ধ্রুবতারা

ধ্রুবতারা

উপন্যাস এপ্রিল ২০১৩

হাসান মুহাম্মদ মিনহাজে আউয়াল (গত সংখ্যার পর) সে হেঁটে কলেজ মোড় পার হয়ে চলে এলো রেললাইনে। আশেপাশের বাড়িঘর ছাড়িয়ে রেললাইন দিয়ে হেঁটে হেঁটে নির্জন একটা জায়গায় চলে এলো। দু’পাশে ক্ষেত, জলাশয়, দূরে গ্রাম। জলাশয়গুলোতে কলমিলতা, কচুরিপানা, শাপলা এসব ঘন হয়ে ঢেকে আছে। রেললাইনের দু’ধারে বনজ বৃক্ষগুলো এখন অনেক বড় হয়েছে। গাছগুলো যখন ছোট ছিল তখন থেকেই দেখে আসছে। রেললাইনের উপর লম্বালম্বিভাবে শুয়ে পড়ল। যথেষ্ট হয়েছে, আর না। এভাবে বেঁচে থাকার চাইতে না বাঁচাই ভালো। শুয়ে বলল, ‘বিদায় হে পৃথিবী! তোমার বুকে আমার আর বাঁচার ইচ্ছা নাই।’ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল সাদা মেঘগুলো ভেসে ভেসে যাচ্ছে। নীল আকাশের মাঝে কেমন একটা সাদা ছোপ রয়ে যাচ্ছে। পাশে বৃক্ষগুলোর দিকে চেয়ে বলল, ‘বিদায় হে বৃক্ষ।’ সকাল বেলা এদিক দিয়ে দু’টো ট্রেন যায়। একটা ট্রেন হলেই হবে। চাকা শুধু উপর দিয়ে গেলেই দুই টুকরো হয়ে যাবে। কায়দা মতো পড়লে আরও বেশি টুকরো হবে। ট্রেন আসার জন্য অপেক্ষায় শুয়ে রইল। শুয়ে শুয়ে দেখল কয়েকটা সাদা বক উড়ে এসে বসল একটা জলাশয়ের পাড়ে। মাছের খোঁজে এখানে আসে। থাকেও হয়ত পাশের গায়ের বড় বড় গাছের ডালে। এক সময় এখানেই বক শিকারের জন্য আসত। ফাঁদ পেতে বসে থাকত। কিন্তু একটা বকও ফাঁদে পড়েনি। সেসব স্মৃতি মনে হতেই মনটা কেমন যেন আর্দ্র হয়ে উঠল। অনেক অনেক স্মৃতি কেন যেন দ্রুত চোখের সামনে ভাসতে লাগল। পৃথিবীর প্রতি কেমন যেন মায়া লাগল। খানিকটা সময় আরো বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু এই মায়া তাকে বেঁধে রাখতে পারবে না। লাইন কাঁপতে লাগল। শোঁ শোঁ শব্দ শুনল কানে। তারমানে ট্রেন আসছে। প্রস্তুত হলো সে। শেষবারের মতো মনে মনে বলল, ‘বিদায় হে পৃথিবী।’ চিরকুট লিখে যাওয়ার কথা মনে হলোÑ আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয় কিংবা ওমুক ওমুক দায়ী। পরমুহূর্তে মনে হলো কার জন্য চিরকুট লিখে রেখে যাবে? কাউকেই আর তার ভালো লাগছে না। প্রস্তুত হয়ে চোখ বুজে রইল। ক্রমে শোঁ শোঁ আওয়াজ প্রকট হল। রেললাইনের কাঁপন বাড়ছিল। এক সময় ট্রেনের আওয়াজ পাওয়া গেল। ভয় লাগছিল। উঠে যাবে কিনা এ চিন্তাও মনে এলো। কিন্তু এত সহজে সিদ্ধান্ত বদলাবার লোক সে নয়। ট্রেনের হুইসেল কানে বাজল। তখনও চোখ বন্ধ। আর কিছুক্ষণ পর সে মুক্তি পাবে এ যন্ত্রণা থেকে। ‘মুক্তি মুক্তি’ মনে মনে উচ্চারণ করল। মুক্তি হয়ত না, আত্মহত্যা মহাপাপ এবং এতে নিশ্চিত জাহান্নাম জুটবে। পরক্ষণে মনে হলো, জাহান্নামের আজাবই ভোগ করবে কিন্তু এদের আচরণ নয়। এমন সময় পাশে কথার আওয়াজে চোখ মেলল। দেখল কয়েক জন শ্রমজীবী লোক কথা বলতে বলতে ঘুন্টির ওদিক থেকে আসছে। সে উঠে এলো। এদের সামনে শুয়ে থাকলে পাশে এসে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করবে। সে কারও প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। হাসাহাসিও করতে পারে কিংবা ধরাধরি করে সরিয়ে আনবে। সে আত্মহত্যা করবে শান্তিতে, জোরজবরদস্তি করে না। লোকগুলো চলে গেলে শুয়ে পড়বে ভাবল। লোকগুলো ওর সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে নিরাপদ দূরত্ব অতিক্রম করার আগেই ট্রেন পাশ কাটিয়ে চলে গেল অনেক দূরে। এর পরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করা যায় না। এখন মানুষজনের চলাচল আরও বাড়বে। লোকজনের কারণে শান্তিতে আত্মহত্যাও করতে পারবে না। তাহলে কিভাবে আত্মহত্যা করবে ভাবল। আত্মহত্যা না করলেও এখন আর বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে নেই। দূরে কোথাও চলে যাবে। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে নেমে এলো রেললাইন থেকে। জামতলার রাস্তা দিয়ে কলেজ মোড়ে এসে একটা রিকসায় উঠল। এখন যাবে স্টেশনে। লোকাল ট্রেনগুলোর ভাড়া কম। টিকিট না কাটলেও চলে। ও রকম কোনো লোকাল ট্রেনে চড়ে বসে থাকবে। চলে যাবে যতদূর ট্রেন যায়। ওখানে ওকে কেউ চিনবে না। এরপর সেও কোনো শ্রমজীবী মানুষের মতো হবে। পাঁচ রাস্তার মোড়ে এলে রাস্তার পূর্ব দিকে লাল ইটের বাসার দিকে নজর পড়লে কেন যেন মনে হল নবীন ভাইয়ের সাথে শেষ দেখাটা করে যাওয়া যায়। এই একটা মানুষকে এখনও ভালো লাগে। রিকসাওয়ালাকে বলল ডানে মোড় নিয়ে মসজিদের কাছে যেতে। নবীন ভাইদের বাসার কাছে এলে রিকসা থেকে নেমে এসে দাঁড়াল গেটের সামনে। বাসার ভেতরে ঢুকতে বেশি হাঙ্গামা পোহাতে হলো না। দারোয়ানকে বললে সে বাগানের বড় শিউলি ফুলের গাছটার দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা  করল। নবীন ভাই খালি পায়ে বাগানে হাঁটছিলেন। সে এগিয়ে গেল। শিউলি ফুলের গাছের নিচে অনেকগুলো লাল সাদা শিউলি ফুল পড়ে আছে। সে সেদিকে ভ্রƒক্ষেপও করল না। পাশে একটা গোলাপ ফুল গাছে থোকা থোকা সাদা গোলাপ ফুল ফুটে আছে। সেদিকেও তার দৃষ্টি গেল না। অথচ একদিন এ গোলাপ ফুল গাছের জন্য কত হৈ চৈ করত। হাঁটা থামিয়ে হানীফকে দেখে তাকিয়ে ছিলেন নবীন ভাই। হানীফ কাছে এলে বললেন, ‘এতো সকালে, কী ব্যাপার?’ হানীফ ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘দেখা করতে এলাম। আর কখনো দেখা হবে কি না সে জন্য।’ ‘কী হয়েছে? আর দেখা হবে না কেন?’ ‘আমি চলে যাচ্ছি।’ ‘কোথায়?’ ‘জানি না। অজানার উদ্দেশ্যে।’ নবীন ভাই হানীফের মুুখের দিকে ভালোভাবে তাকালে। দেখলেন, কপালের কোণায় লাল হয়ে আছে। যেন কিছু একটা আচড় কেটেছে। বাম হাতের কব্জিতে ফোলা দাগটাও চোখে পড়ল। হাতটা সোজা  করে রাখতে পাচ্ছে না। বললেন, ‘কপালে কী হয়েছে? হাতেও তো দাগ বসে গেছে।’ ‘কিছু না।’ নবীন ভাই রুমের দিকে হাঁটা ধরলেন। বললেন, ‘ভেতরে আয়।’ নবীন ভাইয়ের পেছন পেছন গেল সে। রুমে এসে বসলেন চেয়ারে। বসে আবার বললেন, ‘কী হয়েছে বল।’ এখনও যাকে বিশ্বাস করা যায়, যদি সমস্যার কথা আলাপ করা যায় তিনি হলেন নবীন ভাই। বয়সে বড় হলেও ভালো সম্পর্ক। যখন তিনি অহর্নিশ সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্য কাজ করতেন অফিসের ফুটফরমায়েস খাটার জন্য তাকে রাখতেন। ফুটবল মাঠে যখন প্র্যাকটিস করতেন তখনও সাথে রাখতেন। বলটা এনে দেয়ার জন্য, পানির বোতলটা এগিয়ে দেয়ার জন্য। যেখানে যেতেন সাথে নিয়ে যেতেন। স্নেহের পরশ ছিল তার মাথায়। এই দুঃসহ পরিস্থিতিতে তার কাছে যেন সব কথা বলা যায়। আর যাই হোক তিনি অন্তত দুঃখগুলো বুঝবেন। তার সাথে রাগারাগি করবেন না। সমবেদনা জানাতেও পারেন। হানীফ তার দুঃসহ অবস্থার কথা বর্ণনা করার ফাঁকে কয়েকবার চোখ মুছল। জনসমক্ষে কখনো কেঁদেছে এমন নজীর নেই। অন্য একটা মানুষের সামনে কাঁদছে এই সঙ্কোচবোধও চোখের পানি আটকাতে পারল না। নবীন ভাই দয়ার্দ্র হলেন না, সান্ত্বনার সুরে বললেন না, ‘কাঁদিস না সব ঠিক হয়ে যাবে। চোখের পানি আগে পড়ছে তাও ভালো, পরে পড়লে কোনো লাভ হতো না। চোখের পানিতে বালিশ ভেজালে কিংবা অর্ধেক রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে বসে থাকলেও না। এ জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় কর। নিজের শক্তি সামর্থ্যের ব্যবহার কর। এখনও সময় আছে যা টেবিলে বস, পড়াশুনা কর পরিস্থিতি পাল্টে যাবে।’ ‘কিন্তু এমন হলো কেন? সবাই কেমন রূঢ় আচরণ করা শুরু করল, যে যা বলার উপযুক্ত না তাই বলল। যে যে আচরণ করার যোগ্য না সে সেই আচরণ করল।’ নবীন ভাই সহজ ভাষায় সে উত্তর দিলেন না। বললেন, ‘তুই যদি বোবা, কালা হতি, পড়াশুনা না করে কোনো রিকসার গ্যারেজে কাজ করতি তাহলে কি আমি তোর সাথে এভাবে কথা বলতাম? আমি যদি ভীষণ অসুস্থ হতাম কিংবা ভার্সিটিতে না পড়ে বাসের হেলপার হতাম তুই আসতি আমার কাছে? আমার তোর মধ্যে ভালো সম্পর্ক আছে সত্য, তবু কিছু শক্তি সামর্থ্য, যোগ্যতা আছে বলেই একে অপরের সাথে কথা বলছি। অন্যেরা আমাদের সাথে কী আচরণ করবে সেটা নির্ভর করে আমাদের অবস্থানের উপর। সবাই যখন দেখছে বছরের পর বছর তোর পড়াশুনায় মন নেই, রেজাল্ট খারাপ করছিসÑ লোকজন তোকে কী ভাববে? সে রকম আচরণই করেছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে তখন, যখন তুই ভেবেছিস তোর দ্বারা আর পড়ালেখা হবে না। তখন তুই হয়ে গেছিস একেবারে ফেল্টুস। যে কোনো পরিবর্তনের সূচনা হয় আমাদের মনে। তুই বাস্তবে পড়াশুনা বন্ধ না করলেও যেহেতু তোর মন ও রকম হয়ে গেছে তখন লোকজনের খারাপ ব্যবহার হয়েছে অনেক বেশি। এই হচ্ছে সমস্যা। কিন্তু দ্বন্দ্ব হচ্ছে তুই যে আচরণ পেয়ে অভ্যস্ত সে আচরণই পেতে চাচ্ছিস। দ্বিতীয়ত হতে পারে হতাশা, দুশ্চিন্তা, বিষণœতা, রাগ ক্ষোভের কারণে তুই সঠিক আচরণ করতে পারছিস না। অন্যের আচরণে হঠাৎ রেগে যাচ্ছিস। অন্যের আচরণে মনে হচ্ছে তোকে অবজ্ঞা করছে। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে। ফেল্টুস ভাবার পর তোর গতিপথও পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তুই গিয়েছিস সেন্টুর দোকানের পেছনে, আমিরের সাথে গিয়েছিস সমীহ করে কথা বলতে। সিগারেট খাওয়ার চেষ্টা করেছিস। গতিপথ পাল্টে ফেলার দরুণ কুল্যে বদমায়েশ তোর সাথে ইতরামী করার সাহস পেয়েছে। তৃতীয়ত যারা খারাপ আচরণ করছে সেগুলো শক্তভাবে প্রতিরোধ করতে পারছিস না মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকার কারণে। পড়াশুনা না করলে বাপ-মা মারবেই। স্যাররা দেখতে পারবে না। কোনো পিতা-মাতাই চায় না তার সন্তান খারাপ ছেলেদের সাথে মিশুক, পড়াশুনা না করুক, নষ্ট হয়ে যাক। তাই তোর সাথে মিশতে বাঁধা দিয়েছেন। শোন, ওসব চিন্তা বাদ দে। এখন বাসায় যা পড়াশুনা কর। পরিস্থিতি পাল্টে যাবে।’ ‘এখন কি পড়াশুনা করতে পারব? বছরের কয় মাস চলে গেছে দেখেছেন? পড়াশুনা এখন মনে হয় আমার দ্বারা আর হবে না।’ ‘হবে। অন্যরা পারলে তুই পারবি না কেন? তুই কি ওদের কারও চেয়ে খারাপ ছাত্র ছিলি নাকি? ক্লাস ফাইভেও তো ট্যালেন্টপুলে স্কলারশিপ পেয়েছিলি।’ নবীন ভাই পড়াশুনার কিছু টেকনিক বলে দিলেনÑ যা তিনি বই পড়ে জেনেছেন, অন্য কারও মাধ্যমে জেনেছেন, নিজে পালন করেন। আর কিছু উপদেশ দিলেন যেগুলো প্রায়োগিক। পনেরো. ক্যালেন্ডারে সরকারি ছুটির দিনগুলো লাল রঙ করা থাকে। হানীফ লাল কলম দিয়ে ওর সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে ক্রস চিহ্ন দিল। গুনে দেখল পরীক্ষার আগে অনেকগুলো দিন পড়বে না, পড়ার কথা চিন্তাও করবে না। নবীন ভাইয়ের প্রথম উপদেশ সপ্তাহে একদিন ছুটি। একদিন ছুটি থাকলে বাকি ছয়দিন পড়ায় পূর্ণ উৎসাহ পাওয়া যায়। বইপত্র, সিলেবাস ঘেটে দেখল অনেক পড়া। টার্গেট ঠিক করে পড়তে বসল। বাসার কেউ কথা বলত না। প্রয়োজন হলে সংক্ষেপে বলত। সেও নিজেকে গুটিয়ে নিল। স্কুল থেকে আসার পর বাসা থেকে বের হতো না, মাঠে খেলতে যেত না। কেউ এসে ডাকতও না খেলার জন্য। স্কুলে একা  একা বসে থাকত। স্যার ক্লাসে না থাকলে কিংবা টিফিন পিরিয়ডে সবাই গল্পগুজব করত, হৈ হল্লা করত। ও বসে থাকত একা একা। টিভি দেখত না। বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলোও না। ইন্টার স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় ওদের স্কুল চ্যাম্পিয়ন হল। খেলা নিয়ে অনেক হৈ চৈ হলো। টিম গঠনের সময় ওকে কেউ কিছু বলেনি। খেলা দেখতে মাঠে যেতে বলেনি। ক্লাস টেনের মানু ভাই ছিল ক্যাপ্টেন, ওদের ক্লাসের এহসান ছিল ভাইস ক্যাপ্টেন। স্কুল ম্যাগাজিন বের হলো। আনোয়ার স্যার প্রচুর পরিশ্রম করে লেখা সম্পাদনা করে প্রেসের সব ঝামেলা সয়ে বের করলেন। ওদের ক্লাসের কয়েকজন কবিতা, গল্প দিল ম্যাগাজিনে। আলমাস দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ইংরেজিতে একটা প্রবন্ধ লিখল। মতিন ছিল বিজ্ঞাপন ম্যানেজার। ওকে কেউ কিছু জিজ্ঞেসও করেনি। সন্ধ্যার আগে এসে দাঁড়াত বারান্দায়। কখনো ছাদে পাইচারি করত। রাতে আবার রুমে এসে পড়তে বসত। সোবহান স্যারের বাসায় সকালে পড়তে যেত। সোবহান স্যার ওদের স্কুলেরই টিচার ছিলেন। রিটায়ার্ড করেছেন। তেমন কাজ থাকত তার। গণিতের জটিল, আশ্চর্য বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতেন। ছাত্র-শিক্ষকের আলোচনা জমত ভালো। পৃথিবী চলছিল নিজের গতিতে। তার জন্য কোনো কিছু থেমে ছিল না। পাখির কলকাকলি থেমে ছিল না একদিনের জন্যও। কারও খাওয়া-দাওয়া বন্ধ ছিল না, হাসি বন্ধ ছিল না। শুধু সে ছিল না কোনো কিছুতে। এক  বিকেলে ছাদে হাঁটছিল। দুই বাসা পুবে তিনতলা বাসায় আলোকসজ্জা দেখল, গেট সাজানো হয়েছে। সাজানো দেখে বুঝল বিয়ে বাড়ি। সন্ধ্যা পেরুনোর আগেই দেখল গেটের সামনে ঝলমল পোশাকের লোকজন। আজ গায়ে হলুদ হয়ত। গেটের সামনে ভিডিও করা হচ্ছে। নওশাদকে দেখল ভিডিও ক্যামেরার সামনে। নাফিজ, জুয়েলসহ আশেপাশের বাসার সব ছেলেরাই আছে বড়দের পাশাপাশি। সে জানত না। বিয়ের দাওয়াত পেয়েছিলেন হানীফের আব্বা, গিয়েছিলেনও। অনেক হৈ চৈ, আমোদ আহ্লাদ হলো। ওর যাওয়া হয়নি। এরপরও ভালো কিছু লক্ষণ দেখা গেল। প্রথম যেটা হলো স্কুলে পড়া না পারার একটা প্রবণতা হয়ে গিয়েছিল। সেটা দূর হলো। স্যারেরা মারধর করার সুযোগ পেলেন না। বকাবকিও করার সুযোগ পেলেন না। এর অনেক পরে স্কুলে ইসহাক এসেছিল কথা বলতে, ও কিছু বলেনি। নি¯পৃহভাবে কথা বলেছে। যাতে আর কখনো কথা বলতে না আসে। পরীক্ষার আগে এক দুপুরে হানীফ রুমে বসে পড়ছিল। জানালা দিয়ে দেখল গেট দিয়ে ঢুকছে  হাবলু। মলিন চেহারা। হাবলুর সাথে অনেকদিন দেখা হয়নি। কারণ সে স্কুলে যায় না। হানীফ ওদিকে তাকাল না। উঠে গেল না কলাপসিবল গেট খুলতে। হাবলু কলিং বেল টিপল না। রুমের জানালার সামনে দাঁড়াল। হানীফ নিস্পৃহভাবে বলল, ‘ভেতরে আয়।’ হাবলু এলো না। বলল, ‘ভেতরে আসব না। তোর খবর শুনেছি। খুব ভালো লেগেছে পড়াশুনা করছিস।’ ‘কী খবর তোর?’ জিজ্ঞেস করল হানীফ। ‘গাঁজা ছেড়ে হেরোইন ধরেছিস?’ হাবলু বলল, ‘গাঁজা খাই না।’ হানীফ সচকিত হলো। বলল, ‘কেন?’ হাবলু বলল, ‘গাঁজা টেনে কী হবে? ভবিষ্যৎ পরিণতি কী? আজ গাঁজা টানছি কাল হেরোইন খাব। গাঁজার টাকার জন্য এখনই বাসা থেকে চুরি করি, ক’দিন পর বাসা থেকে যখন চুরি করতে পারব না তখন শফির সাথে ছিনতাই করব। ছিনতাই করতে গিয়ে পাবলিকের হাতে ধরা পড়ে গণপিটুনিতে প্রাণ হারাব। বেঁচে থাকলে অথবা ধরা না পড়লে বড় সন্ত্রাসী হব। জীবনটা এভাবে নষ্ট করব কেন?’ হানীফ তন্ময় হয়ে শুনছিল। বলল, ‘হঠাৎ এই পরিবর্তন। ধোলাইয়ের ডোজ বেশি পড়েছে?’ হাবলু ঠাট্টায় গেল না। বলল, ‘ধোলাই দিলে কাজ হতো না। ধোলাই তো আর কম দেয়নি। মামা এসেছিলেন বাসায়। আমার অবস্থা শুনেছিলেন হয়ত। একরাতে বাসায় ফিরলে তিনি একাকী আমার সাথে আলাপ করলেন। ত্রিশ বছর আগেও গাঁজা ছিল, ছাত্র ছিল। তার দু’জন সহপাঠীর তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরলেন। একজন এখন ভার্সিটির টিচার। অন্যজন রাজমিস্ত্রি। ক্লাস নাইনে উঠে যে গাঁজা ধরেছিল কলেজের গণ্ডি পেরুবার সুযোগ তার হয়নি। ত্রিশ বছর পর আমার অবস্থান বেছে নেয়ার সুযোগ দিলেন। তিনি আমার উপর জোর করলেন না, ধমক দিলেন না। তার বুঝানোর মাঝে কেমন যেন একটা মাদকতা ছিল। আমি আকৃষ্ট হয়ে গেলাম। তুই পড়াশুনা করছিস আশাকরি ভালো করবি। আমিও আশা করি ফেল করব না। আরও আগে পড়তে বসলে হয়ত আরও ভালো করতাম। যাই হয়েছে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আরও পরেও তো পড়তে বসতে পারতাম। তখন থেকে পড়লে হয়ত পাসও করতে পারতাম না। এর মাঝে মনে হলো তোর সাথে অনেকদিন দেখা হয়নি, দেখা করে আসি। আসি।’ হানীফ বলল, ‘ভেতরে আয়।’ হাবলু বলল, ‘না। তোর নিশ্চয় ডিস্টার্ব হচ্ছে। এখন কারও সাথে দেখা করার নিশ্চয় কথা ছিল না।’ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে ফিরে তাকাল। বলল, ‘ইসহাকের খবর জানিস?’ ‘ভালো আছে। হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় ভালো করেছে। ফাইনালেও ভালো করবে।’ ‘ওর আব্বা-আম্মা বড় ভাইয়া খুব টাইট অবস্থায় রেখেছে। আমি ভয়ে ত্রিসীমানায় ঘেষিনি।’ হানীফ বলল, ‘তুই গাঁজা ধরেছিলি কেন?’ ‘এক বিভ্রান্তিকর অবস্থার মধ্যে। যখন তুই বললি বড়বাড়ির চারদিকে নজর রাখতে সেদিন খুব সকালে বেরিয়েছিলাম সাইকেল নিয়ে। দুপুরে যখন বাসায় ফিরলাম তখন বাসায় এসে দেখি প্রচণ্ড রাগারাগি চলছে। স্কুলে যাইনি এক অপরাধ তার উপর ছোট বোনটা চাকু দিয়ে হাত কেটে ফেলেছে। সেই রাগ ঝাড়ল আমার উপর। আমি বড় বাড়িতে যাওয়ার জন্য চাকু যোগাড় করেছিলাম, সেই চাকু কেমন করে ওর হাতে পড়ে। বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম ফুফুর বাসায়। ফুফুর বাসায়ও দেখলাম কেমন বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে। চলে এলাম সেখান থেকেও। মন খারাপ করে বসেছিলাম লাভলু ভাইয়ের দোকানের সামনে। এর মধ্যে শফি এসে বলল, ‘হাবলু একা বসে আছিস মুখ ভার করে, মন খারাপ?’ আমি কথা বলছিলাম না। ও আবার বলল, ‘সমস্যা হলে সমস্যার সমাধান আছে, মন খারাপ হলে ভালো করার মেডিসিন আছে। দুনিয়াতে এতো মজা থাকতে মন খারাপ করে বসে থাকবি কেন? নে একটা টান দে।’ একটা সিগারেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি নিচ্ছিলাম না। ও আরও অনেক কথা বলছিল। আমিও ভেবে দেখলাম জায়গা যেহেতু কোথাও মিলছে না, এখানেই যোগ দেই। সিগারেট হাতে নিলাম। প্রথম প্রথম ওই আমাকে সিগারেট দিত। কিনতে হতো না। গাঁজাও দিত। খেতে খেতে নেশা হয়ে গেল। তখন ওরা দিত না। আমি নিজে কিনে খাওয়া শুরু করলাম। সেই ছিল শুরু।’ ষোলো. পরীক্ষার দিন সকাল বেলা কেমন যেন স্বপ্নবিভ্রম মনে হচ্ছিল। এই যে টেবিলে বইপুস্তক, এই দৃশ্য আগেও দেখেছে। মনে পড়ে ক্লাস ফাইভে বার্ষিক পরীক্ষার দিনগুলোতে সে এমনিভাবে সারা বই একবার রিভিশন দিয়ে যেত। পরীক্ষাগুলো হতো খুবই ভালো। সে রকম একটা দিন মনে হচ্ছিল। নাস্তার টেবিলে দেখল ওর আব্বা নাস্তা শেষ করেছেন প্রায়। হানীফকে দেখে বললেন, ‘কী পরীক্ষা, সাধারণ গণিত?’ ‘জ্বী’ বলে মাথা নাড়ল হানীফ। ‘তাড়াহুড়ো করিস না। উত্তর দেয়া শেষ হলেও পরীক্ষার সময় থাকতে হল থেকে বের হবি না। বারবার খাতা উল্টে দেখবি কোথাও শূন্য দেয়া বাদ পড়ে গেছে কিনা। যোগের জায়গায় বিয়োগ হয়ে গেছে কি না। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে কলম, পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স যা লাগে নিয়ে যাবি। ভুল করে কিছু ফেলে রেখে যাস না।’ পরীক্ষার আগে অনিবার্য সব উপদেশ। তবু স্মরণ করিয়ে দেয়া। ব্যাগ নিয়ে অফিসে রওয়ানা হওয়ার আগে ওর আম্মার সাথে কথা শেষ করে ওর দিকে ফিরে বললেন, ‘আল্লাহ হাফেজ।’ পরীক্ষার হলে স্থির হয়ে বসে ছিল হানীফ। আশেপাশে অন্য ছাত্রদের চাঞ্চল্যপূর্ণ কথা ওর কানে আসছিল। সে গায়ে লাগাল না। স্যার এলেন খাতা হাতে। স্যার খাতা দিলে খাতায় নাম রোল লিখে বসেছিল। ঘণ্টা বাজলে প্রশ্ন দিলেন স্যার। প্রশ্নে চোখ বুলিয়ে দেখল প্রতিটা অঙ্কা সে পারবে। প্রথম থেকেই উত্তর লিখতে শুরু করল। অঙ্কগুলো করা শেষ করেও চুপ করে বসেছিল ওর আব্বার কথা মতো। আবার কেন জানি স্বপ্নবিভ্রমের মতো লাগল। এমন দিন যেন সে আগেও কখনও কাটিয়েছে। পরীক্ষার হল থেকে বের হওয়ার সময় সামনে দু’জনের কথাবার্তা কানে এল। অঙ্কের রেজাল্ট মিলাচ্ছিল। একজন বলল, ‘যাহ অঙ্কটা ভুল হয়ে গেল।’ হানীফ কিছু বলল না। তবে মনে মনে বলল, একটা অঙ্ক ভুল হওয়া মানে অনেক নম্বরের হেরফের হওয়া। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পড়াশুনা থেকে সাময়িক ছুটি। বিগত দিনগুলোর পড়াশুনার চাপের পর মন হালকা লাগছিল। এখন সারাদিন খেললেও কেউ বকবে না, সকাল বেলা গল্পের বই পড়লেও ওর আম্মা লাঠি নিয়ে আসবেন না। সন্ধ্যারাত থেকে ঘুমিয়ে সকাল বেলা উঠলেও রাগারাগি করবেন না। হানীফ বাসা থেকে খুব একটা বের হতো না। কারও সাথে দেখা করতে যেত না, মাঠে খেলতে যেত না। সন্ধ্যায় বসে ছিল ছাদে। পশ্চিম আকাশের লাল আলোর রেখা মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে তখন। বাসা বাড়ি, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের বাতি জ্বলে উঠেছিল অনেক আগেই। দেখল নইমুদ্দি, খালেদ, ইদ্রিস ব্যাডমিন্টনের র‌্যাকেট হাতে গল্প করতে করতে টিএনটি অফিসের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। টিএনটি অফিসের সামনের ফাঁকা জায়গায় এবারও কোর্ট কেটেছে খেলার জন্য। লাইট জ্বালিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত ব্যাডমিন্টন খেলবে। অলি, জনি, নতুনদের দেখল ওদের বাসার ভেতরে অল্প জায়গায় স্ট্যাম্প গেড়ে ক্রিকেট খেলছে। এদের দেখে বিষণœ হলো। একবার মনে হলো যাবে নাকি সব ভুলে এদের সাথে খেলতে? বলবে, ‘আমায় নিবি তোদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলায়? খরচ আমিও সমান দেব।’ আবারও কি অপমানিত হতে চায়? ভেতরে ভেতরে হাঁসফাস করল। পাশের রুম থেকে ওর আম্মা ডেকে বললেন, ‘স্কুলে যা।’ আম্মা চেয়ারে বসে সোয়েটার বুনছিলেন। হানীফ তার কথা ঠিকভাবে শুনল না। হানীফের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আবার ডাকলেন, ‘রেজাল্ট দিবে ছেলেরা সেজেগুজে কত আগ্রহ ভরে স্কুলে যাচ্ছে, সেদিকে কোনো খেয়াল নেই?’ স্কুলের কথা শুনে বিরক্ত হয়েছিল। রেজাল্টের কথা শুনে মনে হলো তাই তো, আজকে রেজাল্ট দিবে। গোসল করার সময় ছিল না। হাত-মুখ ধোয়ে রওয়ানা হল স্কুলে। স্কুলে কারো হাতে বই-খাতা নেই। পড়া মুখস্থ বলতে হবে না, হোমওয়ার্ক দেখাতে হবে না বলেই যেন আনন্দ বেশি। স্কুলের সামনের মাঠে, করিডোরে বিভিন্ন স্থানে জটলা করে কথা বলছিল সবাই। রেজাল্টই আলোচনার মুখ্য বিষয়। কে ফার্স্ট হবে, কে সেকেন্ড, কে থার্ড এসব অনুমান করছিল। একেকজন একেক রকম বলছে। হানীফ যখন স্কুলে পৌঁছল তখন ছাত্ররা সব ক্লাসে চুপচাপ বসে আছে। হেডস্যার এলেন রেজাল্ট ঘোষণার জন্য। যারা প্লেসে আছে তাদের নাম তিনি ঘোষণা করেন। বাকিদেরটা ক্লাস টিচার। ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। সবাই অপেক্ষা করছিলÑ কী ঘোষণা করবেন হেডস্যার। কার নাম প্রথমে ঘোষণা করবেন। কিন্তু তিনি যে নাম প্রথমে ঘোষণা করলেন তাজ্জব বনে গেল সবাই। ক্লাস টিচারও। প্রথম হয়েছে মোহাম্মদ হানীফ। হানীফ ভালো করবে এমন একটা আভাস পেয়েছিল সবাই, পরীক্ষার আগে ক্লাসগুলোতে ওর রেসপন্স দেখে তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু এতটা ভালো করবে ভাবতে পারেনি কেউই। দ্বিতীয় আলমাস, তৃতীয় মতিন। চতুর্থ রাফিদ পেছনে চলে গেছে। তার স্থানে উঠে এসেছে খালিদ। ইসহাক প্লেসের পর পরই। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই লাগল খানিকক্ষণ। কী শুনল সবাই! অবশ্য এতো বিস্ময়ের কিছু নেই। এক সময় যে প্রথম ছিল সে তার স্থান পুনর্দখল করে নিয়েছে। হানীফ একদম স্বাভাবিক। যেন এ রেজাল্টের জন্যই অপেক্ষা করছিল। কিংবা এমনটি না হলেও সে দুঃখিত হতো না। সতেরো. গত দু’দিনে তিনবার চেষ্টা করেও নবীন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারল না হানীফ। নবীন ভাইদের বাসার বাগান পেরিয়ে বারান্দায় এলে নবীন ভাইয়ের আব্বার হানীফ মুখোমুখি হয়ে গেল। তিনি বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। তাকে দেখেই চমকে গেল। রাশভারী স্বভাবের এই লোকের সামনে সে পড়তে চায় না। বরফ-শীতল গম্ভীর গলায় কথা বলেন, শুনলেই দুনিয়াটা নিরানন্দ লাগে। দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া শোভনীয় হবে না মনে করে সালাম দিল। পত্রিকার পাতা থেকে মুখ তুলে তাকালে দৃষ্টির গম্ভীরতায় ঝাঁকুনি খেল সে। দেখে হয়ত চিনতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু চিনলেন না, এটা নিশ্চিত। নবীন ভাইয়ের কাছে যখন ঘনঘন আসত তখন অনেকবার পরিচয় দিয়েছে। এরপরও পরবর্তীতে আসলে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করতেন, ‘কী নাম?’ হানীফ জিজ্ঞেস করল, ‘আঙ্কেল ভালো আছেন?’ সংক্ষেপে বললেন, ‘ভালো।’ তখনো তার দৃষ্টিতে না চেনার ছাপ। কিন্তু জিজ্ঞেস করছেন না। হানীফ বুঝতে পেরেও পরিচয় দিল না। বরং আবার জিজ্ঞেস করল, ‘নবীন ভাই কি বাসায় আছেন?’ তিনি পত্রিকার পাতায় চোখ নামিয়ে বললেন, ‘ওর রুমে দেখ। টিকিট বুকিং দিয়ে ফিরেছে।’ ‘টিকিট বুকিং? নবীন ভাই কোথাও যাচ্ছেন? ‘ও কানাডা চলে যাচ্ছে।’ হানীফরে মুখ থেকে অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রশ্ন বেরিয়ে এলো, ‘কেন? ‘ট্রিনিটি ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করবে।’ খুশির কথা। হানীফের কেন যেন খারাপ লাগল। কানাডা চলে গেলে তো যখন খুশি দেখা করতে পারবে না, কথা বলতে পারবে না। মনে হলো একটা ছায়া তার উপর থেকে চলে যাচ্ছে। বিছানায় অনেক কাগজপত্র, ফাইল ছড়ানো। নবীন ভাই একটা একটা করে দেখে ফাইলে গুছিয়ে রাখছিলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে হানীফ সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে ক্লান্ত গলায় নবীন ভাই বললেন, ‘আয়।’ হানীফ রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, ‘খুব ব্যস্ত?’ নবীন ভাই বললেন, ‘না, তেমন না। তোর কী খবর?’ হানীফ শার্টের বুক পকেট থেকে রেজাল্টশিট বের করে এগিয়ে দিল। রেজাল্টশীটে চোখ বুলিয়ে ক্রমশ তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, হাসির রেখা ফুটে উঠল মুখে। উচ্ছ্বসিতভাবে বললেন, ‘এই তো চাই। এই তো চাই! স্থির লক্ষ্য আর একাগ্র চেষ্টা মানুষকে সব সময়ই সফল করে। সাহসী মানুষেরাই পৃথিবীর নানা রহস্যের অবগুণ্ঠন উন্মোচন করেছে। পালতোলা জাহাজে করে দুঃসাহসে যারা নতুন পৃথিবী আবিষ্কারে বেরিয়েছিল তারাই আবিষ্কার করেছে নতুন নতুন দেশ। জীবন জয়ে চাই সাহস। যারা সাহসের সাথে স্বপ্ন দেখে তারাই হয় ব্যতিক্রম। সাহসী মানুষেরাই হয় সবার শ্রদ্ধা, সম্মানের পাত্র।’ নবীন ভাই বলে চলছিলেন, ‘যোগ্যতাকেই মানুষ সম্মান করে। ও তোকে তো বলাই হয়নি আমি কানাডা চলে যাচ্ছি।’ হানীফ ছোট্ট করে বলল, ‘তাই তো শুনলাম।’ কথা বলতে বলতে নবীন ভাইয়ের গলার স্বর নিচু হয়ে এলো। কাগজপত্র গুছাতে গুছাতে শুধু বললেন, ‘নিজের শক্তি সামর্থ্যরে উপর নির্ভর কর। নিজের সম্ভাবনা বিকশিত করার গতি সচল রেখে সকল কাজ কর। নিজের সম্ভাবনা বিকাশের গতি রুদ্ধ করে কোনো কিছু করতে গেলে এমনকি ভালো কাজও করতে গেলে মুখ থুবড়ে উল্টে পড়বি।’ নবীন ভাইকে তার কাজ শেষ করার সময় দিতে গল্প থামিয়ে  হানীফ চেয়ার ছেড়ে উঠে বুক-শেলফের সামনে দাঁড়াল। এর আগে যতবার এ বাসায় এসেছে তখন বই দেখার আগ্রহ ছিল না। নাড়াচাড়া করে শেলফ থেকে একটা বই বের করল। চমৎকার গ্লোসি পেপারের মোটা বই। ইংরেজি হওয়াতে সব বুঝতে পারছিল না। কিন্তু পাখির ছবিগুলো আকৃষ্ট করল। পাখি, পাখির বাসা, ডিম, বাচ্চা পর্যবেক্ষণের ইন্সট্রুমেন্ট দেখে ভাবনার জগৎ প্রসারিত হচ্ছিল। হানীফ অভিভূত হয়ে বলল, ‘পৃথিবীতে এতো প্রজাতির পাখি আছে আমার ধারণাই ছিল না। পাখিগুলোর আকার, আকৃতি, রং, বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্র্যময়তা দেখে পাখির প্রতি আগ্রহ জাগছে।’ নবীন ভাই ফাইলপত্র, আলমারির ড্রয়ারে রেখে বিছানায় বসে বললেন, ‘পাখি সম্পর্কে জানবি।’ হানীফ মাথা নেড়ে আপত্তি জানিয়ে বলল, ‘আমার লক্ষ্য অরনিথলজি নয়, আর্কিটেকচার।’ স্বল্পবুদ্ধিতার জন্য অন্য কেউ হলে হয়ত উপহাস করত। নবীন ভাই করলেন না। বললেন, ‘আর্কিটেক্ট হলেই কি অরনিথলজি সম্পর্কে জানা যাবে না? মানুষ পাখির উড়াউড়ি দেখেই প্রথম উড়ার স্বপ্ন দেখেছিল। পাখির উড়বার কৌশল দেখেই বিমানের ডিজাইন এঁকেছিল। একই বিষয় থেকে বিভিন্নজন বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। পাখি দেখে জুওলজিস্ট পাখির বায়োলজিক্যাল বিষয় নিয়ে চিন্তা করে, চিত্রশিল্পী ছবি আঁকে, কবি কবিতা লেখে, শিকারী শিকার করে। তুইও হয়ত পাখির বাসার আর্কিটেকচারাল ডিজাইন দেখে নতুন কোনো ডিজাইনের বাড়ি বানানোর ধারণা পেয়ে যেতে পারিস। মেরু অঞ্চলের পাখিদের ফিজিওলজিক্যাল ক্যারেক্টারেস্টিকস দেখে মেরু অঞ্চলের উপযোগী বাড়ি বানানোর বুদ্ধি মাথায় আসতে পারে।’ হানীফ খুশি মনে বলল, ‘মেরু অঞ্চলের পাখি দেখার সাথে মেরু এলাকাও দেখা হবে। আফ্রিকার গহীন অরণ্যের পাখি দেখতে গেলে গহীন অরণ্য দেখা হবে।’ নবীন ভাই বললেন, ‘আমি পড়াশুনা করতে যাচ্ছি ব্যক্তিগত খরচে। মামা সুযোগ করে দিয়েছেন। গিয়ে উঠব মামার কাছে। তোর সুযোগ আছে গৌরবজনক উপায়ে পড়াশুনার সুযোগ গ্রহণের, স্কলারশিপের। যোগ্যতাকে সুযোগ সব সময় হাতছানি দিয়ে ডাকে। ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বিখ্যাত গণিতশাস্ত্রবিদ, এনালাইটিক্যাল জিওমেট্রির উদ্ভাবক। তাই বলে কি তিনি কবি হননি? এখন তো সবাই তাকে কবি হিসাবেই জানে। শোন্, অর্থহীন কথা কাজ বাদ দিলে প্রচুর সময় পাবি। যখন কোনো কাজে সফল হবি দেখবি কাজ করতে আরো ভালো লাগছে। একটা সাফল্য দশটা সাফল্যের পথ খুলে দেয়। কোনো কাজ না পারা গর্বের বিষয় নয়, পারাটাই গর্বের।’ আঠারো. বাসায় ফিরে দেখল ছোট চাচা বিছানায় শুয়ে আছেন। হানীফ বিস্ময়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মুহূর্তকাল। এমন সময় তাকে বাসায় দেখবে ভাবেনি। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘ছোট চাচা! কখন এলেন?’ ছোট চাচা হানীফের বিস্ময়, আনন্দ দেখেও খুশি হলেন না। হালকাভাবে বললেন, ‘এই মাত্র।’ যেমনভাবে শুয়ে ছিলেন তেমনিভাবেই শুয়ে রইলেন। পাশ ফিরে চোখ তুলে তাকালেনও না। হানীফ অভিযোগের সুরে বলল, ‘আপনি আসবেন আগে জানাননি কেন?’ ‘জানিয়েছি।’ ‘কোথায়, আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি।’ ‘না জানালে আমি কী করব?’ ছোট চাচা বিছানায় চোখ বুজে রইলেন। জার্নি করে আসায় পরিশ্রান্ত। এখন হয়ত ঘুমুবেন। হানীফ অপেক্ষা করছিল তার রেজাল্টের খবর জানতে চান কি না। ঘুমিয়ে পড়েছেন ভেবে রুম থেকে চলে যাওয়ার মুহূর্তে বিছানায় উঠে বসলেন। মনে হলো এবার বুঝি জানতে চাইবেন ওর রেজাল্টের খবর। তিনি বিছানা থেকে নেমে ব্যাগ থেকে কাপড় বের করলেন গোসল করার জন্য। হানীফ ধৈর্য ধরে থাকতে না পেরে বলল, ‘ছোট চাচা, আমার কোনো খবর জানতে চাইলেন না যে।’ ‘কী জানতে চাইব?’ ‘আমার রেজাল্টের খবর।’ ‘তোর রেজাল্টের কী খবর?’ এমনভাবে জিজ্ঞেস করলেন যেন জানার কোনো আগ্রহ নেই তার। ‘আমি প্রথম হয়েছি।’ ‘প্রথম হয়েছিস? ভালো।’ আবারও তিনি ভাবলেশহীনভাবে বললেন। ‘আমার পুরস্কার?’ ‘কিসের পুরস্কার? ক্লাস ফোর ফাইভে এমন ফার্স্ট-সেকেন্ড হলে কিছুই হয় না।’ হানীফ বাধা দিয়ে বলল, ‘ক্লাস নাইন।’ ‘ওই একই কথা। এখন ফার্স্ট হলেই কি, লাস্ট হলেই কি? কোন দাম নেই। এসএসসি, এইচএসসিতে ভালো করলে দাম আছে। তখন ভালো করলে আসিস, চিন্তা করে দেখব কী করা যায়।’ হানীফ রীতিমতো থমকে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। এ কেমন করে কথা বলছেন ছোট চাচা। যেন অচেনা কোনো মানুষ। ছোট চাচা তো এমন ছিলেন না। একটা সাফল্যে উৎসাহ দিবেন তা না করে কেমন খাটো করে দেখছেন। সাফল্য ছোট হোক বড় হোক অন্যকে উৎসাহিত করতে হয় এই বিষয়টাও ভুলে গেছেন? ােট চাচা বোধ হয় হানীফের মুখাবয়ব খেয়াল করছিলেন। বললেন, ‘তোর রেজাল্টের খবর পেয়েছি গত পরশুদিন। তোর আম্মা ফোন করে জানিয়েছেন। তুই তো আমাকে খবরটা দিলি না। আমার সাথে একবারও কথা বললি না।’ হানীফ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। রেজাল্টের খবরটা যে ছোট চাচাকে দেওয়া প্রয়োজন কিংবা কথা বলা প্রয়োজন, এ কথাটা খেয়ালই ছিল না। ছোট চাচার দিকে তাকাল কতটুকু রাগ করেছেন দেখার জন্য। তার চেহারায় রাগের কোনো ছাপ না দেখে হানীফ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘তাহলে এতক্ষণ এসব বলছিলেন যে।’ ‘তুই আমাকে স্মরণ রাখিস না, আমি তোর খোঁজখবর রাখব কেন?’ হানীফ ভুল স্বীকার করে অনেকটা ক্ষমা চাওয়ার মতো করে বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে ছোট চাচা। আমার খেয়াল ছিল না।’ ‘কী পুরস্কার চায়?’ ওকে এভাবে পুরস্কার বেছে নেয়ার দায়িত্ব দেয়ায় খানিক চিন্তিত হলো। হঠাৎ করে এমন সুযোগ আসবে ভাবেনি। এমন কিছু চাওয়া বোকামি হবে যা জোরজবরদস্তি করে সে যে কোনো সময় আদায় করতে পারবে। আবার যা চাইবে তাই দেবেন তাও তো না। অনেক ভেবে বলল, ‘লোনা পানির হাওয়া খাব।’ অপ্রত্যাশিত উত্তর এলো, ‘মঞ্জুর।’ হানীফ খুশির ধাক্কা সামলে বলল ‘পনেরো দিন থেকে আসব।’ ছোট চাচা এতে রাজী হলেন না। বললেন, ‘এতো লম্বা ছুটি নিতে পারব না। পনেরো দিন হবে না, চারদিন।’ লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে হল হানীফের । বলল, ‘তাই হবে।’ এত সহজে রাজি হয়ে যাবেন ভাবেনি। তবে কি তাই সত্যি যে প্রবল স্পৃহা সুযোগ সৃষ্টি করে? চেষ্টা করলে তাহলে তার বড় লক্ষ্যও পূরণ সম্ভব। ওর মন কল্পনায় চলে গেল সমুদ্র সৈকতে। হু হু করে বাতাস বইছে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউগুলো এসে আছড়ে পড়ছে বালুকাময় তীরে। আকাশের নীল রং সাগরের পানিতে মিশে পানি নীল দেখাচ্ছে। নবীন ভাইয়ের রুমে দেখা সমুদ্রের ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল। এখন সে রকম একটা সমুদ্র দেখবে কাছ থেকে। কখন যাত্রা শুরু হবে তার জন্য এখন শুধু অপেক্ষা। তার আগে এখানের কাজগুলো শেষ করতে হবে। ছোট চাচা কথাবার্তা এবং খাওয়া-দাওয়া সেরে রুমে ফিরলে হানীফ এসে বসল বসল পাশে। বলল, ‘আমরা কোথায় কোথায় যাব? পুরো ভ্রমণের পূর্ব-পরিকল্পনা থাকলে ভালো হত না?’ ‘তুই পরিকল্পনা করে ফেল। প্রথম দু’দিন থাকব সী বীচে। হানীফ দাঁড়িয়ে বলল, ‘একটু থামুন, আমি খাতা-কলম নিয়ে আসছি।’ দৌড়ে ওর রুম থেকে খাতা-কলম নিয়ে এলো। খাতায় লিখে বলল, ‘সমুদ্রে সাঁতার কাটব?’ ‘তা তো বটেই। সুইমিং কস্টিউম আছে না?’ ‘না। ওসব লাগবে না। ট্রাউজার দিয়েই কাজ চালিয়ে নেব। থাকব কোথায়? হোটেলে?’ ‘হুঁ। ইচ্ছে করলে আমার এক কলিগের বাড়িতে থাকতে পারি। কিন্তু যেতে চাইছি না। একেবারে সমুদ্রের কাছে কোনো হোটেলে উঠব। সী ভিউ স্যুট থেকে যাতে সমুদ্র দেখা যায়। সকালের ঘুম ভাঙবে সমুদ্রের গর্জন শুনে।’ ‘ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া।’ ‘তারপর যাব হিমছড়ি। সেই সাথে কক্সবাজার শহরটা ঘুরে ঘুরে দেখব। এরপর যাব সেন্টমার্টিন। সেন্টমার্টিনে একদিন থাকব। এসবের ফাঁকে ডুলাহাজরা সাফারি পার্কটা দেখতে হবে। এই মোটামুটি।’ ‘সাথে কী কী নিতে হবে? আমার তো অভিজ্ঞতা নেই।’ ‘টুথপেস্ট, টুথব্রাশ থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র। শীতের কাপড়-চোপড় তো লাগবেই। যে কোনো ভ্রমণের জন্য অপরিহার্য ফাস্ট-এইড বক্স নিতেই হবে।’ ওর আম্মা রান্নাঘর থেকে এসে বললেন, ‘কী কথা হচ্ছে চাচা ভাতিজাতে?’ ছোট চাচা বললেন, ‘প্ল্যান-প্রোগ্রাম। কক্সবাজার যাচ্ছি আমরা।’ ‘ভালো তো যাও। কিন্তু আমরা বাদ থাকব কেন?’ ‘আপনারা তো পরীক্ষায় প্রথম হতে পারেননি।’ হানীফের আম্মা যেন বিষয়টা বুঝলেন। বললেন, ‘তাই বলো।’ বাসার কলিংবেল বেজে উঠল সাথে কিছু ছেলের হইচই, চেঁচামেচি। হানীফ উঠে গেল। ব্যাট, বল, স্ট্যাম্পসহ জহির, নাফিজ, রায়হান ও আশেপাশের বাসার কিছু ছোট ছেলে এসেছে। হানীফকে দেখে রায়হান বলল, ‘হানীফ ভাইয়া, মসজিদের পূর্ব পাশের বাসার ছেলেদের  সাথে আমাদের খেলা আছে, আমাদের সাথে খেলতে হবে। চলুন।’ ‘এখন আমি খুব ব্যস্ত আছি। খেলতে পারব না।’ ‘না কেন? আমরা হারব কেন? আমাদের একটা মানইজ্জত আছে না? মসজিদের পূর্ব পাশের বাসার  মুসা, আইয়ুব বেশি লাফালাফি করছিল। আমরা নাকি কিছুই খেলা জানি না। ওদের বড় বড় কথায় বিরক্ত হয়েই না খেলার কথা বললাম। আমাদের দলে কোনো বড় প্লেয়ার নাই।’ বাকিদের দিকে নির্দেশ করে বলল, ‘এরা তো ঠিকমত ব্যাটই ধরতে পারে না। বোলিং করতে গেলে বল পিচের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তেই নিতে পারে না।’ ‘আমি কক্সবাজার যাচ্ছি বেড়াতে। প্রস্তুতির কাজ আছে । ‘কক্সবাজার!কবে?’ ‘পরশু দিন।’ ‘তাহলে আজ খেলতে অসুবিধা কী?’ ‘প্রস্তুতির ব্যাপার আছে না? কক্সবাজার যাব বললেই তো ব্যাগে দু’টো শার্ট, প্যান্ট ভরে দৌড় দেওয়া যায় না।’ রায়হান বলল, ‘কক্সবাজার থেকে ফিরে এলে আমরা আরেকটা খেলা খেলব। তখন কিন্তু না করতে পারবেন না।’ হানীফ বলল, ‘তখন দেখা যাবে।’ বাক-বিতণ্ডা আর তর্ক বিতর্কে পাখির মতো কিচির মিচির করতে করতে সবাই বেরিয়ে গেল। ঊনিশ. আপন মনে ছবি আঁকছিল হানীফ। বেড়াতে যাওয়ার আগেই ছবিটা শেষ করতে হবে। হাবলু রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে কাকে যেন ডাকল, ‘আয়’ হাবলুর কথা শুনে হানীফ  ইজেল থেকে ঘাড় ফিরে তাকাল। ইসহাক রুমে প্রবেশ করলে হানীফ ক্ষোভ মিশ্রিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ওর দিকে। ইসহাক বুঝতে পেরে  বলল, ‘আশা করি রাগ করিসনি।’ হানীফ যে ক্ষোভভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তা ধরে রাখতে পারল না। অস্ফুটভাবে বলল, ‘না।’ তবে গলার স্বরটা ভারী হয়ে এলো। ইসহাক তার অবস্থা বোঝানোর চেষ্টা করে বলল, ‘খুব সতর্ক প্রহরার মধ্যে রেখেছিল। কেমন সতর্কতা বুঝতে পারছিস? বাইরে বের হতে দিত না, বিকেলে খেলা ছিল বাসার মধ্যে। স্কুলে কার সাথে মিশি এটাও খেয়াল রাখতেন। তোদের কারও সাথে মেশার ব্যাপারে ছিল কড়া নিষেধাজ্ঞা। লঙ্ঘন করার সাহস হয়নি। তাছাড়া স্কুলে তোর সাথে কয়েকবার কথা বলার চেষ্টাও করেছিলাম তুই কেমন এড়িয়ে গেলি।’ হানীফ গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি জানি। এখন এসেছিস কেন?’ ‘এখন তো সমস্যা নেই। পরীক্ষা শেষ, রেজাল্টও খারাপ করিনি। তোর অবস্থাতো আরও ভালো। এখন মনে হয় আব্বা-আম্মার শাসনে ভালোই হয়েছে। নইলে পড়াশুনা হয়ত খারাপ করতাম।’ হাবলু হানীফকে বলল, ‘চল, একটু হাঁটব।’ ‘শীতের রাত কনকনে ঠাণ্ডা। কোথায় যেতে চাস?’ ‘বিশেষ কোথাও না। একটু হাঁটব আর কি। বড়বাড়ির ওদিকে যাব।’ হানীফ চেয়ার ছেড়ে উঠছিল, বড়বাড়ির কথা শুনে অর্ধেক পথে থেমে গেল। বলল, ‘মনে আছে?’ ‘সব মনে আছে। বড়বাড়িতে গিয়ে ধরা খেয়েই এই অবস্থা।’ ‘কী হয়েছিল সেদিন ইসহাক? ধরা পড়লি কিভাবে?’ গেটের বাইরে এসে জিজ্ঞেস করল হানীফ। ‘সেদিন কপালটা খারাপ ছিল নয়ত কুকুরটা ওমন ঘেউ ঘেউ করবে কেন? আর ভয়ে আমিই বা ওয়াল টপকে অন্যের বাসায় ঢুকব কেন? তোদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। কিছু দূর এগুতেই একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল। আমি পাত্তা দিলাম না। হেঁটে আসছিলাম। কিন্তু কুকুরের ঘেউ ঘেউ কমছিল না। পেছন পেছন দৌড়ে আসছিল। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে কে যেন পেছন থেকে আসছিল। চৌকিদার হবে হয়ত। রাস্তার পাশে বড় ইটের টুকরা খুঁজলাম কুকুরের মাথা থেতলে দেওয়ার জন্য। কিন্তু হাতের কাছে কোনো ইট, লাঠি কিছুই খুঁজে পেলাম না। আমি ভয় পেয়ে ওয়াল টপকে জামান সাহেবের বাসার ভেতরে ঢুকে পড়লাম। কুকুরের ঘেউ ঘেউ তবু থামছিল না। ওয়ালের কাছে এসে ঘেউ ঘেউ করছে। এর মধ্যে বাসার ভেতরে কেউ একজন জেগে উঠল। একটা রুমের বাতি জ্বলে উঠল। ওয়ালের উপর দাঁড়িয়ে থাকলে ধরা পড়ে যাব ভেবে ভেতরে নেমে গেলাম। এর মধ্যে দরজা খুলে চড়া গলায় কে যেন বলল, ‘কে? কে?’ তালে তালে বাঁশি ফুঁকতে ফুঁকতে চৌকিদার এসে হাজির। চৌকিদার এসে বলল, ‘কী হইছে স্যার?’ জামান সাহেবই সম্ভবত ভেতর থেকে বললেন, ‘কে যেন বাসার ভেতরে ঢুকল।’ ‘গেট খুলেন স্যার দেখি।’ চৌকিদার বলল। বাসার আরও দু’একজনও তখন জেগে উঠেছে। জামান সাহেব গেট খুললেন না। কিন্তু টর্চ জ্বালিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। আমার তো ভয়ে আত্মা খাঁচাছাড়া। পাতাবাহার গাছের আড়াল থেকে সরে এসে বাসার পেছনের ওয়াল টপকে যেই ডোবার পাড়ে নামতে যাব, আবার কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। তোয়াক্কা না করে নিচে নেমে দৌড়াতে লাগলাম। পেছনের ডোবার পাড়ের সরু রাস্তা দিয়ে এসে কিশলয় কিন্ডার গার্টেনের সামনের রাস্তা দিয়ে মেইন রোড ধরে আমাদের বাসার কাছে এসেছি তখনও কুকুরটা দৌড়ে আসছিল। বাসার ওয়াল টপকে ভেতরে নামলাম। চৌকিদার হয়ত খুঁজে পেত না কিন্তু কুকুরটার ঘেউ ঘেউয়ের কারণেই আমার অবস্থান সনাক্ত করা সহজ হয়ে পড়ল। চৌকিদার গেটে এসে কলিংবেল টিপল। আব্বা, দাদু সবার ঘুম ভেঙে গেল। উঠে এলেন। চৌকিদার বলল, ‘স্যার আপনার বাসায় চোর ঢুকছে।’ আব্বা গেট খুলে দিলেন। বাসায় খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। আমি পেছনের দিকে কিচেনের সানশেডের উপর বসে ছিলাম। এরপরও ধরা পড়ে গেলাম। তবু রক্ষা এটুকু যে চৌকিদার খোঁজাখুঁজি করে চলে যাওয়ার পর যখন সবাই আবার ঘুুমুতে যাবে তখন আম্মা এসে বললেন, ইসহাক তো রুমে নাই। গেল কোথায়? আমার রুমে গিয়ে হয়ত আমাকে না দেখে সারাবাসা খুঁজে না পেয়ে সবাইকে জানালেন। উপায়ন্ত না দেখে বেরিয়ে এলাম। আমাকে দেখে সবার চক্ষু তো চড়ক গাছ। জেরার পর জেরা চলতে লাগল। বের করে ফেলল সব তথ্য। বাকিটা তো সবাই জানিস।’ তিনজন এসে দাঁড়াল বড়বাড়ির পেছনের রাস্তায়। হিজল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নীরব হয়ে গেল। হয়ত সবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সেইদিনের সব কথা। হানীফ দেখল এই সেই বড়বাড়ি। ছয়মাস আগেও ছিল এখনও আছে। তখন যে দৃষ্টিতে দেখত আজ তা অনুপস্থিত। তখন যে রকম অনুভূতি হতো আজ তা হচ্ছে না।ব ড়বাড়ি বদলে গেছে? গুরুত্ব হারিয়েছে? বদলেছে ওরা। কিন্তু কোথায় বদলেছে? হাত পা যা ছিল তাই আছে। তাহলে? বদলেছে চিন্তাধারা, আচরণ, বিশ্বাসে। হাবলু বলল, ‘আমি জেনেছি।’ দু’জনেই তাকাল ওর দিকে। ‘ওটা আসলে কোনো চোরাকারবারী ছিল না। কিছু ফার্নিচার আনা হয়েছিল। কার্টুন যেগুলো দেখেছিলাম তাতে ছিল মোটর সাইকেলের পার্টস। ওয়ারেসুল হক সাহেবের ছোট ভাই জাওয়ায়েদুল হক সাহেব এ বাসার খালি কামরাগুলো গোডাউন হিসাবে ব্যবহার করেন। সেই গোডাউনে ফ্যাক্টরি থেকে মালামাল এনে নামিয়েছিল।’ ‘কে বলল তোকে?’ জিজ্ঞেস করল হানীফ। ‘দারোয়ানের কাছ থেকে জেনেছি।’ ওয়ালের কাছ ঘেষে দাঁড়াল হানীফ। ওয়ালে হাত দিয়ে কি যেন অনুভব করার চেষ্টা করল। অস্ফুট স্বরে বলল, ‘কী দিন ছিল কী দিন গেছে।’ ‘আজও খাবি নাকি ডাব?’ কৌতুক করে বলল হানীফ। ইসহাক বলল, ‘চুরি করে খেতে হবে না। আজ কেয়ারটেকারকে বললে পেড়ে দিবে। এমনকি ওয়ারেসুল হক সাহেব যদি আসেন, তাকে বললেও তিনি দেবেন।’ হানীফ বলল, ‘আজ দিলেও খাব না।’ ইসহাক বলল, ‘এখানেই পরিবর্তন। আমাদের সামনে এখন অনেক কাজ, আছে জয়ের স্বপ্ন।’ বিশ. ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। তাদের খেলা দেখে আপসোস হচ্ছিল না, খেলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। এখানে খেলার চেয়েও বেশি আনন্দদায়ক কিছু সময় অপেক্ষা করছে তার সামনে। মাঠের পশ্চিম পাশের রাস্তাটা তখনো  পার হয়নি, পেছন থেকে ডাক শুনল। গলার স্বর শুনে সচকিত হয়ে উঠল হানীফ। পেছন ফিরে তাকালে রীতিমত বিস্মিত হল। মতিন তাকে ডাকছে। রিকসাওয়ালাকে রিকসা  দাঁড় করাতে বলল। মাঠের দিক থেকে দৌড়ে কাছে এসে মতিন বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’ এতদিন যাকে প্রতিপক্ষ ভেবেছে সেই আজ তার সাথে কথা বলতে এসেছে। কিংবা যাকে প্রতিপক্ষ ভেবেছে সে তা ভাবেনি। ও নিজে মনে মনে বানিয়েছে। দেখল মাঠে জগলুও আছে। খেলা থামিয়ে যেন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। মাঠের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এনে বলল, ‘মার্কেটে। কিছু কেনাকাটা করব।’ ‘কী কিনবি?’ হানীফ বিরক্তিতে সে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে  বলল, ‘অনেক কিছু।’ মতিন আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। মূল প্রসঙ্গে এসে বলল, ‘সে যাই হোক, প্র্যাকটিস করতে আসছিস না কেন? জুনিয়র ক্রিকেট টুর্নামেন্টে এবার আমরা ভালো করব।’ হানীফ বাকিটুকু শুনতে চাইল না। মতিনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি খেলব না।’ মতিন বলল, ‘কেন?’ ‘কাজ আছে। আমি আজ রাতের ট্রেনে কক্সবাজার যাচ্ছি। সপ্তাহখানেক থাকব।’ ‘বেড়িয়ে এসে খেলবি। টুর্নামেন্ট তো শুরু হবে আরও দু’সপ্তাহ পর।’ হানীফ তাতেও রাজি হলো না। বলল, ‘বেড়ানো শেষ হলেও আমার আরও কাজ আছে।’ ‘তুই অমত করছিস কেন? গতবারও তো খেললি। ব্যাটিংয়ের জন্যই তোকে খেলতে হবে। বোলার আমাদের আছে কিন্তু ব্যাটসম্যান কোথায়? ওপেনিং ভালো করবে এমন ব্যাটসম্যান আর কে আছে?’ হানীফের একবার বলতে ইচ্ছে হল, ‘জগলুকে নামিয়ে দে।’ বলল না। জগলু না কাকে নামাবে সে তাদের ব্যাপার। হানীফকে নীবর থাকতে দেখে মতিন আবার বলল, ‘কথা বলছিস না কেন? একজন অলরাউন্ডার হাতছাড়া হলে দলের কতটুকু ক্ষতি হবে বুঝতে পারছিস? এমনিতেই অন্যান্য টিম বাইরে থেকে খেলোয়াড় হায়ার করে আনবে শুনছি। আমরা কাউকে আনছি না। আচ্ছা ঠিক আছে, এখন ঘুরে আয়। আমি রশীদ ভাইকে বলব তোর সাথে কথা বলতে। এবারও রশীদ ভাই আমাদের টিম ম্যানেজার।’ রিকসাওয়ালাকে হাত দিয়ে চলার ইশারা করল হানীফ। ট্রেনের প্রথম শ্রেনণীর কামরায় বসে ছিল হানীফ। গায়ে সোয়েটার, পায়ে সু, উলের টুপিতে ঢেকে আছে মাথা, কান। হাতে হাতমোজা। শীত যেন কোনোভাবেই কাবু করতে না পারে তাই এতসব ব্যবস্থা। হাতের বই রেখে জানালা দিয়ে তাকাল প্লাটফর্মের দিকে। ট্রেন ছাড়ার সময় বেশি বাকি নেই। এখনও ছোট চাচা আসেননি। ফাস্ট এইড বক্স নেয়া হয়েছে,বক্সে সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় ওষুধ নেওয়া হয়েছে কিন্তু তার গ্যাসট্রাইটিসের ওষুধ শেষ, সেগুলো নেয়া হয়নি। কখন বেশি দরকার পড়ে বলা যায় না। সে সব ভেবে ট্রেনে ওকে বসিয়ে রেখেই নেমে গেছেন ওষুধ কিনতে। এই বাজে অসুখটা তার কখনই ছিল না। লোহা খেয়ে হজম করতে পারেন এমন একটা কৃতিত্ব ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে থাকায় খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম করেছেন। তাতে অসুখটা বাসা বেঁধেছে। ট্রেন যদি ছেড়ে দেয়, ছোট চাচা যদি না আসেন তাহলে কী করবে ভেবে বেশ উদ্বিগ্ন হলো। হুইসেল বেজে উঠল একসময়। ট্রেন নড়তে লাগল। টেনশন করবে না মনে করলেও টেনশনে হার্টবিট বেড়ে গেল, অস্থির লাগছিল। ব্যস্তভাবে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল আসছে কি না। অনেক যাত্রীই তাড়াহুড়ো করে ট্রেনে উঠছে কিন্তু ছোট চাচা নেই। এরপর ট্রেন চলতে শুরু করল। প্রথমে আস্তে, খানিক বাদে জোরে। ট্রেন ছাড়তেই হানীফের হার্টবিট এত বেড়ে গেল যে মনে হচ্ছিল পাশের লোকজন তার আওয়াজ শুনতে পাবে। ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে তাড়াতাড়ি নামতে পারবে না। পাশের যাত্রীকে বলবে কি না, ‘আমি যাব না,দরজা দিয়ে নেমে যাচ্ছি দয়া করে আমার ব্যাগ গুলো জানালা দিয়ে নামিয়ে দেবেন?’ ইতস্তত করে যখন দাঁড়াবে ভাবছিল তখন দেখল ছোট চাচা ওষুধের প্যাকেট হাতে ব্যস্তভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাকে দেখে সুস্থির হলো, হার্টবিট স্বাভাবিক হয়ে এলো। হানীফের হাতে বই দেখে বললেন, ‘পড়বি নাকি ঘুমুবি?’ ‘পড়ব। বইটা ভালো লাগছে।’ ‘আমি তাহলে ঘুমাই। ট্রেনে, বাসে ঘুমুতে কোনো অসুবিধা হয় না।’ তিনি চোখ বুজলেন। বইয়ের পাতায় ডুবে ছিল হানীফ। একবার মুখ তুলে তাকাল। কামরায় আলো জ্বলছে। যাত্রীরা আয়েসী ভঙ্গিতে বসে কেউ সহযাত্রীর সাথে কথা বলছে, কেউ ঝিমুচ্ছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ট্রেনের আলো রেললাইনের পাশের বিল-ঝিলের অল্প একটু অংশে পড়ছে। দূরে গ্রামের বাড়ির বৈদ্যুতিক বাতি চোখে পড়ল। রেললাইনের পাশে কয়েকটা গাছ দেখে মনে পড়ল এক সকালে এমনি জায়গায় সে এসেছিল। শুয়ে ছিল রেললাইনের উপর। বিষাদ নিয়ে বলেছিল বিদায় পৃথিবী। সেদিন যদি সত্যিই সফল হতো তাহলে আজকের এই আনন্দদায়ক মুহূর্ত উপভোগ করতে পারত না। সমুদ্র দেখার পরিকল্পনা করতে পারত না। বিষাদগ্রস্ত হলেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়া বোকামী। আবার বইয়ে ডুবে গেল হানীফ। কামরার মধ্যে লোকজনের কথাবার্তা কমে এলো। ঘুমে ঢুলছিল কেউ, বাকিরাও চুপ। রেললাইনের দু’পাশেও বিস্তীর্ণ মাঠ, শস্যক্ষেত, জলাশয়ও শান্ত। রাতের আঁধার আর নিস্তব্দতা ভেদ করে শব্দ করে এগিয়ে চলছে ট্রেন।    (সমাপ্ত)

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ