ও বৈশাখী কালবৈশাখী

ও বৈশাখী কালবৈশাখী

প্রবন্ধ নিবন্ধ শাহাদাৎ সরকার এপ্রিল ২০২৪

বাংলা নববর্ষের সূচনা মাস বৈশাখ। আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখের গুরুত্ব অপরিসীম। পহেলা বৈশাখের মধ্য দিয়ে পুরোনো হিসাব চুকিয়ে আমরা প্রবেশ করি নতুন বছরে- নতুন জীবনে। এই কারণেই বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমরা উদযাপন করি সর্বজনীন এক উৎসব-নববর্ষ। 

ছয় ঋতুর প্রথম ঋতু গ্রীষ্ম আর প্রথম মাস বৈশাখ। বৈশাখে প্রকৃতি নতুন বিন্যাসে সজ্জিত হয়। সজল প্রকৃতির উল্লাস অসীম নীলিমায় নানা বর্ণের মেঘের বিস্তার আমাদের চৈতন্যে সঞ্চারিত করে সঞ্জীবনী মন্ত্র- আমাদের চোখে প্রশান্তির কাজল পরিয়ে দেয় সর্ববিস্তৃত প্রকৃতির। এ ভূ-খণ্ডের প্রতিটি মানব মনে এর প্রভাব পড়ে। যেহেতু শিল্পীরা তুলনামূলকভাবে অধিক সংবেদনশীল তাই তাদের শিল্পীচৈতন্যে এর রেখাপাত প্রগাঢ় হয়ে পড়ে। 

কবিদের আমরা জানি যে কোনো চিত্তবিক্ষোভ বা আনন্দ আলোড়নকে একটি শিল্পিত ভাষ্যে রূপায়িত করার নৈপুণ্যভাস্বর কারিগর হিসেবে। ফলে প্রকৃতি ও মানবপ্রকৃতিকে বিজড়িত করে বিকশিত যে সংস্কৃতি তার একটি বিশিষ্ট অভিব্যক্তি বৈশাখকেন্দ্রিক কবিতায় পাওয়া যায়। প্রাচীন কবিতায় ঋতুকেন্দ্রিক মানব মনের আনন্দ-বেদনা-বিরহ-যাতনা যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি আধুনিক কালের কবিদের কবিতায় উঠে এসেছে বৈশাখের নানারূপ। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম বৈশাখ মাসে। হয়তো তাই বৈশাখের প্রতি তার অন্যরকম টান। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বৈশাখ এসেছে বহুমাত্রিকতার দ্যোতনায়- সুরে, ছন্দে, রুদ্রতায়, রুক্ষতা আর জীবনের মতো পারিবর্তনিক অনুভবের চঞ্চল অভিজ্ঞতায়। তিনি বৈশাখে যেমন দেখেছেন ধ্বংস রূপ, তেমনি দেখেছেন নতুন বছরের নতুন প্রত্যাশার উল্লাস। ‘বৈশাখ আবাহন’ কবিতায় তার এই বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার রূপ দেদীপ্যমান :

এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ

তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে

বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক...

যাক পুরাতন স্মৃতি যাক ভুলে যাওয়া গীতি

অশ্রু বাষ্প সুদূরে মিলাক।

‘বৈশাখ আবাহন’ বাংলা সাহিত্যে বৈশাখ নিয়ে লেখা সর্বাধিক গাওয়া কবিতা/গান। বৈশাখ নিয়ে সর্বাধিক পরিচিত ও পঠিত কিশোর কবিতার রচয়িতাও রবীন্দ্রনাথ; কবিতাটি হচ্ছে:

আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে

বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।

বৈশাখকে রবীন্দ্রনাথ অবলোকন করেছেন রুদ্ররূপেও। কল্পনা কাব্যের ‘বৈশাখ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের রুদ্র বৈশাখ ভিন্নমাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছে-

হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ,

ধূলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,

তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল

কারে দাও ডাক-

হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ?

শুধু রুদ্র রূপ নয়, বৈশাখের রুক্ষ রূপও রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়ায়নি। বৈশাখের রুক্ষ রূপ তুলে ধরে তিনি শান্তির প্রার্থনায় আনত হয়েছেন শক্তির কাছে: 

হে বৈরাগী, করো শান্তিপাঠ।

উদার উদাস কণ্ঠ যাক ছুটে দক্ষিণে ও বামে

যাক নদী পার হয়ে, যাক টলি গ্রাম হতে গ্রামে,

পূর্ণ করি মাঠ।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম বৈশাখ মাসে নয়, তবু তিনি স্বভাব আর কাব্যভাবে বৈশাখের মতো রুদ্র, প্রকৃতির মতো অশান্ত। তিনি সময়ের মতো বিপ্লবী জয়লেখ আর নতুন সৃষ্টি-নেশায় মগ্ন যোদ্ধার মতো বিদ্রোহীত্বকে বৈশাখে প্রত্যক্ষ করেন। তিনি বৈশাখের তাণ্ডবীয় আগমনে ভীত নন, বরং উল্লসিত, মাতোয়ারা আর আনন্দে আত্মহারা। তাই কবিতায় তিনি উদ্বেল হয়ে ওঠেন বিদ্রোহের কালঝড় আর সাইক্লোনের প্রাবল্যে :

ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়

তোরা সব জয়ধ্বনি কর

তোরা সব জয়ধ্বনি কর

ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? -প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন!

আসছে নবীন-জীবন-হারা অ-সুন্দরে র্কতে ছেদন!

তাই যে এমন কেশে বেশে

প্রলয় বয়েও আস্ছে হেসে-

মধুর হেসে!

ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির সুন্দর।

নজরুলের বৈশাখ বিপ্লবীর অস্ত্র যেন। বজ্রের মতো গর্জে ওঠে সে অস্ত্র। তার সন্ধ্যা কাব্যের ‘কালবৈশাখী’ কবিতায় স্বভাবসিদ্ধ অগ্নিঝরা কণ্ঠে তাই দেখতে পাই :

বারেবারে যথা কাল-বৈশাখী ব্যর্থ হলো রে পুব-হাওয়ায়,

দধীচি-হাড়ের বজ্র-বহ্নি বারেবারে যথা নিভিয়া যায়,

কে পাগল সেথা যাস হাঁকি-

‘বৈশাখী কাল-বৈশাখী!’

কবির আক্ষেপ, বৈশাখ তার প্রকৃত রুদ্ররূপ ধরে আবির্ভূত হয়নি। তাই এখনো বিদেশি শত্রু আমাদের ঘাড়ে বসে আছে। বৈশাখকে তার আহ্বান; এসে যেন শেষ করে দেয় শত্রুদের চিহ্ন:

কাল-বৈশাখী আসেনি হেথায়, আসিলে মোদের তরু-শিরে

সিন্ধু-শকুন বসিত না আসি ভিড় করে আজ নদীতীরে।

জানি না কবে সে আসিবে ঝড়

ধূলায় লুটাবে শত্রুগড়,

রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের পর বাংলা ভাষায়বাংলা নববর্ষকে নিয়ে দীর্ঘতম কবিতা লেখিয়েদের মধ্যে অন্যতম কবি ফররুখ আহমদ। তিনি ‘বৈশাখ’ ও ‘বৈশাখের কালো ঘোড়া’ নামে যে দু’টি কবিতা রচনা করেছেন তা বৈশাখের কবিতায় ভিন্নমাত্রা দান করেছে। বৈশাখ তার কাছে মহাশক্তির প্রতীক, যা কল্যাণ সাধনের জন্যই আবির্ভূত হয় :

ধ্বংসের নকীব তুমি হে দুর্বার, দুর্ধর্ষ বৈশাখ

সময়ের বালুচরে তোমার কঠোর কণ্ঠে

শুনি আজ অকুণ্ঠিত প্রলয়ের ডাক ॥

ফররুখ তার ‘বৈশাখের কালো ঘোড়া’ কবিতায় বৈশাখকে বিমূর্ত করেছেন মহাশক্তিধররূপে। যেমন-

বৈশাখের কালো ঘোড়া উঠে এলো। বন্দর, শহর

পার হয়ে সেই ঘোড়া যাবে দূর কোকাফ মুলুকে,

অথবা চলার তালে ছুটে যাবে কেবলি সম্মুখে

প্রচণ্ড আঘাতে পায়ে পিষে যাবে অরণ্য, প্রান্তর।

ফররুখ আহমদের কাছে বৈশাখ শুধু মাস নয়, শুধু নবর্ষের সূচনা নয়; একই সঙ্গে বিপ্লবের মমতা, নির্ভীকতার পাঠ, আপসহীনতার মন্ত্র। তার এ দৃঢ় দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায় ‘বৈশাখ’ কবিতায় :

‘সংগ্রামী তোমার সত্তা অদম্য, অনমনীয়- বজ্র দৃঢ় প্রত্যয় তোমার,

তীব্র সংঘর্ষের মুখে বিশাল সৃষ্টিকে ভেঙে অনায়াসে কর একাকার

সম্পূর্ণ আপোষহীন, মধ্যপথে কোন দিন থামে না তো, জানে না বিরতি,

তোমার অস্তিত্ব আনে ক্ষণস্থায়ী এ জীবনে অবিচ্ছিন্ন, অব্যাহত গতি,

প্রচণ্ড সে গতিবেগ ভাঙে বস্তি, বালাখানা, ভেঙে পড়ে জামশিদের জাঁক,

লাভ-ক্ষতি সংজ্ঞাহীন, নিঃশঙ্ক, নিঃসঙ্গ তুমি

হে দুর্বার, দুর্জয় বৈশাখ।

কবি কায়কোবাদ তাঁর কবিতায় বৈশাখের চিত্র এঁকেছেন এইভাবে-

কি ঘোর ভীষণ দৃশ্য

আঁধারে নিমগ্ন বিশ্ব

অনন্ত অসীম সিন্ধু সম্মুখে পশ্চাতে ।

সফেন তরঙ্গগুলি

লুণ্ঠিয়া পড়িয়ে আসি

অনন্তের পদমূলে ত্রিমুখীর স্রােতে! (নববর্ষ)

বৈশাখের ঝড়ের পরের চিত্র এঁকেছেন কবি জসীমউদ্দীন তার ‘বোশেখ শেষের মাঠ’ কবিতায় এইভাবে-

বোশেখ শেষে বালুচরের বোরো ধানের থান,

সোনায় সোনা মেলিয়ে দিয়ে নিয়েছে কেড়ে প্রাণ।

কবি বে-নজীর আহ্মদ বৈশাখকে আহ্বান করছেন নবাঙ্কুরের জন্য। তিনি বলছেন-

পুরাতনের শীর্ণ পাতা জীর্ণ যাহা পড়–ক ঝরি

মৃত্যু-মলিন পান্থ যারা ছাড়ি যাকনা সরি।

ধ্বংস বাউল যাকরে নাচি

বাঁচার যাহা রইবে বাঁচি,

মুমূর্ষুরা মরণ যাচি চরণ তলে থাক না পড়ি।

আবার ধরা নবীন প্রাণের নবাঙ্কুরে উঠুক ভরি। 

কবি বন্দে আলী মিয়া তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন বৈশাখের ভূ-প্রকৃতির চিত্র-

বিহানের খরা আসিয়া পড়েছে ধূসর মাঠের পরে

চষা জমিনের চাপ চাপ মাটি চিকমিক চিক করে;

রফিকুল হক তপ্ত বৈশাখের ছবি এঁকেছেন-

বোশেখ মাসে রোদের তাপ, / শুকনো মুখে মলিন ছাপ। /

ডানপিটেরা / ভরদুপুরে / তালপুকুরে দিচ্ছে ঝাঁপ।

সুকুমার বড়–য়া প্রকৃতিতে কালবোশেখির ছবি এঁকেছেন-

কালবোশেখির ঝড়ে / আমের শাখা নড়ে, / ঝরা ফুলের হাতছানিতে / মন থাকে না ঘরে।

আবদুল হাই শিকদার বৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব তুলে এনেছেন-

খামোখাই গাছদের ধরে ধরে আছড়ায়

যেন রাগী খুব পাজি ধোপারে,

বাহাদুরি দেখবার জন্য সব বাড়িঘর,

কান ধরে পাঠাচ্ছে ওপারে।

মোশাররফ হোসেন খান বোশেখকে তুলনা করেছেন দস্যি ছেলের সাথে। যে ভয় ঠেলে বেরিয়ে আসে রুদ্ধ দ্বার ভাঙতে।

বোশেখ মানে দস্যি ছেলে

ভয় ভাবনা নেইকো যার

বোশেখ মানে ভয়কে ঠেলে

ভেঙ্গে ফেলা রুদ্ধ দ্বার।

বোশেখের সেই দস্যিপনা শেষে এক মোহনায় মিলবো সবাই এসে। তাই কবি মতিউর রহমান মল্লিক কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়ে উঠি-

আয় না সবাই এক হয়ে যাই

বৈশাখের এই দিনে,

হৃদয় দিয়ে সকল হৃদয়

একে একে করিগো জয়

মন দিয়ে মন

নেইগো সবাই কিনে

বৈশাখের এই দিনে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ