Home নিয়মিত রহস্যভেদ উদ্ধার অভিযান -খন্দকার নূর হোসাইন

উদ্ধার অভিযান -খন্দকার নূর হোসাইন

পাঁচ.
একটানা এভাবে বসে থাকতে ভালো লাগছে না সিয়ামের। উপায় নেই, থাকতে বাধ্য সে। নিজেকে গাছের পেছনে লুকিয়ে টনির বাড়ির ওপর চোখ রেখেছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল কিছু ঘটেনি। চোখ আর সায় দিচ্ছে না এ কাজে। ঘুমকেই লাখ টাকার সম্পত্তি মনে হচ্ছে এখন। ঝিমুনি চলে এসেছে। চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে জেগে থাকার শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছে। গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে ঝোপের মধ্যেই বসে রইল সিয়াম।
হঠাৎ ভারী দুটো পদশব্দে নড়েচড়ে বসল সে। ঘুম ছুটে পালালো বহুদূরে। টনির বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো একজন। পিঠে ঝোলানো ব্যাগ। আলো আঁধারিতে চেহারা চেনা যাচ্ছে না। কে ওটা? টনি? প্রয়োজনের টানে ফিরে এসেছে? তবে কি সে ইচ্ছে করেই গা ঢাকা দিয়েছে?
লম্বা পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছে লোকটা। একটু দ্বিধা করল সিয়াম, শেষে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিলো। দ্রুত হাঁটছে অচেনা অতিথি। সতর্কতার প্রয়োজনই মনে করছে না। আকাশে সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। কমে এসেছে চাঁদের আলো। ছায়ামূর্তির মতো দেখাচ্ছে লোকটাকে। এটা মানুষ নাকি অন্য কিছু? এত জোরে হাঁটছে কেন? খুব ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যায়, বাম পাটা সামান্য বাঁকা। মুদ্রা দোষ মনে হয়। টনির হাঁটা দেখেছে সে। এ লোক টনি হতেই পারে না।
মাটিতে পড়ে আছে গাছের মরা পাতা। খুব সাবধানে এগোচ্ছে সিয়াম। সামান্য একটু শব্দ হলেই ঘুরে দাঁড়াবে লোকটা। পাঁচ মিনিটেই পিচঢালা রাস্তায় পৌঁছে গেল ওরা। বিপত্তিটা বাধলো এখানেই। রাস্তায় ফেলে রাখা প্লাস্টিকের বোতলে পা পড়ল সিয়ামের। সামান্য শব্দই বোমা ফাটানোর মতো মনে হলো। থেমে গেল লোকটা। পাই করে পেছনে ঘুরে দাঁড়ালো। চোখাচোখি হয়ে গেল সিয়ামের সাথে। এমনটা আশা করেনি সিয়াম। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সে। লোকটা এগিয়ে এলো। এবার খেয়াল করল সিয়াম, কালো মাস্ক পরে আছে সে। তাকিয়ে আছে সিয়ামের দিকে। ভাবখানা এমন, সিয়ামের ভেতরটা পড়ে নিচ্ছে।
‘কে আপনি?’
জবাব দিলো না লোকটা। আরো কাছে এসে দাঁড়ালো। আচমকা ধাম করে ঘুসি বসিয়ে দিলো সিয়ামের চোয়ালে। ঘুসি খাওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। একটাই যথেষ্ট মনে হলো। চোখে জ্বলে উঠলো হাজারো তারা। ঝাপসা হয়ে এলো সবকিছু। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল সে।
একসময় খসখসে নরম কিছুর স্পর্শে জেগে উঠল সে। গালটা ঘষে দিচ্ছে কেউ। আঠালো ভেজা কিছু লেগে আছে পুরো চেহারায়। চোখ খুলতেই যা দেখার দেখে ফেললো। ওয়াক থু! কোন ফাঁকে বাঘা চলে এসেছে। হতচ্ছাড়াটা এতক্ষণ ওর নাক, চোখ সব চেটে দিচ্ছিল। উঠে বসে আগুন চোখে বাঘার দিকে তাকালো সিয়াম। ওকে জেগে উঠতে দেখে খুশিতে লেজ নাড়াচ্ছে পাজি কুকুরটা।
গায়ের শার্টটা খুলে মুখ মুছে নিলো সে। বাড়ি গিয়ে সাবান দিয়ে গোসল করা লাগবে। বহু কষ্টে বমি আটকে বাড়ি ফিরে এলো সে।

ছয়.
‘গত রাতেও ভূত দেখা গেছে গ্রামে। রাত হলেই তেমাথার মোড় থেকে ভেসে আসে রক্ত হিম করা ভূতের হাসি।’ পলাশ বলল, ‘শুনলাম রাতে নাকি কেউ টয়লেটেও যাচ্ছে না ভয়ে, সন্ধ্যার আগেই সব সেরে নিচ্ছে।’
ছোটকাকুর লাইব্রেরি রুমে বসে আলোচনা করছিল ওরা।
সকালে আবার মিলিত হয়েছে খুদে গোয়েন্দারা।
‘টনি বাড়ি ফেরেনি। এইমাত্র পান্না ফুপুর ওখান থেকে ঘুরে এলাম।’ দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে সিয়াম, ‘ফুপু রাতে বাড়ি ছিল না। সুযোগ পেয়ে তালা ভেঙে টনির রুমে ঢুকেছিল কেউ। টনির পরিধেয় পোশাকসহ অনেক কিছু হাতিয়ে নিয়ে গেছে।’
‘মূল্যবান কিছু নিয়েছে?’ ফাহিম জিজ্ঞেস করল।
‘না, সাধারণ জিনিসপত্র।’ সিয়াম বলল।
‘চোরে এ কাজ করেনি। ফাহিম, কিছু বুঝতে পারছো?’ পলাশ বলল।
‘টনিকে শক্তভাবে ফাঁসানোর জন্য ওর ব্যবহৃত জিনিসপত্র দরকার। টনিকে যারা ফাঁসাতে চায় তাদের কেউ এটা করতে পারে।’ ফাহিম বলল।
‘অচেনা লোকজনের সাথে ওঠাবসা করছে কেরামত মিয়া। গত রাতেই দেখলাম।’ একটু ভেবে পলাশ বলল, ‘মনে হচ্ছে তার পেছনেও কেউ লেগেছে। মাথায় যেভাবে বাড়ি খেয়ে জ্ঞান হারালো।’
‘হু, গোপনে কোনোকিছু করছে কেরামত মিয়া। জানতে হবে আমাদের।’ পলাশকে বলল ফাহিম, ‘তুমি আজ থেকে কেরামত মিয়াকে অনুসরণ করবে।’
‘তার আর দরকার হবে না,’ হাঁফাতে হাঁফাতে রুমে ঢুকলো সজল। ‘তোরা এখনো বসে আছিস? ওদিকে যা হবার হয়ে গেছে।’
‘কী হয়েছে?’ ফাহিম বলল।
‘কেরামতকে মিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কিডন্যাপ করেছে।’
‘কী?’ উঠে দাঁড়ালো ফাহিম।
‘জলদি চল, বাড়িতে গেলে সূত্রটুত্র পেতে পারিস।’
কেরামত মিয়ার বাড়ি বেশি দূরে নয়। বাইসাইকেল নিয়ে পাঁচ মিনিটেই চলে এলো ওরা।
বাড়ির আঙিনায় অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল রুবেল। ফাহিম জিজ্ঞেস করল, ‘কীভাবে হলো এসব?’
‘সকাল থেকে মামাকে পাওয়া যাচ্ছে না। মামি তার মায়ের ওখানে। মামা একাই ছিল রুমে। মোবাইল বিছানায় পড়ে আছে।’
দেরি না করে কেরামত মিয়ার রুমে চলে এলো ওরা। সবকিছু এলোমেলো হয়ে আছে। দুটো কাচের গ্লাস ও একটা আয়না ভাঙা। কাচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। বোঝাই যাচ্ছে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে।
রুবেলকে ফাহিম জিজ্ঞেস করল, ‘এতকিছু হয়ে গেল, আপনি কোথায় ছিলেন?’
‘বাড়িতে। কিন্তু এসব কখন হয়েছে জানতে পারিনি। বড়ো বাড়ি, এক পাশে থাকলে অন্য পাশে কী হচ্ছে বোঝা যায় না।’
জবাবটা ফাহিমের মনঃপূত হলো না। কিছু বলল না এ নিয়ে।
‘পুলিশকে ফোন করেছেন?’ সিয়াম জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ, পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছি। ওরা এলো বলে।’
ক্লু পাওয়ার আশায় রুমের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুঁজলো ফাহিম ও পলাশ। সিয়াম ও সজল বাইরে গেল খুঁজতে। বাড়ির পেছনের গেইট খোলা। বোঝা গেল ওদিক দিয়ে কেরামত মিয়াকে নিয়ে গেছে। হতাশ হলো ওরা। শক্ত মাটিতে পায়ের ছাপও পড়েনি।
একটু পরই সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি এলো। সবকিছু শুনে নোট করে নিলো একজন। ভাঙা কাচের টুকরোগুলো প্যাক করে নিলো পুলিশ। রুবেলকে আরো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে চলে গেল ওরা। ভাবনায় পড়ে গেল ফাহিম। কী শুরু হলো গ্রামে? একটা খুনের পর দু’জন নিখোঁজ। কাকে আগে খুঁজবে? টনি নাকি কেরামত মিয়া? কেরামত মিয়া কোনোকিছুর সাথে জড়িয়ে পড়েছে। খলিলের খুন হবার পেছনে তার কোনো হাত থাকতে পারে? তাতে তার কী লাভ? মনে মনে ছক কষে নিলো ফাহিম। রাতেই হবে ওদের উদ্ধার অভিযান। অনেক কিছু জানতে হবে আজ।

সাত.
হাতে কোনো সূত্র না পেয়ে ভূতের পিছু নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফাহিম। গোয়েন্দা প্রধানের নির্দেশে রাস্তার পাশে খাদের মধ্যে লুকিয়ে আছে সিয়াম ও পলাশ। ফাহিম ও সজল বাজারের ওদিকে আছে। সামনে তেমাথা। মোড়ে বেঞ্চ রাখা আছে। ঘড়িতে রাত সাড়ে নটা। রাস্তায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আরো পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে হলো ওদের। পৌনে দশটায় ব্যাটারি চালিত ভ্যান এসে দাঁড়ালো মোড়ের কাছে। ভ্যানে দুজন আরোহী। একজন চালক। একজনের হাতে বড়ো ব্যাগ। চোখের পলক ফেলা ভুলে গেল দুই কিশোর।
একজন বেঞ্চের ওপর ব্যাগটা রেখে ভেতর থেকে বের করল দুটো সাদা আলখেল্লা। দু’জন দুটো পরে নিলো। সবশেষে পরল মুখোশ। ফাহিমকে টেক্সট করে করে জানিয়ে দিলো সিয়াম।
এরাই তাহলে মানুষকে ভয় দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। নিশ্চয়ই শখের বসে বেকার ভূত হওয়ার লোক এরা নয়। ভূতের খেলার আড়ালে অন্য কিছু চলছে। গ্রামের দিকে পা বাড়ালো ভূত দুটো। দু’ ধাপ দিতে নিজেরাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। বাজারের ওদিকে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল। দূর থেকে দেখা গেল হেডলাইটের আলো। তড়িঘড়ি করে ভ্যানে চড়ে বসল ভূত দুটো। পোশাক খোলার সময় নেই। ভ্যান ছেড়ে দিলো। মনে মনে ফাহিমকে ধন্যবাদ দিলো সিয়াম।
ছোটো কাকুর পুরনো মোটরসাইকেল আছে। সজল চালাতে পারে। ওটাকেই কাজে লাগিয়েছে ফাহিম। সামনে দুটো হেডলাইট ও সাইরেন বক্স লাগিয়ে নিয়েছে। রাতে হেডলাইট দুটো সামনে থেকে দেখলে যে কেউ পুলিশের জিপগাড়ি ভাববে।
ওরা ওদের কাজ করেছে। এবার সিয়াম ও পলাশের পালা।
ঝোপ থেকে বাইসাইকেল বের করে ভ্যানের পেছনে ছুটলো ওরা। রাতে সাইকেল দুরন্ত গতিতে ছুটছে। দূরত্ব রেখে অনুসরণ করছে ওরা। আস্তে আস্তে ভ্যানের সাথে দূরত্ব বাড়ছে। এভাবে পারা যাবে না। ওদের কষ্ট কমিয়ে দিতে এগিয়ে এলো ফাহিম ও সজল। মোটরসাইকেল নিয়ে আগে চলে গেল। দুটো হেডলাইট বন্ধ করে দিয়েছে। ভ্যান আরোহীদের নিরাপদে অনুসরণ করাই প্রধান লক্ষ্য এখন। একটু পর থেমে গেল ফাহিম ও সজল। মোটরসাইকেলে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এগিয়ে গেল সিয়াম ও পলাশ। এবার বেশ সুবিধা হলো। রাস্তা ভাঙা এদিকে। ভ্যান জোরে যেতে পারছে না। ছেলেদের এখনো দেখতে পায়নি ভ্যানের আরোহীরা। ভ্যানটি পরিত্যক্ত রেলস্টেশনে এসে থেমে গেল। রাত বাড়ছে, চাঁদের আলোও ক্রমেই উজ্জ্বল হচ্ছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে রেলস্টেশনের ঘরগুলো। লম্বা একটি মাত্র প্লাটফর্ম আছে স্টেশনে। অধিকাংশ স্থানই সবুজ ঘাসে ঢাকা। দশ বছর ধরে কোনো ট্রেন দাঁড়ায় না বলে মানুষের যাওয়া-আসা নেই। দোকানপাট থাকার প্রশ্নই আসে না। প্লাটফর্মের পর তিনটা ঘর। মাঝেরটা টিকিট কাউন্টার। বিপরীত দিকে বিভিন্ন ধরনের গাছ বুনো পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ফাহিম ও সজল পৌঁছে গেল ওদের কাছে।
প্লাটফর্মের কাছে আসতেই সামনে কারো পদশব্দ শুনতে পেল ওরা। দেরি না করে গাছের পেছনে চলে গেল চার কিশোর। আস্তে আস্তে স্পষ্ট হলো মানুষের অবয়ব। টিকিট কাউন্টার থেকে বেরিয়েছে সে। সুঠাম দেহি, পেশিবহুল শরীর। পায়ে বুট জুতো। গালে বড়ো একটা কাটা দাগ। বাম পা সামান্য বাঁকিয়ে হাঁটে।
ফিসফিস করে সিয়াম বলল, ‘এই লোকই মনে হচ্ছে টনির রুমে ঢুকেছিল।’ চোয়ালে একবার হাত বুলিয়ে নিলো সে।
চলে গেল লোকটা। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বেরিয়ে এলো ছেলেরা।
টিকিট কাউন্টারের দরজায় দু’জন পাহারাদার আছে। কাউকে লুকিয়ে রাখার পারফেক্ট জায়গা এটা। এখানেই কেরামত মিয়াকে রেখেছে কি না জানে না ওরা। পাহারাদার রাখার মানে একটাই, কাউকে বন্দী করে রেখেছে, নয়তো মূল্যবান কিছু লুকিয়ে আছে ভেতরে। সার্চ করে দেখতে হবে। ভেতরে ঢোকার কথা অন্যদের বলল ফাহিম। কাউন্টারে ঢুকতে হলে গার্ড দুটোর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ভাবনায় পড়ে গেল ফাহিম।
দু’জন বয়স্ক মানুষের সাথে মারামারিতে ওরা পারবে না। লোক দুটোর হাতে লাঠিও আছে। অন্য অস্ত্রশস্ত্রও থাকতে পারে কাছে। শক্তিতে নয় বুদ্ধি দিয়ে কাজ করতে হবে। অন্যদের সে কথা বলল ফাহিম। প্রত্যেকের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলো। পলাশ ও সিয়াম চলে গেল। একটু দূরে গিয়ে শক্ত গাছের ডাল ভেঙে আনলো ফাহিম। পকেট নাইফ দিয়ে কেটে লাঠি বানিয়ে ফেলল সে। সজলের হাতে ধরিয়ে দিলো লাঠিটা। গার্ড দুটোর ওপর নজর রাখল ওরা। একটু পর পাশের জঙ্গল থেকে বিভিন্ন রকম শব্দ আসতে লাগলো। এই যেমন গাছের ডাল ভাঙার শব্দ, ঘনঘন কোকিলের ডাক ইত্যাদি। গার্ড দুটো বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। নিজেদের মধ্যে কথা বলে, টিকিট কাউন্টারের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিলো। একজন জঙ্গলের দিকে চলে গেল, অন্যজন আগের জায়গাতেই পায়চারি করতে লাগলো। হাতে বিড়ি। দৌড়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালো ফাহিম, ‘বিপদে পড়েছি। সাহায্য করবেন?’
এ জায়গায় একজন কিশোরকে দেখে অবাক হলো লোকটা। বিড়িতে একটা টান দিয়ে ছেড়ে দিলো। তার অজান্তেই পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সজল। লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই কানের নিচে লাঠির আঘাত পেল। টলে উঠল সে। ফাহিম ও সজল ধরাধরি করে মাটিতে শুইয়ে দিল। এর জ্ঞান ফেরার আগেই যা করার করতে হবে।
জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে পলাশ ও সিয়াম। সিয়ামের হাতে গাছের ডালের তৈরি লাঠি। অনবরত উদ্ভট শব্দ শুনে এদিকে এগিয়ে এলো একজন গার্ড। ওদের কাছাকাছি চলে এসেছে। গাছের পেছনে ওত পেতে রইলো সিয়াম। পলাশ এগিয়ে গিয়ে লোকটার সামনে দাঁড়ালো। ওকে দেখে ধমকে উঠলো লোকটা। মুখ দিয়ে ভেংচি কাটলো পলাশ। লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে এলো লোকটা। দৌড় শুরু করল পলাশ।
‘এই পাজি ছেলে, দাঁড়া, ধরতে পারলে বাপের নাম ভুলিয়ে দেব।’ হাতের লাঠিটা ছুড়ে মারলো পলাশের দিকে। লাগাতে পারলো না। সিয়ামের পাশ দিয়ে দৌড়ে চলে গেল পলাশ। প্রস্তুত ছিল সিয়াম। লোকটা কাছাকাছি আসতেই হাতের লাঠিটা বাড়িয়ে দিলো। লাঠির সাথে বেঁধে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল ছুটন্ত গার্ড। একটুও দেরি করল না সিয়াম। তার ওপর চেপে বসে কিল-ঘুসি ছুড়তে লাগলো। ওর সাথে যোগ দিলো পলাশ। লোকটা দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। মাটিতে একটা গড়ন মারল। ওরা দুজন ছিটকে পাশে পড়ে গেল। দেরি না করে উঠে দাঁড়ালো লোকটা। আটকানোর চেষ্টা করলো সিয়াম ও পলাশ। পাত্তাই দিলো না ওদের। সিয়ামের নাক বরাবর একটা ঘুসি চালিয়ে দিলো সে। নাক ধরে বসে পড়লো সিয়াম। আঘাতটা বেশ জোরে লেগেছে, নাক ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। শেষবারের মতো লোকটাকে আটকাতে গেল পলাশ। ওকে শূন্যে তুলে মারলো আছাড়। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো পলাশ। হাড়গোড় ঠিক আছে কি না দেখে নিল। লোকটাকে আটকাতে পারল না ওরা। মাসুদ নামের কাউকে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে রেলস্টেশনের দিকে চলে গেল। ছেলেদের চালাকি বুঝে ফেলেছে সে।

আট.
দরজায় তালা মারা। জ্ঞান হারানো লোকটার পকেট হাতড়ে চাবি বের করল ফাহিম। তালা খুলে ভেতরে ঢুকলো সে। বাইরে লাঠি হাতে সজল দাঁড়িয়ে রইলো। কাউন্টারের ঘরটা অনেকদিন পরিষ্কার করা হয়নি। টর্চ জ্বালিয়ে দেখতে লাগল সে। দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল রুমের কোনায়। ওখানে বসে আছে চেনা দুটো মুখ। টনি ও কেরামত মিয়া। লাইটের আলো পড়ায় চোখ বুজে গেল ওদের। কেরামত মিয়ার চোখেমুখে একরাশ জিজ্ঞাসা।
তাড়া দিয়ে ফাহিম বলল, ‘পরে সব বলবো। দেরি করা যাবে না। বেরোতে হবে। সিয়াম ও পলাশ একটা লোককে আটকে রেখেছে।’
টনিকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল সে। কয়েকদিন বদ্ধঘরে থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছে টনি।
পরিবেশটা এতক্ষণ শান্ত ছিল। কারো হাঁকডাকে অশান্ত হয়ে গেল। বাইরে কারো চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সজলের সতর্কসঙ্কেত শোনা গেল। মাসুদ নামের কাউকে ডাকতে ডাকতে এদিকে আসছে একজন গার্ড। সিয়াম ও পলাশ তাকে আটকাতে পারেনি। জ্ঞান হারানো লোকটার নাম ধরে ডাকছে সে। দেরি না করে বন্দী দুজনকে নিয়ে দরজার কাছে চলে এলো ফাহিম। বেরিয়েই পড়লো গার্ডের সামনে। সঙ্গীকে পড়ে থাকতে দেখে ভীষণ রেগে গেল সে। হাতের লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে এলো। কিছু একটা করা দরকার। ফাহিমকে ভাবার সময় দিলো না লোকটা। ওর মাথা বরাবর চালিয়ে দিলো লাঠি। আঘাত থেকে বাঁচাতে পাশে সরে গেল সে। আঘাত থেকে পুরোপুরি নিজেকে বাঁচাতে পারল না। ঘাড়ে এসে লাগলো। বসে পড়লো সে। লাঠি হাতে লুকিয়ে ছিল সজল। সুযোগ হাতছাড়া করল না। গার্ডের মাথার পেছনে সজোরে আঘাত করল। পড়ে গেল গার্ড। সাথে সাথে ধরে ফেললো কেরামত মিয়া। অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় এক ধাক্কায় টিকিট কাউন্টারের মধ্যে চালান করে, দরজা আটকে দিলো। ভেতরে গিয়ে গালাগালি করতে লাগল লোকটা। সিয়ামের নাক ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। টিস্যু পেপার চেপে ধরে রেখেছে সে। তবে আঘাতটা গুরুতর নয়। একটুতেই রক্ত বন্ধ হয়ে গেল। পলাশেরও কোনো হাড় ভাঙেনি। তবে ব্যথা পেয়েছে। আর দেরি করল না ওরা। টনি ও কেরামত মিয়াকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরল।
[চলবে]

SHARE

Leave a Reply