’ হানীফ বুঝল আজ কেন ও খেলতে আসেনি। কিন্তু বাবুর কী হল? ও আসেনি কেন? ও-ও কি ধরা পড়ল? বাবুর সাথে স্কুলেও দেখা হয়নি। স্কুলে যায়নি আজ। দেখল, মতিন খেলছে। বড়বাড়ির চারদিকে এক চক্কর ঘুরে এলো। বড়বাড়ির উল্টোদিকে জাফরানী নার্সারি। বেশ বড়ই বলতে হবে। প্রচুর পরিমাণে গাছের চারা আছে এখানে। শুধু যে ফলের চারা তাই না, ফুলের চারাও  আছে। পাশের বড় পুকুর থেকে পানি এনে ঝরনা দিয়ে দু’জন লোক গাছে পানি দিচ্ছিল। সে নার্সারির সামনে দাঁড়িয়ে গাছ দেখার ছলে বড়বাড়ির গেটের দিকে নজর রাখছিল। এখন কি গেটে গিয়ে নক করবে? বলবে বলটা ভেতরে পড়েছে। এ সুযোগে সে দেখে নেবে ভেতরটা। সাথে অন্য কেউ থাকলে ঢুকে পড়বে বাড়ির ভেতর? নাকি গল্প করবে জিল্লু মিয়ার সাথে? গতরাতে কে এসেছিল জানতে চাইবে। জানতে চাইলেই বলবে নাকি? হয়ত তখন আরও সতর্ক হয়ে যাবে। এসব ভাবল। নার্সারির গাছ দেখার পরে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে রইল। এমন সময় দেখল বড়বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে এক লোক। মোটর সাইকেলে হুঁস করে চলে গেল। লোকটা নিশ্চয় এই কাজে জড়িত। পেছনে কিছু দূর যেতেই মোটর সাইকেল দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। তবে বুদ্ধি আছে হানীফের। মোটর সাইকেলের নম্বর দেখে নিয়েছে। মনেও রেখেছে। আরও কিছু ঘটে কি না দেখার জন্য বসে রইল পুকুর পাড়ে। গাড়ির হর্ন শুনে বড়বাড়ির গেটের দিকে তাকাল। দেখল, একটা নীল রঙের প্রাইভেট কার এসে দাঁড়িয়েছে। গেট খুলে গেল, প্রবেশ করল গাড়ি। সে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। ওদিকে তখন মাগরিবের নামাজের আজান দিয়েছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। এমন সময় আরও কারও প্রয়োজন ছিল। হাবলুর খেলা শেষ হলো বোধহয়। ওকে ডাকতে হবে। আর বাসায় গিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে হবে। ফিরে এলো বাসায়। ঢোকার মুহূর্তে বাসার কাজের মেয়ে আলেয়া বলল, ‘এখন বাসায় আইসেন না। খালুজান লাঠি নিয়া ঘোরাঘুরি করতাছে।’ লাঠি নিয়ে ঘোরাঘুরির কথা শুনে ভয়ে চমকে উঠল হানীফ। গেটের বাইরে মাথা নিয়ে বলল, ‘কেন?’ ‘জানি না, আগে পালান। গতরাইতে কই গেছিলেন? চুরিচামারি না কি কইরা বাসায় ফিরছেন। অফিস থাইক্যা ফিরনের পথে কারা জানি খালুজানরে খবর কয়া দিছে।’ হানীফ দেখল তার ধারণাই ঠিক। সে বাসায় পৌঁছার আগেই খবর পৌঁছে গেছে। বাসার ভেতর তার আব্বার গলার আওয়াজ শুনল। আম্মার সাথে রাগারাগি করছে। রাস্তায় মানুষজন চলাচল করছে। কতক বাসাবাড়ি থেকে আলো এসে পড়ছে রাস্তায়। কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। কলেজ মোড়, হাইস্কুল মোড়, পুকুর পাড় সব জায়গায় খোঁজ নিয়েও হাবলুর কোনো হদিস পেল না। ওকে পেলেও দু’জন বিকেলের বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করতে পারত। বড়বাড়িতে আর একপাক ঘুরে আসার জন্য গেল। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে বাতি না জ্বলায় তখন বেশ অন্ধকার। বড়বাড়ির পেছনের দিকে উত্তর-পশ্চিম ওয়ালের কাছে এসে ওয়াল টপকাল। ঘাস, জঙ্গল সরিয়ে পুকুরের পশ্চিম পাড়ে কাঁঠাল গাছের কাছে এসেই সতর্ক হয়ে গেল। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে কারা যেন। বাসার সামনে বাতির আলো পড়ে না এমন একটা অন্ধকারময় জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তিনজন। ওদের আলাপ শুনতে পেলে ভালো হত। এই মুহূর্তে তার দরকার সহকারীর। কি সুযোগটাই সে মিস করছে। আবার উল্টো পথে ফিরে এলো বড়বাড়ি থেকে। হাঁটতে হাঁটতে নতুন বাজারে প্ল্যানেট প্লাজার সামনে এসে দাঁড়াল। টিভি শো-রুমের অনেকগুলো টিভি একসাথে চলছে। একেক টিভিতে একেক অনুষ্ঠান, তবে শব্দ নেই। শুধু ছবি দেখাই সার। ফিরে এলো বাসার কাছে। কিছুটা অসহায় লাগল নিজেকে। মনে হচ্ছে সবাই কত ভালো আছে। শুধু ও ভালো নেই। নওশাদদের বাসার জানালা দিয়ে আলো আসছে। নওশাদ নিশ্চয় পড়ছে। ওর তো পড়াই হয় না। পরীক্ষায় ভালো করবে কী করে? ইচ্ছে করে একেবারে শান্তশিষ্ট ভদ্রছেলেটি হয়ে যেতে। সবার নয়নমণি হতে। পড়ার সময় পড়ে, খেলার সময় খেলে, বাবা-মার অতি আদরের ধন। কিন্তু হতে পারে না। এখন তো আর ইচ্ছে করলেই গিয়ে পড়তে বসতে পারবে না। এই অবস্থা অবশ্য প্রথম না। আরও ঘটেছে, অসংখ্যবার। তাতে শিক্ষা হয়নি। প্রতিবারই মনে হয়েছে এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেলে আর কখনো এমন দুষ্টুমি করবে না। বিপদ কেটে গেলে আর মনে থাকে না। তিন. পরদিন হাবলুর সাথে দেখা হল মাঠের পশ্চিম পাশের পানির ট্যাঙ্কির কাছে। ছোট একটা বল নিয়ে আপন মনে খেলছিল। হানীফ কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খবর হাবলু?’ ‘ভালো।’ বল উপরের দিকে ছুড়ে আবার তা ধরার ফাঁকে বলল হাবলু। ‘রাতে বাসায় গিয়েছিলি?’ ‘না। ফুফুর বাসাতে আছি। তোর কী অবস্থা?’ ‘পালিয়ে পালিয়ে থাকি। ইসহাককে নাকি খুব মারধর করেছে?’ ‘হু। জহির তো তাই বলল।’ ‘আর মারের চোটে নিশ্চয় আমাদের নাম বলে দিয়েছে?’ ‘তাই মনে হয়। ওর আব্বা সবার বাসায় জানিয়েছে। তবু ভালো এখনও শাহী এলান দেয়নি। তাহলে সবাই জেনে যেত, আর পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো। যদি অন্য কেউ ইসহাকের আব্বাকে বলে দিয়ে থাকে তবে তাকে শায়েস্তা করতে হবে।’ হাবলু কঠিন স্বরে বলল, ‘এমন ছ্যাঁচা দেব যে সারাজীবনেও এমন ভুল হবে না। আগে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে নিক। বাবুর কী হয়েছে?’ ‘ভালোই আছে হয়ত।’ ‘গতরাতে তোকে অনেক খুঁজেছি। আচ্ছা, এই সুযোগ কি হেলায় ছেড়ে দেওয়া যায়?’ ‘কী করবি?’ জিজ্ঞেস করল হাবলু। ‘তোকে খুঁজে না পেয়ে আমি একাই গিয়েছিলাম বড়বাড়িতে।’ হাবলু কথার মাঝে আত্মপক্ষ সমর্থনের মত বলল, ‘খেলতে তো এলি না। আমিও তোকে খুঁজেছি। সন্ধ্যার পর বাসায় গিয়েছি, গিয়েই তো শুনি মহা হুলস্থূল। কে যেন বাসায় খবর দিয়েছে।’ ‘সে যাই হোক, কাল গিয়ে দেখি তিন জন পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আলাপ করছে। যে সব ক্লু পেয়েছি তাতে করে এদের ধরতে পারলেই আমরা একধাপ এগিয়ে যাব। যদি একবার শুধু সফল হতে পারি তাহলে দেখবি পরবর্তীতে আর এতো সমস্যা হবে না। তখন আমাদের প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসাবে নাম ছড়িয়ে পড়বে। পুলিশের সাথে আমাদের ভালো যোগাযোগ থাকবে। আমরা চারজন মিলে একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ সেন্টার খুলে বসব। রাখ না তোর মতিন আর ফতিন। স্যারেরা আমাদের কী রকম দাম দেবে ভাবতেই পারবি না। আমি যখন এই স্বপ্ন দেখি তখন উত্তেজনায় আমার সারা শরীর শিহরিত হয়ে ওঠে। কিন্তু ইসহাক যে ফাদে আটকে পড়েছে সে কবে যে ছাড়া পাবে, বাবুরও ওদিকে কোনো পাত্তা নেই।’ ‘সব কাজের শুরুতে একটু সমস্যা থাকবে। যেমন ধর মোটর সাইকেল স্টার্ট নেওয়ার সময় একটু বেশি খাটনি লাগে না? পরে কি আর কষ্ট করতে হয়? একবার স্টার্ট নিয়ে নিলে তখন অল্প পরিশ্রমেই অনেক দূর যায়। তেমনি এটা হচ্ছে আমাদের স্টার্ট দেওয়ার সময়। এখন একটু কষ্ট করতে হবে, ধৈর্য দরতে হবে। যখন সফল হয়ে যাব তখর আর এত কষ্ট করতে হবে না। তখন দেখবি কত জনে কেস নিয়ে আসবে। আমাদের পর্যায়ক্রমে পাহারা দেয়া প্রয়োজন। শোন্, কাল সকালে তোর দায়িত্ব হবে বড়বাড়ির আশেপাশে থাকা, যা কিছু ঘটে রিপোর্ট করা।’ (চলবে)

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ