Home স্বাস্থ্য কথা খুব ছোঁয়াচে এক রোগ -ডা. এহসানুল কবীর

খুব ছোঁয়াচে এক রোগ -ডা. এহসানুল কবীর

চিকেন পক্স হলো এক ধরনের ভাইরাস ঘটিত রোগ যেটা ‘ভেরিসেলা জোস্টার’ নামক ভাইরাস দিয়ে হয়। এটাকে বাংলাতে ‘জলবসন্ত’ বলা হয়। আরেক ধরনের পক্স রয়েছে যেটাকে ‘গুটিবসন্ত’ বলা হয় যা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর থেকে বিশ্বে আজ বিরল। এখন আর সেটা দেখা যায় না। ইদানীং ‘মাংকিপক্স’ নামে আরেক ধরনের পক্সের নাম শোনা যাচ্ছে যা আরো বেশি ভয়ঙ্কর। তবে চিকেন পক্স মারাত্মক কোনো রোগের নাম নয়। যত্ন সহকারে চিকিৎসা করলে ২-৩ সপ্তাহের মধ্যেই সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে যায়।

✪ চিকেন পক্স কখন হয়?
সাধারণত শীতের শেষের দিকে এবং বসন্তের আগমনের প্রাক্কালে আরামদায়ক আবহাওয়ায় রোগজীবাণুর বিস্তার বেশি হয়। তাই এ সময় চিকেন পক্স বেশি দেখা যায় অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রাদুর্ভাবটা বেশি থাকে। তবে এটা যে কোনো সিজনেই এটা হতে পারে।

✪ চিকেন পক্স কাদের বেশি হয়?
সব বয়সীদেরই হতে পারে। তবে ১-১৪ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদেরই বেশি হতে দেখা যায়। তবে গর্ভবতী মা এবং তার গর্ভস্থ বা নবজাতক সন্তান বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।

✪ চিকেন পক্সের লক্ষণগুলো কী কী?
প্রথমত, হালকা জ্বর দিয়ে শুরু হয়। এর সাথে গায়ে ব্যথাও হয়। এর ২-৩ দিন পরে গায়ে লালচে পানি বা পুঁজযুক্ত ফুসকুড়ি বা র‍্যাশ দেখা দেয়। সেটা ক্রমশ মুখে, গলায়, ঘাড়ে, পিঠে, বুকে এবং শরীরের অন্যত্র জায়গায় দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি গায়ে প্রচণ্ড চুলকানি হয়। এর সাথে কাশি, ক্ষুধামন্দা, অনিদ্রা, অবসাদগ্রস্ততা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ থাকতে পারে।

✪ চিকেন পক্সের রোগী কতদিন ছোঁয়াচে থাকে?
এটা খুবই ছোঁয়াচে রোগ। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, থুতু দ্বারা এমনকি তার কাছে থাকলে বা তার পক্সের রস বা পুঁজ অন্যজনের গায়ে লাগলেও চিকেন পক্স হতে পারে। সাধারণত গায়ে র‍্যাশ ওঠার ২-৩ দিন আগে থেকে অর্থাৎ জ্বরের শুরু থেকে চামড়ার খোসা ওঠা বা শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ছোঁয়াচে সময়কাল থাকে। সেটা প্রায় ৭-১০ দিন হতে পারে।

✪ চিকেন পক্সের পরিণতি কী হতে পারে?
সাধারণত ২-৩ সপ্তাহ পরে এটা নিরাময় হয়ে যায়। তবে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের পরবর্তীতে আবারো চিকেন পক্স হতে পারে। এ ছাড়া যথাযথভাবে চিকিৎসা না করলে পানিশূন্যতাসহ বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন, যেমন- গলার ইনফেকশন (টনসিলাইটিস), নিউমোনিয়া, সেপসিস বা রক্তের ইনফেকশন, মস্তিষ্কের ইনফেকশন বা এনকেফালাইটিস ইত্যাদি কঠিন রোগও হতে পারে। এ ছাড়া মুখে বা গায়ে ছোট ছোট গর্ত হয়ে কালো স্থায়ী দাগ বসে যেতে পারে।

✪ চিকিৎসা কী?
প্রথম কথাই হচ্ছে বিশ্রামে থাকা। পক্সের কারণে প্রচণ্ড চুলকানি হয় বিধায় নখ দিয়ে চুলকানো ঠিক নয়। কারণ ত্বক খুব স্পর্শকাতর অঙ্গ। তাতে ত্বকের ইনফেকশন বেড়ে যেতে পারে। সে জন্য নখ কেটে রাখতে হবে। প্রতিদিন আলতো করে গা মুছিয়ে দিতে হবে। গায়ে কোনো প্রকার তেল, লোশন ইত্যাদি লাগানো যাবে না। শরীরের চুলকানি প্রতিরোধে ‘ক্যালামিন লোশন’ মাখলে আরাম বোধ হতে পারে। পক্সের রোগীর ঘর আলো বাতাসে পরিপূর্ণ থাকতে হবে।
যেহেতু চিকেন পক্স ভাইরাসজনিত রোগ, তাই এন্টি-ভাইরাল জাতীয় ওষুধ যেগুলো বাজারে পাওয়া যায়, যেমন-এসাইক্লোভির, ভ্যালাসাইক্লোভির ইত্যাদি যা চিকেন পক্স হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সেবন করতে পারলে গায়ে জ্বালা-যন্ত্রণা ও ত্বকে ফোস্কা দাগ কম হয়। এ ছাড়া জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, চুলকানির জন্য এন্টি-হিস্টামিন ও ভিটামিন জাতীয় ওষুধের পরামর্শ দেওয়া হয়। এ সময় সুতির হালকা জামাকাপড় পরা উচিত এবং প্রতিদিন দুই বেলা জামাকাপড় চেঞ্জ করে পরা ভালো। চিকেন পক্স সেরে যাওয়ার পরেও কিছুদিন বাইরের রোদে ঘোরাফেরা না করাই উচিত। কারণ সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি ত্বককে ক্ষতি করতে পারে।

✪ প্রতিরোধের উপায় কী?
বিশ্বজুড়ে চিকেন পক্সের টিকা আসার পরে এটার প্রাদুর্ভাব কমে গেলেও বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে এখনো তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। চিকেন পক্সের ভ্যাকসিন ২টা ডোজ কমপ্লিট করলেই বলা যায় ৯৪ শতাংশ সুরক্ষিত থাকা যাবে। তবে শিশুদের এক বছরের পর থেকে এই ভ্যাকসিন দিতে হয়। এরপর ৪ থেকে ৬ বছর পরে আরেকটা বুস্টার ডোজ দিতে হয়। কারণ এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা থাকে প্রায় পাঁচ বছরের মতো। আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা ঘরে রাখা উচিত। যেসব শিশু-কিশোরদের চিকেন পক্সের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়নি, তাদেরকে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরে রাখাই শ্রেয়।

✪ এ সময় খাবারের কোন বিধি নিষেধ আছে কি?
এ সময়টাতে খাবারের কোনো বিধিনিষেধ নেই। শরীরের আর্দ্রতা ধরে রাখতে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। এ ছাড়া দুধ, স্যুপ, ডাবের পানি, গ্লুকোজের পানি, ফলের রস ইত্যাদি পান করা যেতে পারে। বেশি বেশি উচ্চমাত্রার প্রোটিন জাতীয় খাবার (মাছ, মাংস, ডাল, ডিম, দুধ) ও ফল খেতে হবে। তবে লেবু জাতীয় ফল অ্যালার্জি অ্যালার্জি নয়। খাবারে তেল-মশলা হালকা রাখতে হবে। তবে চর্বি জাতীয় খাবার (মাখন, পনির, নারিকেল, চীনাবাদাম, চকোলেট, কিশমিশ) এড়িয়ে চলা ভালো। কারণ এগুলো প্রদাহ বাড়িয়ে দেয়। তবে খাবারটা যেন হালকা গরম ও ফ্রেশ হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আগের থেকে খাবারে অ্যালার্জির ইতিহাস থাকলে সেই খাবারগুলো পরিহার করতে হবে।

✪ চিকেন পক্সের দাগ তোলার উপায় কী?
নিমপাতা ফুটিয়ে সেই পানি দিয়ে গোসল করলে পক্সের দাগ কমিয়ে আনা যায়। ডাবের পানিরও ভালো ভূমিকা রয়েছে এক্ষেত্রে। পক্সের দাগ তোলার জন্য কিছু ক্রিম বা লোশন বাজারে আছে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ বা লোশন ব্যবহার করা উচিত নয়।

SHARE

Leave a Reply