এইচ.আর ১৮৯

এইচ.আর ১৮৯

সাইন্স ফিকশন ইসরাত জাহান হাফসা এপ্রিল ২০২৪

‘টাইম ট্র্যাভেল? কথাটা কতটা যুক্তিহীন তুমি জানো?’

‘কিন্তু এটা সত্যি।’

‘তুমি বলতে চাচ্ছো তুমি ২০৫০ সাল থেকে বর্তমানে অর্থাৎ ২০৩৩ সালে এসেছো?’

‘জি।’

সুরভী বিরক্তিভরা চোখে তাকালো সামনে বসা মেয়েটির দিকে। বয়স ১৫-১৬ হবে। এ বয়সের মেয়েরা অন্যকে অবাক করতে ভালোবাসে। সুরভী কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো, ‘মানলাম তুমি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছো। কিন্তু আমার কাছে কী চাও?’

সোফিয়া মুখ তুলে বললো, ‘কারণ আঙ্কেল ম্যাক্স আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছে।’

‘আঙ্কেল ম্যাক্স মানে? তুমি ম্যাক্সের কথা বলছো? সে তোমার আঙ্কেল হয় কীভাবে? তার সাথে গতকালও আমার দেখা হয়েছে।’

‘আমার কথাটা শোনো।’

সুরভী দাঁড়িয়ে বললো, ‘অনেক শুনেছি তোমার মনগড়া কথা। প্লিজ গেট লস্ট।’

‘তোমার আমাকে সাহায্য করতেই হবে।’

‘তুমি এক্ষুনি বের হবে।’

সোফিয়া শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো সুরভীর দিকে। অতঃপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই পকেট থেকে বন্দুক বের করে তাক করলো সুরভীর কপাল বরাবর। সুরভীর সারা মুখ আতঙ্কে ছেয়ে গেল। সে কল্পনা করেনি মেয়েটা এমন কিছু ঘটাবে। সোফিয়া বন্দুক নামিয়ে বললো, ‘বসো প্লিজ।’

সুরভী বসে ঢকঢক করে পানি খেলো, এতক্ষণ রাগে তার খেয়াল ছিল না মেয়েটি বাংলায় কথা বলছে। কিন্তু এই জাপানে তার কাছে বাঙালি মেয়ে কেন আর কীভাবে আসবে?

‘আমার কথা মন দিয়ে শোনো প্লিজ! আমি ২০৫০ সাল থেকে বর্তমানে এসেছি। জানি কথাটা অবিশ্বাস্য তবে সত্যি। তোমরা প্যারালাল ইউনিভার্সের সাথে আমাদের ইউনিভার্সের কানেকশনের জন্য বিশেষ যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলে। নামটা হলো এইচ.আর ১৮৯। ঠিক?’

সুরভী কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না এই মেয়ে এসব কীভাবে জানে। কথাটা সে, রামিম আর ম্যাক্স ছাড়া কারো জানার কথা না। সোফিয়া আবার বলতে শুরু করলো, ‘তোমরা প্যারালাল ইউনির্ভাসে সম্পূর্ণ বিশ^াস করো এবং বের করেছিলে অবশ্যই আরেকটি ইউনিভার্স আছে। যেটা সম্পূর্ণ আমাদের ইউনিভার্সের মতোই। সেখানে হুবহু আরেক পৃথিবী রয়েছে যেখানে আমরা রয়েছি। আমাদেরই আরেক রূপ রয়েছে। আজ থেকে তিন বছর আগে অর্থাৎ ২৩ ডিসেম্বর ২০৩০ তোমাদের এই আবিষ্কার শেষ হয়েছিল।’

‘হ্যাঁ, এইচ.আরের কাজ ছিল কোনোভাবে সেই ইউনিভার্সের সাথে আমাদের ইউনিভার্সের যোগাযোগ স্থাপন করা। কিন্তু আমরা সফল হতে পারিনি। ঐদিনের পর থেকে সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেছে। ঘটনার আগের পৃথিবী আর এই পৃথিবীর আমরা কোনো মিল পাচ্ছিলাম না। ঘটনার পর ম্যাক্স প্রায়ই সব ভুলে যেত। বর্তমানে সে হাসপাতালে রয়েছে। ঘটনার পর আমি জানতে পারি আমার বাবা-মা অনেক আগেই মারা গেছে কিন্তু ঘটনার দিন তারা জীবিত ছিল। আমরা আরো অবাক হয়ে লক্ষ করেছি আমরা ঘটনার আগে যাদের চিনতাম তারা অনেকেই আমাদের চেনে না। আবার যাদের আমরা চিনি তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক আগে যে রকম ছিল বর্তমানে সে রকম না। কিন্তু তাদের কাছে এগুলো খুবই নরমাল। সব অদ্ভুত আর অন্যরকম কেবল আমার, রামিম আর ম্যাক্সের কাছে। রামিম এসব কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে না। সে নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছে।’

‘তোমরা হয়তো ভাবছো তোমরা এক্সপেরিমেন্টে সফল হতে পারোনি কিন্তু আসলে যা চাচ্ছিলে তা করতে না পারলেও অন্য কিছু করেছো। তোমাদের ওই দিন ওই এক্সপেরিমেন্টের কারণে তোমরা তিনজন অন্য ইউনিভার্সে চলে এসেছো। অর্থাৎ বর্তমানে তোমরা যে ইউনিভার্সে বসবাস করছো তা আসলে তোমাদের ইউনিভার্স না। এটি সম্পূর্ণ আলাদা পৃথিবী।’

‘তোমার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’

‘আচ্ছা মোট কথা, তোমাদের এক্সপেরিমেন্টের ফলে একটা হিউজ ইফেক্ট সৃষ্টি হয়। যার ফলে তুমি, ম্যাক্স আর রামিম এক ইউনিভার্স থেকে অন্য ইউনিভার্সে চলে এসেছো।’

‘অর্থাৎ আমরা বর্তমানে যে পৃথিবীতে বাস করছি তা আসলে আমাদের পৃথিবী না?’

‘না। দুই ইউনিভার্সে আমরা থাকলেও এক বিশাল তফাত রয়েছে। অর্থাৎ মানুষগুলো এক হলেও স্বভাব, চরিত্র, সম্পর্ক কিছুই এক না। তাই আমি চাচ্ছি তুমি আমার সাথে ২০৩০ সালে যাবে সেই এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করতে।’ সোফিয়া সুরভীর হাত ধরে বললো, ‘সাহায্য করবে আমাকে?’

সুরভী এতক্ষণে খেয়াল করলো এই মেয়ের সাথে রামিমের চেহারার অদ্ভুত মিল রয়েছে। সে মেয়েটির সব কথা বিশ্বাস করেছে কারণ তার কাছে এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সে এসব সহ্য করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে। সুরভী বললো, ‘করবো।’

সোফিয়া মুখে হাসি টেনে বললো, ‘আমার একার পক্ষে ২০৩০ সালে গিয়ে ওদের বিশ^াস করানো কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। কারণ ওরা কখনোই বিশ্বাস করবে না।’

‘আমার সাথে তোমার সম্পর্ক কী?’

‘আমি তোমার আর রামিমের মেয়ে।’

সুরভী অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো। সে বললো, ‘তোমার কথা আমি বিশ্বাস করছি কারণ এছাড়া আমার আর উপায় নেই। আমি বর্তমানে আমার জীবনের মানেই খুঁজে পাচ্ছি না। আমি তোমার সাথে যাবো।’

সোফিয়া সুরভীকে নিয়ে টাইম মেশিনটার সামনে গেল। সুরভী বললো, ‘টাইম মেশিনটি কে বানিয়েছে?’

‘আঙ্কেল ম্যাক্স।’

সোফিয়া সুরভীকে নিয়ে টাইম মেশিনে উঠে বসলো। টাইম ফিক্সড করলো ২৩ ডিসেম্বর ২০৩০। তখনি টাইম মেশিনটি নড়ে উঠলো আর অদ্ভুত এক আলোর ঝলকানি দেখা গেল।

কিছু সময় পরেই তারা টাইম মেশিনটি থেকে নামলো। সুরভী খেয়াল করলো সে তাদের অতি পরিচিত ল্যাবের সামনে রয়েছে। গত তিন বছর এই ল্যাবে আসা হয় না। সুরভী বললো, ‘আমাদের থামাতে পারলে কি আমরা আমাদের পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবো? সব আগের মতো হবে?’

সোফিয়া বললো, ‘বিশ্বাস রাখতে পারো।’

তারা দরজায় ধাক্কা দিয়ে দেখলো তা বন্ধ। সুরভী দরজায় একটা বাটনে ক্লিক করে বললো, ‘এইচ.আর ১৮৯।’ সাথে সাথে দরজাটি খুলে গেল।

সোফিয়া আর সুরভী ভেতরে ঢুকে দেখলো এলোমেলো করে জিনিসপত্র ছড়ানো আর তার মধ্যে রামিম ঘুমিয়ে আছে। সোফিয়া বিরাট এক মেশিন দেখিয়ে বললো, ‘এটিই তাহলে এইচ.আর ১৮৯?’

‘হ্যাঁ।’

সোফিয়া মেশিনটাকে ছুঁয়ে বললো, ‘এটি নষ্ট কীভাবে করবো? আগুন জ্বালিয়ে দেই?’

তখনি রামিম ঘুম থেকে উঠলো। সে সোফিয়াকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বললো, ‘হু আর ইউ?’

সুরভী রামিমের পাশে বসে বললো, ‘আমি সব বলছি।’

তখনি আরেক সুরভী আর ম্যাক্স ল্যাবে ঢুকলো। দুটো সুরভীকে দেখে সবার মাথা ঘুরে উঠলো। সুরভী বললো, ‘প্লিজ হাইপার হবে না। আমি সব বলছি।’ অতঃপর সে এই ৩ বছরের সব কাহিনিসহ আজকের কথা বললো। বর্তমানের সুরভী বললো, ‘তার মানে আমাদের এই এক্সপেরিমেন্টটা করা উচিত না?’

রামিম রেগে বললো, ‘আমার এত বছরের কষ্ট আমি বিফলে যেতে দেবো?’

ম্যাক্স বললো, ‘শান্ত হ প্লিজ।’

‘আমি কোনোভাবেই এটা বন্ধ করবো না। আজকে আমাদের সাফল্যের দিন। এইসব কথায় আমি বিশ্বাস করবো না। সুরভী আমার স্ত্রী হলেও কোনো দিনই আমার ভালো চায়নি। ও চায় না আমি ভবিষ্যতে সফল হই। এ কারণেই ও এসেছে।’

সোফিয়া বললো, ‘এই এক্সপেরিমেন্টের কারণে তোমাদের তিনজনের জীবন সম্পূর্ণ পালটে যাবে। ২০২৪ সালে মম অর্থাৎ সুরভী মানসিক চাপে আত্মহত্যা করবে। তুমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে। এরকম জীবন তোমরা চাও?’

রামিম চিৎকার করে বললো, ‘আমি বিশ্বাস করি না।’ বলেই সে মেশিনটির সামনে যায়। কেউ তাকে থামানোর আগেই সে চালু করতে যাবে এমন সময় সবাই এক বিকট আওয়াজে রামিমের দিকে তাকিয়ে দেখে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। সোফিয়া রামিমকে গুলি করেছে। বর্তমানের সুরভী মাটিতে বসে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘তুমি এটা কী করলে!’

সোফিয়ার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ভবিষ্যতের সুরভী সোফিয়াকে ধরতে যাবে তখনি সে মাথা ঘুর পড়ে গেল।

‘সুরভী মা ঘুম থেকে উঠে পড়। অনেক বেলা হয়েছে।’ মায়ের ডাকে সুরভীর ঘুম ভাঙলো। সে লাফ দিয়ে উঠে বসলো। পাশে দেখলো তার মা বসে আছে। তাহলে কি সে তাদের পৃথিবীতে চলে এসেছে? সে মাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এখন কত সাল? কয় তারিখ?’

‘মাথা গেছে তোর? ২৪ ডিসেম্বর, ২০৩৩! তাড়াতাড়ি খেতে আয়। রামিম ও ম্যাক্স এসেছে।’

সুরভী এক দৌড়ে তাদের কাছে গেল। গিয়ে দেখলো রামিম আর ম্যাক্স নাশতা করছে। সে তাদের কাছে গিয়ে বললো, ‘তোমরা এইচ.আর ১৮৯ নামের কিছু চেনো?’

রামিম বললো, ‘ঘুম থেকে উঠে কী আজগুবি নাম বলছো? এটা কী?’

ওরা হাসতে লাগলো। সুরভী পাশের দেওয়ালে তাকিয়ে দেখলো তার আর রামিমের বিয়ের টাইপোগ্রাফি টাঙানো। 

সুরভী ভাবছে তাদের পৃথিবীতে চলে আসলেও রামিম আর ম্যাক্সের তো সব মনে থাকার কথা। আর রামিমকে তো সোফিয়া গুলি করেছিল। তাহলে কি সে শুধু পৃথিবীতেই মারা গেছে? আর এই পৃথিবীতে বেঁচে আছে। অর্থাৎ এক ইউনিভার্সে মারা গেলেও অন্য ইউনিভার্সে সে বেঁচে থাকবে? না কি এটা সম্পূর্ণ আলাদা একটি ইউনিভার্স যার সাথে পূর্বের দুটোর মিল নেই। তার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে রামিম বললো, ‘আমি কিন্তু ঠিক করে ফেলেছি মেয়ে হলে নাম সোফিয়া রাখবো।’


কিশোরকণ্ঠ জাতীয় সায়েন্স ফিকশন লেখা প্রতিযোগিতা ২০২৩-এর দ্বিতীয় স্থান অধিকারী সায়েন্স ফিকশন 

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ