বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর বিশ্বে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা দুই লাখ ৩৬ হাজার। ২০১৬ সালে তাদের এক জরিপে দেখা গেছে যে, ঐ বছর বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার শিশু-কিশোর পানিতে ডুবে মারা গিয়েছে অর্থাৎ দৈনিক গড়ে প্রায় ৪০ জন। আর সব বয়সী মানুষের মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার। তার মধ্যে ৫ বছরের নিচে শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪৩%। এটা কিন্তু এক ভয়াবহ চিত্র।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক ২০২০-এর প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, ৫ বছরের নিচের শিশুদের নিউমোনিয়ায় মারা যাওয়ার পরেই দ্বিতীয় প্রধান ঘাতক হচ্ছে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। সাধারণত পানিতে ডুবে মোট মৃত্যুর ৯০% ঘটে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি।
✪ কারণ কী?
– গ্রামাঞ্চলে সাধারণত ঘরের কাছাকাছি ডোবা, পুকুর, জলাশয় ইত্যাদি থাকার কারণে ছোট্ট শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করার ঘটনা খুব বেশি দেখা যায়।
– এ ছাড়া বন্যা, নদী ভাঙন, জলোচ্ছ্বাসের সময় পানিতে পড়ে শিশু-কিশোরদের মৃত্যুর সংখ্যা কম না।
– জলযান দুর্ঘটনায় পানিতে ডুবে মারা যাবার ঘটনাও রয়েছে প্রচুর।
– সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যানবাহন নদীতে বা পানিতে পড়ে মৃত্যু হওয়ার ঘটনা অসংখ্য রয়েছে।
– বর্ষার মৌসুমে শিশু-কিশোরদের বড়শি দিয়ে নদীতে, ডোবায় বা পুকুরে মাছধরার একটা আলাদা নেশা বা কৌতূহল পেয়ে বসে। এর মাধ্যমেও দুর্ঘটনা ঘটে।
– সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে গেলে এরকম দুর্ঘটনা প্রায়শই শোনা যায়।
– শহরের শিশুরা গ্রামে গেলে অজ্ঞতাবশত পানিতে ডোবার ঘটনা বেশি ঘটে থাকে।
– আবার শহরের শিশুদের বাথটাব বা বালতির পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করার অনেক ঘটনা রয়েছে। কারণ শুধুমাত্র মুখ পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেলেই শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু সম্ভব।
– অনেক সময় এক শিশু-কিশোর আরেক শিশু-কিশোরকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেও মারা যায়।
✪ কখন পানিতে ডুবে মৃত্যু বেশি হয়?
সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর অর্থাৎ বর্ষাকালে পানিতে ডোবার ঘটনা বেশি হয়। কারণ এ সময় শিশু-কিশোররা বর্ষার পানিতে জলকেলিতে মেতে ওঠে এবং এই বিপত্তি ঘটে। আবার সারা বছরজুড়ে বেশির ভাগ শিশুই মারা যায় সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৩টার মধ্যে। কারণ এ সময় বাড়িতে তেমন কেউ থাকে না। শুধুমাত্র মা রান্নাঘরে বা অন্যকাজে ব্যস্ত থাকে আর এই ফাঁকেই এই দুর্ঘটনা ঘটে।
✪ কতক্ষণ পানিতে ডুবে গেলে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে?
আমরা জানি পানিতে ডুবে গেলে মানুষ শ্বাস নিতে পারে না। শ্বাস নিতে না পারলে ব্রেনে অক্সিজেনের অভাব হয়। আর এই অবস্থায় যদি পাঁচ মিনিটের বেশি কেউ ডুবে থাকে তাহলে তার মৃত্যুর আশঙ্কাই বেশি থাকে।
✪ পানিতে ডুবে গেলে করণীয় কী?
আতঙ্কিত না হয়ে বরং ধৈর্য ধরে আশপাশের লোকদের সাহায্যের জন্য ডাকতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, জীবন বাঁচানোর জন্য প্রতিটি সেকেন্ড এ সময় খুবই মূল্যবান। যত দ্রুত সম্ভব তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করতে হবে। তবে উদ্ধারকারীকেও সাঁতার জানতে হবে এবং সাবধান থাকতে হবে। কারণ ডুবন্ত ব্যক্তি তাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরতে পারে যাতে দুজনেরই জীবন বিপন্ন হতে পারে। উদ্ধারের পর তাকে আলো-বাতাসপূর্ণ জায়গায় শোয়াতে হবে। বেশি ভিড় করা যাবে না। ডুবন্ত ব্যক্তি দীর্ঘক্ষণ পানিতে থাকার কারণে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত কমতে থাকে বিধায় উদ্ধারের পর ভেজা জামাকাপড় দ্রুত সরিয়ে শুকনা জামাকাপড় পরাতে হবে। নাকে, মুখে ও কানের ময়লা বের করে পরিষ্কার করে দিতে হবে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য। এরপর তাকে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।
উল্লেখ্য, এক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের চলা কিছু কুসংস্কার পরিহার করতে হবে। নইলে জীবনহানির আশঙ্কা রয়েছে। যেমন- শিশু-কিশোরকে মাথায় তুলে নিয়ে ঘোরানো, পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করার চেষ্টা, লবণ বা ছাই দিয়ে শরীর ঢেকে রাখা, বমি করানোর চেষ্টা করা ইত্যাদি অকাজের মাধ্যমে সময় নষ্ট না করে দ্রুত নিকটস্থ চিকিৎসাকেন্দ্রে নেওয়াটা জরুরি।
✪ প্রতিরোধে করণীয়
পানিতে ডুবে অকাল মৃত্যু কারো কাম্য নয়। তবে এটি প্রতিরোধযোগ্য। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, প্রশাসন সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সচেতনতাই পারে এটা প্রতিরোধ করতে। তবে এ ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলা উচিত। যেমন-
– গ্রামাঞ্চলে যেসব জায়গায় পুকুর, নদী-নালা, খানাখন্দ, পুকুর, ডোবা রয়েছে সেসব এলাকার মানুষকে সচেতন হতে হবে বেশি।
– বিশেষ করে তাদেরকে এসব এলাকায় ছোটো শিশুদেরকে অধিকতর তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। পরিবারের মা যখন কাজে ব্যস্ত থাকবে পরিবারের অন্য সদস্য বাচ্চাদেরকে দেখভাল করার চেষ্টা করতে হবে। উল্লেখ্য, দিনের প্রথমভাগে শিশুদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাখতে পারলে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ কমানো সম্ভব।
– পুকুর, ডোবা এসব জায়গায় চারপাশ থেকে বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে।
– শিশু-কিশোরদের সাঁতার শেখাতে হবে।
– পানি ধরে রাখার পাত্রগুলোকে (বালতি, ড্রাম) সঠিকভাবে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা বা পানিশূন্য করে রাখা উচিত।
– এ ছাড়া শিশু-কিশোরদের একা একা পানিতে নামতে না দেওয়া উচিত।
– নদীপথে যাত্রার সময় লাইফ জ্যাকেট পরিধান করা উচিত।
– যেসব শিশু-কিশোরদের খিঁচুনি বা মৃগীরোগ আছে তাদেরকে এসব জলাশয়ের কাছে বা সুইমিং পুলের কাছে আসতে দেওয়া উচিত নয়।
– পানিতে ডুবে যাওয়া মৃত্যু প্রতিরোধে জনসচেতনতার জন্য প্রতি বছর ‘২৫ জুলাই’ দিবসটি পালন করা হয়, যাতে সবাই এ ব্যাপারে সজাগ থাকে।