আমাদের মহানবী সা.

আমাদের মহানবী সা.

প্রচ্ছদ রচনা মুহাম্মদ আবু সুফিয়ান সেপ্টেম্বর ২০২৩

আদম আ. পৃথিবীর প্রথম মানুষ। প্রথম নবী। আল্লাহ তায়ালা আদম আ.-কে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, যেন তিনি আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলেন। তাঁর সন্তানদেরও আল্লাহর কথা মেনে চলতে শিক্ষা দেন। আদম আ.-এর কাজের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল পৃথিবীর কেন্দ্রভূমি হেজাযে। হেজাযের একটি অংশ মক্কা। আদম আ. তাঁর দায়িত্ব পালন শেষে ইন্তেকাল করেন।

দিন যায় রাত আসে। রাত যায় দিন আসে। নদীর একূল ভাঙে, ওপার গড়ে। কত জনপদ বিরান হয়ে যায়। আবার বিরান কোনো ভূমিতে গড়ে ওঠে নতুন জনপদ। আদম আ.-এর স্মৃতিবিজড়িত হেজাযের মক্কাও একসময় বিরান হয়ে পড়ে।

শত শত বছর চলে গেছে এর মধ্যে। একসময় আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলেন মক্কাকে আবাদ করবেন। মুখর করবেন মানুষের পদচারণায়। আল্লাহর ইবাদতে আবার করে তুলবেন সজীব। তখন পৃথিবীতে নবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ইবরাহিম আ.। আল্লাহ তায়ালা নবী ইবরাহিমকে নির্দেশ দিলেন জনবিরান মক্কায় তাঁর স্ত্রী হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাঈলকে রেখে আসতে। আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ছিল, তাঁদের মাধ্যমে জনবিরান মক্কা প্রাণ ফিরে পাবে।

ইবরাহিম আ. আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করলেন। হাজেরা ও ইসমাঈলকে রেখে এলেন মক্কায়। ইসমাঈল ধীরে ধীরে বড়ো হলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকেও নবী মনোনীত করলেন। আলাইহিস সালাম। নবী ইসমাঈল আ.-এর সন্তান-সন্ততিতে মক্কা আবার ধীরে ধীরে মুখর হয়ে উঠল।

আল্লাহ তায়ালা মক্কায় তাঁর ঘর স্থাপনের নির্দেশ দিলেন নবী ইবরাহিমকে। যেন মানুষেরা সেখানে এসে আল্লাহর ইবাদত করতে পারে। ইবরাহিম আ. পুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে মক্কায় স্থাপন করলেন আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ। তিনি দোয়া করলেন, পুত্র ইসমাঈলের বংশধরদের মধ্য থেকে যেন আল্লাহ তায়ালা রাসূল প্রেরণ করেন। সেই রাসূল যেন মানুষকে শিক্ষা দিতে পারেন কিতাব ও হিকমত। মানুষকে করতে পারেন পরিশুদ্ধ ও সুন্দর।

নবী ইবরাহিমের সেই দোয়ার কথা পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ অপেক্ষায় থাকল একজন রাসূলের, যিনি এসে পৃথিবীকে ভরিয়ে দেবেন ন্যায় ও সৌন্দর্যে। যিনি মানুষকে শিক্ষা দেবেন সত্য কথা বলতে। ন্যায়পরায়ণ হতে। তিনি হবেন অসহায়ের সহায়। নিরাশ্রিতের আশ্রয়। অন্যায়, অসত্য, অসুন্দরকে তিনি মুছে ফেলবেন। সত্য, সুন্দর ও ন্যায়কে বিকশিত করবেন।


মা আমিনার কোলে

নবী ইসমাঈল আ.-এর ইন্তেকালের পর হাজার বছর পার হয়ে গেছে। মক্কা এখন জমজমাট একটি শহর। বহু দূরের দেশ থেকে মানুষ এখানে আসে আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ জিয়ারত করতে। মক্কার লোকেরাও দেশ-বিদেশে যায় ব্যাবসা করতে। এভাবে মক্কার মানুষদের সাথে হয় বহু দূর-দূরান্তের মানুষের লেনদেন, সম্পর্ক ও আত্মীয়তা। 

মক্কায় যারা বসবাস করেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা গোত্রের নাম কুরাইশ। কুরাইশরা নবী ইসমাঈল আ.-এর বংশধর। তারা বায়তুল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু ততদিনে তারা নবী ইবরাহিম ও ইসমাঈল আ.-এর দেখানো পথ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। এক আল্লাহর ইবাদত বাদ দিয়ে তারা শুরু করেছে মূর্তির পূজা। তারা অনবরত মিথ্যা কথা বলছে। মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছে। অসহায়ের ওপর জুলুম করছে। চারদিকে অশান্তি ও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে। ভালো মানুষেরা চিন্তায় পড়ে গেছে, কী করে এ অবস্থার পরিবর্তন করা যায়।

কুরাইশদের অন্যতম নেতা আবদুল মুত্তালিব। আবদুল মুত্তালিবের দশ পুত্র। তাদের একজনের নাম আবদুল্লাহ। আবদুল্লাহর স্ত্রীর নাম আমিনা। আবদুল্লাহ বিয়ে করেছেন পাশের শহর ইয়াসরিবে। পাশের মানেও একেবারে কাছাকাছিও নয়। মক্কা থেকে ইয়াসরিবের দূরত্ব প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। 

৫৭০ সাল। আবদুল্লাহ বিদেশে ব্যাবসা করে মক্কায় ফেরার সময় ইন্তেকাল করেন। এর তিন মাস পর এলো রবিউল আউয়াল মাস। এই মাসের দ্বিতীয় সোমবার আমিনার ঘর আলোকিত করে জন্ম হয় এক পুত্রের। তাঁর নাম রাখা হয় মুহাম্মাদ। মুহাম্মাদের আগমনে সকলে খুশি হন। 


আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সা.

ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে উঠেন মুহাম্মাদ। যখন তিনি বুঝতে শেখেন, তখন দেখেন, চারদিকে চলছে অন্যায়-অবিচার। মানুষ মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। একজন আরেকজনের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। দুঃখী-অসহায় মানুষের কষ্টে মুহাম্মাদ ব্যথিত হন। তিনি ভাবতে থাকেন, কীভাবে মানুষকে ভালো করা যায়। কীভাবে অন্যায় থেকে মানুষকে ফেরানো যায়। কীভাবে মানুষের জীবনকে করা যায় সুন্দর ও সফল। এসব ভাবতে ভাবতে মুহাম্মাদ সাহায্য চান আল্লাহর। যেন আল্লাহ তাকে পথ দেখান। তিনি নিরিবিলিতে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য মাঝে মাঝে চলে যেতেন পাশের এক পাহাড়ে। পাহাড়টির নাম হেরা। হেরার গুহায় বসে তিনি বায়তুল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকতেন আর ভাবতেন। আর দোয়া করতেন আল্লাহর কাছে।

৬১০ সাল। রমজান মাস। মুহাম্মাদের বয়স তখন চল্লিশ। একদিন হেরা গুহায় আসেন আল্লাহর ফিরিশতা জিবরিল আ.। তিনি মুহাম্মাদকে জানান, আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নবী মনোনীত করেছেন। এখন থেকে তিনি আল্লাহর নবী ও রাসূল। এখন থেকে মানুষকে ডাকতে হবে আল্লাহর পথে। ডাকতে হবে সত্যের পথে। সকল অন্যায় বন্ধ করতে হবে। ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখন থেকে মুহাম্মাদ হলেন আল্লাহর রাসূল। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

আল্লাহর নির্দেশমতো মুহাম্মাদ সা. মানুষকে ডাকলেন আল্লাহর দিকে। মূর্তিপূজা বাদ দিয়ে এক আল্লাহর ইবাদত করতে বললেন তিনি। মিথ্যা, অন্যায়, অবিচার থেকে দূরে থাকতে বললেন। মানুষের উপকার করতে বললেন। ছোটোদের স্নেহ করতে বললেন। বড়োদের শ্রদ্ধা করতে বললেন। কিন্তু খুব কম মানুষই তাঁর কথা শুনল। মক্কার অনেক খারাপ মানুষ মুহাম্মাদ সা.-এর বিরোধিতা করল। মুহাম্মাদ সা.-কে কষ্ট দিলো। এমনকি শেষ পর্যন্ত তারা মুহাম্মাদ সা.-কে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করল।

ইয়াসরিবের লোকেরা প্রতি বছর বায়তুল্লাহ জিয়ারত করতে আসে মক্কায়। মুহাম্মাদ সা. তাদেরকেও আল্লাহর পথে ডাকলেন। তারা মহানবীর ডাকে সাড়া দিলেন। ইসলাম গ্রহণ করলেন। মুসলিম হয়ে গেলেন ইয়াসরিবের অনেক লোক। তারা দেখলেন, মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর সাথিরা মক্কায় নিরাপদ নন। মক্কার লোকেরা তাঁদের কষ্ট দিচ্ছে। তখন ইয়াসরিবের মুসলিমরা মুহাম্মাদ সা.-কে তাদের কাছে চলে আসার দাওয়াত দিলেন। অবশেষে মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর সাথিরা ইয়াসরিব চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। 


মদিনায় এলেন মহানবী

৬২২ সাল। মহানবী মুহাম্মাদ সা. মক্কা থেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন ইয়াসরিবে। এখন থেকে ইয়াসরিবেই থাকবেন তিনি। ইয়াসরিবে চারদিকে তাই সাজ সাজ রব। সবার মনে আনন্দ। তাদের জীবন যেন শুরু হচ্ছে নতুনভাবে। নতুন সাজে। এমনকি ইয়াসরিব শহরের নামও নতুন করে রাখা হয়েছে। নতুন নাম হয়েছে মদিনাতুন-নবী। অর্থাৎ নবীর শহর। সংক্ষেপে মদিনা।

মদিনার এক ছোট্ট ছেলে আনাস। বয়স দশ বছর। বাবা বেঁচে নেই। মায়ের আদরে-যতেœ বড়ো হচ্ছেন। মা উম্মে সুলাইম। খুবই দরিদ্র তারা। মদিনার এক প্রান্তে তাদের ছোটো ঘর। 

আনাসের মা উম্মে সুলাইমও নবিজির আসার খবর পেয়েছেন। সম্পর্কে তিনি নবী মুহাম্মাদ সা.-এর খালা হন। অবশ্য খুব নিকটাত্মীয় না, একটু দূর সম্পর্কের খালা। তিনি দেখলেন, সবাই যে যা পারে উপহার নিয়ে যাচ্ছেন নবীজির জন্য। উম্মে সুলাইমের তো উপহার দেওয়ার মতো তেমন কিছু নেই। তিনি তাঁর ছেলে আনাসকে সাথে নিয়ে নবীজির কাছে উপস্থিত হলেন। বললেন-

‘হে আল্লাহর নবী। সবাই আপনাকে কিছু না কিছু উপহার দিচ্ছে। আমার তেমন কিছু নেই। এ হলো আমার ছেলে আনাস। সে বেশ চটপটে ও বুদ্ধিমান। একেই আপনার কাছে উপহার দিচ্ছি। সে লিখতে জানে। আপনাকে ছোটো ছোটো কাজে সহযোগিতা করতে পারবে।’

নবীজি সা. খুশিমনে আনাসকে কাছে টেনে নিলেন। নবীর স্নেহে আনাস দিন কাটাতে লাগল। সব সময় সে নবীজির সাথে থাকত। আবার কখনও এক দৌড়ে বাড়ি গিয়ে মায়ের সাথে সময় কাটিয়ে আসত। এভাবে দশ-দশটি বছর আনাস প্রিয় নবীর আদর-স্নেহে কাটিয়েছেন। এই দীর্ঘ দশ বছর নবীজির কাছ থেকে কত কিছু শিখেছেন, কত কী দেখেছেন, জেনেছেন- তার কি হিসেব আছে!

আনাস বলেন- ‘আমি দশ বছর নবীজির সাথে সাথে ছিলাম। ছোটো ছোটো কাজ করে দিয়ে তাকে সাহায্য করতাম; অথচ তিনি কখনও আমাকে বকাঝকাও করেননি। এমনকি কখনও এ কথাও বলেননি যে, তুমি এটা কেন করেছ? ওটা কেন করোনি?’

নবীজি সব সময় সবাইকে আগে সালাম দিতেন। এমনকি ছোটোদের সালাম নেওয়ার জন্য তিনি অপেক্ষা করে থাকতেন না। আনাস রা. বলেন, নবীজি শিশু-কিশোরদেরও আগে সালাম দিতেন। একদিন নবীজি আমাকে আদরের সাথে বললেন- “ও প্রিয় ছেলে! তুমি যখন তোমার বাড়িতে যাও, তখন বাড়ির লোকজনকে সালাম দেবে। এই সালাম দেওয়া তোমার জন্য হবে বরকতময়। আর তোমার ঘরের লোকদের জন্যও হবে বরকতময়।”

আরেকদিন আনাস নবীজির সাথে খেতে বসেছেন। নবী সা. বললেন- “ছেলে! বিসমিল্লাহ বলে খাও। আর প্লেটের একদিক থেকে খাও।”


ছোটোদের প্রিয়জন তিনি

আনাসের ছোটো ভাই কাবশা। তার ডাকনাম আবু উমাইর। আবু উমাইরের একটি পোষা পাখির ছানা আছে। বুলবুলি ছানা। আরবিতে বলা হয় নুগাইর। ‘নুগাইর’ শব্দের অর্থ-ছোট্ট পাখির ছানা।

আবু উমাইর নুগাইরকে খুব ভালোবাসে। হাতের ওপর দানা নিয়ে নুগাইরকে খাওয়ায়। নুগাইরও তাকে চেনে। টুকটুক করে তার হাত থেকে দানা খুঁটে খুঁটে খায়। তাদের খুব ভাব হয়। 

পাড়ার ছেলেরা যখন মাঠে খেলতে যায়, তখন আবু উমাইর খেলে নুগাইরের সাথে। নুগাইর ফুড়–ত করে উড়ে বসে ঘরের চালে, নাহয় উঠোনের খুঁটির ওপর। আবার এসে বসে আবু উমাইরের কাঁধে। খিদে পেলে চিউক চিউক করে ডেকে ওঠে। আবু উমাইরও যেন বোঝে তার ভাষা। সে খুদ নিয়ে আসে। টুকটুক করে খায় নুগাইর।

কখনও-বা আবু উমাইর ছড়া কাটে। নুগাইর চুপ করে শোনে। ছড়া শেষ হলে আবার চিকচিক করে গান গায় নুগাইর। আবু উমাইর সে গান শোনে। এভাবেই দিন কাটছিল তাদের। মহা আনন্দে। হাসিখুশিতে।

কিন্তু একদিন! একদিন নুগাইরের কী যেন অসুখ হলো। মুখ ভার করে থাকল সারাদিন। তারপর মারা গেল নুগাইর। ছোট্ট বন্ধু পাখির ছানা নুগাইরের মৃত্যুতে খুব কষ্ট পেল আবু উমাইর। খুব করে কাঁদল সে। সারাদিন কিছুই খেল না। তারপর নুগাইরকে গর্ত খুঁড়ে কবর দিয়ে এলো।

কয়েকদিন পরও তার মন ভালো হচ্ছিল না। মুখ ভার করে ঘরের দাওয়ায় বসেছিল সেদিনও। এসময় তাদের বাড়ির দিকে আসছিলেন প্রিয় নবী। নবীজিকে আসতে দেখে আবু উমাইরের মন কিছুটা হালকা হলো। তিনি আবু উমাইরকে খুব আদর করেন। নবীজি আবু উমাইরের কাছে এসে ছড়া কাটলেন-

‘ইয়া আবা উমাইর

মা ফাআলান নুগাইর।’

‘ওহে আবু উমাইর

কী করল ও নুগাইর।’

নবীজির মতো এত বড়োজনের মুখে তাকে নিয়ে ছড়া কাটতে দেখে ফিক করে হেসে ফেলল আবু উমাইর। তার মনের মেঘ কেটে গেল। মন ভালো হয়ে গেল ছোট্ট আবু উমাইরের।


রহমের নবী তিনি

আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মাদ সা. ছিলেন রহমের নবী। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন গরীব-দুঃখীকে। ভালোবাসতেন সবুজ গাছপালাকেও। ভালোবাসতেন পশুপাখিসহ সবাইকে। তাই তো আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “হে নবী! আপনাকে তো বিশ^বাসীর জন্য রহমত হিসেবে পাঠানো হয়েছে।” 

রাসূল সা. কোনো অভাবীকে ফেরাতেন না। সবাইকেই সাধ্যমতো সহযোগিতা করতেন। গরীব-দুঃখীর দুঃখ দূর করতে তিনি সবাইকে উপদেশ দিতেন। উপদেশ দিতেন, সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতে। দেখা হলে সালাম দিতে। সবার সাথে সুন্দর ব্যবহার করতে। নবীজি বলতেন-“তোমরা বেশি বেশি সালাম দেবে এবং মানুষকে খাওয়াবে।”

নবিজির এই শিক্ষায় তাঁর সাথিরা উৎসাহিত হতেন। তারাও সকলের প্রতি দয়া দেখাতেন। সকলকে সহযোগিতা করতেন। এভাবে সবদিকে একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরি হয়। 

একদিন নবিজির স্ত্রী আয়িশা রা. ঘরে বসে আছেন। তখন তাঁর ঘরে এলেন এক মহিলা। সাথে ছোট্ট দুটি মেয়ে। তাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে, তারা ক্ষুধার্ত। আয়িশা রা.-এর ঘরে ছিল শুধু তিনটি খেজুর। খাওয়ার জন্য আর কিছুই ছিল না। কিন্তু তিনি জানতেন নবিজির উপদেশের কথা। তাই তিনি নিজে না খেয়ে সেই খেজুর তিনটি মহিলাকে দিলেন। মহিলা তার মেয়ে দুটির হাতে একটি করে খেজুর দিলেন। আরেকটি নিজে খাবেন বলে হাতে নিলেন। মেয়েরা খেজুর পেয়েই সাথে সাথে খেয়ে ফেলল। তারপর তারা মায়ের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকল। মা কী আর করবেন। নিজের ভাগের খেজুরটিও দুভাগ করে মেয়েদের দিয়ে দিলেন। পরম মমতায় মেয়েদের খাওয়ালেন। 

আয়িশা রা. মায়ের এমন স্নেহ দেখে খুব খুশি হলেন। নবিজি ঘরে এলে আয়িশা রা. সেই মহিলা ও তার মেয়েদের ঘটনাটি নবিজিকে বললেন। তিনিও মায়ের মমতার কথা শুনে খুশি হলেন। তিনি বললেন-“এই মমতাই তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে।”


আরেকদিনের কথা। নবীজি কোথাও যাচ্ছিলেন। তাঁর সাথিরাও ছিলেন তাঁর সাথে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ নবীজির খুব প্রিয় একজন সাথি। তিনিও আছেন।

অনেকখানি পথ চলার পর তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। বিশ্রামের জন্য বিরতি দেওয়া হলো। সবাই যার যার মতো করে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। কেউবা দু-একজন একসাথে হয়ে গল্প করছিলেন। 

নবীজিও একটু দূরে গেলেন কোনো প্রয়োজনে। ফিরে এসে তিনি দেখলেন, একটি পাখি লোকজনের মাথার ওপর ঘুরেফিরে ওড়াউড়ি করছে। খুব ওপরে না; একেবারে মাথার কাছাকাছি। নবীজি বুঝলেন, পাখিটি বিপদে পড়েছে। তিনি সাথিদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন-

- ‘কে এ পাখিটির ছানা নিয়ে এসে তাকে কষ্ট দিয়েছে?’

- ‘আমি এনেছি হে আল্লাহর রাসূল।’ নবীর সাথিদের একজন বললেন।

- ‘তার ছানা তাকে ফিরিয়ে দাও।’ নবীজি আদেশ দিলেন।

পাখিটির ছানা ফিরিয়ে দিলে সে শান্ত হলো। কোনো প্রাণীকে কেউ শুধু শুধু কষ্ট দিলে নবীজি তা খুবই অপছন্দ করতেন। এমনকি তিনি একটি পাখির বিষয়েও ছিলেন যত্নবান!


বিদায় প্রিয় নবীজি

নবীজির নেতৃত্বে ও তাঁর সাথিদের চেষ্টায় আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হলো। পুরো আরবে ফিরে এলো শান্তি। ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হলো। অন্যায় দূরীভূত হলো। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর হয়ে গেল।

৬৩২ সাল। হিজরি ১০ম সালের রবিউল আউয়াল মাস। আল্লাহর রাসূল সা.-এর এবার বিদায়ের সময় হলো যেন। তিনি অসুস্থ হলেন। মদিনায় মসজিদে নববীর পাশে তাঁর ঘরে ইন্তেকাল করলেন তিনি। বিদায় নিলেন মহানবী। মহানবীর বিদায়ের বেদনায় মুষড়ে পড়লেন তাঁর সাথিরা। কিন্তু তাঁরা সেই বেদনাকে সাথে করেও উঠে দাঁড়ালেন আবার। কারণ, নবীজি তাঁর দায়িত্ব শেষ করে বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু তাঁদের দায়িত্ব যে এখনও বাকি।

পৃথিবীর দিকে দিকে ইসলামের অমিয় বাণী নিয়ে রাসূলের সাথিরা ছুটলেন। পৃথিবীর দিকে দিকে আল্লাহর দ্বীনের সৌন্দর্য পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করলেন তাঁরা। একটি নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। হৃদয় থেকে হৃদয়ে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। মহানবী থেকে তাঁর সাথিদের হৃদয় হয়ে আমাদের পর্যন্ত। এক নতুনের স্বপ্ন নিয়ে আমরা জেগে রই। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। আল্লাহর দ্বীনকে ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন। এই সবুজের স্বপ্ন নিয়ে আমরা পথ চলি।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ