ছক্কার রাজ্যে রাজারা    -হাসান শরীফ

ছক্কার রাজ্যে রাজারা -হাসান শরীফ

খেলার চমক জানুয়ারি ২০১৭

আকাশের ঠিকানায় বল পাঠানোতে আনন্দই আলাদা। এটা দেখেও তৃপ্তি, হাঁকিয়েও সন্তুষ্টি। দর্শকরা যেন অপেক্ষায় থাকেন কখন নামবে বিগ হিটাররা। তাই ছক্কাবাজদের কদর একটু বেশিই। ক্রিস গেইল, ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম, শহিদ আফ্রিদি, বিরাট কোহলিরা এ কারণে একটু বেশি জনপ্রিয়। ক্রিকেটের বিবর্তনের ফলে এখন ছক্কার সংখ্যা বাড়ছে। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আত্মপ্রকাশের পর এর গতি বাড়ে। আর টোয়েন্টি-২০ ক্রিকেট যেন বাউন্ডারি আর ওভার বাউন্ডারি মারার খেলা। তার সাথে পাল্লা দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটেও বাড়ছে ছক্কাবাজদের সংখ্যা।
টি-২০ দিয়েই শুরু করা যাক। এই ছক্কার রাজত্বে শাসন চালাচ্ছেন ক্রিস গেইল। তিনিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ছক্কা হাঁকিয়েছেন। তবে নিউজিল্যান্ডের ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম যে গতিতে এগুচ্ছেন, তাতে তিনি যেকোনো সময় ধরে ফেলতে পারেন তাকে।
একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ছক্কাবাজ হিসেবে সবচেয়ে পরিচিতি পেয়েছিলেন পাকিস্তানের শহিদ আফ্রিদি ও শ্রীলংকার সনৎ জয়াসুরিয়া। তাদের অবসর নেয়ার আগে পর্যন্ত তারাই ছিলেন স¤্রাট। এখনো এখানে রাজত্ব করছেন আফ্রিদি, ৩৫১টি ছক্কা নিয়ে। জয়াসুরিয়া আছেন দ্বিতীয় স্থানে। তবে অনেক পেছনে। তার ছক্কা ২৭০টি। তৃতীয় স্থানে আছেন ক্রিস গেইল। তার ছক্কা ২৩৮টি।
টেস্ট ক্রিকেটে সর্বাধিক ছক্কার অধিকারী নিউজিল্যান্ডের ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম। তার ছক্কার সংখ্যা ১০৭টি। দ্বিতীয় স্থানে আছেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। তার ঠিক ১০০টি। তৃতীয় স্থানে আছেন ক্রিস গেইল, ৯৮টি। তিনি তো এখন আর টেস্ট খেলছেন না। ফলে ১০০টি ছক্কা হাঁকানো এখনই সম্ভব হচ্ছে না। তবে যদি আর একটিও টেস্টে খেলার সুযোগ পান, তবে তিনি হতে পারেন বিরল ক্রিকেটার। সব ফরম্যাটে শত ছক্কা হাঁকানো একমাত্র ব্যাটসম্যান।
ছয় বলে ছয়টি ছক্কা হাঁকানোর রেকর্ডও আছে। টেস্ট ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত তা কেউ করতে পারেনি। তবে একদিনের আন্তর্জাতিক, টোয়েন্টি-২০ এবং প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে এই নজির আছে। এর প্রথম উদাহরণটি গড়েন সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে বিবেচিত গ্যারি সোবার্স। ১৯৬৮ সালে কাউন্টি ক্রিকেটে সনসিতে নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে গ্লামারগনের ম্যালকম ন্যাশের বলের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য কীর্তিটি গড়েন। অধিনায়ক হিসেবে তখন সোবার্সের দ্রুত রান তোলার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে  ন্যাশ বাঁ-হাতি স্পিনার হলেও স্পিন নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। তার ভাষায়, ‘সোবার্স এলেন এবং দ্রুত আমার স্লো-বোলিং ক্যারিয়ার শেষ করে দিলেন। এটা ছিল খুবই দুঃখজনক সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা।’ ছয় বলের ওভারের পঞ্চমটি বাউন্ডারির প্রান্তে তালুবন্দি হলেও ফিল্ডার ততক্ষণে দড়ির ওপর পা দিয়ে ফেলেছিলেন। আর ষষ্ঠ বলটি মাঠের বাইরে হারিয়ে গিয়েছিল, পরদিন এক স্কুলছাত্র রাস্তা থেকে সেটি কুড়িয়ে ফেরত দিয়েছিল।
দীর্ঘ ১৭ বছর পর বারোদার তিলকরাজের এক ওভারের ছয় বলে ছয়টি ছক্কা হাঁকিয়ে সোবার্সের সেই রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেন ভারতের রবিশাস্ত্রী। মজার ব্যাপার হলো, শাস্ত্রী কিন্তু বিগ হিটার হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। বরং স্লো ব্যাটিংয়ের জন্য তিনি সমালোচিত হতেন। ১৯৮৫ সালের ৪ জানুয়ারি কলকাতায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করতে ৭ ঘণ্টা সময় নিলে দর্শকরা তার দিকে ফল-মূল ছুড়েছিলেন। কিন্তু এর এক সপ্তাহ পর তাকে দেখা গেল ভিন্ন মূর্তিতে। বোম্বাইয়ের হয়ে রনজি ট্রফিতে খেলতে নেমে স্লো বাঁ-হাতি বোলার তিলকরাজকে তুলোধোনা করেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সেঞ্চুরিটি করতে তিনি ৩৫৪টি বল খেলেছিলেন, আর বারোদার বিপক্ষে ডবল সেঞ্চুরি করেছিলেন ১২৩ বলে ১১২ মিনিটে।
বাংলাদেশও এক ওভারে ছয়টি ছক্কা হাঁকানো প্রত্যক্ষ করেছে এবং সেই কৃতিত্ব গড়েছেন ‘ছক্কা নাঈম’। ঢাকার প্রিমিয়ার ক্রিকেটে  ১৩ নভেম্বর, ২০০৯-এ মিরপুর স্টেডিয়ামে মোহামেডানের লেগ স্পিনার মার্শাল আইয়ুবের ওভারে গাজী ট্যাংকের নাঈম ইসলাম সেটা করেন। ৪৯তম ওভারে তার এই তান্ডব সত্ত্বেও ম্যাচে গাজী ট্যাংক হেরে গিয়েছিল।
বর্তমানকালের ছক্কাবাজদের ভিড়ে আরেকজন প্রায় হারিয়েই গেছেন। তাকেই ক্রিকেটের সেরা ছক্কাবাজ হিসেবে অভিহিত করা যায়। তবে তার দুর্ভাগ্য তিনি আধুনিককালে জন্মগ্রহণ করেননি। করলে একদিনের আন্তর্জাতিক এবং হালের টোয়েন্টি-২০ ক্রিকেটে মহানায়ক বনে যেতেন। তখনও তার ছক্কা মারাটা মিথের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটে সমারসেটের হয়ে আর্থার ওয়েলার্ড তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ৫ শতাধিক ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন। তার প্রথম শ্রেণীর ১২,৪৮৫ রানের প্রায় এক-চতুর্থাংশই ছিল ছক্কার সাহায্যে। এক মওসুমে (১৯৩৫) সালে তার ৭২টি ছক্কা হাঁকানোর রেকর্ড গড়েছিলেন। এর আগের দুই মওসুমে তথা ১৯৩৫ ও ১৯৩৬ সালে তিনি ১২৯ বার বল শূন্যে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি দুবার উপর্যুপরি ৫টি বলকে ছক্কা বানিয়েছিলেন। তিনি ব্র্র্যাবোর্ন স্টেডিয়ামে ভারতের অমর সিংয়ের একটি বল গ্যালারির বাইরে ফেলেছিলেন। মেপে দেখা যায় তিনি বলটি পাঠিয়েছিলেন ১১৭ গজ দূরে এবং স্ট্যান্ডের উচ্চতা ছিল প্রায় ৬০ ফুট। তবে তিনি কিন্তু সেঞ্চুরির ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে ছিলেন। তিনি মাত্র একটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন এবং তাতে লেগেছিল ৯০ মিনিট।
ছক্কাবাজদের কথা এলে পাকিস্তানের জাভেদ মিয়াঁদারে প্রসঙ্গও আসবে। ১৯৮৬ সালে শারজায় অস্ট্রেলেশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে তিনি মিলিয়ন ডলারের ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন। ২৪৬ রান তাড়া করতে গিয়ে এক বল বাকি থাকতে পাকিস্তানের স্কোর দাঁড়ায় ৯ উইকেটে ২৪২। শেষ বলটি করতে এগিয়ে আসেন চেতন শর্মা। মিয়াঁদাদ তখন ১১০ রানে অপরাজিত ছিলেন। তিনি জানতেন জয় পেতে হলে তাকে কিছু করতে হবে। ফুল টস বলটি এলো উঁচু হয়ে এবং তিনি সেটি পাঠিয়ে দিলেন মাঠের বাইরে। ভারতের উইকেটরক্ষক চন্দ্রকান্ত পন্ডিত পরে বলেছিলেন, ‘আমরা যেন চেতনা হারিয়ে ফেললাম। এরপর ড্রেসিংরুমে শ্মশানের স্তব্ধতা নেমে এলো।’
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ