ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ)

ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ)

স্মরণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪

ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম..

Mazahইমাম ইবনে মাজাহ (রহ)-এর ডাক নাম মুহাম্মদ উপনাম আবু আবদুল্লাহ। নিসবতি নাম আল বরি আল কাজবিনি। পূর্ণনাম হাফিজুল হাদিস ইমাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মাজাহ আর রবিয়ি আল কাজবিনি। তিনি কাসপিয়ান সাগরের উপকূলের অধিবাসী ছিলেন বলে তাঁকে কাজবিনি বা কাসপিয়ানি বলা হয়। কিন্তু ইবনে মাজাহ নামেই তিনি অধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ২০৯ হিজরি সনে ইবনে মাজাহ কাজবিন নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। এই শহর তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান ইবনে আফফান (রা)-এর শাসনামলে বিজিত হওয়ার পর থেকেই ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রে পরিণত হয়। তৃতীয় হিজরি শতক থেকেই এ শহর ইলমে হাদিসের চর্চায় বিশেষ উৎকর্ষতা লাভ করে। ফলে ইবনে মাজাহ বাল্যকাল থেকেই ইলমে হাদিস চর্চার অপূর্ব সুযোগ লাভ করেন। পারিবারিক পরিবেশেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। আরবি ও ফার্সি ভাষায় তিনি অপূর্ব দক্ষতা অর্জন করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কাজবিনেই সমাপ্ত করেন। এরপর দীর্ঘ একুশ বছরকাল আপন জন্মস্থানে হাদিস অধ্যয়ন সমাপনান্তে মক্কা, মদিনা, দামেশক, কুফা, বসরা, বাগদাদ, হিমস, খুরাসান, বলখ, মিসর, তিন্নসি, ইসপাহান, নিশাপুর, ওয়াসত প্রভৃতি জ্ঞানকেন্দ্র সফর করে হাদিস শিক্ষা ও হাদিস সংগ্রহ করেন। এ সময় তিনি যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগণের নিকট হাদিস অধ্যয়ন করেন এবং বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। ইবনে মাজাহ যে সমস্ত মুহাদ্দিসের নিকট হাদিস অধ্যয়ন করেন তাঁদের মধ্যে আলী ইবন মুহাম্মদ, আবু হাসান তানফেসী, আবু বকর আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ, আবু সাদ আবদুল্লাহ আল আসাদ, ইবন হিব্বান তামিমি, মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ নুমায়র, আবু বকর আন আবি শায়বাহ, ইবরাহিম ইবন মুনসযির হিশামি, দাউদ ইবন রশিদ, আবদুল্লাহ ইবন মুআবিয়াহ, আমর ইবন রাফে, আবু হাজার বিজলি, ইসমাইল ইবন মুসা ইবন হাইয়ান তামিমিী, হিশাম ইবন উমারাহ এবং মুহাম্মদ ইবন আবু খালেদ আবু বকর কাজবিনি প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইমাম ইবন মাজাহ অল্প দিনের মধ্যেই ইলমুল হাদিসে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং সমকালীন যুগে একজন প্রতিষ্ঠিত মুহাদ্দিস হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর যশ, খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য বিদ্যার্থী তাঁর নিকট এসে বিদ্যার্জন করে তাদের জ্ঞান-তৃষ্ণা নিবারণ করত। তাঁর ছাত্রের সংখ্যা অনেক বেশি। তন্মধ্যে সুলায়মান ইবন ইয়াযিদ, ইবরাহিম ইবন দিনার, আবুল হাসান ইবন কাত্তান, মুহাম্মদ ইবন ঈসা আস সাফিয়ার, ঈসা ইবন আবসার (রহ) প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইমাম ইবনে মাজাহ অসাধারণ মেধা, নিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও প্রজ্ঞা দিয়ে হাদিস যাচাই-বাছাই করেন। তিনি হাদিস গ্রহণ ও যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যে নীতিমালা অনুসরণ করেন তা নিম্নরূপ : ১.    বর্ণনাকারীকে অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ হতে হবে; ২.    বর্ণনাকারীকে ফাসিক ও বিদআতি হওয়া চলবে না; ৩.    সহীহ আকিদার অনুসারী হতে হবে; ৪.    আদব ও শিষ্টাচারের অধিকারী হতে হবে; ৫.    বর্ণনাকারীদের বিশ্বস্ততা ও দোষ-গুণ বিশ্লেষণপূর্বক হাদিস গ্রহণীয়; ৬.    সনদের বলিষ্ঠতা দ্বারা সমর্থন পাওয়া গেলে অপর বর্ণনাসূত্রে বিচ্ছিন্নতা দেখা দিলেও তা আপাতত গ্রহণযোগ্য; ৭.    বুখারি ও মুসলিমের সূত্রে বর্ণিত সকল হাদিস গ্রহণযোগ্য; ৮.    খ্যাতনামা আলেম ও ফকীহগণ যে সমস্ত হাদিসের ওপর আমল করেছেন সেসব হাদিস গ্রহণযোগ্য; ৯.    দুর্বল হাদিস অপরাপর সহীহ হাদিস দ্বারা সমর্থিত হলে তা সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য। ইবনে মাজাহ রচনা করেন বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আস সুনান’ যা সুনানে ইবনে মাজাহ বা ইবনে মাজাহ শরিফ নামে সুপরিচিত। এ হাদিস সঙ্কলনখানি সব দিক দিয়ে সমস্ত সিহাহ সিত্তা গ্রন্থাবলির মধ্যে বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী। প্রথম এর রচনা, সজ্জায়ন, সৌকর্য। দ্বিতীয়ত, এ গ্রন্থের হাদিসসমূহে বিশেষ পুনরাবৃত্তি নেই। অপর কোনো সঙ্কলনে এই বিশেষত্ব দেখতে পাওয়া যায় না। মুহাদ্দিস শাহ আবদুল আজিজ দেহলবী (রহ) ইবনে মাজাহ শরিফের উচ্চ প্রশংসা করেছেন। অপরিসীম শ্রম সাধনা ও যাচাই বাছাইয়ের পর ইমাম ইবনে মাজাহ এ গ্রন্থখানার প্রণয়নকার্য সম্পন্ন করেন। লাখ লাখ হাদিস থেকে বাছাই করে চার হাজার হাদিসকে তিনি বিভিন্ন অধ্যায়ে সাজিয়ে দিয়েছেন। এ গ্রন্থে মোট ৩২টি পরিচ্ছেদ। মোট হাদিসের সংখ্যা ৪৩৩৮টি। ইমাম ইবনে মাজাহ এ গ্রন্থ ছাড়াও আরো বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। হাদিসের ভিত্তিতে কুরআনের একটি বিরাট তাফসির গ্রন্থও তিনি রচনা করেন। তারিখে মিলিহ তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থে তিনি সাহাবাদের যুগ থেকে নিজের সময়কাল পর্যন্ত বিস্তারিত ইতিহাস আলোচনা করেছেন। ইমাম ইবনে মাজাহ ২৭৩ হিজরির ২২ রমজান সোমবার ৬৪ বছর বয়সে কাজবিন শহরে ইন্তেকাল করেন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ