ইমাদের স্বপ্ন

ইমাদের স্বপ্ন

তোমাদের গল্প ফাতিমা রিমি নভেম্বর ২০২৩

স্কুল ছুটির পর স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চারা হৈ-হুল্লোড় করে বেরিয়ে এলো। কিন্তু ছোট্ট ইমাদ মন খারাপির এক বিশাল বোঝা নিয়ে চুপচাপ গেটের কাছে এসে দাঁড়াল।

ইমাদকে নিতে এসেছে তার বাবা। ছেলের মাথার পেছনে স্নেহমাখা হাত রেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তিনি ডাকলেন, ইমাদ, কী হয়েছে বাবা?

ইমাদ যেন ঘোরের মধ্যে ছিল, বাবার ডাকে হকচকিয়ে হাসির চেষ্টা করে বলল, কিছু হয়নি তো বাবা।

কিন্তু ইমাদের বাবা বুঝে নিলেন একটা কিছু হয়েছে তো নিশ্চয়ই। তবুও তিনি বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে বাবা, এসো তাহলে বাসায় ফেরা যাক।

বাবা তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, মন খারাপ করো না। বাবা অফিস থেকে ফিরে তোমার সাথে গল্প করবে।

বাসায় মায়ের সাথে টুকটুক করে গল্প করতে করতে ইমাদ ভুলেই গেল মন খারাপের কথা।

খাঁ খাঁ দুপুরে হন্তদন্ত হয়ে ক্লান্তি যখন পুরো শহর জুড়ে নেমে পড়ছিল তখন ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে ইমাদ তার বই অনুরাগী মায়ের পাশে বসে এলোপাথাড়ি বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে, কখনো আঁকিবুঁকি আর কখনো কুটকুট করে কাগজ কেটে এটা ওটা বানাতে বানাতেই বিকেল নেমে আসে। চারপাশের সবুজ গাছপালা রোদের আলোকচ্ছটায় ঝলমলে সবুজ হয়ে হেলেদুলে শীতল বাতাস দিয়ে যায়। এই সময়টুকুতে মায়ের পক্ষ থেকে টুঁ শব্দটিও পাওয়া যায় না কারণ তিনি সেই সময়টা ইয়া বড় কোনো বইয়ের পাতায় চোখ, মুখ গুঁজে হৃদয় মন গুলিয়ে ফেলেন।

ইমাদের চোখ বুজে আসে ঘুমে, মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।

যখন ঘুম ভাঙলো চারপাশে সন্ধ্যা নেমে এসেছে, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। তার বাবা অফিস থেকে ফিরে নামাজের প্রস্তুতি শেষ করেছে মাত্র। বৃষ্টি থামতে বেশ রাত হয়ে গেল, কিন্তু বাবা ইমাদকে নিয়ে রাতেই বের হলেন বৃষ্টি ভেজা শহর দেখতে। ইমাদের ভীষণ ভালো লাগছে, বাবা বললেন, আরাফের খুব দামি সুন্দর ছোট্ট বাইকটি দেখে তোমার মন খারাপ হয়েছিল তাই না? মাথা উঁচিয়ে সে বাবার দিকে তাকায়, সেটা তুমি কেমন করে জানলে বাবা?

উমম...জেনেছি, কিভাবে জানতে পারি তুমিই বলো?

- আম্মু ফোনে বলেছে নিশ্চয়ই।

- হুউউউ, ঠিকই ধরেছে বুদ্ধিমান ছেলে আমার।

বাবা হাতের ইশারায় ফুটপাথের দিকে তাকে দেখালো, ইমাদ বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, ছোট ছোট খোপ খোপ এগুলো কী বাবা?

বাবা বললেন-এগুলো ঘর।

ইমাদ অবাক হয়ে দেখতে থাকে শুধু। এমন প্লাস্টিকে মোড়ানো পাখির বাসার মতো খোপ খোপ এইসব ঘর হয় কি করে? যখন বাবা তাকে বললো এখানে মানুষ ঘুমায়, তখন সে আরো বিস্ময়াভিভূত হয়ে যায়। 

বৃষ্টি হওয়ার কারণে অধিকাংশ ঝুপড়ির মানুষই চারপাশ এঁটে ঘুমিয়ে পড়েছে। দুই একটির বাইরে শুধু কেউ কেউ ভেতরে ঢোকার জন্য একপাশ খোলা রেখেছে তারা বাইরে এখনো কোনো কাজ করছে কেউ রান্না, কেউ টুকটাক এটা সেটা করছে। ছোট্ট ইমাদ ভেবে কূলকিনারা পায় না, এভাবেও মানুষেরা বসবাস করতে পারে! দরজা জানালাবিহীন এমন ঘরে ঘুমানো ভেবেই তো তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

ইমাদের বাবা বললো দেখেছো, এরা প্রতিদিন তিনবেলা পেটপুরে খাবারও পায় না। অথচ আমাদের দেখো সুন্দর পরিপাটি একটা বাসা আছে, আরামের বিছানা আছে, প্রতিদিন কতরকমের খাবার খেতে পারছি তবুও বিলাসিতা বা শখ আহ্লাদের কোনো একটা জিনিসের অভাববোধ হলেই আমাদের মন খারাপ হয়ে যায়, নিজেদেরকে অসুখী ভাবা শুরু করি। কেন এমন হয় বলতে পারো ইমাদ? কারণ মানুষ সবসময় ভুলে যায় জীবনের মূল উদ্দেশ্য। তারা ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীর জীবনকেই অনন্তকালের সুখের জায়গা মনে করে, এ কারণে সমাজের মানুষগুলো যে যেভাবে পারে অন্যকে বঞ্চিত করে, তাদের ন্যূনতম অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়ে নিজের বিলাস ব্যাসনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করে। কিন্তু তোমার মনে রাখতে হবে তুমি একজন মুসলিম, তোমার সাহসী বীর পূর্বপুরুষদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ইসলামের সেই শৌর্য-বীর্য ফিরিয়ে আনতে হবে। এইসব বঞ্চিত মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। তোমার মতো ছোট্ট ছোট্ট কিশোররাই তো একদিন এই দেশ ও পুরো পৃথিবী পরিচালনা করবে তাই তোমাদের জানতে হবে খলিফাতুন মুসলিমিনদের জীবনচরিত। তাদের রেখে যাওয়া পদচিহ্নে পা ফেলে ফেলে তোমাদের এগিয়ে যেতে হবে একই গন্তব্যের দিকে। ইমাদ তুমি তো খোলাফায়ে রাশেদার অনেক গল্প শুনেছো তাই না? 

- জি বাবা, শুনেছিই তো।

তোমার মনে নেই হযরত আবু বকর রা.-এর অনাড়ম্বর আর নেক আমলে ভরপুর জীবন এবং হযরত উমর রা.-এর কথা? যিনি রাতের আঁধারে খুঁজে ফিরতেন অসহায়, বঞ্চিত মানুষদেরকে এবং নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে যেতেন তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী।

-জি বাবা, আমার খুব মনে আছে, আমিও তো তাঁদের মতো হতে চাই। 

-হুম, জানি, আমার সোনার টুকরো ছেলে তুমিও তাঁদের মতোই হতে চাও।

তোমার বাবা একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তোমার অনেক শখ হয়তো পূরণ হয় না; সেসব নিয়ে কি তাহলে তোমার মন খারাপ করা চলবে? 

ইমাদ ছোট্ট করে হাসি দিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে দেয়- তা কখনো চলবে না বাবা।

বাবাও হেসে ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে দেন।

ততক্ষণে বাসার সামনে রিকশা চলে এসেছে। নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ এক প্রশান্তচিত্ত মন নিয়ে রিকশা থেকে নেমে যায় ইমাদ এবং ভাবতে থাকে পৃথিবী জুড়ে নেমে আসুক লক্ষ লক্ষ কিশোর যারা পৃথিবীকে সাজিয়ে তুলবে নতুন এক রূপ মাধুর্য দিয়ে, যেখানে আর কেউ শোষণ বঞ্চনার শিকার হবে না।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ