খুদে  বাহিনীর গুহা অভিযান । মূল : অ্যালান ফিনচ । রূপান্তর : হোসেন মাহমুদ

খুদে বাহিনীর গুহা অভিযান । মূল : অ্যালান ফিনচ । রূপান্তর : হোসেন মাহমুদ

অনুবাদ গল্প নভেম্বর ২০১৮

৬.

ন্যান্সি আর ডেভ বাড়িতে পৌঁছে। ড্রয়িং রুমে গিয়ে ঘড়ি দেখে। রাত সাড়ে নয়টা বাজে। ওরা বাড়ি থেকে বেরিয়েছে সাড়ে আটটায়। এই এক ঘণ্টার মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। এখন দ্রুত পুলিশকে সব জানাতে হবে। দাদুর ঘরের দিকে তাকায়। আলো নেই। তার মানে দাদু-দাদি শুয়ে পড়েছেন। ঘুমিয়েও গেছেন হয়ত। কিন্তু উপায় নেই। দেরি করা যাবে না। দু’জন ছুটে গিয়ে দাঁড়ায় দরজার সামনে। ন্যান্সি আস্তে নক করে। আবার। তারপর আবার। দাদুর গলা শোনা যায়-

: কে?

: দাদু আমি ন্যান্সি। দরজা খুলুন।

একটু সময় কাটে। দরজা খোলেন দাদু। বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন-

: কী ব্যাপার? তোমরা? ডাকছ কেন?

: হ্যাঁ দাদু, একটু সমস্যা হয়েছে। আপনি শিগগির পুলিশকে ফোন করুন। তারা যেন আপনার এখানে এখুনি চলে আসে।

: পুলিশকে ফোন! কিন্তু কেন? কী হয়েছে? কুর্ট কোথায়?

এতগুলো প্রশ্ন করে ফেলেন দাদু একসাথে। ন্যান্সি বলে-

: দাদু প্লিজ, আমার কথা আগে শুনুন। আপনি পুলিশকে ফোন করে দ্রুত আসতে বলুন। জরুরি। তারা আসার পর সব খুলে বলব আমি। দয়া করে দেরি করবেন না।

ন্যান্সির কথায় দ্রুত ড্রয়িং রুমে গিয়ে পুলিশকে ফোন করলেন দাদু। জরুরি ব্যাপার বলে তাড়াতাড়ি আসতে বললেন অফিসারকে। তারপর বেরিয়ে এলেন। এদিকে দাদিও উঠে এসেছেন। পুলিশ আসছে শুনে কিচেনে কফি তৈরি করতে যাচ্ছেন বলে বেরিয়ে গেলেন। ডেভ গেল তাকে সাহায্য করতে।

আট মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলেন পুলিশের সহকারী কমিশনার জন হপকিন্স। দাদুকে আগে থেকেই চেনেন তিনি। তার সাথে আরো তিনজন অফিসার রয়েছেন। তাদের স্বাগত জানিয়ে দাদু ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসালেন। ন্যান্সিকে দেখিয়ে বললেন-

: এ আমার নাতনি ন্যান্সি। সে কিছু জরুরি কথা বলতে চায় আপনাদের।

হপকিন্স অবাক হয়ে চাইলেন ন্যান্সির দিকে। ন্যান্সি বিলম্ব না করে সকালে তাদের গুহায় যাওয়া, লিনের আটক হওয়া, তারপর রাতে অভিযানে বেরনো, মাদক চক্রের নেতার মাদক চালান পাঠানোর প্ল্যান, তাদের এক সদস্যকে আটক করা, গুপ্তধনের কথা সংক্ষেপে জানায়। বিস্মিত অফিসার জিজ্ঞেস করলেন-

: তুমি বলছ যে কুর্ট আর লিন এখনো গুহার মধ্যেই আছে?

: হ্যাঁ, ওরা আপনাদের অপেক্ষায় আছে।

হপকিন্স বললেন-

: তাহলে আর দেরি করা ঠিক হবে না।

এদিকে কফি এসে গেছে। এখন কফি খাওয়ার সময় নয়। কিন্তু দাদির প্রতি সম্মান দেখিয়ে সবাই কাপ হাতে তুলে নিলেন। এর মধ্যেই ওয়াকিটকিতে দু’ জায়গায় কথা সেরে নিলেন হপকিন্স। কফি খাওয়া শেষ হলো তিন মিনিটে। তারপর দাদুর কাছ থেকে বাড়ির সামনে রাস্তা ও গুহার সাথে সংযোগের লোকেশনটা জেনে নিলেন তিনি। অফিসে ডিউটি অফিসারকে এ বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দশজনের একটা পুলিশ টিম পাঠিয়ে দিতে বললেন তখুনি। তিন অফিসারের মধ্যে একজনকে বললেন-

: অফিসার ন্যাশফিল্ড, আপনারা তিনজন ন্যান্সিদের সাথে বাড়ির পেছন দিয়ে যান। আমি পুলিশ টিম এলে তাদের নিয়ে রাস্তার দিক দিয়ে গুহায় ঢুকব। সাবধান থাকবেন। ওয়াকিটকিতে আমাদের যোগাযোগ থাকবে।

দেরি না করে পুলিশদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ন্যান্সি।

এদিকে বেশ ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিল কুর্ট। মাদক চক্রের সদস্য যে লোকটিকে ওরা আটকে রেখেছে তার নাম পেন্স। ন্যান্সি আর ডেভ চলে যাওয়ায় কুর্টদেরকে মাত্র দু’জন দেখে সে মনে মনে খুশি হয়ে উঠেছিল। দু’জন শিশু ওকে বন্দী করে রাখবে, তুলে দেবে পুলিশের হাতে এটা মানতে পারছিল না সে। এ রীতিমতো মান-সম্মানের ব্যাপার। দলের লোকদের কেউ যদি জানতে পারে, তারা তাকে নিয়ে উপহাস করবে। কিন্তু একবার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় পালানোর চিন্তা বাদই দিয়েছিল সে। এখন আবার চিন্তাটা মাথায় বাসা বাঁধে। সমস্যা হলো, হাত দুটো ছেলেটা পেছনে এমনভাবে বেঁধেছে সে কিছু করার কোনো সুযোগই পাচ্ছে না। তার ওপর ছেলেমেয়ে দুটো খুব কড়া নজর রেখেছে তার ওপরে। বাড়াবাড়ি করলে বিপদ হতে পারে। ছেলেটাকে বিচ্ছুর মত মনে হয়। গুলি করার ভয় দেখিয়েছে। এবার হয়ত গুলিই করে বসবে।

কুর্ট আর লিন নিজেদের মধ্যে কী ব্যাপারে যেন আলোচনা করছে। পেন্সের দিকে নজর নেই। সুযোগটা নেয় পেন্স। নিঃশব্দে পাথরটার কোণের দিকে সরতে থাকে। সরতে সরতে পাথরটার মাথায় পৌঁছে যায়। সামনেই গুহার প্রশস্ত জায়গা। পেট্রোম্যাক্সের আলো জ্বলছে। সে সময় জ্যাককে দেখতে পায়। এদিকেই আসছে। সেই যে গুপ্তধনের গুহায় দৌড়ে যেতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে সে ধরা পড়ল, সে সময় তার সাথে থাকা জ্যাক পালিয়ে গিয়েছিল। পেন্স মনে করেছিল সে দলের বাকিদের কাছে গেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তা সে যায়নি। বরং এতক্ষণ কোথাও হয়ত লুকিয়ে ছিল। তারপর কারো কোনো সাড়া না পেয়ে হয়ত এখানে ফিরে এসেছে। হঠাৎ জ্যাক তাকে দেখতে পায়। চিৎকার করে ওঠে সে-

: এই পেন্স! তুমি কি করছে ওখানে বসে?

ছুটে আসে সে তার কাছে। মেঝেতে বসে পড়ে তার হাতের বাঁধন খুলতে যায়। কিন্তু তা আর হয় না। কানের পাশে পিস্তলের স্পর্শে জমে যায় জ্যাক। হাত থেমে যায় তার। ভুল করে ফেলেছে সে। পিস্তলধারীর চেহারাও দেখা হয়ে গেছে। সেই বিচ্ছু ছেলেটা। তার সাথে একটি মেয়েও আছে। মেয়েটির হাতে একটি মাঝারি সাইজের কাঠ। আঘাত করতে তৈরি।

কুর্ট কঠিন স্বরে বলে-

: নড়ো না বাপু। সাবধান। আমার পিস্তল থেকে গুলি বেরিয়ে যেতে পারে।

লিনকে বলে-

: শয়তান দুটোকে আমি দেখছি। তুই একগাছা দড়ি আন তো।

ড্রাগনের দিকে ইশারা করে কুর্ট। লিন ড্রাগনের দিকে এগোয়। ড্রাগনের সে কাঠের আগুন নিভে গিয়েছিল। লিন এক পাশ থেকে একটি দড়ি খুলে আনে। তার কাছ থেকে দড়ি নিয়ে কুর্ট বলে-

: আমি এ লোকটাকে বাঁধছি। তুই পিস্তলটা নে। কেউ নড়লে সাথে সাথে সাথে তার মাথায় গুলি করবি।

দড়িটা একটু চিকন হলেও বড় ছিল। আগে জ্যাকের হাত পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেলে। এ সময় তার নাম জানতে চায় কুর্ট। কোনো জবাব মেলে না। লিন পিস্তল দিয়ে মাথায় একটা গুঁতো দিতেই অবশ্য ফল মেলে। অনিচ্ছার সাথে নামটি বলে সে- জ্যাক। পেন্সের দিকে ইঙ্গিত করে কুর্ট-

: ওর নাম কী?

: পেন্স।

কুর্ট বলে-

: বা! এই তো ভালো লোক। পুলিশ আসছে। তোমরা যদি আমাদের সাথে কোনো ঝামেলা না কর আর তথ্য দিয়ে সহায়তা কর, সেটা তোমাদের জন্য ভালো হবে। তাহলে তোমাদের পক্ষে আমরা দু-একটা কথা বলব যাতে অন্যদের চেয়ে শাস্তি কম হয়।

: রাখো তোমার শাস্তি! বলে ওঠে জ্যাক- আমাদের বস গুপ্তধনের গুহা থেকে এখনি ফিরবে। তখন কে বাঁচাবে তোমাদের?

জবাবে জ্যাকের পা ভালো করে বাঁধে কুর্ট। তাকে বসিয়ে দেয় পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে। তারপর তার কাছ থেকে প্রায় পাঁচ হাত দূরে সরিয়ে নেয় পেন্সকে। জ্যাকের বিপরীত দিকে মুখ করে বসায় তাকে যাতে দু’জন কোনো কথা বলতে না পারে। এবার লিনের কাছ থেকে পিস্তল নিয়ে জ্যাকের পাশে দাঁড়ায়। লিন যথারীতি দাঁড়ায় গিয়ে পেন্সের পাশে। বলে-

: আচ্ছা দেখা যাক, কে কাকে বাঁচায়। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে পড়বে।

পেন্স যখন ধীরে পাথরের এ প্রান্তে সরে আসছিল তখন লিনের সাথে কথা বলছিল কুর্ট। হঠাৎই তার সতর্ক চোখের কোণে হাত বাঁধা লোকটির ধীর নড়াচড়া চোখে পড়ে। মুহূর্তেই উঠে দাঁড়ায়। সে সময় পাথরের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া পেন্সের উদ্দেশ্যে জ্যাকের চিৎকার শোনা যায়। আয় লিন- বলেই সে তিন লাফে পৌঁছে যায় পেন্সের কাছে। তারপর পিস্তল তাক করে কাবু করে জ্যাককে।

 

৭.

সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। বন্দী দু’জনের দিকে কড়া নজর রেখেছে কুর্ট আর লিন। অপেক্ষা করছে কখন পুলিশ নিয়ে আসে ন্যান্সি। আচ্ছা, ওরা কি ঠিকমত বাড়ি যেত পেরেছে, দাদুকে ডেকে তুলে তাকে দিয়ে পুলিশকে টেলিফোন করাতে পেরেছে? পুলিশ কি এসেছে? কথা বলেছে ওদের সাথে? ওরা কি পুলিশকে ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে পেরেছে? কুর্টের মাথায় নানা চিন্তা ঘুরতে থাকে। এদিকে মনের ভেতর একট চাপা শঙ্কা কাজ করছে। গুপ্তধনের খোঁজে যাওয়া মাদক চক্রের নেতা ও তার সাথীরা যদি পুলিশ আসার আগেই ফিরে আসে তখন কি হবে? সে ও লিন তাদের অতগুলো লোককে কাবু করতে করতে পারবে না। সে প্রশ্নই আসে না। এখানে বিপুল পরিমাণ হেরোইন ও কোকেন রয়েছে। এই ভয়ঙ্কর মাদক পাচারের কাজ করছে এ লোকগুলো। তারা বহু টাকা আয় করছে এর মাধ্যমে, কিন্তু চরম ক্ষতি করছে মানুষের। বিশেষ করে কিশোর-তরুণরাও এখন মাদকের নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে। আর মূল্য যাই হোক, সব জায়গাতেই মাদক মেলে। এত আইন, এত কড়াকড়ি- তার মধ্যেও মাদক ব্যবসা কিভাবে চলে তা এক বিরাট রহস্য। কুর্ট নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ে। সব না হলেও অনেক খবরই রাখে সে। সে অনুমান করে যে এই নির্জন সমুদ্রসৈকতের গুহাগুলো বেছে নেয়ার কারণ আছে। বিশেষ যোগাযোগের মাধ্যমে এই মাদক চক্র জাহাজের মাধ্যমে এগুলো আনে। এটাই সবচেয়ে নিরাপদ পথ। জাহাজ থেকে কার্টন নামিয়ে বোটে করে এগুলো এখানে এনে স্টক করে। তারপর চাহিদামত সড়ক বা রেলপথে বিভিন্ন জায়গায় পাঠায়। তবে ধারা পড়ার ভয়ে তারা একসাথে বেশি পরিমাণ মাদক কখনো পাঠায় না। কে জানে এরা কতদিন ধরে এ কাজ করছে আর কত তরুণ-কিশোরের জীবন ধ্বংস করে তাদের ও তাদের বাবা-মাদের সকল স্বপ্ন নষ্ট করে দিচ্ছে।

হঠাৎ খড়খড় আওয়াজ কানে আসতেই চমকে ওঠে সে। কি ব্যাপার? পর মুহূর্তেই টর্চের আলোর উদ্ভাস চোখে পড়ে। এ সময় গুহাপথে ওয়াকিটকিতে কথা শোনা যায়। কে যেন জিজ্ঞেস করছে- রজার বলছি। তোমরা কি পৌঁছে গেছ? এদিক থেকে জবাব দেয় কেউ- চার্লি বলছি। আমরা গুহায় পৌঁছে গেছি।

এ সময় ওদের কাছে দৌড়ে আসে ন্যান্সি আর ডেভ। তাদের সাথে তিনজন পুলিশ অফিসার। ন্যান্সি কুর্টকে বলে-

: ঠিক আছিস তো তোরা?

তার জবাবের অপেক্ষা না করে কুর্টকে টেনে নিয়ে যায় ইন্সপেক্টর ন্যাশফিল্ডের দিকে। পরিচয় করিয়ে দেয় তাদের-

: মি. ন্যাশফিল্ড! এই হচ্ছে কুর্ট। আর কুর্ট, ইনি অফিসার ন্যাশফিল্ড।

ন্যাশফিল্ড কুর্টের কাছ থেকে সংক্ষেপে সম্পূর্ণ পরিস্থিতির একটি ধারণা নেন। মাদক চক্রের আটক দু’ সদস্যকে দেখিয়ে দেয় সে। সঙ্গী অফিসাররা দু’জনের বাঁধন খুলে হাতকড়া পরিয়ে দেন। সবাই গিয়ে জড়ো হয়। বড় গুহায়। এর মধ্যে হপকিন্সও পৌঁছে যান। এক নজর দেখেই কুর্টকে চিনে ফেলেন তিনি। কেউ পরিচয় করিয়ে দেয়ার আগেই তার কাছে এগিয়ে যান-

: হ্যালো ব্রেভ বয়! আমি পুলিশের সহকারী কমিশনার জন হপকিন্স। ঠিক আছ তো তুমি?

জবাবে মাথা নাড়ে কুর্ট। হপকিন্স হ্যান্ডশেক করেন তার সাথে। পুলিশ অফিসারের হাতে বেশ জোর আছে, বুঝতে পারে কুর্ট। এ সময় তার চোখ পড়ে হাতকড়া পরানো মাদক চক্রের আরো দু’সদস্যের দিকে। আরে, এ দু’জন না ড্রাগন দেখে পালিয়ে গিয়োছিল! কুর্টকে তাদের দিকে অবাক চোখে চাইতে দেখে হপকিন্স বলেন-

: ওদের আমরা রাস্তার দিকে গুহার প্রবেশপথ থেকে আটক করেছি। এখন এখানে কি অবস্থা বল।

কুর্ট তাকে গোটা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে। ইঙ্গিতে দেয়ালের গায়ে সারি দিয়ে রাখা কোকেন ও হেরোইনের প্যাকেটগুলো দেখায়। কয়েকজন পুলিশ অফিসার ছুটে যান সেদিকে।

এবার আসল সমস্যা। তা হলো, মাদক চক্রের নেতাসহ তার গোটা দলকে আটক করা। কুর্টের কাছ থেকে গুপ্তধনের গুহার দিকে যাওয়ার পথটা জেনে নেন হপকিন্স। দু’জন পুলিশকে গুহাপথে একটু এগিয়ে গিয়ে অবস্থান নেয়ার জন্য বললেন তিনি। এদিকে একটু কাজ সারবেন তিনি। ততক্ষণে মাদক চক্রের লোকজন যদি ফিরে আসে তাহলে সতর্ক করে দেবে তারা।

চার বন্দীকে ঘিরে ধরে পুলিশরা। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে তাদের। কঠিন স্বরে হপকিন্স বলেন-

: পরিস্থিতিটা তোমরা বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই। অতএব কৌশল খাটানোর চেষ্টা করে লাভ হবে না। আপাতত অল্প কিছু প্রশ্নের জবাব দাও।

কিছুক্ষণের মধ্যেই এ মাদক চক্রের সব খোঁজখবর জানা হয়ে গেল। এ মাদক চক্রের নাম ডেল্টা কার্টেল। তাদের নেতার আসল নাম জানে না কেউ, নিরাপত্তার স্বার্থেই নাকি জানানো হয় না। সবাই তাকে রেড অ্যারো বলে জানে। ডাকে বস বলে। এবার কুর্ট জিজ্ঞেস করে-

: আচ্ছা, গুপ্তধনের ব্যাপারটা কী?

চারজনের মধ্যে একজন মাত্র ব্যাপারটা বলতে পারল। সে যা শুনেছে সে গল্পটি এই যে, আঠারো শতকের মাঝামাঝি জলদস্যুদের একটি দল বিভিন্ন জাহাজ থেকে লুণ্ঠন করা ধনরত্ন নিয়ে ঘটনাচক্রে এ সৈকতের কাছে এসে পৌঁছে। তখন এদিকে লোক বসতি ছিল না। জলদস্যু নেতা ধনরত্নগুলো এখানকার গুহার ভেতরে আপাতত লুকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা এ গুহাটি নির্বাচন করে। কারণ, এ গুহাটি ছিল বিরাট। আর এর ভেতরে ছিল আরে কিছু গুহা যা সাধারণত দেখা যায় না। একটি ছোট গুহা বেছে নেয় তারা। তার মেঝে খুঁড়ে ধনরত্নগুলো একটি বড় আবলুস কাঠের বাক্সে ভরে মাটি চাপা দেয়া হয়। আবলুস কাঠ সহজে পচে না। মোট পাঁচজন জলদস্যু এ বিষয়টি জানত। সাথীদের নিয়ে জলদস্যু ক্যাপ্টেনের এক বছর পর এখানে ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু তা আর হয়নি। কিছুদিন পর ইংল্যান্ডের এক যুদ্ধ জাহাজের সাথে যুদ্ধে জলদস্যু নেতাসহ অনেকে নিহত হয়। বাকিরা আটক হয়ে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কারাগারে কাটায়। তাদের মধ্যে সেই পাঁচজনের একজনও ছিল। গুরুতর অসুস্থতার কারণে মৃত্যুর কিছুদিন আগে সে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে শেষদিনগুলো কাটায়। ধারণা করা হয় যে সেই গুপ্তধনের গুহার একটি নকশা এঁকেছিল। তারপরই কিছু লোক গুপ্তধনের কথা জানতে পারে। কিন্তু কেউ তা খুঁজে পেয়েছে কিনা তা কেউ জানে না। আদৌ গুপ্তধন এখানে আছে কিনা তাও কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না। এই মাদক চক্রের নেতা কিভাবে যেন এ গুপ্তধনের কথা জানতে পারে। তার কাছে নাকি গুপ্তধন যে গুহায় রাখা তার একটি হাতে আঁকা পুরনো নকশা আছে। তা নিয়ে এর আগে সে গুপ্তধনের সম্ভাব্য গুহাটি চিহ্নিত করেছে। আজ তা উদ্ধার করতে গেছে।

একটু পরই হপকিন্স তার পুলিশ দল নিয়ে কথিত গুপ্তধনের গুহার দিকে অগ্রসর হলেন। তাদের সবার হাতে শক্তিশালী টর্চ ও পিস্তল। মাদক চক্রের আটক চার সদস্যকে সামনে রাখা হলো। কুর্টদের চারজনকেও সাথে নিলেন তিনি। বলা যায় না, গোলাগুলি হতে পারে। তাই ওদেরকে রাখলেন দলের মাঝামাঝি। কারণ, তাদের অন্তত চারজনের কাছে পিস্তল আছে বলে আটক লোকগুলো জানিয়েছে। ইতোমধ্যে জেনে নিয়েছেন যে গুপ্তধনের কথিত গুহায় যাবার একটিই পথ। সে গুহা থেকে অন্যদিকে যাবার উপায় নেই। দস্যুদের যেহেতু পালানোর পথ নেই তাই তাদের আটক করতে খুব একটা সমস্যা হবে না বলেই মনে হলো তার। টর্চের আলো জ্বেলে এগোতে শুরু করলেন তারা।

দেখানো পথে কিছুটা পথ এগোতেই কয়েকজন লোককে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। দু’তিনজনের হাতে মশাল। মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিলেন হপকিন্স। আটক চারজনসহ পুলিশদের নিয়ে নিঃশব্দে অন্ধকারের মধ্যে একটু পিছিয়ে যান। এখানে জায়গাটি খানিকটা প্রশস্ত। চাপা গলায় খুব দ্রুত কিছু নির্দেশ দিলেন তিনি। পুলিশরা সবাই চোখের পলকে অর্ধচন্দ্রাকারে দাঁড়িয়ে অবস্থান নিলেন। মাঝখানে সামনে রাখা হলো চার বন্দীকে। ততক্ষণে কথা বলতে বলতে একেবারে কাছে এগিয়ে আসে মাদক চক্রের সদস্যরা। হপকিন্সের চাপা গলার নির্দেশের, সাথে সাথে পুলিশদের তেরোটি টর্চলাইট এক সাথে জ্বলে ওঠে। এতগুলো শক্তিশালী টর্চের আলোয় চারদিক দিনের আলোর মত আলো হয়ে ওঠে। হতভম্ব হয়ে পড়ে ডেল্টার সদস্যরা। গর্জে ওঠেন হপকিন্স-

: হ্যান্ডস আপ!

বিনা বাক্যব্যয়ে হাত ওপরে তোলে সবাই। সবাইকে ঘিরে ফেলেন অফিসাররা। মাদক চক্রের চারজনের হাতে পিস্তল ছিল। তাদের হাত থেকে নিয়ে নেয়া হয় সেগুলো।

রেড অ্যারোকে জিজ্ঞেস করেন হপকিন্স-

: তা মি. বস, গুপ্তধন কোথায়? খুঁজে পেয়েছ কি?

জবাব দেয় না সে। সবাইকে সার্চ করার নির্দেশ দেন হপকিন্স।

ডেল্টার দুই সদস্যের কাছে দু’টি ছুরি পাওয়া যায়। দু’জনের কোমরে গোঁজা ছিল। কিন্তু তথাকথিত গুপ্তধনের সন্ধান মেলে না। হপকিন্স বুঝতে পারেন, কোথাও কোনো গোলমাল হয়েছে। কৌতূহল বাড়ে তার। কিন্তু এরা কেউ কথা বলছে না। একটা কৌশল নেন তিনি। সবাইকে নিয়ে চলে আসেন বড় গুহাটায়। তারপর মাদক চক্রের এক সদস্যকে ঝট করে আলাদা করে ফেলেন। দু’জন অফিসারকে বলেন- সাইজ করুন ওকে।

নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে দু’জন অফিসার এগিয়ে গিয়ে জাপটে ধরেন তাকে। টেনে নিয়ে যেতে থাকেন এক কোণে। পুলিশের সাইজ করার মানে কী, সে ব্যাপারে লোকটির ধারণা আছে বোঝা গেল। ভীত গলায় বলে ওঠে সে-

: আমাকে ছেড়ে দিন। সব বলছি।

তাকে হপকিন্সের কাছে হাজির করেন অফিসাররা।

লোকটির কাছ থেকে জানা গেল, বসের নির্দেশে গুহা খোঁড়াখুঁড়ি করেছে তারা অনেকক্ষণ ধরে, কিন্তু কিছুই মেলেনি। মনে হয়, বসকে ভুয়া তথ্য দিয়ে ঠকিয়েছে কেউ। গুপ্তধন না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসছিল তারা। এত পরিশ্রম করেও কিছু না পাওয়ায় সবার মন-মেজাজ খারাপ। তাই সতর্কতা তেমন ছিল না তাদের। সে জন্যই ধরা পড়ে গেছে। নইলে তারা ধরা পড়ত না।

হপকিন্স বলেন-

: ধরা যখন পড়েছ তখন কপালে দুঃখ আছে। সারাজীবন আর জেল থেকে বেরোতে হবে না।

কয়েকজন অফিসার হেরোইন-কোকেনের স্তূপীকৃত প্যাকেটগুলো খুলে অকুস্থলে একটি সিজার লিস্ট তৈরি করেন। এতে কিছুটা সময় লাগে। ইতোমধ্যে ওয়াকিটকিতে পুলিশ কমিশনারকে ঘটনার একটা তাৎক্ষণিক রিপোর্ট দিয়েছেন হপকিন্স। বিশেষ করে কুর্ট ও তার খুদে বাহিনীর জন্যই যে মাদক চক্রকে ধরা সম্ভব হয়েছে সে কথা জানিয়েছেন। শুনে কমিশনার অবাক হয়ে বলেছেন, তাই নাকি?

সিজার লিস্ট তৈরি হয়ে গেছে। সব হেরোইন- কোকেনসহ কড়া পাহারায় মাদক চক্রের সদস্যদের নিয়ে রাস্তার দিকটায় বেরিয়ে আসেন হপকিন্স। এদিকে আরো কিছু পুলিশ এসে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ এসকর্টসহ একটি গাড়ি এসে থামে। হপকিন্স অবাক হয়ে দেখলেন, পুলিশ কমিশনারের গাড়ি। নেমে এলেন পুলিশ কমিশনার জিম হারবার্ট। বুঝতে পারলেন, মাদক চক্রকে আটক করার খবর পেয়েই কমিশনার এসেছেন। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, কিন্তু এত গুরুত্বপূর্ণ নয় যে স্বয়ং পুলিশ কমিশনারকে আসতে হবে। ততক্ষণে কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। জন হপকিন্সকে আগে থেকেই চেনেন। বললেন-

: কংগ্র্যাট হপকিন্স। আপনি ও আপনার অফিসাররা খুব ভালো কাজ করেছেন। কিন্তু আমি যে জন্য এলাম, তারা কই?

মুহূর্তে হপকিন্সের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় ব্যাপারটা। তার ডাকে কুর্টরা সবাই এগিয়ে আসে কাছে। কিছুক্ষণ আগেই সে ও ন্যান্সি তাদের কাছে থাকা পিস্তল দু’টি তুলে দিয়েছে হপকিন্সের কাছে। তিনি ওদের দিকে তাকিয়ে বলেন-

: এই যে স্যার! এ হচ্ছে কুর্ট, সাথে তার বাহিনীর সদস্যরা- ন্যান্সি, লিন ও ডেভ। জানেন স্যার! ওরা চারজন আপন ভাইবোন।

: তাই নাকি! অবাক হন হারবার্ট। তারপর হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দেন কুর্টের দিকে। বলেন-

: সাহসী ছেলে তুমি!

তারপর হ্যান্ডশেক করেন ন্যান্সি, লিন ও ডেভের সাথে। ডেভের দিকে চেয়ে বিস্ময়ের সাথে বলেন-

: ভয় পাওনি তুমি ইয়ং বয়!

ঝটপট উত্তর দেয় ডেভ-

: একটুও না।

৮.

সব বন্দী, আটক করা হেরোইন ও কোকেনের প্যাকেটগুলো নিয়ে পুলিশ অফিসাররা চলে গেলেন। রয়ে গেলেন কমিশনার জিম হারবার্ট, সহকারী কমিশনার জন হপকিন্স, ইন্সপেক্টর ন্যাশফিল্ড ও অন্য তিন-চারজন অফিসার। হারবার্ট বললেন-

: এবার এ সাহসী ছেলে-মেয়েগুলোকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হয়, কী বলেন মি. হপকিন্স!

: হ্যাঁ স্যার। আমি ওদের নিয়ে যাচ্ছি। বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।

: চলুন, আমিও যাই।

খুদে-বাহিনীর-অভিযান-২খুদে বাহিনী বা গ্রুপ ফোরের সদস্যরা হপকিন্সের গাড়িতে ওঠে। সেখান থেকে তাদের দাদুর বাড়ির দূরত্ব এক কিলোমিটারেরও কম। তাই অল্পসময়ের মধ্যেই পৌঁছে যায় তারা।

গাড়ি থেকেই দাদু বাড়ির সামনে বেশ কিছু লোক চোখে পড়ে কুর্টের। এত রাতে এত লোক! সবার আগে লাফ দিয়ে নামে কুর্ট। গেটের কাছে যেতেই দাদুকে দেখতে পায় সে। উদ্বিগ্ন চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন তিনি। কুর্ট তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে ন্যান্সি, লিন ও ডেভও এসে পৌঁছে। তাদের জড়িয়ে ধরেন দাদু। কুর্ট দেখে, তার গাম্ভীর্য সরে গেছে। মুখে হাসি। বলেন-

: কী কা- ঘটিয়েছ তোমরা দেখেছ? আমাদের ঘুমাতে দাওনি। প্রতিবেশীরা অনেকেই খবর জেনে চলে এসেছেন।

হাজির হন হারবার্ট ও হপকিন্স। হপকিন্স কুর্টের দাদুকে দেখিয়ে হারবার্টকে বলেন-

: স্যার! ইনি জেফ সাদারল্যান্ড। এখানকার বিশিষ্ট ব্যক্তি। এদের দাদু।

হারবার্ট করমর্দন করেন তার সাথে। বলেন-

: এ সাহসী ছেলে-মেয়েগুলো চমৎকার কাজ করেছে। পুলিশ বিভাগ ওদেরকে একটা রিসেপশন দেবে। আমরা কাল যোগাযোগ করব ওদের সাথে। ভালো থাকুন। আমরা আসছি এখন।

হপকিন্সও বিদায় নেন তার কাছ থেকে। চলে যান তারা সবাই। প্রতিবেশীরাও পা বাড়ান নিজ নিজ বাড়ির দিকে ।

: খুদে বাহিনী, চল ঘরে যাই আমরাও।

ওদের দিকে চেয়ে বললেন দাদু।  [সমাপ্ত]

 

* অ্যালান ফিনচ ১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্যের ব্রাইটনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য অনেক ছোটগল্প-উপন্যাস লিখেছেন। ‘খুদে বাহিনীর গুহা অভিযান’ নামের কিশোর উপন্যাসটি তার ‘ট্রেজার ইন দ্য কেভ’ নামক ছোট উপন্যাসের রূপান্তরিত রূপ। লেখাটি ইন্টারনেট থেকে নেয়া।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ