অসহায় জীবন

অসহায় জীবন

তোমাদের গল্প ইসমাঈল সাজিদ নিশান জুলাই ২০২৩

তুরস্কের ভয়াবহ ভূমিকম্পের কবলে আজ হাজার হাজার মানুষ পৃথিবী থেকে নিখোঁজ। শত শত বালক, কিশোর বড়ো বড়ো ভবনের নিচে চাপা পড়ে আছে। কেউ কেউ নিহত। সে রকমই এক অসহায় বালক ফারছেদ। রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ হাহাকার শব্দ শুনতে পায়। ঘুমের মধ্যে তার মা তাকে ডাকছে আতঙ্কিত শব্দে। ফারছেদ উঠো বাবা ফারছেদ। হঠাৎ যেন এক ছিটকে খাট থেকে পড়ে যায় ফারছেদ। মা সোকেসের সাথে বাড়ি খেয়ে মায়ের মাথা থেকে পানির কলের মতো রক্ত ঝরতে থাকে। তারপর আর কিছু মনে নেই। ফারছেদের যখন জ্ঞান ফেরে তখন তার পুরো শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। সে দেখে তার চারপাশ অন্ধকার। সে এখন কোথায় সে নিজেও জানে না।

হয়তো কোনো বড়ো দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে আছে। খুবই তৃষ্ণার্ত সে। শরীরের সব শক্তি যেন একদমই শেষ। মায়ের রক্তভরা মুখ ছাড়া আর কিছু মনে নেই তার। আদৌ তার পরিবারের কেউ বেঁচে আছে কি না সেটাও জানে না সে। মা, ভাই, বোন, বাবা সবার মুখ ভাসছে তার চোখে। চোখ থেকে অশ্রু ঝরার মতো পানিও তার দেহে নেই। এভাবে আর কতক্ষণ কতদিন কাটবে। ফারছেদ বাঁচার আশাটুকু ছেড়ে দেয়। এভাবে পানি ছাড়া, খাবার ছাড়া, একটি দেয়ালের চাপায় যেখানে হাত পা-টুকু নাড়ানোর সুযোগ নেই সেখানে বেঁচে থাকার আশাটুকু বৃথা। ফারছেদের জীবন এখন শেষ পর্যায়ে। তার চোখ যেন বন্ধ হয়ে আসছে। ভেসে উঠছে পরিবারের আপন মানুষের মুখগুলো, ফারছেদ মৃত্যুর কাঠগড়ায় নাড়া দিতেই যাচ্ছিল। ঠিক তখনই যেন এ সূর্যের লাল আভা মুখে এসে লাগে তার। ঝাপসা ঝাপসা বোঝা যাচ্ছিল কিছু একই পোশাক পরা লোক। তারপর আর কিছু মনে নেই ফারছেদের। যখন তার জ্ঞান ফিরে তখন সে নিজেকে হসপিটালের বিছানায় আবিষ্কার করে। হঠাৎ এক সাদা পোশাক পরিহিতা নার্স তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে এখন কেমন লাগছে বাবা, যেন তার মায়ের হাতের কোমল স্পর্শ লেগেছে তার মাথায়। কিন্তু কই এটি তো তার মা নয়। তারপর নার্সকে ফারছেদ জিজ্ঞেস করে তার মা বাবা কোথায়? তখনই নার্সের মুখ অনেক গম্ভীর হয়ে যায়। নার্স ফারছেদকে বলে তোমরা যে শহরে থাকতে সেখানে অনেক বড়ো ভূমিকম্পে পুরো শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

ভূমিকম্পের সাত দিন পর রেসকিউ টিমের সদস্যরা তোমাকে ভবনের একদম চাপার নিচ থেকে উদ্ধার করেছে।

ফারছেদ জিজ্ঞেস করে তাহলে আমার মা বাবা।

নার্স বলে ওই ভবন থেকে অনেককে উদ্ধার করা হয়েছে কিন্তু তারা সবাই মৃত। অনেককে পাওয়াও যায়নি। শুধু তোমাকেই জীবিত উদ্ধার করে ওই ভবন থেকে। ফারছেদ জিজ্ঞেস করে ওই ভবন থেকে উদ্ধার করা লাশগুলো কি আছে? হ্যাঁ সব মর্গে রাখা আছে। ফারছেদকে ওই মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে কেউ তার পরিবারের সদস্য কি না তা দেখার জন্য। ফারছেদ মর্গে গিয়ে দেখে সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশের স্তূপ। তাকে এক এক করে লাশের মুখ দেখানো হচ্ছিল। তবে তার পরিবারের কোনো সদস্যদের পাওয়া যাছিল না। তার ভবনের কিছু মানুষকে চিনতে পারলেও বেশির ভাগ মানুষকে চিনতে পারছিল না। কারণ কারো মুখ ছিল থ্যাঁতলানো, আর কারো মুখ ছিল বিকৃত।

ওই ভবনের ছোটোদের লাশগুলো আলাদা রাখা হয়েছিল। তাদের লাশগুলো যখন দেখানো হচ্ছিল তখন সে এক এক মুখ দেখে কেঁদে উঠছিল। সবাই ছিল তার খেলার সাথী- রায়াত, রিভান, রাওফোস, আকিস। সবার সাথে দশ দিন আগেও একসাথে খেলা করেছিল। আর আজ তারা মর্গের লাশ হয়ে শুয়ে আছে। দশ দিন আগেও ফারছেদ জানতো না যে তার জীবনে আসবে এক বিভীষিকাময় দিন। একটা দুই বছরের মেয়ে শিশুকে দেখে সে জোরে কেঁদে ওঠে। কতটা অসহায় হলে একটি ছেলে এভাবে কেঁদে ওঠে নার্স ভাবছিল। দুই বছরের শিশুটি ছিল তার বোন। হাতটা পুরো থেঁতলে গেছে। তার বোনের সেই আদর মাখা ডাক, তার ছোটো ছোটো হাত দিয়ে তাকে চুল টেনে দিত। এসব ভেবে সে কেঁদে ওঠে। তারপর তাকে কিছু মানুষের কাটা অংশগুলো দেখানো হলো: কারো হাত, কারো পা। কান্না কান্না স্বরে অংশগুলো দেখছিল ফারছেদ। একটি হাত তার বেশ চেনা চেনা লাগছিল। তারপর হাতের আংটি দেখে বোঝা গেল তার মায়ের আদর মাখা ডান হাত। অতি শব্দে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ফারছেদ। যে হাত দিয়ে তার মা তাকে খাবার খাইয়ে দিত মাথায় হাত বুলিয়ে দিত সে হাত আজ লাশের কাটাছেঁড়ার অংশ। অসহায়ত্ব যেন তার জীবনকে ঝপসা করে দিলো। এই বিভীষিকাময় ভূমিকম্প তার থেকে সবাইকে কেড়ে যেন তাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল যে, জীবনের বাকি পথটা তাকে অসহায়ত্বের সাথে একাই চলতে হবে। সে রাতের কথা এখনো মনে পড়ে ফারছেদের যখন তার পরিবারের সবাইকে শেষ দেখেছিল।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ