জয়িতাদের খেলার জায়গাটি

জয়িতাদের খেলার জায়গাটি

গল্প মনির বেলাল ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সুপারির গাছ দুটি কেটে ফেলেছে। তারা পড়ে আছে নিথর- একেবারে চুপচাপ। যেন পাটিতে জড়ানো ওছিরুদ্দির মরা। সুপারি গাছের আশপাশের আর কেউ বেঁচে নেই। কঁচুর ঝাড়-ঢোল কলমির ডালগুলো, ভাটফুলের গাছ; এমনকি লজ্জাবতীর গাছগুলোকেও ওরা রেহাই দেয়নি। কাটা সব গাছগুলোকে ওরা ফেলে রেখেছে পুরোনো ইটের দেওয়ালের বাইরে। লজ্জাবতীর লতাগুলোর কথা ভেবে বেশি কষ্ট পাচ্ছে জয়িতা। ঐ লতাগুলো তো তাদের হাতের স্পর্শও সহ্য করতে পারত না। কুকড়ে যেত নিজের ভেতর। অথচ তাদের সাথেও এ পাষাণেরা কী ব্যবহার করেছে! ঢোল কলমির ডালগুলোর মধ্যে এক জোড়া ছোট্ট পাখি বাসা বেঁধেছিল। তাদের বাসাটিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। পাখি জোড়া ফিরে এসে এখন কোথায় থাকবে? কোথায় তারা ঘুমাবে? পাখির বাসাটি তালহা নিয়ে যেতে পারে। সে জয়িতাদের পাশের রুমেই থাকে। বেশ দুষ্টু। স্কুলে যায় না। সারাদিন ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। ওর মা-বাবা দুজনেই গার্মেন্টসে চাকরি করে। সারাদিন তাদের ডিউটি। রাত আটটা-নয়টার দিকে তারা বাসায় ফেরে। এ কারণে তালহাকে তার দাদির কাছে থাকতে হয়। অনেক ছোটো থেকেই সে তার দাদির কাছেই থাকে। তার দাদি তাকে বকা দেয়। কিন্তু সে তার দাদির কোনো কথাই কানে তোলে না। তার মা-বাবা তাকে ব্র্যাকের স্কুলে দিয়েছিল। সে যায় না। এজন্য তার মা-বাবা প্রায় তাকে পেটায়। সে ভীষণ চিৎকার করে কাঁদে। কিন্তু সে ভালো হয় না। তালহা-জয়িতা, এন্টন, মোকাব্বেল, শাওন সবার থেকে বড়ো। আবার শক্তিশালীও। জয়িতারা কেউ তার সাথে খেলতে চায় না। কিন্তু সে মাঝে মাঝে আসে- জয়িতাদের সাথে খেলার জন্য জোর করে। তখন তারা সবাই মিলে চিৎকার করলে- সে পালিয়ে যায়। কড়ই গাছটিই ছিল তাদের আশ্রয়। ঠিক যেন তাদের মাথার ওপরের টিনের চাল। কড়ইগাছের পাতাগুলোও আস্তে আস্তে মরে যাচ্ছে। কাকজি লেবুর গাছটিকে ফেলে রাখা হয়েছে সবচেয়ে দূরে।

লেবুগাছটি যেখানে ছিল সেই বরাবর তারা মাটি খুঁড়ছে। আট-দশজন মানুষ। লম্বা লম্বা লাইনগুলো এখন প্রায় কবরের সমান গর্ত হয়ে গেছে। মাটি খোঁড়া ঐ লোকগুলোর কোমর পর্যন্ত এখন মাটির নিচে। তারা প্রতিনিয়ত কোদাল দিয়ে মাটি কাটছে- আর তুলে তুলে ছুড়ে ফেলছে যতটুকু সম্ভব দূরে। তাদের ভেতরে কোনো দুঃখ নেই- যেন তাদের ভেতরে বিন্দুমাত্র আপসোস নেই। তারা মেতে আছে নিজেদের উপভোগ্য গল্পে। ছুঁড়ে ফেলা কাঁচামাটির ঢিলার মধ্যে তার পুুতুলের কাটা মাথাটি গড়াগড়ি খাচ্ছে। পুতুলটির শরীরের বাকি অংশ কোথায়? দেখা যাচ্ছে না! হয়তো চাপা পড়েছে ঐ মাটির নিচে। মাটির হাড়ি-পাতিল, বাসন-কোসন, কুলা, শিল-পাটা, গ্যাসের চুলা, দুইটি মাটির পুতুল- এগুলো তার বাবা তাকে কিনে দিয়েছিল ডগরতলীর মেলা থেকে। পুতুল দুটির একটি হারিয়ে গেছে। কোথায় রেখেছিল খুঁজে পায় না। কে নিয়েছে- কাউকেই সে সন্দেহ করতে পারে না। তালহা দুষ্টু। তবে তার পুতুল লুকিয়ে রাখবে- না, এত খারাপ সে নয়। এই সবকিছু খেলা শেষে তারা এখানেই লুকিয়ে রেখে যেত। এন্টনের খেলনা গাড়িটা পুরোনো হয়ে গিয়েছিল। তাই সে গাড়িটা আর বাসায় নিয়ে যেত না। এখানেই রেখে যেত। কালো রঙের নতুন বন্দুকটা শুধু নিয়ে যেত। তাদের খেলনাগুলোর একটাও জয়িতা দেখতে পাচ্ছে না। সবই কী তাহলে ঐ মাটির নিচে চাপা পড়ে গেছে? এরইমধ্যে এন্টন চারদিকে ঘুরে তাদের খেলনাগুলো খোঁজা শুরু করেছে। জয়িতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। তার কোনো নড়াচড়া নেই। এন্টন তার গাড়িটি খুঁজে পেয়েছে। জয়িতার খেলনাগুলোর মধ্যে মাটির তৈরি গ্যাসের চুলাটি শুধু সে পেয়েছে। বাকিগুলোর হদিস নেই। এন্টন গ্যাসের চুলাটি জয়িতার হাতে দিয়ে বলল, ‘চলো, বাসায় ফিইরা যাই। আর কিছু পাওয়া যাইত না।’

এন্টনরা চাকমা। সে আর তার মা ঢাকাতে নতুন এসেছে। এন্টনের বাবাও জয়িতার বাবার সাথে রপ্তানিতে চাকরি করে। তারা থাকেও এক বাসাতে। এন্টনের বাংলায় কথা বলতে কষ্ট হয়। এন্টনের বাবার কথাগুলো জয়িতাদের মতোই। তিনি অনেকদিন থেকে ঢাকায় আছেন বলেই হয়তো। 

এন্টন আর জয়িতা দুজনেই ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। মর্নিং শিপ্টে তাদের ক্লাস। সাড়ে এগারোটায় ছুটি হয়। বাসায় ফিরতে ফিরতে বারো-সাড়ে বারোটা বেজে যায় কোনো কোনো দিন। এরপর গোসল-খাওয়াদাওয়া শেষে বেলা গড়িয়ে যায়। তখন তার মা তাকে আর বাইরে বেরুতে দেয় না। ঘুমানোর জন্য চাপ দিতে থাকে। অথচ সে টিভি’র রিমোট হাত থেকে নামাতে চায় না।  মুটু-পাতলু, রুদ্রা, নিক্স, গোপাল ভাঁড়, ওগি- এগুলোই তার বেশি পছন্দ। তার মা চুলায় ভাত-তরকারি চাপিয়ে যতবার রুমে আসে- তাকে ঘুমানোর জন্য ধমক দেয়। জয়িতাও তার মায়ের এমন ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ধমকের সাইজ আর মাত্রা বুঝে সে ঘুমায়। তার বাবা দুপুরে বাড়ি আসে না। তার বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা নিশ্চিত। রাতও হয়। অফিস থেকে বেরিয়ে মুদি দোকানের এটাওটা-সবজি বাজার নিয়ে বাসাতে ফেরে। আর বাইরে বের হয় না। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে স্কুলের পড়াগুলোর অন্তত অর্ধেকটা শেষ করা লাগে- তারপর তার মুক্তি। অবশ্য আগে বেরিয়েও লাভ নেই। কারণ পাঁচটা না বাজলে- কারো মা’ই কাউকে বের হতে দেয় না। জয়িতার মা অনবরত তাকে সাবধান করতে থাকে, ‘দিনকাল ভালো না। খবরদার দূরে কোথাও যাবি না। ঐ ঘেরা বাউন্ডারির বাইরে যাবি না। সবাই একসাথে থাকবি। অপরিচিত কেউ ডাকলে- দৌঁড়ে বাসার দিকে চলে আসবি।’ তাদের খেলার জায়গাটি- তাদের বাসার জানালা থেকে পরিষ্কার দেখা যায়।

আজকে স্কুল থেকে ফিরে এন্টন প্রথমে ঐ ঘটনাটি দেখেছে। তারপর সে জয়িতাকে ডেকে এনেছে। এন্টনেরও ভীষণ মন খারাপ। ঘটনাটি বোধহয় মোকাব্বেল আর শাওন এখনও জানেই না। 

গ্যাসের চুলাটি হাতে নিতেই জয়িতার দুচোখ ফেটে পানি গড়াতে লাগল। ডগরতলীর মেলাতে যাওয়ার জন্য জয়িতা ভীষণ ঝুম ধরেছিল। তার মা মেলায় যেতে দিতে চায় না। তার মায়ের কথা- এই মেলাতে কোনোকিছু পাওয়া যায় না। তার থেকে ঘোড়াপীরের মাজারের মেলাই ভালো। সংসারের দু-একটা জিনিস পাওয়া যায় ওখানে। তবে জয়িতার বাবা এদিক থেকে অনেক ভালো। বাবাকে জয়িতার খুব পছন্দ। শুধু টিভি’র রিমোট নিয়ে তার বাবার সাথে মাঝে মাঝে একটু যুদ্ধ বাধে। বাবা তাকে মেলাতে নিয়ে গিয়েছিল। তার মা যায়নি। জয়িতার সেই সব খেলনাগুলোও হারিয়ে গেল। গ্যাসের চুলা হাতে সে বাসায় ফিরল। তার গাল বেয়ে নেমে যাওয়া অশ্রুস্রোত থেমেছে। তবে বালুরচরের জলরেখার মতোন ঐ দুই গালে শুকনো জলের দাগ স্পষ্ট। তার মা তাকে ভাত খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। আজ জয়িতার প্রিয় তরকারি- মাছের ডিম রান্না করেছে তার মা। তারপরও সে কিচ্ছু মুখে দিচ্ছে না। সোজা বিছানায় উঠে কাঁদতে থাকে। তাকে বোঝানোর জন্য তার মা কত কথা বলছে। কিছুতেই তাকে বোঝাতে পারছে না। তার মা বলছে, ‘এটা ঢাকা শহর। কত মানুষ এখানে আছে, আবার রোজ নতুন মানুষ আসছে। নতুন বাসা না বানালে এই মানুষগুলো থাকবে কোথায়? আর বাসা বানানোর জন্যই তো জায়গাটা ওভাবে ঘিরে রেখেছিল। যতদিন ফাঁকা ছিল- তোরা খেলেছিস, ব্যাস! দেখ, বলে তার মা তাকে তাদের রুমের জানালার দিকে তাকানোর ইঙ্গিত করে। যতখানি ফাঁকা জায়গা দেখা যাচ্ছে- সবই তো ভাগ ভাগ করে ইটের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। তাহলে কী এরা বাসা বানাবে না? এ মুহূর্তে জয়িতার কোনোকিছু দেখতে ইচ্ছে করছে না। কিছু শুনতেও ইচ্ছে করছে না। তবে তার মা যা তাকে দেখাতে চাচ্ছে- তা তো সে রোজই দেখে। তাদের জানালার সাথে যেই ফাঁকা জায়গাটি আছে- সেটুকুতেও তিনটি ওরকম ইটের দেওয়াল তোলা। অর্থাৎ জায়গাটিকে তিন ভাগে ভাগ করা। জয়িতা এগুলোকে এভাবে কোনোদিন দেখেনি। সে তার বাসা থেকে স্কুল পর্যন্ত মনে মনে এক পলকে দেখে এলো। সব জায়গাই এরকম দেওয়ালের কবজায়। জয়িতার মা প্রতিনিয়ত তার হাত থেকে টিভি’র রিমোট কেড়ে নেয়। আজ সে তার দিকে রিমোট এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘নে, টিভি দেখ। আর সামনের মাসে তো আমরা তোর নানির বাড়িতে যাচ্ছিই; দশ-বারো দিন থাকব। তখন ঐশি-মারুফার সাথে জান ভরে খেলিস।’ কথাগুলো বলে উঠে যাওয়ার সময় বলল, ‘তোর বাবাকে দই আনতে বলেছি।’ তার মা রুম থেকে বেরিয়ে গেলে- সে রিমোটটি ছুঁয়েও দেখল না। বালিশটা টেনে তার মাথার নিচে দিলো।     

জয়িতার বাবা অফিস থেকে ফিরে এসে বলল, ‘মা তোমাকে আমি আবার খেলনা কিনে দেবো। কান্নাকাটি করো না। জয়িতা কান্না জড়ানো কণ্ঠে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু বাবা, ওসব খেলনা নিয়ে আমি খেলব কোথায়? জয়িতার বাবার মুখে আর কোনো কথা নেই। সে ডানে-বামে ঘুরছে আর উত্তর খুঁজছে মেয়ের প্রশ্নের...!

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ