কিশোরকণ্ঠ ও আমি

কিশোরকণ্ঠ ও আমি

স্মৃতিকথা মাসুম খলিলী জুন ২০২৩

এখন যে ‘নতুন কিশোরকণ্ঠ’, সবচেয়ে বেশি প্রচারিত কিশোর মাসিক, তা প্রথম বের হয়েছিল ‘কিশোরকণ্ঠ’ হিসেবে। তখনো পত্রিকাটির আনুষ্ঠানিক ডিক্লারেশন নেওয়া হয়নি। সাময়িক পত্রিকা হিসেবে শুরু হয় এটি। উদ্দেশ্য ছিল কিশোর মনের যে ভাবনা, সেটাকে তাদের সৃষ্টির যে মূল উদ্দেশ্য উপলব্ধি করিয়ে সামনে এগিয়ে নেওয়া। ছড়া কবিতা গল্প শিক্ষামূলক নানা লেখার পাশাপাশি জীবনবোধ তৈরির নানা রচনা নিয়ে এটি আত্মপ্রকাশ করে ১৯৮৪ সালে। এরপর থেকে কোনো মাসে এর প্রকাশনা থেমে যায়নি।

আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে তখন ঢাকায় আসি। বলা যায় সুহৃদ ওবায়েদ ভাই আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। কর্মজীবন নিয়ে আমার প্রথম ভাবনা ছিল আব্বার মতো শিক্ষক হওয়া। আবার অগ্রজ দুই ভাইয়ের ছাত্রজীবনে সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত থাকার বিষয়টিও নানা সময় উদ্দীপ্ত করতো সংবাদকর্মী হওয়ার জন্য। ছাত্রজীবনের শেষ পর্যায়ে কর্মজীবন সম্পর্কে নতুন করে ভাবনা তৈরি হয় আমার। অগ্রজদের দেখাদেখি দুয়েকবার সংবাদপত্রে ছোটোখাটো লেখার প্রতি আগ্রহও সৃষ্টি হয়। তখন অবজারভার গ্রুপের একটি বিখ্যাত কিশোর পত্রিকা ছিল ‘কিশোর বাংলা’। রফিকুল হক দাদুভাই সম্ভবত পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন। এই পত্রিকায় দেশের সব কিশোরই সংবাদ পাঠাতে পারতো তাদের নানা ধরনের সৃজনশীল সাহিত্য সংস্কৃতি কর্মকাণ্ডের। সংবাদদাতার নামে সেটি প্রকাশ হতো। সাতকানিয়া থেকে পাঠানো এ ধরনের সংবাদ সম্ভবত ছিল আমার ছাপা হওয়া প্রথম সংবাদ। এটি সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার প্রতি আমার আগ্রহকে কিছুটা উসকে দেয়।

সত্তরের দশকের প্রথম ভাগে বড়ো ভাইদের সুবাদে পাওয়া পত্রিকা গণকণ্ঠ, বাংলার মুখ আর আমার আগ্রহে সংগৃহীত দৈনিক আজাদ পত্রিকা নিয়মিত পড়তাম। এর পাশাপাশি ঢাকা ডাইজেস্টের ছিলাম একনিষ্ঠ পাঠক। স্কুল ও কলেজ জীবনের এই কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা এক সময় বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ও প্রকাশনার সাথে আমাকে জড়িত করে।

এই সামান্য অভিজ্ঞতাই হয়তোবা আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসনের তুখোড় ছাত্র আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ আমাকে ঢাকামুখী করতে উদ্বুদ্ধ করেন। ওবায়েদ ভাইকে নিয়ে বাংলাদেশে লোকপ্রশাসনের অ্যাকাডেমিক চর্চার অন্যতম স্থপতি প্রফেসর মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান স্যারের অনেক স্বপ্ন ছিল। তিনি চাইতেন ওবায়েদ ভাই অ্যাকাডেমিক বিষয়ে মনোযোগী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন। কিন্তু এর মধ্যে তাকে অ্যাকাডেমিক অঙ্গন ছেড়ে চলে যেতে হয় ঢাকায়। চট্টগ্রামের কিশোর সংগঠন ঝিঙ্গেফুলের আসরের অন্যতম সংগঠক ছিলেন ওবায়েদ ভাই। জাতীয় পর্যায়ে একই ধরনের দায়িত্ব পালনের জন্য তার প্রতি আমন্ত্রণ আসে ঢাকায় যাবার। তিনি ঢাকায় গিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সফলতার সাথে একটি শিশু সংগঠনের প্রধান সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। আনিস স্যারের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়।

তখন কিশোরদের পত্রিকা প্রকাশনার সাথে যুক্ত হতে ওবায়েদ ভাই ঢাকায় নিয়ে আসেন আমাকে। কলাবাগানের একটি ম্যাচে থাকতাম আমরা। সাইফুল আলম খান মিলন ভাইয়ের ভাবনায় আসে কিশোরদের জন্য একটি পত্রিকা বের করতে হবে। তখন মাসুদ আলী ভাই সম্ভবত ছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক (প্রকাশনা)। সব সৃজনশীল প্রকাশনা ও কর্মকাণ্ডে তিনি ছিলেন উদ্দীপকের মতো। আরেক প্রাণবন্ত সবুজ মনের মানুষ ছিলেন মতিউর রহমান মল্লিক ভাই। জীবনধর্মী সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা আর একটি কল্যাণময় সমাজের স্বপ্ন ছিল তার জীবনজুড়ে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের একান্ত পৃষ্ঠপোষক মিলন ভাই ও তাসনিম ভাই পরিকল্পনার সাথে এই ভাবনা মিলে ‘কিশোরকণ্ঠ’ নামে প্রতি মাসে একটি কিশোর পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। দেশের শীর্ষ কবি আল মাহমুদ ছিলেন ফুলকুঁড়ি আসরের অন্যতম উপদেষ্টা। ওবায়েদ ভাইয়ের সাথে ছিল তাঁর পারিবারিক সম্পর্ক। তিনি তখন শিল্পকলা একাডেমির উপপরিচালক। তার সুপরিসর কক্ষটি ছিল আমাদের পরামর্শ ও আড্ডার একটি কেন্দ্র। বুলবুল সরওয়ার ছিলেন তখন ঢাকা মেডিক্যালের সম্ভবত দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ফজলে রাব্বি হলের দোতলার একটি রুমে থাকতেন। মেডিক্যালের ব্যস্ত পড়াশুনার ফাঁকে সময় করে আমরা হাজির হতাম কবি আল মাহমুদের কাছে শিল্পকলা একাডেমিতে। নানা বিষয়ে কথার ফাঁকে তার সাথে কিশোরকণ্ঠ প্রকাশনার বিষয়ে পরামর্র্শ করি আমরা। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে একটি কিশোর পত্রিকা বের করতেন মাসুদ আলী ভাই। এর সাথে কাজ করতেন আমাদের কাছে সেজান সরকার হিসেবে পরিচিত শিল্পী আবদুর রোউফ সরকার। কাঁচা সুপারিসমেত মিষ্টি জর্দা মেশানো পান সব সময় তার মুখে থাকতো। কাছে গেলে পেতাম তার মিষ্টি সুবাস। মাসুদ আলী ভাই আমাদেরকে তার কাছেও নিয়ে যান। পত্রিকা শিল্প সৌকর্য নিয়ে তিনি নানা পরামর্শ দেন। 

এর মধ্যে এক সময় কিশোরকণ্ঠ প্রকাশের দিন তারিখ ঠিক হয়। ওবায়েদ ভাইয়ের সাথে কাজে নেমে পড়ি আমি আর বুলবুল সরওয়ার। শিল্পী হামিদ ভাই থাকতেন তখন হাতিরপুল বাজারের কাছাকাছি এক বাসায়। দৈনিক আজাদের পরে তিনি কাজ করতেন দৈনিক খবর ও সংগ্রামে। ওনার বাসা ছিল আমাদের কাজ ও পরামর্শের একটি জায়গা। হামিদ ভাইয়ের বড়ো ছেলে রবিন তখনো শিশু, বাকিরা দুনিয়ায় আসেনি। ভাবীর পরিবেশন করা চা বিস্কুটের সাথে চলতো আমাদের কাজ ও আড্ডা। এভাবে কিশোরকণ্ঠের কাজ এগিয়ে চলে।

এ সময়টাতে ঢাকায় ফটোকম্পোজের ব্যবস্থা ছিল হাতেগোনা দুটি জায়গায়। এর মধ্যে একটি ছিল মগবাজারের আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেসে। এই প্রেসে ম্যানেজার হিসেবে বিভিন্ন বিভাগে কাজ করতেন কবির ভাই, মশিউর ভাই ও সালাম ভাই। আমাদের কাজের জন্য তারা ছিলেন উদারহস্ত। যেখানে যে ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন পেতে দেরি হতো না। হামিদ ভাইয়ের চমৎকার প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণে প্রথম সংখ্যা কিশোরকণ্ঠের পেস্টিংয়ের কাজ শেষ হয়। কুরআন হাদিসের শিক্ষামূলক গল্প, জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা ফিচার আর কিশোর ছাত্রদের বিভিন্ন তৎপরতা ও অনুষ্ঠানের খবর নিয়ে বের হয় প্রথম সংখ্যা কিশোরকণ্ঠ। আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেসের রোটারি মেশিনে ছাপা হয় এর ভেতরের অংশ। এর কাভার চার রঙের হলেও ভেতরটা ছাপা হয় সাদা কালোতে। প্রথম সংখ্যাটি ছাপা হয় ২০ হাজার। তখন বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টারের মাসিক কলম পত্রিকায় কাজ করতেন মল্লিক ভাই এবং মাসিক পৃথিবীর সাথে যুক্ত ছিলেন আসাদ বিন হাফিজ। দু’জনই শিশুসাহিত্যে এরই মধ্যে খ্যাতিমান হয়ে উঠেছেন। কিশোরকণ্ঠ নিয়ে ভাবনা চিন্তার সাথে জড়িয়ে ছিলেন তারাও। তবে এর প্রতিটি কর্মকাণ্ডের সাথে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন বুলবুল সরওয়ার, সেদিনের তরুণ মেডিক্যাল ছাত্র যিনি পরে কবি লেখক ও কথা সাহিত্যিক হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। বেশ ক’টি খ্যাতনামা মেডিক্যালে অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর প্রায় অর্ধশত বইয়ের এই রচয়িতা এখন নির্বাক। যেদিন সুলতান সালাউদ্দিনের ওপর একটি মহা উপন্যাস লেখা শুরু করার কথা ছিল সেদিনই অফিসে স্ট্রোকে আক্রান্ত হন তিনি। এখন অনেকটাই নিশ্চল ও নির্বাক।

কিশোরকণ্ঠের প্রথম দিকের প্রতিটা সংখ্যায় ওবায়েদ ভাইয়ের পরিশ্রম, মাসুদ ভাইয়ের পরামর্শ, হামিদ ভাইয়ের কাজ আর বুলবুলের কলমের ছোঁয়া রয়েছে। আমাদের সবার ওপর অগাধ আস্থা রাখতেন মিলন ভাই এবং তাসনিম ভাই। প্রায় চার দশকের বয়সী কিশোরকণ্ঠ এখন অনেক পরিণত। মোশাররফ হোসেন খানের মতো এক পরিপক্ব কবি ও সাহিত্যসেবীর সম্পাদনায় এর প্রতিটি সংখ্যা অসাধারণ হয়ে প্রকাশ হচ্ছে। নানা বাধা বিপত্তির মাঝেও আনুষ্ঠানিক ডিক্লারেশনের মাধ্যমে ‘নতুন কিশোরকণ্ঠ’ এখন একটি সাড়া জাগানো পত্রিকা। এর প্রতিটা সংখ্যার লক্ষ কপি সারা দেশে হাজারো কিশোরকে পরিণত লেখক ও আদর্শ মানুষ হওয়ার জন্য প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। এমন একটি সমাজের স্বপ্ন বুকে নিয়ে শিশু-কিশোররা বড়ো হচ্ছে যা একদিন নিশ্চয়ই শান্তিময় সবুজ দেশে পরিণত করবে এই ভূখণ্ডকে।

আজ যারা জীবনে মধ্য গগনে তাদের অনেকের জীবনের মোড় পরিবর্তনে নিয়ামক হয়ে ছিল কিশোরকণ্ঠ।

প্রথম দিকে কিশোরকণ্ঠের প্রায় প্রতিটি সংখ্যায় কবি আল মাহমুদের লেখা থাকতো। মল্লিক ভাইয়ের লেখা উদ্দীপনা জোগাতো কিশোরদের। গোলাম মোহাম্মদের মতো কিছু লেখক এখন আর নেই। কিশোর মনে স্বপ্ন জাগাতে যে বীজ সেদিন কিশোরকণ্ঠের মাধ্যমে রোপিত হয়েছিল তা এখন অনেক সুশোভিত হয়েছে। এটি এই জনপদের মানুষকে নিশ্চয়ই পরম করুণাময়ই একদিন এর ফলপ্রাচুর্যে ভরিয়ে দেবেন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ