চঞ্চল শিশুমন

চঞ্চল শিশুমন

প্রতিবেদন মার্চ ২০১৫

আব্দুল হাদী আল-হেলালী#

বাবা-মায়ের পুরো সময়টাই কাটে শিশুকে নিয়ে। এত পরিশ্রম, এত পরিকল্পনা, এত উদ্যোগ, এত স্বপ্নের বিরাট অংশজুড়েই আছে শিশু। যে ঘরে শিশু নেই সে ঘরটিতে যেন বড় ধরনের অপূর্ণাঙ্গতা রয়ে গেছে। এত ভালোবাসা, এত সাধনার ধন শিশু, তাকে বড় করে তোলা কিন্তু সহজ নয়। বড়রা শিশুদের কাছে যেমনটা প্রত্যাশা করেন, শিশু কিন্তু অনেক সময় তেমনটা করতে আগ্রহী থাকে না। তখন অভিভাবকেরা দুঃখিত হন, বিরক্ত হন, হন আশাহত। কেন হয় এমনটা? জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে শিশুরা বড়দের অবাধ্য হয়। এটা বড় হওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ। এর মাধ্যমে শিশু বড়দের প্রত্যাশা ও আগ্রহের বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। সে তার নিজস্ব সত্তা সম্পর্কে ধারণা পায়। সে প্রশ্ন করে, কেন একটি কাজ তাকে করতেই হবে তা জানতে চায়, এই অভিজ্ঞতাগুলোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে তার ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। বেশ কিছু বিষয় সে বড়দের থেকেও নেয়। সাথে সাথে গড়ে ওঠে তার নিজস্ব সত্তা। সে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এবং একধরনের স্বাধীনতার স্বাদ পায়। যখনই তারা তাদের অভিভাবকদের সাথে কোন দ্বন্দ্বে জড়ায়, তখনই তারা তাদের অভিভাবকদের নিয়ম-নীতির সীমা এবং তাদের নিজেদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের সীমা সম্পর্কে ধারণা পায়। একটা মাত্রার মধ্যে শিশুর অবাধ্যতা তাই স্বাস্থ্যকর। শিশু যদি বাবা-মায়ের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে বিনা প্রশ্নে মেনে নিত তবে সে হয়ে উঠতো বাবা-মায়ের ব্যক্তিত্বের কপি যা মোটেই কাম্য নয়। মানবপ্রজাতির বিকাশে বৈচিত্র্যের কোন বিকল্প নেই। ব্যক্তিত্বের কার্বণ কপি দরকার নেই। দরকার নতুন ধরনের মানুষ। মাঝে মাঝে এই ধরনের অবাধ্যতা অল্পতেই মিটে যেতে পারে। আবার কখনো কখনো এটা তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে ওঠে। তখনই এটা সমস্যায় পরিণত হয়। অনেক কারণে শিশু অবাধ্য হয় কোন কোন বাচ্চা ও কোন কোন অভিভাবকের মেজাজ জন্মগতভাবেই বেশ চড়া থাকে, তারা বেশ অস্থির, হঠকারী ও অল্পতেই বিরক্ত হয়। শিশু তার স্বাধীনতা প্রকাশের অংশ হিসেবেও বাবা-মায়ের অবাধ্য হতে পারে। একক অভিভাবক অথবা যেসব বাবা-মা চাপের মধ্যে আছেন তাদের আচরণ বাচ্চাদের মধ্যে অনেক সময় অনিশ্চতয়তা, নিরাপত্তাহীনতা বা রাগ তৈরি করে যার ফলে তারা অবাধ্য হতে শুরু করে। অন্যদের অবাধ্যতা দেখেও শিশু অবাধ্যতা শিখতে পারে। বাবা-মায়ের সাথে শিশুর সম্পর্ক যদি তেমন ভালো না হয়, বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে যদি তারা তাকে যথেষ্ট গুণগত সময় দিতে ব্যর্থ হন, তখন শিশুর মধ্যে তাদের প্রতি অবাধ্যতা দেখা যায়। অনেক সময় অবাধ্যতা করে শিশু সুবিধা পায়। ফলে সে অবাধ্যতাই শিখে। এমনও হতে পারে যে, সাধারণভাবে সে তার সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারে না। কিন্তু আচরণ খারাপ করলে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে তার চাহিদা বড়রা মেনে নেন। শিশু যখন ভালো আচরণ করে তখন অভিভাবকেরা তার প্রতি মনোযোগী হন না। কিন্তু খারাপ আচরণ করলে তারা তার প্রতি নেতিবাচক মনোযোগ দেন। বকাঝকা করেন। সে এই মনোযোগ পছন্দ করে। ফলে সে আরো বেশি করে অবাধ্য আচরণ করে। কিছু মানসিক রোগ থাকলে শিশুর মধ্যে অবাধ্যতা বেশি দেখা যায়। যেমন, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুরা তাদের বোঝার অক্ষমতার জন্য অবাধ্যতা বেশি করে। অটিজম আছে এমন শিশুরা নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। তাদের গুরুতর যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন সমস্যা থাকে। ফলে তারা বড়দের নির্দেশনা বুঝতে পারে, যার ফলে তারা তা মানতেও পাওে না। বৈশিষ্ট্যের কারণেই এরা বেশ অবাধ্যতা করে। শিশুদের মধ্যে বিষণœতা ও উৎকণ্ঠা রোগ থাকলেও তাদের আচরণ খারাপ হয়ে থাকে। যখন আপনার শিশু ক্রমাগত অবাধ্যতা করে তখন তার কারণ অনুসন্ধান করুন। এই কারণগুলো দূর করার ব্যবস্থা করুন। শিশুর অবাধ্যতা দূর করার জন্য এমন কিছু পদক্ষেপ নিন যা প্রকৃত অর্থে কার্যকর। এ ক্ষেত্রে  আপনার পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে কতটা সম্মান করে তা দেখুন। যদি তারা একে অপরের সাথে অসৌজন্য করে তবে শিশুও তা শিখবে। শিশু সব আচরণই দেখে শিখে। পরিবারের সদস্যরা সৌজন্য বজায় রাখলে শিশুও সৌজন্য শিখবে। বড়দের উচিত একে অপরের মূল্যবোধ, ধারণা, ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোকে সম্মান করা। তবে শিশুরাও এমনটা করতে শিখবে। বড়দের শিশুর জন্য রোল মডেল হয়ে উঠতে হবে। তাদেরকে তাদের বড়দের মান্য করতে হবে। নিজে খারাপ ব্যবহার করে শিশুর কাছে সৌজন্য আশা করাটা বৃথা। পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন বাড়াতে হবে। মনোমালিন্য তৈরি হলে আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করতে হবে। পরিবারের সদস্যরা ভাষা ব্যবহারে সংযত হবেন। তারা কথা দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করবেন। কোন কথার মানে দাঁড় না করিয়ে কী বলতে চান তা পরিষ্কার করে বলে ফেলবেন। অন্য সদস্যদের কোন কাজে তার অসুবিধা হলে তা মুখে বলবেন ও আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করবেন। এই গণতান্ত্রিক পরিবেশ শিশুকে তার মত প্রকাশ করতে সাহায্য করে। তার সাথে দ্বিমত থাকলে অভিভাবকেরা তা বুঝিয়ে বলবেন। ফলে শিশুর অবাধ্যতার প্রয়োজন পড়বে না। শিশুর একটি অনুরোধ রাখতে না পারলে তার জন্য অন্য একটি বিকল্প প্রস্তাব দিলে ভালো হয়। শিশু ভালো আচরণ করলে তাকে পুরস্কৃত করুন; যেমন, আদর করুন, প্রশংসা করুন, পছন্দের জিনিস কিনে দিন। শিশুদের পছন্দমতো খাবার দেয়া, খেলনা কিনে দেয়া, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, প্রশংসা, আদর এসবই পুরস্কার হিসেবে কাজ করে। ভালো আচরণ পুরস্কৃত করলে এই ধরনের আচরণের সম্ভাবনা আরো বেড়ে যাবে। যতটা সম্ভব শিশুর খারাপ আচরণ উপেক্ষা করুন। কোন ধরনের মনোযোগ না পেলে খারাপ আচরণ কমে যাবে। শিশু-কিশোররা হুমকি দিয়ে বা খারাপ আচরণ করে যাতে লাভবান না হয় তা নিশ্চিত করুন। যেমন, হুমকি দিলেও তার হুমকির কাছে নতি স্বীকার করে তার চাহিদা পূরণ করবেন না। ছোটবেলা থেকেই শারীরিক ও দলীয় খেলায় শিশুকে উৎসাহিত করুন। শিশুর বিকাশে খেলার গুরুত্ব অনেক। বয়স উপযোগী খেলার ব্যবস্থা করুন। খেললে খারাপ আচরণ করার জন্য শিশু কম সময় পাবে। বাবা-মা ও অভিভাবকেরা একমত হয়ে শিশুর ওপর পারিবারিক শৃঙ্খলা আরোপ করবেন। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে, শৃঙ্খলা সবার ক্ষেত্রেই যাতে সমানভাবে প্রয়োগ করা হয়। শিশু-কিশোরদের কথা গুরুত্বসহ শুনুন ও বিবেচনা করুন। যদি আপনি তাদের সাথে ভিন্নমত হন তবে তাদেরকে ভিন্নমতের কারণ ব্যাখ্যা করে বলুন। শিশুকে মারবেন না। তাকে ভয় দেখাবেন না। শিশু-কিশোরদের ভালবাসুন। দুষ্ট বাচ্চাদের বা সমস্যাপূর্ণ বাচ্চাদের স্নেহ-ভালোবাসা আরো বেশি প্রয়োজন। এ ছাড়া শিশু বা অভিভাবকদের যদি রাগের সমস্যা থাকে বা কোনো মানসিক সমস্যা থাকে তবে তার যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুকে কিছু করতে বললে তা কার্যকরভাবে বলতে হবে। তবেই তার নির্দেশনা মেনে চলার সম্ভাবনা বাড়বে। শিশুকে কার্যকরভাবে নির্দেশনা দেবার কতগুলো নিয়ম আছে যা অনুসরণ করে আমরা শিশুর অবাধ্যতা কমাতে পারি- শিশুকে নির্দেশনা দেবার সময় ভদ্রভাবে সৌজন্যের সাথে দিতে হবে। এ জন্য এ কাজটি করে দাও প্লিজ-এভাবে বলা যায়। নির্দেশনা দেবার সময় চিৎকার করে বা খারাপ ভাষায় বলবেন না। তার কাছাকাছি গিয়ে তার চোখে চোখ রেখে তাকে নির্দেশনা দিন। নিশ্চিত হোন যে, আপনার কথায় সে মনোযোগ দিয়েছে। সে যদি টিভি দেখতে থাকে বা খেলায় ব্যস্ত থাকে তবে সম্ভব হলে তার এই কাজটি একটি পর্যায় পর্যন্ত শেষ হতে দিন। এরপর টিভি বা খেলা বন্ধ করে তারপর নির্দেশনা দিন। আপনার নির্দেশনা সে বুঝেছে কি না তা তার থেকে জেনে নিন। একেকবারে একেকটি করে নির্দেশনা দিন। জটিল নির্দেশনা হলে একবারে নির্দেশনা না দিয়ে ধাপে ধাপে এটিকে কয়েকটি ভাগে ভেঙে কয়েকবারে এই নির্দেশনাটি দিন। শিশু একেকটি নির্দেশনা মানলে ধাপের পরবর্তী নির্দেশনাগুলো দিন। নির্দেশনা দেবার সময় কতটুকু সময়ের মধ্যে এটি করতে হবে তা-ও পরিষ্কার করে বলে দিন। যে শিশু বড়দের কোন নির্দেশনা মানতে চায় না তাকে নির্দেশনা দেবার সময় এটি মানতে উৎসাহিত করতে হেসে, পিঠ চাপড়ে বা কৌতুক করে নির্দেশনা দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রত্যাশিত আচরণকে পুরস্কৃত করলে এটি করার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। শিশুর সাথে আলাপক্রমে পুরস্কার ঠিক করা যেতে পারে। জটিল ধরনের নির্দেশনার ক্ষেত্রে প্রতিটি ধাপ অনুসরণ করার সাথে সাথে পর্যায়ক্রমিকভাবে পুরস্কার দেয়া যায়। পুরস্কারের সাহায্যে একঘেয়ে ও নিরানন্দ কাজও করিয়ে নেয়া যায়। পুরস্কার তাৎক্ষণিকভাবে দিলে ভাল হয়। শিশুকে নির্দেশনা দিয়ে কাজ শুরু পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তারপর আপনি আপনার কাজে যেতে পারেন। এরপরও তার কাজের ধারাবাহিকতার দিকে লক্ষ্য রাখুন। অনেক সময় শুরু করেও সে কাজ থামিয়ে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে শান্তভাবে কিন্তু দৃঢ়তার সাথে তাকে আবার কাজটি শুরু করতে বলুন। নির্দেশনা দেবার পর শিশু যদি বিভ্রান্ত বোধ করে নির্দেশনাটি এবং কেন এটি দেয়া হচ্ছে এই বিষয়টি শিশুকে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলুন। একবার বুঝিয়ে বলাই যথেষ্ট। এরপর প্রয়োজনে দৃঢ়তার সাথে নির্দেশনাটি পুনরাবৃত্তি করবেন। আর ব্যাখ্যা করবেন না। শিশুকে একটি কাজ থেকে অন্য কাজে সরিয়ে নিতে হলে তাকে অন্তত পাঁচ মিনিট আগে বলুন। তাকে মানসিক প্রস্তুতি নেবার সময় দিন। এরপরও দুই মিনিট আগে আরেকবার মনে করিয়ে দিন। এরপর তাকে সে যে কাজটি করছে তা থেকে সরিয়ে নিয়ে অন্য কাজে লাগান। শিশুকে নির্দেশনা কিভাবে দেবেন তা শিশুর বয়স, বুদ্ধিমত্তা, বা কোন প্রতিবন্ধিতা (শারীরিক বা মানসিক) আছে কিনা তার ওপর নির্ভর করে। বোঝার ক্ষমতার অভাব থাকলে অত্যন্ত সাধারণ ভাষায় একেকবারে একটি করে নির্দেশনা দিতে হবে। সবশেষে মনে রাখা দরকার যে, শিশু প্রতিটি ক্ষেত্রে বড়দের সব আদেশ নির্দেশ মেনে চলবে এমনটা আশা করা যায় না। তার অবাধ্যতা একটা মাত্রার মধ্যে থাকলেই হলো। লক্ষ্য রাখুন আপনি শিশুর থেকে খুব বেশি প্রত্যাশা করছেন কি না। শিশুর মধ্যে সাধারণ চঞ্চলতা থাকে। আর এই চঞ্চলতা একটি শিশুকে মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত করে গড়ে তুলতে সহায়ক।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ