Home খেলার চমক আরব ফুটবলে ‘বসন্ত’ -আবু আবদুল্লাহ

আরব ফুটবলে ‘বসন্ত’ -আবু আবদুল্লাহ

গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে কাতারে বসেছিলো বিশ্বকাপ ফুটবল। প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে চমৎকার খেলেছে আরব বিশ্বের দেশগুলো। অঞ্চলটি বরাবরই ফুটবল বিশ্বে পিছিয়ে ছিলো; কিন্তু নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ আসরে অঞ্চলটির দলগুলো যেন গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে।
এ প্রসঙ্গে তোমাদের জানিয়ে রাখি, আরব বিশ্ব বলতে আরবি ভাষাভাষী মানুষের দেশগুলোকে বোঝানো হয়। এর মধ্যে সৌদি আরব, ইরাক, কুয়েত, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আছে। তেমনি আছে উত্তর আফ্রিকা মহাদেশের কয়েকটি দেশ- মিসর আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো, প্রভৃতি। (ইরান মধ্যপ্রাচ্যের দেশ হলেও আরব দেশ নয়, ইরানের প্রধান ভাষা ফারসি)।
আরব বিশ্বের ছোট একটি দেশ কাতারে বসেছিলো বিশ্বকাপের আসর। নিজের অঞ্চলে, পরিচিত দর্শকদের সামনে বিশ্বকাপ পেয়ে যেমন মানসিকভাবে এগিয়ে ছিলো আরব দেশগুলো, তেমনি ছিলো তাদের ভালো করার ক্ষুধা। যার ফলাফল আমরা দেখেছি মরক্কোর ইতিহাস সৃষ্টিকারী নৈপুণ্যে। দলটি আফ্রিকা মহাদেশ ও আরব বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে এবার খেলেছে সেমিফাইনালে। সেমিতে ফ্রান্সের বিপক্ষে দুর্দান্ত লড়াই করার পরও হেরে গেছে। এ ছাড়া দুই ফাইনালিস্ট ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনা প্রথম রাউন্ডে হেরেছে আরবদের কাছে।
যেভাবে এসেছে সাফল্য
বিশ্বকাপে মরক্কোর সাফল্য কোনো হুট করে পাওয়া অর্জন নয়, অথবা নয় কোনো দুর্ঘটনা। বরং এই সাফল্য তাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা আর পরিশ্রমের ফসল। এবারের বিশ্বকাপের ড্র অনুষ্ঠিত হওয়ার পর কেউ ভাবেনি মরক্কো দ্বিতীয় রাউন্ডে যাবে। কারণ দলটির সাথে এফ গ্রুপে সঙ্গী হয়েছিলো ক্রোয়েশিয়া ও বেলজিয়াম। ক্রোয়েশিয়া ২০১৮ আসরের রানার আপ। বেলজিয়াম সে আসরে হয়েছিলো তৃতীয়; কিন্তু অ্যাটলাস লায়ন্স হিসেবে পরিচিত মরক্কো তার গর্জনে কাঁপিয়েছে বিশ্ব। ক্রোয়েশিয়াকে পেছনে ফেলে আর বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্মকে শূন্য হাতে বাড়ি পাঠিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আশরাফ হাকিমিরা। এরপর নকআউট পর্বে হারিয়েছে স্পেন ও পর্তুগালকে। দুর্ঘটনা একদিন বা এক ম্যাচে ঘটানো সম্ভব, বারবার নয়।
মরক্কোর এই ফিরে আসার গল্পটার শুরু বছর দশেক আগে। ফুটবল নিয়ে মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশটিতে চালু হয় বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদ ফুটবল অ্যাকাডেমি। এই অ্যাকাডেমির নির্মাণব্যয় ছিলো ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
রাজধানী রাবাতের কাছে আড়াই বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা এই অ্যাকাডেমিতে বিশ্বমানের বেশ কয়েকটি মাঠ, আবাসন ব্যবস্থা, ফিটনেস সেন্টার, চিকিৎসা কেন্দ্রসহ ফুটবলারদের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই তৈরি করা হয়েছে। অ্যাকাডেমিতে খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের খোলামেলা পরিবেশে বসবাসের সুযোগ দিতে তৈরি করা হয়েছে একটি গ্রাম।
ইউরোপের ফুটবল অ্যাকাডেমিগুলোর মানের কথা মাথায় রেখে গড়া হয়েছে এই অ্যাকাডেমি। এখানেই শেষ হয়, এই অ্যাকাডেমির ১২টি শাখা খোলা হয়েছে মরক্কোর ১২টি অঞ্চলে। এই শাখাগুলোর মাধ্যমে সারা দেশ থেকে কিশোর প্রতিভা অন্বেষণ করে পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় অ্যাকাডেমিতে। সেখানে তাদের লেখাপড়া আর ফুটবল শেখা চলে এক সাথে। নারী ও পুরুষ- দুই শাখাতে অ্যাকাডেমির রয়েছে পৃথক কার্যক্রম।
আর ছিলো একদল দক্ষ ফুটবল কর্মকর্তা। যারা কথার ফুলঝুরি না ছুটিয়ে কাজ করেছেন নীরবে। কনফেডারেশন অব আফ্রিকান ফুটবলের সেক্রেটারি জেনারেল মরক্কোর নাগরিক মউয়ান হাজিকে পদত্যাগ করিয়ে দেশে আনা হয়। তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় ফুটবলার তৈরির প্রকল্পের। মোট কথা পুরো ফুটবল কাঠামোটাই পাল্টে যায় মরক্কোর।
এরপর দেশটি একের পর এক আফ্রিকান ফুটবলের আসর আয়োজন করতে থাকে। বিভিন্ন দেশ প্রীতিম্যাচ খেলতে আসে সেখানে। মরক্কো তার অ্যাকাডেমিতে বিভিন্ন দলকে ফ্রি ক্যাম্প করার সুযোগ দেয়। এর ফলে প্রচুর ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় দেশটির ফুটবলাররা। আফ্রিকার যেসব দেশের ফুটবল অবকাঠামো শক্ত নয়, তাদের হোম ভেন্যু হিসেবে নিজেদের স্টেডিয়ামগুলো ব্যবহারের সুযোগ দেয় মরক্কো।
এছাড়া ফিফা বিশ্বকাপে ভালো করার জন্য মরক্কো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী ফুটবলারদের মরক্কোর হয়ে খেলতে আগ্রহী করেছে। এবারের বিশ্বকাপ দলের সবচেয়ে বড় তারকা হাকিম জিয়েচের জন্ম ও বেড়ে ওঠা নেদারল্যান্ডসে অভিবাসী হওয়া একটি মরোক্কান পরিবারে। ডাচদের হয়ে বয়সভিত্তিক ফুটবলেও খেলেছেন হাকিম; কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পিতৃভূমি মরক্কোকেই বেছে নেন চেলসির এই উইঙ্গার।
স্পেনে জন্ম নেয়া ডিফেন্ডার আশরাফ হাকিমি বেড়ে উঠেছেন রিয়াল মাদ্রিদের অ্যাকাডেমিতে। এখন খেলছেন মেসি নেইমারের সাথে পিএসজিতে। অধিনায়ক রোমাইন সাইসও জন্ম নিয়েছেন ফ্রান্সে। ক্লাব ফুটবলও খেলছেন ইউরোপে। তারা সবাই বিশ্বকাপে মরক্কোর জার্সিতে মাঠে নেমেছেন। এই খেলোয়াড়দের সাথে স্থানীয়ভাবে বেড়ে ওঠা একদল প্রতিভাবান ফুটবলারের সমন্বয়েই মরক্কো এবার কাতারে পা রেখেছে।
সৌদি আরব, তিউনিসিয়ার চমক
আরব বিশ্বের আরেক দেশ তিউনিসিয়াও বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে হারিয়েছে রানার আপ হওয়া ফ্রান্সকে। গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে তারা ফ্রান্সকে ১-০ গোলে হারিয়ে অঘটনের জন্ম দেয়। ইউরোপের আরেক দেশ ডেনমার্কের বিপক্ষেও গোলশূন্য ড্র করেছে তিউনিসিয়া।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটিতেও আরব বিশ্বের দলটি দারুণ খেলেছে। ৫৯ শতাংশ বল দখলে রেখেও দুর্ভাগ্যজনভাবে তারা হেরে গেছে ১-০ গোলে। ওই ম্যাচটি ড্র করতে পারলেও তিউনিসিয়া দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে যেত। তবু দলটি ফুটবলে যে উন্নতির ছাপ দেখিয়েছে, তা আশা জাগানিয়া।
এবারের বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা তাদের প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেছিলো সৌদি আরবের বিপক্ষে। সবাই ভেবেছিলো মেসিদের কাছে ¯্রফে উড়ে যাবে সৌদিরা। এর আগে ২০১৮ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে রাশিয়ার কাছে ৫-০ গোলে হেরেছিলো তারা।
সেই ইতিহাস মনে রেখেই হয়তো এমন পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিলো; কিন্তু ঘরের কাছে বিশ্বকাপ খেলতে নেমেছে আমূল পাল্টে যাওয়া এক দল। তারা মেসিদের ২-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপের প্রথম অঘটনের জন্ম দেয়। যা দেশটির ফুটবলের উন্নয়নেরই আভাস দেয়।
স্বাগতিক কাতার কোনো ম্যাচ জিততে না পারলেও তুলনামূলক ভালো ফুটবল খেলেছে। দলটির বেশ কয়েকজন ফুটবলার বিশ্ব কাপের মাঠে নজর কেড়েছেন। যার ফলে সামগ্রিকভাবে এবারের বিশ্বকাপকে উপলক্ষ করে আরব বিশে^র ফুটবলে নতুন বাঁকবদল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

SHARE

Leave a Reply