কালোত্তীর্ণ কবি ফররুখ আহমদ

কালোত্তীর্ণ কবি ফররুখ আহমদ

বিশেষ রচনা শাহীন সুলতানা জুন ২০২৩

“রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?

এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?

সেতারা হেলাল এখনও ওঠেনি জেগে?

তুমি মাস্তুলে আমি দাঁড় টানি ভুলে;

অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।”

এই বিখ্যাত কবিতার মধ্য দিয়ে যিনি আমাদের হৃদয়-মসনদ দখল করে নিয়েছিলেন- তিনি বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত কবি ফররুখ আহমদ। যিনি মুসলিম রেনেসাঁর কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত। 

কবি ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরা (পূর্বে যশোর) জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সৈয়দ হাতেম আলী এবং মা রওশন আখতার। গ্রামের স্কুলেই তিনি লেখাপড়া শুরু করেন। পরে তালতলা মডেল হাইস্কুল, বালিগঞ্জ সরকারি হাইস্কুল ও খুলনা জেলা স্কুলে ভর্তি হন। তাঁর স্কুল জীবনের শিক্ষক ছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা। তরুণ বয়সে কবির মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা বাসা বেঁধেছিল প্রধান শিক্ষক কবি গোলাম মোস্তফার সাহচর্যে সে পুষ্প মল্লিকা প্রস্ফুটিত হয়েছিল পত্র পল্লবে।

কিশোর বয়স থেকেই তিনি কবিতাচর্চায় মনোনিবেশ করেন।

কবি দর্শন ও ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন।

ঢাকা বেতারে তিনি “ছোটদের খেলাঘর” অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর পদচারণা থাকলেও একজন শক্তিমান কবি হিসেবেই তিনি খ্যাতি লাভ করেন। কবিতা, ছড়া, গল্প, প্রবন্ধ, শিশু সাহিত্যে তাঁর দখল ছিল চোখে পড়ার মতো। লিখেছেন মহাকাব্য ‘হাতেম তায়ী’ জনপ্রিয় কাব্যনাটক নৌফেল ও হাতেম। সনেট, গীতিনাট্য, গদ্যরচনায়ও ছিলেন সমান পারদর্শী।

তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ সাত সাগরের মাঝি, সিরাজুম মুনীরা, ধোলাই কাব্য, হাতেম তায়ী, নৌফেল ও হাতেম, কাফেলা, সিন্দাবাদ, দিলরুবা ইত্যাদি।

বড়োদের পাশাপাশি ছোটোদের জন্যও তিনি লিখেছেন অন্তর উজাড় করে। অসংখ্য নান্দনিক ছড়া, শিশু-কিশোর কবিতা, গান, হামদ-নাত লিখে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ছোটোদের জন্য লেখা তাঁর প্রথম বই পাখির বাসা (১৯৬৫) বিপুলভাবে সমাদৃত হয়ে ‘ইউনেস্কো পুরস্কার’ জিতে নেয় ১৯৬৬ সালে। এ ছাড়া হরফের ছড়া, চাঁদের আসর, ছড়ার আসর, ফুলের জলসা, চিড়িয়াখানা, দাদুর কেচ্ছা এক নতুন জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তিনি নিজে স্বপ্ন দেখতেন শিশু-কিশোরকে উদ্বুদ্ধ করতেন স্বপ্ন দেখতে। তিনি গোটা জাতিকেও স্বপ্নে উদ্বেলিত করে তুলেছেন। তিনি ছিলেন কালোত্তীর্ণ কবি।

পাখির বাসা বইটি তিনি শিশু-কিশোরদের নামে উৎসর্গ করেন। তিনি লিখলেন-- 

‘নতুন মানুষ এল যারা

খোদার দুনিয়াতে

ছোট্ট আমার পাখির বাসা

দিলাম তাদের হাতে।’

শিশুতোষ গানে লিখলেন--

“ডালে ডালে পাখির বাসা

মিষ্টি মধুর পাখির ভাষা...

আর মাতৃভাষা বাংলা আমার

সকল ভাষার সেরা।”

পৌষের কথা কবিতায় লিখলেন-

উত্তরী বায় এলোমেলো

পউষ এল পউষ এল

হিমেল হাওয়ায়...পউষ এল পউষ এল।”

পাখির বাসা কবিতায় লিখলেন-

“আয় গো তোরা ঝিমিয়ে পড়া দিনটাতে...

কোন বাসাতে দোয়েল ফেরে সাঁঝরাতে।”

তাঁর সমস্ত ছড়া-কবিতাই সুখপাঠ্য। অসাধারণ সব দীপ্তিময় শব্দ, ছন্দ মিল, ভাব ও ভাষার প্রয়োগে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। শিশু মনস্তত্ত্বের ওপরে ছিল তাঁর অগাধ জ্ঞান। সৎ চরিত্রবান আদর্শ মানুষ হিসেবে শিশুরা যাতে গড়ে উঠতে পারে সেজন্য প্রতিটি লেখায় তিনি কৌশলে চমৎকার সব উপদেশ ও উৎসাহব্যঞ্জক বাণী সাজিয়ে দেন।

ফুল, পাখি, প্রকৃতি, পাহাড়, সমুদ্র, নারঙ্গিবন, পরিযায়ী পাখি, হিজল বন, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ, রুপালি জলরাশি, কাঁটা গোলাপ, শতমূলী লতা আরো কত কি! কিছুই বাদ যায়নি তাঁর লেখা থেকে।

বাংলা ভাষায় শিশুদের জন্য কাহিনীকাব্য রচনা করে তিনি ব্যাপক সাড়া ফেলে দেন। তাঁর শিশু-কিশোর উপযোগী গ্রন্থের সংখ্যা- ২১।

কবি ছিলেন একজন সক্রিয় ভাষাসৈনিক। ১৯৫২ সালে লিখলেন-

“মধুর চেয়েও মধুর যে ভাই আমার দেশের ভাষা” গানটি ভাষা আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। 

১৯৪৩ সালের করুণ দুর্ভিক্ষ তাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। সে সময় তিনি দুর্ভিক্ষের ওপর ১৯টি কবিতা রচনা করেন। ক্ষতবিক্ষত হৃদে বিখ্যাত ‘লাশ’ কবিতায় তিনি লিখলেন-

‘যেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে পড়ে আছে জমিনের পর;

সন্ধ্যার জনতা জানি কখনো রাখে না সে লাশের খবর।’

চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ নিয়েও কবিতা লিখেছেন তিনি।

বাংলা সাহিত্যের মহান উচ্চতায় অধিষ্ঠিত এই আপসহীন কবির কবিতা পড়লে নতুন করে জেগে উঠতে ইচ্ছে করে, স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘সাত সাগরের মাঝি’ জাতির মধ্যে এক অনন্য স্বপ্ন নির্মাণের তোলপাড় সৃষ্টি করে। 

অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের জন্য তিনি লেখেন অসংখ্য কবিতা। সারাজীবন তিনি অবহেলিত মানুষের কথা লিখেছেন। 

কবি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, প্রেসিডেন্ট পদক প্রাইড অব পারফরম্যান্স, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন।

জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে কবি অভাবের তীব্রতায় ছিলেন জর্জরিত। তবু সৎ, ধার্মিক, মানবতাবাদী ও আত্মমর্যাদাশীল ব্যক্তি হিসেবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। অর্থ, ক্ষমতা, ভোগ-বিলাসিতা কখনো তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি।

তিনি লিখলেন- 

“তোরা চাস নে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া

তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া।”

১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর ২৭ রমজানে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে কবি ইন্তিকাল করেন। তাঁর মৃত্যু বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি করেছিল এক অভাবনীয় শূন্যতা। আমরা বিশ্বাস করি, কালজয়ী সৃষ্টির মাধ্যমেই তিনি বেঁচে থাকবেন দশ আর দেশের মানুষের হৃদয়ে, ইরানি গোলাপের মতো সুরভি ছড়িয়ে মাতোয়ারা করবেন অনন্তকাল।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ