দুহাতে বিলাও রোদ্দুর

দুহাতে বিলাও রোদ্দুর

উপন্যাস ছন্দা দাশ জুন ২০২৩

[গত সংখ্যার পর]


গাড়িতে বসে তুষার তার চাচ্চুকে যখন মিনারের ঘটনা বলছিল সাগর কান পেতে শুনছিল। তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর হচ্ছে কি না তুষার বুঝতে পারছে না। চাচ্চু খুব উত্তেজিত। খুব গম্ভীর মুখে বসে ভাবছেন। তারপর বললেন, এ নিয়ে পরে তোকে বলবো। আজ আমরা আনন্দ করতে এসেছি। সব ভুলে এখন তাই নিয়ে মেতে যাবো। 

ওরা চিড়িয়াখানার সামনে এসে পড়েছে। 

গাড়ি থেকে নেমে ওরা টিকিট কেটে ঢুকে গেল। অনেকদিন পর বাইরের খোলা আবহাওয়ায় এসে দাদীর যে কী আনন্দ! একহাতে চাচ্চুর হাত আর অন্য হাত তুষারের কাঁধে রেখে উনি গুটিগুটি পায়ে হাঁটছেন। আর ফেলে আসা দিনের কথা বলে যাচ্ছেন। সাগর যে আসতে চাইছিল না সেই এখন সবচেয়ে বেশি খুশি। একদৌড়ে হাতি, আবার বাঘ, হরিণের কাছাকাছি গিয়ে কতো যে ছবি তুলছে। খাবার ছুঁড়ে দিচ্ছে। চিড়িয়াখানায় ওদের তিন ঘণ্টা কেটে গেল। ইতোমধ্যে ওরা সবাই ক্লান্ত। চাচ্চু বললো, চল এবার আমরা খেতে যাই। খাওয়ার কথা শুনেই সাগর বললো, আমি কিন্তু আজ চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খাবো। চাচ্চু বললেন, একদম।

ওরা খাবার অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছে। হঠাৎ সাগর বললো, চাচ্চু তুমি জানতে আজ প্রবীণ দিবস? চাচ্চু ভীষণ অবাক হয়ে বললেন, মানে? প্রবীণ দিবসও আছে নাকি? জানতাম না তো? 

সাগর মোবাইল খুলে বললো, এইতো মা প্রবীণ দিবসে দাদীর সাথে ছবি পোস্ট করেছে। চলো চাচ্চু আমরা দাদীকে নিয়ে একটা ছবি তুলি। 

চাচ্চু হেসে বলে, মাকে ছবিতে নয় রে সোনা, আমাদের হৃদয়ের মধ্যে রাখতে হয় রে। এ দেখাবার বিষয় হতে পারে না।


মাটির কাছাকাছি


গ্রামটির নাম রসুলপুর। রসুলপুর মনে হলেই তুষারের কবি জসীম উদ্দীনের কবিতার লাইন ক’টি মনে পড়ে যায়, 

আসমানীরে দেখতে যদি 

তোমরা সবে চাও

রহীমদ্দীর ছোট্ট বাড়ি

রসুলপুরে যাও।

বাড়ি তো নয়, পাখির বাসা

ভেন্না পাতার ছানি

একটুখানি বৃষ্টি হলেই 

গড়িয়ে পড়ে পানি।

কিন্তু কবিতার সাথে গ্রামের মিল খুঁজে পায় না। কোথায় রহীমদ্দী চাচা, কোথায় তার বাড়ি, কে আসমানী? 

গ্রামের বাড়িগুলো এখন প্রায় সবগুলোই পাকা। সেই পদ্মদিঘি, কাকচক্ষু জলে গাছেদের ছায়া, কৃষাণ বধূর হাতে ধানের শীষ, নিকানো উঠান, কলমির দল, কিছুই আর নেই। গ্রামের মানুষের সরল আন্তরিকতা কোথায়? সবাই এখন শহুরে জীবনের মতো অভ্যস্ত। এখানেও প্রযুক্তির করাল গ্রাস। ক্ষেত্র বিশেষে আরও যেন ভয়ঙ্কর। শিক্ষা যখন অপাত্রে দান করা হয় তখন তা ভয়ঙ্কর হয়। গ্রামের যুবক, কিশোর কিশোরী মোবাইল ব্যবহার করার কারণে কেমন উচ্ছন্নে যাচ্ছে তা চাচ্চুর কাছে সেদিন আলোচনা করতে শুনেছে ভালো চাচাকে।

ভালো চাচা চাচ্চুর ছেলেবেলার বন্ধু। একই পাড়ার ছেলে। সেই ছেলেবেলার মতো আজও ওরা আন্তরিক। ভালো চাচাও স্কুল শিক্ষক। দু’জনে দেখা হলেই আগের মতো একসাথে খাওয়া, গল্প। এখন তো বন্ধুত্ব নেই, আন্তরিকতা নেই। সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। ওদের খেলা নেই, গল্প নেই, শৈশব নেই। আছে শুধু প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দৌড়। প্রতিষ্ঠিত মানে এখন টাকা। কী নিদারুণ দিন এসেছে চাচ্চু বলে। তব্ওু গ্রামে এলে তুষারের খুব ভালো লাগে। শহরের ফ্ল্যাট বাড়িতে কেমন যেন একটা দমবন্ধ পরিবেশ। এখানে খোলা আবহাওয়ায় বসে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায় চাচ্চুর সাথে বসে কত মানুষের সাথে গল্প হয়। এখনও পুরোপুরি সবার শরীর, মন থেকে কাদামাটির গন্ধ যায়নি। জরিনা বুবু তুষাররা এলে কতো খুশি হয়। কী খাওয়াবে, কী রান্না করবে সারাদিন এই নিয়ে ব্যস্ত। এবার মা, বাবা, চাচী ওরাও সবাই এসেছে। গ্রামে এলে শীতের তীব্রতা বোঝা যায়। রোজ ভোরবেলা সে চাচ্চুর সাথে রাস্তা ধরে হাঁটতে যায়। সাগরকেও ডাকে। ও লেপের নিচ থেকে উঠতেই চায় না। তুষার মাঝে মাঝে জোর করে তুলে নিয়ে গেলে আবার খুব খুশি হয়ে হাঁটতে থাকে নদীর পাশ দিয়ে, মুঠো ভর্তি মটরশুঁটি নিয়ে। ঘাসের ওপর শিশিরগুলো মুক্তোর মতো হাসতে থাকে। এসব কখনও শহরে বাস করা ছেলেমেয়েরা দেখতে পায় না। চাচ্চু তাইতো বলে দেখে নি বলেই তো এখন আর ওদের মধ্যে কোনো গভীরতা নেই। তুই দেখবি সাহিত্যেও এখন আর তার প্রভাব পড়ে না। কেমন নীরস, প্রাণহীন। 

সকালবেলা চাদর জড়িয়ে চাচ্চু বারান্দায় বসে পড়ছিল।

রোজ গান শোনা তাঁর অভ্যাস। বাবাও পাশে বসে চিরাচরিত নিয়মে মোবাইলে মগ্ন।

জরিনা বুবু গরম চা আর নতুন গুড়ের মোয়া দিয়ে গেছে। 

এমন সময় আপাদমস্তক কাঁথা জড়িয়ে ভালো চাচা এসে, উপস্থিত। চাচ্চু বললেন তাই তো ভাবছিলাম আজ সকালের চা তোকে ছাড়া জমবে কেমন করে? ভালো চাচা বললেন কাল রাতে চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রের খাতা দেখতে গিয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভাগ্য কতো অন্ধকার! আমরা ওদের কোন পৃথিবী দিয়ে যাচ্ছি দেখ। বলেই কাঁধে ঝোলানো থলে থেকে পরীক্ষার খাতা বের করে চাচ্চুর সামনে খুলে ধরলেন। সবাই কাছে এসে ঝুঁকে দেখে খাতায় কিছু লেখা নেই। দুটো ছবি আঁকা। একজন মা মোবাইল হাতে ব্যস্ত। আর তার পাশে ছোট মেয়েটা বসে কাঁদছে। মেয়েটা লিখেছে আমার মা আমাকে পড়ায় না, ভালোবাসে না। মা সারাদিন মোবাইলে কথা বলে আর মোবাইলকে ভালোবাসে। আমি মোবাইল হলে ভালো হতো। তাহলে মা আমাকে ভালোবাসতো। আমি কিছু লিখতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট হয়। ভালো চাচার পড়া শেষ হলে কারো মুখে কথা নেই। অনেকক্ষণ পিন পতন স্তব্ধতা। চাচ্চুই প্রথম কথা বলে উঠলো। এতোদিন আমি যে কথা বলে আসছি তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ মিলে গেল। এই কচি কচি বাচ্চাগুলো কীভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভালো চাচা বললেন, এর উল্টোটাও আছে কিন্তু। কোন কোন মা-বাবাদের দেখি সন্তানকে নিয়ে অতিরিক্ত উচ্চাশা। পড়া পড়া করে কেড়ে নিচ্ছে ওদের আনন্দ, ওদের শৈশব। পড়া মানে প্রথম স্থান ওদের লাভ করতেই হবে যে কোন কিছুর বিনিময়ে। যেন প্রথম না হলে সে মানুষ হবে না। অথচ একবারও নিজেদের জীবন নিয়ে ভাবে না। নিজেরা কী ছিল, কেমন ছিল। চোখের সামনে সব কেমন পাল্টে যাচ্ছে। আমরা দেখেও দেখছি না। বুঝেও বুঝছি না। সভ্যতার এই সঙ্কট। আচ্ছা কোনো মা-বাবাকে বলতে শুনেছিস আমার সন্তান ভালো, সৎ একজন মানুষ হোক? সবাই কেবল ভালো রেজাল্টের কথা বলে।

শুনবি না আর এমন কথা। তুষারের বাবা মোবাইল বন্ধ করে অনেকক্ষণ ওদের এই আলোচনা শুনছিলেন। 

কিছু বললেন না। হয়তো ভালো লাগছে না। আবার প্রতিবাদ করতেও পারছেন না। সাগর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওদের মোয়া খেতে দেখে বললো, আমাকে ফেলে তোমরা সব খেয়ে নিলে? ভালো চাচা বললেন, চল তোকে আজ টাটকা খেজুর রস খাওয়াবো। একদম গাছ থেকে নামিয়ে। সাগর তো মহাখুশি। তৎক্ষণাৎ সে গরম জামা, জুতো পরে বললো, চলো না ভালো চাচা। নইলে আমি মোবাইল চালাবো। সবাই ওর কথা শুনে একসাথে হেসে উঠলো।


রূপকথার গল্প 


দুপুর হলে খাওয়া দাওয়ার পর মা, বাবা চাচী একটু গড়িয়ে নেয়। দাদী এখানে এসে যেন অনেক সুস্থ। শহরে যেমন একা শুয়ে থাকে জবুথবু হয়ে। এখানে কিন্তু একদম বদলে গেছে। রাতে ছাড়া বিকেল বা সন্ধ্যেতে না শুয়েও বেশ হাসিমুখে আছেন। তাই দেখে চাচ্চু বললেন আম্মা তো এখানে খুব ভালো আছে। তাহলে আমরা এখানেই শহরের জীবন পাততাড়ি গুটিয়ে চলে আসতে পারি। বেশ ক্ষেতের চাল, পুকুরের মাছ, সবজি, দুধ, ডিম সবই তো আছে। শুধু শুধু শহরে পড়ে থাকা। 

দাদী তাই শুনে তো মহাখুশি। চাচীও চাচার কথায় সম্মত মনে হলো তুষারের। শুধু মা বললেন, আসতেই তো পারি কিন্তু আমার ছেলে দুটোর লেখাপড়া? গ্রামে কি তেমন স্কুল আর শিক্ষক আছে। চাচ্চু বললেন, না না আমি তোমাদের কথা বলছি না। তোমরা যা ভালো মনে করবে তাই তো করবে।

ওদের কথার ফাঁকে তুষার সাগরকে বলে চলো যাবি? কালকের দিনটা চলে গেলে পরশু তো চলে যাবো। নিজেরা নিজেদের মতো একটু ঘুরবো। সাগর এককথায় রাজি। এখন সে আগের মতো মোবাইল নিয়ে সময় কাটায় না। বেশ কিছু আশপাশের ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে। বিকেল হলে তো ওদের সাথে মাঠে বল খেলতে যায়। কিন্তু এখানেও যে মোবাইলের প্রভাব কতোটা তা আজই প্রথম বুঝতে পেরেছে। বরং ক্ষেত্র বিশেষে এর দংশন আরও মারাত্মক। সাগরকে নিয়ে প্রথমে ওদের বাড়ির দু’বাড়ি পরে জহির চাচার ছেলে শামুকে নিয়ে পরে আরও কয়েকজন মিলে নদীতে সাম্পান নিয়ে ঘুরবে বলে এসেছিল। দেখে শামু নেই। চাচীর কাছে জানতে চাইলে বললো ও বাজান শামু তার বন্ধুদের নিয়ে বৈঠকখানা ঘরে আছে। তুমি হেইখানে যাও। ওদের বৈঠকখানা ঘর বসত বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। একটা বাগানবাড়ি বলা যায়। জহির চাচা আসলে এখানে বন্ধু বান্ধব নিয়ে গল্প গুজব করে। তুষার ওখানে গিয়ে দেখে ওখানে পাঁচ ছয়জন বসে মোবাইলে ভিডিও গেম খেলছে। তুষারের মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। তুষারকে দেখে শামু বললো, আসো আসো। তুমি তো শহরের পোলা। আমাদের চাইতে অনেক বেশি জানো মোবাইলের কাজ কারবার। আমরা আজ টাকা বাজি রেখে খেলছি। এক্কেরে জমে উঠেছে। 

তুষার বললো, নাহ্। আমি এসব পছন্দ করি না। এমন কি আমি কখনও মোবাইলে কল করা ছাড়া আর কোনো কাজে ব্যবহার করি না। শানু খিককিক করে হেসে বলে ও তুমি তো আবার তোমার চাচ্চুর আদর্শ ভাতিজা। কথা বলবার সময় ওর মুখ থেকে ভকভক করে সিগারেটের গন্ধ ভেসে আসছে। সব মিলিয়ে তুষারের গা গুলিয়ে উঠলো। ওর মনে হলো জাহান্নাম মনে হয় একেই বলে। নিজেকেই ওর অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন সে সাগরকে এই পরিবেশে নিয়ে এলো। শহরে ও কখনও এমন ছেলেদের কাছাকাছি আসেনি। সাগরের হাত ধরে ও বাইরে বেরিয়ে এলে সাগর বললো ভাইয়া ওরা কি খারাপ ছেলে? আমার খুব খারাপ লেগেছে। ভাইয়া একটা কথা বলি এই তোমার গা ছুঁইয়ে। আমি আর কখনও পড়ালেখা বাদ দিয়ে মোবাইল নিয়ে সময় কাটাবো না। তুমি দেখে নিও। আমি বুঝতে পেরেছি যারা মোবাইল নিয়ে থাকে ওরা ভালো ছেলে না। তুষার সাগরকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে আমি জানতাম তুই কোনদিন ওদের মতো হবি না। তুই যে আমার ভাই। সাগরের হাত আরও জোরে চেপে হনহন করে বড় রাস্তায় উঠে এলে দেখে ভালো চাচা তাঁর সাইকেল চেপে ওদের দিকেই আসছে। ওদের সামনে এসে বলে তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। মহী (মেজ চাচ্চু) বললো, তোমরা শামুদের বাড়ি গিয়েছো। ওখানেও গিয়ে দেখলাম কেউ নেই। তখন একটু চিন্তায় পড়েছিলাম। তাহলে কোথায় যেতে পারো। তারপরে ভাবলাম যাই তো নদীর রাস্তা ধরে। পেয়েও যেতে পারি। তুষার বলে আসলে আমরা তোমার বাড়িতেই যাচ্ছি। তোমার বাড়ির লাইব্রেরি দেখা হয়নি। নদীতেও নৌকা নিয়ে ঘোরা হয়নি। ভালো চাচা বললেন শামুদের বাড়ি যাওনি? তুষার আমতা আমতা করে বললো গিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা কয়েকজন মিলে যে কাজটা করছিল আমার ভালো লাগেনি। ভালো চাচা বললেন ঠিক বলেছো। আমিও খেয়াল করেছি। এই ছেলেটা পড়ালেখায় ভালোই ছিল। কিন্তু ইদানীং দেখছি অমনোযোগী। তখনই ভেবেছি খারাপ সঙ্গ ধরছে। গ্রামে এখন শিক্ষিত, ভালো মানুষ নেই বললেই চলে। যারা আছে এরা প্রায় অশিক্ষিত, আনকালচার্ড, গোঁয়ার। এদের ফেরানো কষ্টসাধ্য। কিন্তু কারো না কারো তো ফেরানোর চেষ্টা করতেই হবে। শুধু দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়লে তো হবে না। এইসব ভবিষ্যৎ দেশ রক্ষাকারীদেরও যে সমানভাবে গড়ে তুলতে হবে। আর তার জন্য চাই ভালো, সৎ চরিত্রের মানুষ। তুষারের মন ভালো হয়ে গেল এখন।

ইতোমধ্যে বিকেল নেমে এসেছে। শীতের বিকেলের নরম আলোয় ওরা হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে এসে থামলো। ঘাটে নৌকা বাঁধা। ভালো চাচা এসে ডাক দিতেই মাঝিরা এগিয়ে এসে ডাকলো সালাম বাবু। আমার নৌকায় আসুন। সন্ধ্যের আগেই সব ঘুরিয়ে আনবো। তুষার ভাবে এখনও গ্রামের মানুষ সহজ, সরল। এখনও ওদের মধ্যে ভালোবাসা আছে, আন্তরিকতা আছে মানুষে মানুষে। শিক্ষিত মানুষের অসভ্যতা তাদের জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়নি আধুনিক শহরের মানুষের উৎকট চাকচিক্যের আড়ালে। 

ওরা নৌকায় উঠে বসতেই মাঝি নৌকা ছেড়ে দিলো। কী অপরূপ প্রকৃতি। নদীর দু’পাশ জুড়ে ধান। এখন পৌষ মাস। ধান পেকে তাই সোনার মতো বিচ্ছুরিত। মন অন্যরকম হয়ে যায়। কত রকম ভাবনার আনাগোনা।

সাধে কী আর কবি লিখেছেন ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা, তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা, ভালো চাচা তাঁর সুন্দর কণ্ঠে গান ধরেছেন। কোথা দিয়ে যে একটা ঘণ্টা পার হয়ে গেল। ইতোমধ্যে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এসেছে। দূরে গ্রামগুলোয় এখন আলো জ্বলে উঠেছে। এখন বিজলি বাতির আলোতে তার আসল রূপে এসেছে বৈচিত্র্য। তুষারের খুব ইচ্ছে একবার আদি গ্রামের রূপ দেখবে।

ঘাটে যখন নৌকা এসেছে তখন জমে উঠেছে হাট। কতো মানুষ, কতো তাদের জীবন বৈচিত্র্য। তুষার ভাবে এ দেশ ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। ভালো কাকা হেসে বলে কীরে বাবা তুই যে ভাবে পড়লি। ওদের নিয়ে নিজের বাড়িতে যখন ঢুকলেন ওরা দেখে বাবা, মা, দাদী, চাচী, চাচ্চু সবাই এখানে। ভালো চাচা বললেন কী রে খুব অবাক হয়েছিস তো? নে এবার হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে আমার পড়ার ঘরে ঢুকে যা। আজ রাতটা ওখানেই তোর জন্য রেখেছি। তুষার তো আনন্দে দিলো দৌড়। আহা প্রতিদিন কেন আজকের মতো হয় না। সাগর কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, ভালো চাচা আমি বুঝি তোমার কেউ না? ভালো চাচা ওকে কোলে নিয়ে বললো, তুই তো আমার কোলেই থাকবি।


আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলাও


ভালো চাচার পড়ার ঘরে ঢুকে তুষার অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এ যেন জগৎ সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন এক পৃথিবী। এর রূপ, এর রস, এর সঙ্গে যে মানুষ বাস করে সেও আলাদা এক মানুষ। যেমন ভালো চাচাকে তুষারের মনে হয় উনি যেন সবসময় নিজের মধ্যে ডুবে থাকেন। তাঁকে বোঝার মতো মন নেই কারো। চাচ্চু তাই বলেন ভালো মানুষের সংখ্যা কম থাকে। কিন্তু ওরা থাকে বলেই বাকিরা টিকে থাকে। ঘর ভর্তি শুধু বই আর বই। এতো বই এক জীবনে পড়ে শেষ করা যাবে না মনে হয় তুষারের। সাগর যে কখন তুষারের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তুষার দেখলো সাগর বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। তুষারকে বললো, ভাইজান সব কি ভালো চাচা পড়েছেন? তুষার বললো, তা নয়তো কী? এতো এতো টাকা খরচ করে শুধু সাজিয়ে রাখার জন্য কি বই কেনা হয়েছে? তুষার বইগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। মনে মনে ভাবে ভালো চাচা শহরে থাকলে রোজ শুক্রবার সে চলে যেতো। সারাদিন বই পড়তে পারতো। ওর পড়ার এমন নেশা, কিন্তু এতো বই কোথায় পাবে? ওর বন্ধুরা কেউ বই পড়ে না। তুষারকে পড়তে দেখলে বলে, বুড়ো মানুষের মতো কী পড়া। তাও আবার মোটা মোটা বই। তুই কোন যুগের মানুষ? আমরা পড়লে অনলাইনে পড়ি কখনও প্রয়োজনে। তুষার ওদের কথার উত্তর দেয় না। চাচ্চু বলেছে যে বুঝবে না, তার সাথে বৃথা তর্ক করতে নেই। এতে সময় নষ্ট, মনও খারাপ হয়। বইয়ের সাথে তুষার এক অমোঘ টান। অন লাইনে পড়লেও সে বই ছাড়বে না। বইয়ের গন্ধ ওকে আলাদা সুধা দান করে। এমন হয় বই হাতে নিয়ে সে ছাদে বসে পড়ে, শীতের রাতে লেপের নিচ ওম্ নিতে নিতে বই পড়ার যে আনন্দ, বৃষ্টির দিনে টিনের চালার ঘরে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে গল্পের বই পড়া সে আনন্দ কি অন্লাইনে পড়ায় পাওয়া যায়? ভালো চাচা তুষারকে দেখে বললেন, খুব দুঃখ হয় রে একজীবনে বই পড়ে শেষ হবে না। কথা বলতে বলতে ভালো চাচা অনেকগুলো বই বেছে বেছে নিয়ে টেবিলে রাখলেন। প্রত্যেকটা বই মুছে প্যাকিং করতে করতে বললেন, এই বইগুলো তোদের দু’জনের জন্য দিলাম। খুব যতেœ রাখবি। আমি যখন শহরে যাবো তখন দেখবো তোরা পড়েছিস কি না। বইগুলো আমার খুব প্রিয়। বইয়ের মতো তোরাও আমার প্রিয়। প্রিয় মানুষকে প্রিয় জিনিসই দিতে হয়। কী বলিস?

ওরা উত্তর দেয় না। এসব কথার উত্তর হয় না। বুঝে নিতে হয়। 

রাতে সবাই একসাথে খাওয়া হলো পুকুরের মাছ, ঘরের মুরগি, ডিম, সবজি দিয়ে আর সাথে প্রাণখোলা গল্প। সবার যেন আজ মন খোলা। এমন পরিবেশ শহরে কখনও দেখেনি ওরা। কেউ তো কারো বাড়ি যায় না এমনি এমনি। এখানে যেমন না বলেই একে অন্যের বাড়ি চলে আসে। ঘরে যা আছে তাই দিয়ে আপ্যায়ন করে। সে একখিলি পানও হতে পারে। শহরে না বলে কারো বাড়িতে আসা ভাবতেও পারে না। আর টেবিল ভর্তি খাবার (তার অর্ধেক প্রায় অনলাইনে হোম ডেলিভারিতে আনা) না দিলে নিজেদের বড়লোকিআনা ঠিকমতো দেখানো হয় না বলে টেবিল ভরিয়ে দিয়ে তার অর্ধেকই নষ্ট করতেও দ্বিধা নেই। এর মধ্যে না থাকে আন্তরিকতা না ভালোবাসা। ওই ফেলে দেওয়া খাবারে হয়তো এক অভুক্ত পরিবারের সারা দিনের খাবার। এখন সব যেন লোকদেখানো। এই কৃত্রিমতার ঢেউ গ্রামেও এসে লাগছে। ডিজিটাল পৃথিবী যে। খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে সবাই এসে বসলো খোলা বারান্দায়। আলোহীন রাতের বুকে জ্যোৎস্নাগলা প্রকৃতি। কী ভীষণ সুন্দর! তুষার কখনও এমন রাত দেখেনি। এমন নিসর্গ সৌন্দর্যে কার মন না আকুলিত হয়! কবি সাহিত্যিকের কথা বলাই বাহুল্য। ভালো চাচার অনুরোধে সবাই গান, কবিতায় রাতটাকে আরও মুখর করে তুলছে। দাদীও তার ভাঙা ভাঙা গলায় পুরানো দিনের একখানা গান গাইলো। আজ অনেকদিন পর বাবা মা মোবাইল ছাড়া সময় কাটাচ্ছে আর তা অপার আনন্দে। আসলে সময়ও একটা বিশাল কারণ মানুষকে পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে। এমন পরিবেশ পেলে কি কেউ আর যান্ত্রিক পৃথিবীতে সময় কাটাবে? গান শুনতে শুনতে তুষার কখন ঘুমে ঢলে পড়েছে। ঘুমের মধ্যে সে দেখছে রসুলপুর গ্রামে সে এখন হেঁটে যাচ্ছে কাদামাটির মানুষ হয়ে গান গাইতে গাইতে ‘আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলাও’।

ভোরে চাচ্চুর ডাকে ঘুম ভাঙতেই দেখে সে ভালো চাচার পড়ার ঘরে শুয়ে আছে চাচ্চুর সাথে। চাচ্চু বললো, ওঠ। বাড়িতে যাবি না? আজ রসুলপুরে আমাদের শেষ দিন। আর একবার গ্রামটা ঘুরে আসি তোকে নিয়ে। তোরা আমাদের উত্তরসূরি। এই কঠিন পৃথিবীকে নির্মল রাখার জন্য তোদের মতো কোমল মনের কিশোরের দরকার। নইলে যে রোবটের মতো কৃত্রিম মানুষের পৃথিবীতে হৃদয় বলে কিছুই থাকবে না! 

তুষারের মনে পড়ে ভালো চাচার কথা-দুহাতে বিলাও রোদ্দুর...! [শেষ]

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ