আমাদেরও ভাষা আছে

আমাদেরও ভাষা আছে

তোমাদের গল্প মুহিব্বুল্লাহ কাফি ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আদিল তৃতীয় শ্রেণির নিয়মিত ছাত্র। সে মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করে। স্কুল ছুটি হলে অযথা কোথাও সময় নষ্ট করে না। সোজা বাসায় চলে আসে। বাসায় এসে হোমওয়ার্ক করে। সে মা-বাবার কথা শোনে। দুষ্টুমি করে না। মা-বাবাকে জ্বালাতন করে না।

আদিল প্রতিদিনের মতো আজও স্কুল ছুটি হবার পর সোজা বাসার দিকে আসছিল। হঠাৎ একটি পাখিওয়ালাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। পায়ে পায়ে সে পাখিওয়ালার কাছে গেল। খাঁচার ভেতর একটি পাখি আদিলকে দেখে বলতে লাগল, ময়না কথা কয় না। ময়না কথা কয় না।

আশ্চর্য! পাখি কথা বলছে। পাখির কথা শুনে আদিল আনন্দে মেতে উঠল। পাখি কথা বলতে পারে, আগে জানত না। কী মজা, কী দারুণ!

আদিল বাসায় এসে বাবাকে বলল, আচ্ছা বাবা, পাখিরাও কি আমাদের মতো কথা বলতে পারে? 

বাবা আদিলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ, পাখিরাও আমাদের মতো কথা বলতে পারে। কিন্তু পাখিদের কথা শেখাতে হয়। তাহলেই তারা কথা বলতে পারে। 

আদিল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে উসখুস করতে করতে বলল, আচ্ছা বাবা, সব ধরনের পাখিকে যদি কথা বলা শেখানো হয়, তাহলে কি তারা কথা বলতে পারবে?

বাবা বললেন, সব ধরনের পাখি তো কথা বলতে পারে না। 

আদিল বাবার আরো কাছে এসে বলল, তাহলে কোন কোন পাখি কথা বলতে পারে? 

বাবা বললেন, টিয়া, ময়না, ঘুঘু, শালিক এই পাখিদের কথা বলা শেখালে তবেই তারা কথা বলতে পারবে। 

আদিল বলল, বাবা, আমাকে একটা ময়না পাখি কিনে দাও-না। আমি ময়নাকে কথা বলা শেখাব। ময়না পাখি কথা বলা শিখে গেলে আমার সাথে কথা বলবে। বেশ মজা হবে।

বাবা বললেন, বাবা আদিল, পাখি কেনা ভালো নয়। পাখিদের বন্দি করে রাখা গর্হিত কাজ। 

কিন্তু কে শোনে কার কথা। আদিল বাবার বারণ না শুনে জেদ ধরে রইল। সে মুখটা ভোতা করে বসে থাকল। মা-বাবার সঙ্গে কথা বলে না আদিল। ঠিকমতো খায় না। শেষমেশ আদিলকে খুশি করতে বাবা একটা ময়না পাখি কিনে আনলেন। আদিল খাঁচায় বন্দি একটা ময়না পাখি দেখে হেসে উঠল। বাবাকে জড়িয়ে ধরল। সে ময়না পাখি পেয়ে ভারি খুশি। 

আদিল স্কুল থেকে এসেই ময়না পাখিকে কথা শেখাতে বসে যায়। ময়না পাখিকে বলে, এই পাখি আমার সাথে সাথে বলো, ময়না কথা কয় না। ময়না কথা কয় না। 

এভাবে আদিল এক সপ্তাহ ময়না পাখিকে কথা বলা শেখাল। কিন্তু ময়না পাখি একটা কথাও শেখেনি। আদিল ময়না পাখিকে কথা বলতে বললে ময়না পাখি উলটো আদিলের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তাতে আদিলের ভীষণ রাগ চড়ে যায়। সে আবার বাবার কাছে গিয়ে বলল, বাবা, ময়না পাখি তো কথা বলে না। আদিলের কথা শুনে বাবা হেসে দিয়ে বললেন, বলবে, ময়না পাখি কথা বলবে। তবে আরো দেরিতে। ময়না পাখির সামনে বারবার কথা বলতে হবে। তুমি ময়না পাখির সামনে তার নাম ধরে ডাকবে। দেখবে হঠাৎ একদিন ময়না তোমার সাথে কথা বলছে। 

আদিল ময়না পাখির সামনে ঘোরে আর বলে, ময়না কথা কয় না। আদিল ময়না পাখিকে খেতে দেয় আর বলে, ময়না কথা কয় না। কিন্তু তবুও ময়না পাখিটা কোনো কথা-ই বলে না। এভাবে কিছুদিন কেটে গেল। ময়না পাখিকে আদিল কোনো কথা বলা শেখাতেই পারল না। তবুও আদিল আশা ছাড়েনি। সে ময়না পাখিকে কথা বলা শেখাবেই। 

আদিল স্কুল যায়। বাসায় এসে হোমওয়ার্ক করে। ময়নাকে কথা বলা শেখায়। এভাবে কেটে গেল আরো কিছুদিন। তবুও ময়না পাখিটা একটা কথাও শিখল না। উলটো ময়না পাখি আদিলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। আদিল ময়না পাখির ওপর রাগ করে রাতে ঘুমোতে গেল। ঘুমাল আদিল।

আদিল এবার ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখল তার ময়না পাখি কথা বলা শিখে গেছে। কী মজা, কী মজা! আদিল আনন্দে যেন আধখানা। এবার সে লক্ষ করল, ময়না পাখিটা তাকে বলছে, আদিল, তোমাদের ভাষা বাংলা। তোমাদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিরা উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তোমাদের কিছু দামাল ছেলেরা জীবন দিয়ে বাংলাভাষাকে অর্জন করেছিল। এক দেশের-জনগোষ্ঠীর ওপর অন্য দেশের-জনগোষ্ঠীর ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়।

ময়না পাখি আদিলকে আরো বলতে লাগল, আদিল, তুমি এটা ভেবে দেখেছ কি? আমরা পাখি। আমাদেরও নিজস্ব ভাষা আছে। আমরাও আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলি। আমরা একে অপরের সঙ্গে আমাদের ভাষায় গল্পে মেতে উঠি। আমরা স্বাধীন হয়ে উড়তে ভালোবাসি। যেথায়-সেথায় আমরা মনের আনন্দে, দুই পাখা প্রসারিত করে, স্বাধীনভাবে ওড়াই আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু তোমরা মানুষ আমাদের স্বাধীনতাকে হরণ করো। আমাদের ওপর অত্যাচার করো। আমাদেরকে খাঁচায় বন্দি করে রাখো। আমরা নিরীহ বলে আমাদের মায়ের ভাষার ওপর তোমাদের ভাষাকে চাপিয়ে দিতে দাও। এটা কি অন্যায় নয়, অত্যাচার নয়? পশ্চিম পাকিস্তানিরা তোমাদের ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ায় তোমরা বিক্ষোভ মিছিল করেছিলে। কিন্তু আমরা তো নিরীহ। আমাদের তো বিক্ষোভ মিছিল করার শক্তি নেই। 

ময়না পাখিটার চোখের কোণ দিয়ে পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। ময়না পাখিটা কাঁদতে কাঁদতে আবার বলল, তোমরা মানুষ। তোমরা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। কিন্তু তোমরা আমাদের নিরীহ পেয়ে আমাদের স্বাধীনতা হরণ করো। আমাদের ছোট্ট একটি খাঁচায় বন্দি করে রাখো। জোর করে তোমাদের ভাষা আমাদের ওপর চাপিয়ে দাও। ময়না পাখিটা এবার কান্না করতে লাগল। 

আদিলের ঘুম ভেঙে গেল। মোরগ ডাকা ভোর। আদিলের মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবল, সত্যিই তো। আমি ময়না পাখিকে খাঁচায় বন্দি করে রেখেছি। তাকে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বাংলাভাষা তার ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছি! এটা তো ঠিক নয়। তারও তো ভাষা আছে।

আদিল এসব ভাবতে ভাবতে খাঁচায় বন্দি ময়না পাখির কাছে গেল। এবার সে ময়না পাখিকে বলল, ময়না পাখি, আমি তোমার প্রতি অনেক অন্যায় করেছি। আমি আমার বাংলাভাষা তোমার ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। যেমনটা চেয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। আমি ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা দিয়ো। আজ ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ। আমাদের মাতৃভাষা দিবস। এই মাতৃভাষা দিবসে আমি আর তোমাকে জোর করে আমার বাংলাভাষা শেখাব না। এই ছোট্ট খাঁচায় বন্দি করেও রাখব না। আজ আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো। তুমি স্বাধীনভাবে উড়বে। তুমি তোমার ভাষায় কথা বলবে। তোমার মায়ের সঙ্গে। বন্ধুদের সঙ্গে। তোমার পাড়া পড়শিদের সঙ্গে।

আদিল ময়না পাখির খাঁচাটা নিয়ে তাদের বেলকনিতে আসল। সূর্যের মিষ্টি মিষ্টি রোদ যেন বেলকনিতে মেলা বসিয়েছে। আদিল সেই মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে খাঁচা থেকে ময়না পাখিটা বের করল। দু’হাতে ধরে ময়না পাখিকে একটা চুমু দিয়ে দু’হাত ছেড়ে দিলো আদিল। ময়না পাখি তার ভাষায় চিঁচিঁ করতে করতে ফুড়–ৎ করে উড়াল দিলো। আদিল মুচকি হেসে তাকিয়ে রইল ময়না পাখির উড়ন্ত দুই ডানার দিকে। ময়না পাখি উড়ে গিয়ে বসল আদিলদের সামনের বিল্ডিংয়ে। তাকাল আদিলের দিকে। যেন আদিলকে ধন্যবাদ জানাল। এবার পাখিটা উড়ে দূরে চলে গেল। আদিল চেয়েই রইল।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ