তানিজিং গ্রহের আগন্তুক   -মহিউদ্দিন আকবর

তানিজিং গ্রহের আগন্তুক -মহিউদ্দিন আকবর

বিজ্ঞান সেপ্টেম্বর ২০১৮

আবির বিস্ময়ভরা চোখে অদ্ভুত পোশাক পরা দুইজন অচেনা আগন্তুককে নীরবে পা ফেলে ফেলে ওদের বাড়ির পাশের বিশাল বাগিচা চষে বেড়াতে দেখছে। সে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক হলো। হাজার হাজার ফল-ফলারি আর কাঠের গাছে ঘেরা এই বাগিচা। প্রায় দুই শ’ বছরের পুরনো। আবিরের পূর্ব পুরুষেরা নিজেদের প্রয়োজনেই প্রায় তিন একর জমির ওপর তৈরি করে গেছেন এই বাগিচা। বর্ষার মওসুমে সহজে কেউ বাগিচায় ঢুকতে চায় না। কারণ, এ সময় নানা জাতের বিষধর সাপ এসে আশ্রয় নেয় গাছের শাখা, কোটর আর ঝোপ-ঝাড়ে। তবে শীত ও বসন্তে এই বাগিচা থাকে বেশ সুনসান। বিশেষ করে বসন্তকালে ঝকঝকে নতুন পাতার সাথে বিভিন্ন গাছের বাহারি ফুলে বাগিচা সেজে ওঠে অপরূপ সুন্দর হয়ে। তারপর যখন গ্রীষ্মকাল এসে হাজির হয়, তখন তো কথাই নেই। হরেক ফলের মিষ্টি মধুর ঘ্রাণে পুরোটা বাগিচা যেন মৌ মৌ করতে থাকে। আর সে সুযোগে কেবল আবিরদের বাড়ির ছেলেমেয়েরাই নয়, আশপাশের বাড়ির- মানে, পাড়া পরশি ছেলেরাও এসে জম্পেশ আড্ডা গড়ে তোলে বাগিচার ফাঁক-ফোকরে। আর সে সুবাদে সুযোগ মতো আম, জাম, লিচুও পেড়ে খেয়ে নেয়। তাতে অবশ্য আবিরের আব্বু হাঁক-ডাক করেন না। তিনি বলেন, বছরে একবারই তো ছেলেরা অমন দুষ্টুমি করে। সব ফল পেড়ে বাগান উজাড় করে তো আর নিয়ে যায় না।
আর যেদিন ঘটা করে বিভিন্ন গাছের ফল পেড়ে বস্তা ভরা হয়- সেদিন তো কথাই নেই। সবার ঘরে ঘরে কিছু ফল পাঠানো হয়। কেবল নিজেরাই না খেয়ে পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধুদের নিয়ে খাওয়ার আনন্দই আলাদা। আবিরের আব্বু বলেন, আমার বাপ-দাদার আমল থেকেই এই নিয়মটা হয়ে আসছে। তাতে সবার আশীর্বাদ পাওয়া যায়।
কিন্তু এই বর্ষাকালে যেখানে বাগানের ত্রিসীমানায় যেতেই সবাই ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকে, সেখানে ওরা দুইজন এতো সময় ধরে বাগান চষে বেড়াচ্ছে কোন্ সাহসে! ওরাইবা কারা? ওদের পোশাকও কেমন অদ্ভুত! যেন কোন অভিযাত্রী দলের সদস্য। মাথায়ও হেলমেট আঁটা।
আবির অন্য কাউকে যে ডেকে এ দৃশ্য দেখাবে সে সুযোগও নেই। চারদিকে থৈ থৈ পানি। পুরো গ্রামটাই পানির ওপর ভাসছে। তার মাঝে উঁচু উঁচু ভিটিতে চরের মতো জেগে আছে গ্রামের বাড়ি-ঘরগুলো। আর আবিরদের বাড়ি তো অন্যান্য বাড়ি থেকে একটু উঁচু জমিতেই। তবু নৌকা ছাড়া বের হওয়ার উপায় নেই। বাড়ির চারদিক জুড়ে থৈ থৈ পানি। আবার মাঝে মাঝেই বৃষ্টি নামছে। এরই মাঝে স্কুলপড়–য়ারা চলে গেছে যার যার স্কুলে। কেবল শরীরটা গরম গরম বলে আবিরই রয়ে গেছে বাড়িতে। পড়ারঘর থেকে সোজা নজর ফেলতেই আবির চমকে ওঠে লোক দুটোকে বাগিচায় হাঁটাহাঁটি করতে দেখে। তাই প্রথম থেকেই চুপচাপ ওদের গতিবিধির ওপর নজরটা ধরে রেখেছে।
ওর কখনো মনে হয়েছে আসলে লোকগুলো সাপুড়ে। হয়তো সাপের সন্ধানে বাগিচায় ঢুকেছে। কিন্তু একটু পরেই আবির নিজের ভুল বুঝতে পারে। জীবনে ও অনেক সাপুড়ে দেখেছে। তাদের পোশাক তো অমন নয়। তা ছাড়া সাপুড়ে হলে তো সাথে থাকবে সাপ ধরার ঝাঁপি, নাগিন বাঁশি আর লাঠি। ওদের সাথে ওসব নেই। তবে হাতে লাঠির মতোই কী একটা যেন রয়েছে। সেই জিনিসটি দিয়ে ওরা মাঝে মাঝে বড় বড় গাছের গোড়ায় খোঁচা মেরে কিছু একটা আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে।
হঠাৎই ওদের মাথায় আঁটা হেলমেট থেকে একটা লাল আলোকরশ্মি বেরিয়ে একটা বৃত্তের মতো ওদের চারদিকে চওড়া রিং বলয়ের সৃষ্টি করে ঘুরপাক খেতে শুরু করে। দৃশ্যটা দেখে আবিরের মাথাটাও ঝিমঝিম করতে থাকে। দুই মিনিটের মধ্যেই আবির বুঝতে পারে, ওর পুরো শরীরটা একটা বাতাসে ভরা বেলুনের মতো হালকা হয়ে গেছে। আবির শক্ত হয়ে চেয়ার আঁকড়ে বসতে চায়। কিন্তু নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। ও পরিষ্কার বুঝতে পারছে, ও অনেকটা গ্যাসভরা বেলুনের মতোই শূন্যে উঠে যাচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে শূন্যে ভেসে ভেসে ছুটে যেতে থাকে লোক দু’টির দিকে। আবির প্রাণপণে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আকাশ-বাতাস তোলপাড় করে চিৎকার দেয়।
কিন্তু একি! ওর মুখ থেকে একটা শব্দও বের হয় না। আবির ভীষণ ভড়কে যায়। শূন্যে ভাসমান অবস্থায় থির থির করে ওর সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে। আর এভাবেই ওর পুরো শরীরটা আগন্তুকদের লাল আলোর বলয়ের ভেতরে চলে যায়। আলোর বলয়ের সাথে সাথে আবিরও ঘুরতে থাকে আগন্তুকদের চারপাশে। আর সে অবস্থায়ই ওরা আস্তে আস্তে বাগিচা থেকে বের হয়ে শূন্যে ভাসতে ভাসতে চলে যায় দূরদিগন্তে। আবির আর নিজেকে সামলাতে পারে না। ও সেন্স হারিয়ে ফেলে।
আবিরের যখন সেন্স ফিরে পেলো, তখন আবির আর গ্রামীণ পরিবেশে নেই। আলো ঝলমলে একটা গোলাকার ঘরের মাঝে চমৎকার আয়েশে সোফায় বসে আছে। ওর মাথায় হেলমেট লাগানো হয়েছে আর ওর মুখোমুখি হয়ে বসে আছে সেই আগন্তুকরা।
আবির ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে, আমি এখানে কেন? তোমরাইবা কারা? আর আমাকেইবা ধরে এনেছো কেন? আমার কী অপরাধ?
একসাথে এতোগুলো প্রশ্ন শুনে আগন্তুকদের একজন রিদেমিক কণ্ঠে বলে, ভয় পেয়ো না আবির। আমরা তোমার বন্ধু। আমরা চাই তুমি বায়োনিক ক্ষমতা নিয়ে বেড়ে ওঠো। তাই তোমার মাথায় আমরা এনার্জি বারমেট স্থাপন করেছি। একটু পরই ওতে চার্জ করে তোমাকে বায়োনিক ক্ষমতার অধিকারী করে ছেড়ে দেবো। তখন তুমি একা একাই বাড়িতে চলে যেতে পারবে। সময় লাগবে মাত্র পনের মিনিট। তবে বাড়িতে পৌঁছেই তুমি বারমেটটা লুকিয়ে ফেলবে। এই বারমেটই হবে তোমার চলাচলের বাহন। যখনই মাথায় পরে রিমোট চার্জ করবে, সাথে সাথে প্রতি মিনিটে চলে যেতে পারবে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে। কেউ টেরও পাবে না। যখন খুশি তখনি তুমি আমাদের এই বায়োনিক স্পেসে চলে আসতে পারবে। তারপর মন চাইলে আমাদের সাথে সাথে আমাদের তানিজিং গ্রহেও ঘুরে আসতে পারবে। তবে এখনই আমরা তোমাকে আমাদের গ্রহে নিয়ে যেতে চাই না। আমরা পৃথিবীতে আমাদের একজন প্রতিনিধি হিসেবে তোমাকে পেতে চাই বলেই তোমার সাথে এই বন্ধুত্ব। তোমাকেই- শুধু তোমাকেই আমাদের পছন্দ। আমরা তোমাদের পৃথিবীতে আরো কিছু স্পেস পাঠিয়েছিলাম। সেগুলো কোথায় হারিয়ে গেছে জানি না। আমাদের বিশ্বাস, সেই স্পেসগুলোকে খুঁজে বের করতে তুমিই আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে। কারণ পৃথিবীর অধিবাসী মানুষ হিসেবে তোমার জন্য ওই কাজটা যতো সহজ হবে, আমাদের জন্য তা ততোটাই ঝুঁকিপূর্ণ। তুমি শুধু কথা দাও বন্ধু- তুমি কখনো আমাদের সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না। আমরাও কখনো তোমার কোন ক্ষতি করবো না। কি বলো আবির? তুমি রাজি তো?
আবির মন্ত্রমুগ্ধের মতো সব শুনে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো, রাজি মানে! একশ বার রাজি। তবে তোমরা আর প্রকাশ্যে আমার কাছে আসবে না।
আগন্তুকরা মাথা ঝুঁকিয়ে বললো, ঠিক আছে।
অমনি আবিরকে ধাক্কা লাগায় ওর বড় ভাই নিবিড়। -এই আবির, কি সব রাজি রাজি বলছিস? তোর তো রীতিমত জ্বর উঠে গেছে অ্যাঁ! আরে সত্যি সত্যি জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে দেখছি। এভাবে ঠা-া হাওয়ায় উদোম গায়ে বসে বসে ঝিমোচ্ছিস আর আবোল তাবোল বকছিস। ওঠ ওঠ ঘরের ভেতরে চল।
ভাইয়ার কথা শুনে আবির চোখ মেলে নিবিড়ের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ