ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জমিদারদের আখড়া টাঙ্গাইল

ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জমিদারদের আখড়া টাঙ্গাইল

ভ্রমণ ইরফান তানভীর আগস্ট ২০২৩

এক জীবনে মানুষ কত কিছু হতে চায়। কারোর স্বপ্ন থাকে প্লেনে চড়বে, আর কারোর স্বপ্ন প্লেন চালাবে। কেউ আবার সেই প্লেন বানাবার স্বপ্নে বিভোর। আমার স্বপ্ন সেসব নয়। আমার স্বপ্ন প্লেনের মতো উড়ার কিংবা ভবঘুরে হয়ে ঘুরার। ছোটোবেলায় ‘‘জীবনের লক্ষ্য’’ রচনায় আমরা অনেকেই অনেক রকম স্বপ্নের কথা লিখেছি। কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক অথবা ব্যবসায়ী হওয়ার কথা লিখেছি। আমার যদি এখনও ছোটোবেলার মতো ‘‘জীবনের লক্ষ্য’’ রচনা লেখার সুযোগ আবার হতো, তবে আমি লিখতাম, আমি মরোক্কর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা আর ইতালির মার্কো পোলোর মতো পর্যটক হবো। পৃথিবীজুড়ে ঘুরব আর অপার বিস্ময় দেখে বিস্মিত হবো। আর তাই পৃথিবী দেখার আগে দেশ ভ্রমণে মনোনিবেশ করেছি। এবারের টাঙ্গাইল ভ্রমণটা ছিল হুটহাট করে। যদিও এর কদিন আগ থেকে আমার মনে টাঙ্গাইল নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছিল। বিশেষত টাঙ্গাইল জেলার করটিয়া মসজিদ, মহেড়া জমিদার বাড়ি, আর টাঙ্গাইলের পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা কালের সাক্ষী ছোটো বড়ো জমিদারবাড়ি, পোড়াবাড়ির চমচম, জামদানি শাড়ি আমার স্বপ্নালু চোখে অনেকদিন ধরেই ঘুরাফেরা করছে। এমনিতে ইতিহাস ঐতিহ্যের গন্ধ সবসময় আমাকে তাড়িত করে। কালের সাক্ষী কোনো দৃশ্যপট দেখলে হারিয়ে যাই আমি। পেছনের হাজার বছর আগের কোনো রোদঝলমল দুপুরের ছবি উদয় হয় আমার মনের আয়নায়। 


২৭ মে ২০২৩ শনিবার

বাড়ি থেকে আগের দিন শুক্রবারে ঢাকাতে বোনের বাসায় আসি। পরদিন রাতে, ছোটো ভাই তাওকীরসহ রাতে আলাপ তুলেছিলাম টাঙ্গাইল নিয়ে। তার ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে। এখানে বসেই আমরা সিদ্ধান্ত নেই, আগামীকাল আমরা টাঙ্গাইল যাচ্ছি। ঠিক টাঙ্গাইলের কোথায় কোথায় যাবো তা আমাদের যদিও ঠিক করা হয়নি। তবে টাঙ্গাইলে গিয়ে ঠিক করব- আমরা কোথায় যাবো এখন। ঢাকা থেকে খুব বেশি একটা দূর তো নয় টাঙ্গাইল। মাত্র চুরানব্বই কিলোমিটার। 


২৮ মে ২০২৩ রোববার

ফজরের নামাজ শেষে আমরা বোনের বাসা, ধানমন্ডি থেকে কমলাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হই। সাপ্তাহিক ছুটি শেষে কর্মদিবসের প্রথমদিন আজ। তাই মনে কিছুটা ভয়ও কাজ করছিল যে, নির্ধারিত সময়ে কমলাপুর পৌঁছাতে পারব কি না। আমরা ট্রেনে করেই টাঙ্গাইল যাবো ইচ্ছে করেছি। বাসেও যাতায়াত করা যায়। সেক্ষেত্রে আমাদেরকে বাসের জন্য গাবতলী যেতে হতো। আর যেহেতু দিনে গিয়ে দিনেই ফেরার ইচ্ছে আমাদের, তাই কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে আটটা ত্রিশ মিনিটের সুন্দরবন এক্সপ্রেসে করে যাওয়ার মনস্থির করি। ধানমন্ডি ১৫-এর কেয়ারি প্লাজার সামনে মোটামুটি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কমলাপুরের বাস ইনডেক্সের দেখা পেলাম। বাসের ভেতর যদিও যাত্রী ভর্তি, তবুও উঠে গেলাম, নির্ধারিত সময়ের ভেতর কমলাপুর স্টেশন যাওয়ার তাগিদে। 

একটু দেরি হলেও আমরা ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার আধঘণ্টা আগেই কমলাপুর এসে নামি। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরই- অর্থাৎ টাঙ্গাইল যাওয়ার আগেই, টাঙ্গাইলে আমাদের প্রবেশাধিকার নিয়ে শঙ্কা দেখা দিলো। টিকেট কাউন্টারের দায়িত্বরত লোকটি আমাকে জানিয়ে দিলো, সুন্দরবন এক্সপ্রেসের কোনো টিকেট নেই। আপনারা চাইলে পরেরটার টিকেট নিতে পারেন। যা দশটা ত্রিশ মিনিটে প্লাটফর্ম ছেড়ে যাবে। আমি ওনার কাছে স্ট্যান্ড টিকেট চাইলেও তিনি অপারগতা দেখান। এ শুনে আমরা কিছুটা ভাবনায় পড়ে গেলাম। দশটা ত্রিশের ট্রেনে করে গেলে আমাদের আজ টাঙ্গাইল গিয়ে তেমন কিছুই দেখা হবে না। আবার দিনে গিয়ে দিনেই আমাদের ফিরতে হবে। আমি আর তাওকীর প্লাটফর্মের বাইরে দাঁড়ানো একজন রেল কর্মকর্তাকে দেখে বিস্তারিত বললে- তিনি আমাদের আশস্ত করেন যে, ট্রেনের ভেতর থেকেই আপনাদের টিকেট দেওয়া হবে। এ তথ্য শুনে আমাদের শুকনো মনে যেন পানি ফিরে এলো। যেহেতু কোনো নির্ধারিত বগির আসন আমরা পাইনি, তাই ফাঁকামতন একটা বগিতে আমরা উঠে পড়ি। সিট দুটি খালি পড়ে আছে দেখে আমরা আপাতত সময়ের জন্য শোভন চেয়ারগুলোতে বসি। এ আসনগুলোতে বসেই আমরা গাজীপুর পর্যন্ত আসতে পেরেছি। গাজীপুর থেকে এ আসনগুলোর প্রকৃত মালিক উঠে পড়লে আমরাও দাঁড়িয়ে যাই। সুন্দরবন এক্সপ্রেস ছুটে চলছে খুলনার উদ্দেশ্যে। আমাদের গন্তব্য এই তো সামনে, টাঙ্গাইল। 


তখন দুপুর তেঁতে উঠেছে

আমরা যখন টাঙ্গাইল রেল স্টেশনে নামি, তখন ঘড়ির কাঁটায় বেলা এগারোটা পেরিয়ে। স্টেশনের বাইরে সূর্যের গনগনে আলোতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব। আমরা স্টেশনের বাইরের দিকের একটি ছোটো কনফেকশনারি দোকানদারের কাছে জানতে চাইলাম, আমরা যদি মহেড়া জমিদারবাড়ি যাই, তবে আমাদের কী করতে হবে? দোকানদার ভাইটি দুটি রাস্তা আমাদের বাতলে দিলেন। আপনারা যদি খুব সহজেই মহেড়া জমিদারবাড়ি যেতে চান, তাহলে এখান থেকেই সিএনজি যোগে যেতে পারেন। ভাড়া পড়বে তিনশ টাকা। আর না হয় টাঙ্গাইল বাস স্টেশন থেকে ঢাকা গাজীপুরের কোনো বাসে উঠলে আপনাদের নামতে হবে নাটিয়াপাড়া। সেখান থেকে মহেড়া জমিদারবড়ি আটোরিক্সায় জনপ্রতি ত্রিশ টাকা। আমরা দোকানদার ভাইটির বিশদ ডিরেকশন পেয়ে এবং আমাদের পকেটের অবস্থা বিবেচনা করে, অপশন নাম্বার টু বেছে নিলাম। রিক্সা করে প্রথমে এলাম টাঙ্গাইল বাস স্টেশন। সেখানে নেমেই রোদের অত্যধিক তেজে আমাদের পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। তৎক্ষণাৎ আমাদের মনে পড়ল, বাসা থেকে কেবল দুটি শুকনো পাউরুটি খেয়ে এসেছি। আমাদের কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। একটা দোকান দেখে আমরা পেটপুরে নাস্তা করে নিলাম। বলা যায় না, সারাদিন আর কিছু পেটে পড়বে কি না। আমরা নাশতা করে টাঙ্গাইলের জেলা সদর বাজারটিতে একটু চোখ বুলিয়ে দেখলাম। অন্য অনেক জেলার তুলনায় অবকাঠামো উন্নয়নের স্পর্শ খুব বেশি একটা পড়েনি টাঙ্গাইলের ওপর। তবে টাঙ্গাইলে ঢুকেই আপনার মনে হবে, আপনি ঐতিহাসিক কোনো অঞ্চলে চলে এসেছেন। যার ধুলোতে ইতিহাসের গন্ধ, উঁচু মিনারায় ইতিহাসের প্রলেপ ও দোকানগুলোর আদিম সভ্যতার ছাপ ইতিহাস অনুসন্ধানীদের ব্যাকুল করে তুলবে। যা আমাদেরও আন্দোলিত করেছে। 


জার্নি টু মহেড়া জমিদারবাড়ি 

বাসস্টেশন থেকে ঢাকাগামী ঝটিকা নামক বাসে উঠলাম। নাটিয়াপাড়া পর্যন্ত ঝটিকার ভাড়া জনপ্রতি ত্রিশ টাকা। লোকাল বাসের সাধারণত যে পরিস্থিতিগুলো হয়, একটু সামনে এগিয়ে আবার থামে। তারপর এমন নির্ভার ভঙ্গিতে পুনরায় যাত্রী ওঠানো হয়, যেন এদের কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই। আজ এই রাস্তার ধারে তাদের থেকে যেতেও কোনো সমস্যা নেই। যাত্রীরা কয়েকজন নেমে গেলে ড্রাইভারের টনক নড়ে। সে এবার টান দিলো জাপানের বুলেট ট্রেনের মতো। একটানে সে আমাদের গন্তব্য নাটিয়াপাড়া ফেলে আরও সামনে চলে এলো। আমরা যখন বললাম- ভাই, আমাদের নাটিয়াপাড়া নামিয়ে দিয়েন। আমরা মহেড়া জমিদারবাড়ি যাবো। হেল্পার লোকটি আমাদের নামিয়ে দিয়ে বলল, এখান থেকে রিক্সা নিয়ে মহেড়া চলে যান। একটি অটো রিক্সা ঠিক করে দরদাম করতে চাইলে সে আমাদের জানায়, আমরা নাটিয়াপাড়া- যেখান থেকে সরাসরি মহেড়া জমিদার বাড়ি যাওয়া হয়, তা কিছুটা পেছনে ফেলে এসেছি। যার কারণে ষাট টাকার ভাড়া আমাদের আশি টাকা দিতে হবে। আমরা রাজি হয়ে উঠে বসলাম অটোরিক্সার আরাম কেদেরায়। গনগনে দুপুর। মহাসড়ক পার হয়ে ডানদিকে বাঁক নিয়ে আমাদের রিক্সাটি চলতে লাগল মহেড়া জমিদার বাড়ির উদ্দেশে। চলতি পথে ড্রাইভারকে চাচা সম্বোধন করে গল্প জুড়ে দিলাম। মূলত গল্পের বিষয়বস্তু হচ্ছে, টাঙ্গাইল। উনি আমাদের করটিয়ার ঐতিহ্যবাহী শাড়ির হাট সম্পর্কে তথ্য দিলেন। করটিয়ার শাড়ির হাট বসে বৃহস্পতিবার। কিন্তু টাঙ্গাইলের বিখ্যাত জামদানি শাড়ির এ হাটে নাকি মানুষজন আরও দু তিনদিন আগ থেকেই আসতে শুরু করে। বিশেষ করে পাইকাররা। আমি পাইকারও নই, এমনকি শাড়ি নিয়ে দেওয়ার জন্য ঘরে প্রেয়সীও নেই। তবু আমার লোভ হলো, ইশ, যদি দেখে যেতে পারতাম করটিয়ার ঐতিহ্যবহী শাড়ির হাট। 

মহেড়া জমিদার বাড়ি 

মহেড়া জমিদার বাড়ির আঙিনা ঘিরে গড়ে উঠেছে টাঙ্গাইল পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার। ট্রেনিং সেন্টারটির তত্ত্বাবধানেই এখন এ জমিদার বাড়িটি পরিচালিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় জমিদার বাড়িটিকে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প হিসেবে গড়ে তোলা হয়। এর পরের বছর, ১৯৭২ সালে এখানে পুলিশ ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। যা পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে, পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে উন্নীত হয়। 


আমরা রিক্সা থেকে নেমে টিকেট কাউন্টারে গিয়ে দু’জনের জন্য দুটি টিকিট সংগ্রহ করি। জনপ্রতি টিকেট একশ টাকা করে। জমিদার বাড়িতে ঢুকে আমরা প্রথমে পুরো সীমানাটা একটা চক্কর দিলাম। এ জমিদার বাড়িটি স্পেনের করডোভা নগরীর আদলে নির্মিত। ১৮৯০ সালের দিকে-দুই ভাই, কালিচরণ সাহা ও আনন্দ সাহা মিলে এ জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেন। পুরা টাঙ্গাইল যেন জমিদারদের আস্তানা ভূমি। অসাধারণ সব জমিদার বাড়ির মধ্যে মহেড়া জমিদার বাড়ির নান্দনিক কারুকাজ ও পরিকল্পিত বাগান, পুকুর দেখে আপনার মনে হবে, বোধহয় চলে এলাম সুদূরের স্পেন অথবা সবুজের কোনো অভয়ারণ্যে। জমিদার বাড়ির মূল আকর্ষণ ছাড়াও এ বাড়িটিতে জমিদারদের প্রধান চারটি লজ রয়েছে। চৌধুরী লজ, মহারাজ লজ, আনন্দ লজ ও কালিচরণ লজ। কালিচরণ লজের একপাশে মিউজিয়াম। লজগুলোর নকশাদার কারুকাজ দেখে প্রথমে মনে হবে, এও বুঝি প্রাচীন বাড়ি। এত সুন্দর। প্রবেশপথে বিশাখা সাগর নামের বিশাল এক দিঘীর দেখা মিলবে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে মূল ভবনের পেছনে গেলে স্বচ্ছ পানির আধুনিক পুকুর দেখতে পাই। এতে দর্শনার্থীদের জন্য বসার পুকুরের মাঝবরাবর একটা ছাউনি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এটি পাসরা পুকুর। পাসরা পুকুরের রাস্তা ধরে এগুতেই আমরা বিশাখার দক্ষিণের বিশাল সবুজ আ¤্রকাননের দেখা পাই। মোটা মোটা আমগাছ, বিস্তর তার ডাল-পালা, কার্পেটের মতো নিচে ঘন ঘাসের প্রলেপ দেখে যে কারোরই চোখ আটকে যাবে। আম গাছগুলোকে দেখে মনে হবে, এসব গাছ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ মহেড়া জমিদার বাড়িতে। পাসরা পুকুর ছাড়াও এ জমিদার বাড়িতে রানি পুকুর নামে আরেকটি পুকুর আছে। বিশাল এ পুকুরের চারপাশে সবুজ গাছপালা, আর এর প্রাচীন ঘাটলা দেখে আমরা অপলক তাকিয়ে থাকলাম রানি পুকুরের দিকে। এর মধ্যেই টাঙ্গাইল পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের মসজিদ থেকে জোহরের আজান ভেসে এলো। আমরা আরও কিছুক্ষণ বিক্ষিপ্ত ঘুরাফেরা ও ছবি তুলে মসজিদে চলে যাই। 


ঠিক দুপুরে, বিষ্ণুপুরে 

মহেড়া জমিদার বাড়ি থেকে বের হয়ে আমরা এখন যাচ্ছি বিষ্ণুপুর। টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার থানার পাথরাইল ইউনিয়নের এক পুরনো গাঁ বিষ্ণুপুর। আমাদের গন্তব্য এখন সে বিষ্ণুপুর গাঁয়ে। মূলত টাঙ্গাইলের গ্রাম দেখা ও এখানে একটি পুরাতন কৃষি প্রতিষ্ঠান আছে, তা দেখে যাওয়ার বাসনা নিয়ে আমরা বিষ্ণুপুর যাওয়ার জন্য মনস্থির করি। বিষ্ণুপুরের সে কৃষি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রজব ভাইকে ফোন করলে তিনি আমাদের এখানে আসার পথ বাতলে দেন। রজব ভাইয়ের বাতলানো পথে পা দেওয়ার জন্য আমাদের প্রথমে আসতে হবে করটিয়া বাইপাস। করটিয়া বাইপাসে আমরা একটি অটো রিক্সা করে চলে যাই। ভাড়া নিয়েছে ষাট টাকা। সেখান থেকে বিষ্ণুপুর। দরদাম করে একটা রিক্সা ঠিক করে আমরা চললাম বিষ্ণুপুরের উদ্দেশে। কিছুক্ষণ পাকা রাস্তা চলার পর মেঠোপথের শুরু হলো। আহা, গ্রামীণ ঐতিহ্যের চিরচেনা সে মেঠোপথ। কংক্রিটের সয়লাবে এমন মেঠোপথের আজকাল তেমন দেখা মেলে না। মেঠোপথের শুরু হতেই আমাদের চোখে আদিম গ্রাম বাংলার ছবি ভেসে উঠলো। পথের পাশে খড়কুটোর স্তূপ, মাঠে ধান মাড়াইয়ের পর সিদ্ধ করে তা শুকাচ্ছেন গেরস্ত মা, বোনেরা। রাস্তার সীমানায় কাঁঠাল গাছের সারি থেকে ঝুলে থাকা কাঁঠাল আস্ত এক রূপসি বাংলার ছবি অঙ্কন করেছে। আমরা গ্রামের বাসিন্দা, তবুও বিষ্ণুপুরের এমন মেকিহীন আবেদন আমাদের মুগ্ধ করেছে। প্রশস্ত এক গেইটের সামনে এসে রিক্সা দাঁড়ায়। আমি পুরাতন শ্যাওলা পড়া সদর দরজাটার দিকে চোখ তুলে তাকাই। দরজার ওপরিভাগে একটি টিনের নেমপ্লেটে লেখা ‘‘বীজবিস্তার ফাউন্ডেশন’’ বিষ্ণুপুর, পাথরাইল, দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল।


আমরা ভেতরে ঢুকতেই নাকে একধরনের ভেষজ গন্ধ এসে লাগে। গন্ধটি বলে দেয়, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এ কৃষি প্রতিষ্ঠানটির জন্ম অনেক আগে। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এ প্রতিষ্ঠানটি। সদর দরজার ডানে ফিরতেই বিশাল এক হাঁসশূন্য খামার চোখে পড়ল। এত সবুজ, ছায়াঘন জায়গাটা, সূর্যের আলো প্রকাণ্ড গাছপালা ভেদ করে এখানে আসতে পারছে না। আমরা কিছুক্ষণ সবটা ঘুরে দেখলাম একা একা। প্রতিষ্ঠানটির কয়জন কর্মী এগিয়ে এসে জানতে চাইল, কারোর কাছে আসছেন? রজব ভাইয়ের কথা বললে এদের একজন ভেতরের কামরাগুলোর দিকে চলে যায়। সম্ভবত রজব ভাইকে খবর দিতে। রজব ভাই ফিরে এসে হাসিমুখে আমাদের কুশলাদি জানলেন। তারপর উনি আমাদের দেখাতে লাগলেন এখানকার প্রতিটি কাজ, পরিকল্পনা। প্রথমেই আমাদের তিনি জানালেন, এখানে বাণিজ্যিকভাবে হাতে বানানো মুড়ি, মোয়া, তিলের বিস্কুট ও আরও বেশকিছু খাবার তারা বানান। এখানে প্রতিপালন করা হয় বড়ো সাইজের মোরগ। সবই বাণিজ্যিকভাবে। রজব ভাই আমাদের একটু সামনে এগিয়ে নিয়ে দেখালেন বিশাল এক কর্মব্যস্ত এলাকা। মহিলাদের একটি দল এখানে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত। কেউ চাল ভাজছে, কেউ ধান শুকাচ্ছে, আর কেউ হাঁসের ডিম বাছাই করছে। সবই নিজেদের উৎপাদিত। পথ চলতে চলতে তিনি এখানকার বিশাল বিশাল গাছগুলোর বর্ণনা দিলেন। 

জানালেন তাদের প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনার কথা। কথা বলতে বলতে, বিশাল এক পুরাতন বট গাছের পেছনে একটা দোচালা ঘরে নিয়ে গেলেন আমাদের। সেখানে তাকের মধ্যে ছোটো ছোটো কলসিতে নানান ফল, ফসলের বীজ সংরক্ষণ করা। কথায় কথায় অনেক সময় পার হয়ে গেলে আমরা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। রজব ভাই বিদায় বেলায় আমাদের চা আর হাতে বানানো গুড়ের আঙ্গুর গজার ভাজা পরিবেশন করলেন। বিদায় বেলায় বিষ্ণুপুরের মেঠোপথে আমরা কিছু উচ্ছল শিশুর দেখা পেলাম। তাদের হাতে চকোলেট তুলে দিয়ে আমরা বিষ্ণুপুরের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে লাগলাম পাকা রাস্তার দিকে।

করটিয়া জমিদার বাড়ি মসজিদ

বিষ্ণুপুর থেকে বের হয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেই এবার আমরা করটিয়া যাবো। বিষ্ণুপুরের পাকা রাস্তা থেকে করটিয়া যাওয়ার জন্য আমরা একটা সিএনজিকে থামাই। এ সিএনজিতে করেই আমরা সোজা করটিয়া বাজার যাই। ভাড়া পড়েছে চল্লিশ টাকা। করটিয়া যে জমিদার বাড়িটি আছে তার আঙিনায় এখন স্কুল গড়ে উঠেছে। করটিয়ার এ জমিদার বাড়িটি দেখতে হলে আপনাকে স্কুল সময় আসতে হবে। আমাদের বিষ্ণুপুর থেকে আসতে আসতে চারটা পার হয়ে যাওয়ায় আমরা এ জমিদার বাড়িটি দেখার সুযোগ পেলাম না! কিছুটা ব্যথিত মনে বাঁক ঘুরতেই দেখি, এক ঐতিহাসিক মসজিদ আমাদের ডাকছে- আয় আয় করে। অবিশ্বাস্য আনন্দে আমাদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। জমিদার সা’দত আলী খান পন্নি এ মসজিদটি একুশ বছর ধরে নির্মাণ করেন। বর্তমানে মসজিদটি করটিয়া কেন্দ্রীয় মসজিদ নামে পরিচিত। পাথরের শিলালিপি দেখে বুঝতে পারলাম, এ মসজিদটির নির্মাণ শুরু হয় ১৮৭১ সালে। এ মসজিদটি প্রায় দেড় শ’ বছর আগের। মসজিদ লাগোয়া জমিদারদের পারিবারিক গোরস্থান। গোরস্থানের পাশাপাশি বিশাল ঈদগাহের প্রাচীন মিম্বর দেখে আমার মনে হলো এর নামই তো টাঙ্গাইল। এখানকার পথে প্রান্তরে, বাঁক ঘুরলেই আপনি ইতিহাস ঐতিহ্যের গন্ধ পাবেন। 

সর্বশেষ করটিয়া বাজারে চমচম খেয়ে করটিয়াকে বিদায় জানালাম। যে পথে এলাম, সে একই পথে আবার করটিয়া বাইপাস গিয়ে আমরা ঢাকার একটি বাসে উঠে পড়ি। টাঙ্গাইলের পথঘাট, বাড়িঘর, গাছপালা, মসজিদের মিনার, আমাকে যেন কানে কানে বলে গেল- আবার আসবে হে মুসাফির! আমি মনে মনে এরাদা করি, এ টাঙ্গাইলে আমাকে আবার আসতে হবে। বিকেলের কোমল সূর্যটা তখন পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ