কিশোরকণ্ঠ ও আমি

কিশোরকণ্ঠ ও আমি

স্মৃতিকথা ড. আ. জ. ম ওবায়েদুল্লাহ জুন ২০২৩

কিশোরকণ্ঠ-এর চিন্তার যুগ থেকে তার অব্যাহত পথচলায় আমি তার ছায়াসঙ্গী। এ কথা ভাবতেই আল্লাহর শুকরিয়ায় মাথা নত হয়ে আসে। হৃদয় মনে আনন্দের শিহরণ দোল খেয়ে যায়। পরম মমতায় পত্রিকার কপি হাতে নিয়ে উচ্চারণ করতে ইচ্ছে হয়- প্রিয় ‘কিশোরকণ্ঠ’ আমি তোমায় ভালোবাসি। এ ভালোবাসা লৌকিকতা ও আবিলতামুক্ত এক সীমাহীন হার্দিক ভালোবাসা।


আমাদের শৈশব ও কৈশোর

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ সময় ১৯৭১ সালে আমি অন্য অনেকের মতো স্কুলগামী নওল কিশোর। দশ বছরের দুরন্ত শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছি। বাবার হাত ধরে চট্টগ্রাম শহরের বইপুস্তক আর পত্রিকার পাড়ায় হাঁটতে শিখেছি। চট্টগ্রামে নিউ মার্কেটের উজালা বুক সেন্টার, নিউজফ্রন্ট, বইঘর এসব দোকানপাট চিনছি। পরিচিত হচ্ছি কিশোরদের জন্য প্রকাশিত বই আর পত্রিকাসমূহের সাথে। এখলাস উদ্দিনের কাটুস কুটুস খুব ভালো লাগছে। ভালো লাগছে কচিকাঁচা, খেলাঘর, ধান শালিকের দেশ, শিশু, কিশোর বাংলা ইত্যাদি।

আমরা যখন এসএসসি পাস করে কলেজে পড়ছি তখন বাংলাদেশে বইমেলার সূচনা যুগ। মুক্তধারা তখন একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আয়োজন করে ছোট্ট আকারের বইমেলা। ছোটোদের জন্য তখন বই করতো বইঘর, আহমেদ পাবলিশিং হাউস, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি এবং এর সাথে যুক্ত হয় ইসলামিক ফাউন্ডেশন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে এসবের সাথে পরিচিতি, সম্পৃক্তি ও ভালো লাগা বাড়তে থাকে। 

কিশোর বাংলা জনপ্রিয় পাক্ষিক পত্রিকা ছিল ট্যাবলয়েড সাইজের। তখনকার জন্য খুব সুন্দর রঙিন পত্রিকা ছিল এটি। সার্কুলেশনও ছিল অনেক।

আমাদের মতো পত্রিকাপ্রেমী ও একটু আধটু লেখালেখি যারা করতো তাদের তখন নিয়মিত কিশোর বাংলা, কচিকাঁচা, খেলাঘর, শাহীন শিবির, ধান শালিকের দেশ, শিশু, নবারুণ, ফুলকুঁড়ি ইত্যাদি পত্রিকা পড়ার সময়। এ সময় ইসলামিক ফাউন্ডেশনও চারটি পত্রিকা বের করতো- সবুজপাতা, সাম্পান, সপ্তডিঙা ও ময়ূরপঙ্খী নামে।


কিশোরকণ্ঠের উন্মেষ

১৯৮২ সালের শেষদিকে আমি দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হই। তখনও পুরোদমে ছাত্র আমি। ঢাকা-চট্টগ্রাম নিয়মিত আসা যাওয়া করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। ব্যস্ত নগরীর ততোধিক ব্যস্ত নামীদামি জ্ঞানী-গুণী মানুষদের সাথে ধীরে ধীরে পরিচিত হচ্ছি। স্নেহ, আদর, বাৎসল্য ও ভালোবাসার এক চমৎকার বন্ধনে কত কত মানুষের সাথে মিলে মিশে পথ চলছি। 

আগে থেকেই লেখালিখি ও ছাপাখানার সাথে পরিচয়সূত্রে আমাদের একটি টিম গড়ে ওঠে। আশির দশকের অন্যতম সব্যসাচী লেখক কবি বুলবুল সরওয়ার, আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী মাসুমুর রহমান খলিলী এদের অন্যতম। ঢাকায় এসে কয়েক বছর আমি শিশু-কিশোর সংগঠনের সাথে ভীষণভাবে জড়িত ছিলাম। অন্যান্য কাজের পাশাপাশি নিজের একটি ভালো কিশোর গ্রন্থরাজি ও পত্রপত্রিকার ভালো সংগ্রহশালা গড়ে তুলি। এ সময় আমাদের অন্যতম মেন্টর সাইফুল আলম খান মিলন ভাই ঈদের পর বাড়ি থেকে এসে বললেন ওবায়েদ, যেসব শিশু-কিশোর পত্রিকা আছে এসবে শিশু-কিশোরদের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ হয় না। শিশু-কিশোরদের উপযোগী একটা ভালো পত্রিকা করা যায় না?

গ্রামে একটা প্রবাদ আছে- ‘একেতো নাচুনে বুড়ি, তার ওপর ঢাকের বাড়ি।’ এমন একটা বিষয় পেয়ে আমাদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্যভাব শুরু হলো। উনাকে বললাম ধারণাটা সবাইকে বেশ উদ্বুদ্ধ করেছে। আমরা এখন একটা খসড়া করে আপনার কাছে সহসা প্রস্তাবনা পেশ করবো।

মাসুম খলিলী, বুলবুল সরওয়ারসহ আমাদের একটা ছোটো টিম রাতদিন খাটাখাটি, ঘাঁটাঘাঁটি আর লেখক কবি সাহিত্যিক ও সংশ্লিষ্ট লোকজনকে নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে লাগলাম। কিছুটা প্রথম সন্তান জন্মের আয়োজনের মতো।

কী হবে পত্রিকার নাম? কেমন হবে এর প্রচ্ছদ? কত ফর্মার পত্রিকা? সাইজটাই বা কী হবে?

কেমন হবে ভেতরের ইলাস্ট্রেশন? লেখক-লেখিকা হবেন কারা? প্রতি মাসের কত তারিখে পত্রিকা বের হবে? অফিস কোথায় হবে? এমন হাজার একটা বিষয় তখন সারাক্ষণ মাথায় কিলবিল করছে।

পত্রিকা করতে গেলেই সম্পাদক কে হবেন? সম্পাদনা পরিষদে কারা থাকবেন? প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে কার নাম যাবে? অলঙ্করণ কে করবেন? প্রকাশকই বা কে? এসব অতি আবশ্যক বিষয় আশয়। এর বাইরে আছে একদম নিবেদিতপ্রাণ নেপথ্য কর্মীর কথা। যারা নীরবে পত্রিকার সমস্ত আয়োজন করে, মুদ্রিত পত্রিকা পাঠক লেখকের কাছে পৌঁছে দেয়, পত্রিকার আর্থিক জোগানের জন্য বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে।


অতীত পেছনে টানে

মোটামুটি সবুজসঙ্কেত পেয়ে আমি, খলিলী আর বুলবুল ছুটে গেলাম বিআইসিতে। আমাদের সাংস্কৃতিক বাতিঘর মরহুম মতিউর রহমান মল্লিক ভাই তখন বিআইসি থেকে প্রকাশিত মাসিক কলমে কর্মরত। উনার কাছে গিয়েই আগে সুখবরটি জানালাম- নতুন কিশোর পত্রিকা বের করতে হবে। চা, শিঙাড়া পর্বের সাথে নাম নিয়ে কথা শুরু হলো। মল্লিক ভাই উত্তেজনার সাথে বললেন- নাম পাওয়া গেছে!

‘কিশোরকণ্ঠ’ নামটা কেমন হয়? সবাই একবাক্যে সমর্থন করলেন নামটা। এবং এভাবেই আমাদের অনাগত শিশুর নাম হয়ে গেল কিশোরকণ্ঠ। 

পত্রিকার নাম ঠিক হয়ে গেল। পত্রিকা সংশ্লিষ্ট সকলে নামের ব্যাপারে একমত হলেন। পত্রিকার সম্পাদকের নাম ঠিক হয়ে গেল। কিশোরকণ্ঠ ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারিই থাকবেন পত্রিকার সম্পাদক। আর নির্বাহী সম্পাদক থাকবেন ফাউন্ডেশন কর্তৃক নির্ধারিত ব্যক্তি।

এবার আসলো প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ প্রসঙ্গ। দেশের অন্যতম সেরা প্রচ্ছদশিল্পী, পত্রিকার অলঙ্করণের প্রিয় নাম, বাংলা ফন্টের অন্যতম আবিষ্কারক হামিদুল ইসলাম ভাইয়ের কাছে ছুটলাম আমরা। বললাম- নতুন পত্রিকা বের হবে ‘কিশোরকণ্ঠ’। এর জন্য খাসা একটা প্রচ্ছদ চাই। ইলাস্ট্রেশনও করতে হবে আপনাকে।

হামিদ ভাই করিতকর্মা মানুষ। ভেবে দেখবেন বললেন। আমরাও চলে গেলাম। আমাদের অবাক করে দিয়ে পরদিন ফ্রি হ্যান্ডে একটা লোগো বানালেন হামিদ ভাই। সেই যে হামিদ ভাই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হলেন, আজও তিনি আছেন এর সাথে। ২০২২ সালে যে চারজন গুণী ব্যক্তি কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার পান, হামিদ ভাই তাদের একজন। তাকে সম্মানিত করে কিশোরকণ্ঠ পরিবার নিজেদেরকেই সম্মানিত করলেন।

১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কিশোরকণ্ঠ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। যদি প্রথম প্রকাশনার সাল থেকে গণনা করা হয় তাহলে হাঁটিহাঁটি পা পা করতে করতে চল্লিশতম বর্ষে পদার্পণ করতে যাচ্ছে কিশোরকণ্ঠ। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন। কিন্তু সেদিনের কিশোরকণ্ঠের সকল কর্মীবাহিনী এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছেন। আমরা সবাই মনে তরুণ রয়ে গেলেও বার্ধক্যের দিকে ছুটে চলেছি। 

পত্রিকার একজন নেপথ্য কর্মী হিসেবে, একজন সম্পাদক হিসেবে, এর জন্ম থেকে আজ অবধি কোনো না কোনোভাবে এর সাথে সম্পৃক্ত আছি।

তারই সূত্র ধরে এবং কিশোরকণ্ঠ ছাড়াও বেশ কিছু পত্রিকায় সম্পাদনার সাথে জড়িত থাকার সুবাদে আজ আনন্দের সাথে বলতে চাই- সৃষ্টির আনন্দের চাইতে বড়ো কোনো আনন্দ আর নেই। কিশোরকণ্ঠের প্রথম সংখ্যায় কী কী বিভাগ থাকবে এটি ঠিক করতে গিয়ে আমরা অনেক নতুন লেখক আবিষ্কার করেছি। এক একটা নতুন বিভাগ মানেই কিন্তু নতুন সৃষ্টি আর যিনি ওখানে নিয়মিত লেখেন তিনি হয়ে যান নিয়মিত লেখক। 


আমার আমাকে বলি

কিশোরকণ্ঠ পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার প্রায় চল্লিশ বছর পূর্ণ হতে চলেছে আমার। এটি যেমন তেমন সৌভাগ্য নয়। হে আমার রব, এই সংশ্লিষ্টতার সুবাদে আপনি আমার অতীতের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দিন। এদেশের পথহারা তরুণদের যারাই এই পত্রিকার সান্নিধ্যে এসে পথের দিশা খুঁজে পেয়েছে তাদের দোয়ার বরকতে আমার আমলনামায় সাদাকায়ে জারিয়া নসিব করে দিন।

কী দিয়েছি কী পেয়েছি জানি না তা

শূন্যতায় ভরে আছে জীবনের খাতা

আমার আমাকে বলি

চিরদিন যেনো- ভালো হয়ে চলি।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ