এখন মধ্যরাত। নিস্তব্ধ পরিবেষ্টন। মাঝে মাঝে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান করে দিচ্ছে নিশাচর পাখির ডাক। মৃদু ঠান্ডা বাতাস বইছে। ক্ষীণ থেকে বহু দূরের শব্দও সিয়ামের কানে ধরা পড়ছে। টয়লেট থেকে বেরিয়ে ছোটো কাকুর বাড়ির দিকে হাঁটছে সে। গ্রামের টয়লেট বাড়ি ছাড়া দূরে হয়। গা ছমছমে পায়ে হাঁটা রাস্তা। এ গ্রামে নতুন এসেই এভাবে একা একা বেরোনো উচিত হয়নি। ফাহিমের চিরচেনা গ্রাম। ওকে ডাকার কথা একবার ভেবেছিল সে। আসার সময় দেখে এসেছে, বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ফাহিম। ওর ঘুমটা আর নষ্ট করতে মন চায়নি। অর্ধেকটা পথ চলে এসেছে সে। হঠাৎ থেমে গেল সিয়াম। মুহূর্তে হার্ডবিটের ওঠানামা বেড়ে গেল। দুই জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছে ওর সামনে। ভূত নাকি? ভালো করে খেয়াল করে দেখলো, দুটো শেয়াল ওর দিকে এগিয়ে আসছে। শেষমেশ শেয়ালের কামড় খেতে চায় না সে। রুমে দেরি করেও ফেরা যাবে।
পেছন ফিরে দিলো দৌড়। একটু বাদেই হাঁপিয়ে উঠলো সে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলো। না, নেই শেয়াল দুটো। পিছু পিছু ধাওয়া করেনি। বাঁচা গেছে!
শেয়ালের কবল থেকে রক্ষা পেলেও সর্বনাশ যা হবার হয়েই গেল।
শেয়ালের ধাওয়া খেয়ে সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় চলে এসেছে সে। চারিদিকে গাছ আর ঝোপ। ছোটো কাকুর বাড়ি থেকে কত দূর কে জানে। ভাগ্য ভালো, একটু হাঁটতেই প্রশস্ত রাস্তা পেয়ে গেল। এ রাস্তা ধরে কোনো বাড়ি পেলেই হলো। তখন তাদের সাহায্য নিয়ে ছোটো কাকুর ওখানে যাওয়া যাবে। অনুমানে একটা দিক ধরে হাঁটতে শুরু করল সে। কিছুদূর যেতেই থমকে দাঁড়ালো। কাছাকাছি দুই তিনজন মানুষের উত্তেজিত কথাবার্তা শোনা গেল মনে হচ্ছে। এত রাতে মানুষের কথা শুনে কৌতূহলী হয়ে উঠল সে। ঐ তো, রাস্তার নিচে সুপারি বাগানে টর্চলাইট নাচাচ্ছে কে যেন। এত রাতে ওরা কারা? চোর-ডাকাত নাকি? চট করে পাশের ঝোপে নেমে গেল সিয়াম। মিনিট খানেক পর সুপারি বাগানে চিৎকার দিলো কেউ। চমকে উঠলো সে। দুটো লোক রাস্তা দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। অন্ধকারে মুখ দেখা গেল না কারো। কিছু একটা হয়েছে, মনে হয় কেউ বিপদে পড়েছে, সাবধানে ঝোপ থেকে বেরিয়ে সুপারি বাগানে চলে এলো সে। সামনে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলো। একি? ঘাসের মধ্যে কেউ একজন পড়ে আছে। পেট ফুঁড়ে ছুটছে তাজা রক্ত। এত কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। মুহূর্তকাল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলো। পড়ে থাকা পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সের ছেলেটাকে চিনতে পারল সিয়াম। দুপুরে একেই বাজারে দেখেছিল, খলিল। নাড়ি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। সব শেষ। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে চিরতরে। ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো সে। হারিয়ে গেল দুপুরের ঘটনায়।
জুনের কাঠফাটা রোদে ছাতিমগাছের নিচে বসে আছে সিয়াম। মাথায় লাল হ্যাট। পরনে সাদা টিশার্ট। কুচকুচে কালো চুলের নিচে বাদামি মুখের হাসি। লম্বা জিভ বের করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে এ পাড়ার ডাকাত কুকুর বাঘা। ইতোমধ্যে দুটো মিল্ক বিস্কিট সাবাড় করে ফেলেছে সে। সিয়ামের সাথে বেশ ভাব জমে গেছে বাঘার। পাশে জনা চারেক লোক বসে জিরিয়ে নিচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে একটা ছেলে ওকে ফলো করছে। সিয়াম ঘুরে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। হেসে দিলো সিয়াম। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ছেলেটা। তেলচুকচুকে কালো মানিক। এগিয়ে গেল সিয়াম। তর্জনী নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এই ছেলে, আমাকে ফলো করছো কেন?’
ভ্রু কুঁচকে বলল সে, ‘আমার পাড়ায় এসে আমার কাছেই কৈফিয়ত চাইছো?’
আশপাশে তাকিয়ে কৃত্রিম ভীতস্বরে সিয়াম বলল, ‘ওহ, তাই তো! এখন কী হবে?’
এবার ছেলেটাও হেসে দিলো। ‘তোমাকে চিনতে পেরেছি। তুমি সিয়াম না? ফাহিমের বন্ধু। দুই গোয়েন্দার একজন। ফাহিমের কাছে তোমার ছবি দেখেছি।’
পরিচয় দিলো ছেলেটা। নাম পলাশ।
কথার মধ্যে ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিলো বাঘা। গ্রামের বাজারে হঠাৎ করেই হইচই শুরু হয়েছে। এগিয়ে গেল সিয়াম ও পলাশ। ভিড় ঠেলে উঁকি দিলো। একজন নাক চেপে ধরে আছে, রক্ত বেরোচ্ছে। পলাশ জানালো, ওর নাম টনি, খলিল মেরে নাক ফাটিয়েছে। ফুটবল খেলা নিয়ে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে শুরু হয় হাতাহাতি। তুচ্ছ কথা নিয়ে মারামারি করা টনির পুরনো অভ্যাস। লোকজন ধরে ফেলেছে দুজনকে। মারামারি আর এগোতে দেয়নি। আপাতত বড়োসড়ো কয়েকটা হুমকি দিয়ে থেমে যেতে বাধ্য হলো টনি। চিৎকার দিয়ে বলল, খলিলকে খুন করে ফেলবে সে।
দুই.
সকালে ঘটনাস্থলে আবার এসেছে দুই গোয়েন্দা, ফাহিম ও সিয়াম। কাজ শেষ করে একটু আগে চলে গেল পুলিশ।
এখানে ঝোপঝাড় দুমড়ে মুচড়ে আছে। সবকিছু ভালোভাবে দেখে নিচ্ছে ফাহিম। কোনো সূত্র নেই। পুলিশও কিছু পায়নি। ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো সে। ঠিক তখনই সাত মিটার দূরের ঝোপে একটু অসঙ্গতি লক্ষ করল। ওখানে একটা ঝোপের ডাল বেশি ঝুঁকে পড়েছে মনে হচ্ছে। এগিয়ে গেল ফাহিম। ঝোপের ডালে কালো রঙের বহু পুরনো ডিজাইনের একটা চাবি ঝুলছে। চাবি রিঙে মোরগের পুতুল। চাবিটা হাতে মেলে ধরলো সে। ধস্তাধস্তির সময় কারো পকেট থেকে পড়েছে। ফাহিম নিশ্চিত, এটা খলিলের পকেট থেকে পড়েনি। তার চাবি রিং থেকে শুরু করে সব খানেই ফুটবলের ছাপ। তাহলে কি এটা খলিলের খুনির? আশপাশে আর কিছু পাওয়া গেল না। গতকালের ঘটনা ইতোমধ্যে ফাহিমকে বলেছে সিয়াম। সিয়াম বলল, ‘বেচারা টনিকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করবে এখন, দুপুরে মারামারি করার জন্য বিপদে পড়ে যাবে সে।’
ফাহিম বলল, ‘তর্ক থেকে হাতাহাতির স্বভাব টনির বহু পুরনো। অধিকাংশ সময় টনি মার খায়। ঘটনাগুলো ওখানেই শেষ। এর মধ্যে অন্যকিছু আছে।’
‘আপাতত এখানে কোনো কাজ নেই।’
‘হুম, চল, টনির ওখান থেকে ঘুরে আসি।’
বাইসাইকেল নিয়ে রওনা দিলো দুই গোয়েন্দা। বাড়ির গেটে নক করলে তেতো মুখে দরজা খুললো টনির মা। টনির কথা জিজ্ঞেস করতেই মুখের ওপর দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিলো। সিয়াম চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিল, ওর হাত চেপে ধরলো ফাহিম। আবার নক করলো সে। দ্বিতীয়বার দরজা খুলতেই ওর দাদুর পরিচয় দিয়ে বলল ফাহিম, ‘ফুপু, টনি ভাইয়ার সাথে কথা বলতে চাই।’
এবার কিছুটা সহজ হলো পান্না ফুপু। ভেতরে বসতে দিলো ওদের। বোঝাই যাচ্ছে, বেশ বিরক্ত হয়ে আছে ফুপু। ছেলেদের বলল, ‘কিছু মনে করো না, মন মেজাজ ভালো নেই। পুলিশ এসে যা তা বলে গেল। টনি কোথায় পালিয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। ওদিকে গতকাল রাতে ইলেকট্রিক লাইট আনতে বাজারে গিয়ে আর ফেরেনি টনি। অথচ সবাই মনে করছে টনি খুন করেছে।’
‘তাকে কেউ ফাঁসিয়েছে মনে হচ্ছে? পূর্বশত্রুতা থেকে?’ ফাহিম বলল।
‘কত লোকের সাথেই ঝামেলা হয়েছে ওর। কে ফাঁসাবে কীভাবে বলবো।’ পান্না ফুপু বলল।
‘দুপুরে মারামারি হওয়ার পর টনি ভাই বাড়ি এসে কিছু বলেছিল?’ সিয়াম জিজ্ঞেস করল।
‘না,’ ভ্রুকুঁচকে বলল পান্না ফুপু, ‘তোমরা এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো কেন? এ বয়সের ছেলেপেলেরা খেলাধুলা নিয়ে থাকে।’
মৃদু হাসি দেখা গেল ফাহিমের ঠোঁটে। দুই গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করে ফুপুর হাতে ধরিয়ে দিলো সে।
পান্না ফুপু কার্ড হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। বোঝা গেল, অন্য সময় হলে হেসেই উড়িয়ে দিতো। অবস্থা বুঝে সিয়াম বলল, ‘এতোটা তুচ্ছ ভাববেন না, এর আগেও একটা কেসের সমাধান করেছি।’
ওকে সমর্থন করে ফাহিম বলল, ‘মনে হচ্ছে টনি ভাইকে কেউ বিপদে ফেলেছে। আমরা সত্য জানার চেষ্টা করব। টনি ভাইকেও খুঁজে বের করব।’
‘ওকে দেখলেই পুলিশ গ্রেফতার করবে।’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল পান্না ফুপু।
‘চিন্তা করবেন না। নির্দোষ কেউ সাজা পাবে না।’ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও আবার ঘুরে দাঁড়ালো ফাহিম, ‘আর একটা প্রশ্ন, আপনাদের কোনো চাবি হারিয়েছে?’
অনিশ্চিত মাথা নেড়ে পান্না ফুপু বলল, ‘কই না তো।’
ফাহিম চাবিটা দেখিয়ে বলল, দেখুন তো, চিনতে পারেন কি না।
‘না বাবা, এটা আমাদের না, আর কারো কাছে এটা দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। কোথায় পেলে?’
‘চাবিটা কুড়িয়ে পেয়েছি। ভাবছি এর মালিককে খুঁজে বের করা দরকার।’
সিয়াম বলল, ‘কার্ডে আমাদের ফোন নম্বর আছে। কোনো কিছু জানা দরকার পড়লে আবার আসবো। এখন আসি।’
সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল দুই গোয়েন্দা।
গভীর ভাবনায় ডুবে গেল ফাহিম। খলিল খুন হওয়ার রাত থেকে টনি নিখোঁজ। অন্যরা ভাবছে, টনি খুন করে পুলিশের ভয়ে পালিয়েছে। স্রেফ রাগের বশে কেন সে খলিলকে খুন করবে? এটা করলে অনেক আগেই আরো কয়েকটা লাশ পড়ে যেত গ্রামে। খলিলকে দুজন মিলে খুন করেছে। একজন টনি হলে আরেকজন কে? টাকা দিয়ে কাউকে ভাড়া করবে সে সামর্থ্য তার নেই। খলিলের খুনিরা যদি টনিকে কিডন্যাপ করে? টনির ওপর খুনের দোষ চাপাতে? গতকালের মারামারির সুযোগ কেউ নিতেও পারে। সবার আগে টনিকে খুঁজে বের করতে হবে। খলিলের সম্পর্কে সবকিছু জানার চেষ্টা করবে ওরা। সিয়ামকে করণীয় বলে দিলো ফাহিম।
সাইকেল চালানো অবস্থায় কথা বলছিল দুই গোয়েন্দা। ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। ওদের সামনে কেরামত মিয়া। খলিলের সাথে ব্যাবসা করতো সে। নেতা গোছের লোক। লম্বা গোঁফের নিচে পান খাওয়া লালচে দাঁত। সালাম দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিলো দুই গোয়েন্দা।
দুঃখ প্রকাশ করে বলল কেরামত মিয়া, ‘খলিল খুব ভালো পার্টনার ছিল।’
ফাহিম বলল, ‘আপনার কী মনে হয়? তাকে কে খুন করেছে?’
রহস্যময় কণ্ঠে বলল কেরামত মিয়া, ‘ভালো মানুষের শত্রুর অভাব হয় না। হাতে প্রমাণ নেই। কারো নাম বলতে পারছি না। গতকাল টনি কেমন রেগেছিল ওর ওপর? দেখেছো তোমরা? আজ নাকি টনি হাওয়া।’
‘শুধু এ কারণে টনিকে সন্দেহ করা যায় না।’ ফাহিম বলল।
‘তুমি জানো? রাগ মানুষের শক্তি ও সাহস অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দেয়। আমার তো মনে হচ্ছে ওরাই এ কাজ করেছে। খলিলের সাথে অন্য কারো ঝামেলা হয়নি।’
টনির খুনি দু’জন ছিল, ফাহিম ছাড়া কাউকে বলেনি সিয়াম। কেরামত মিয়ার কথাটা ধরল সে, ‘আপনি কীভাবে জানেন খুনের সাথে একাধিক ব্যক্তি জড়িত?’
রেগে গেল কেরামত মিয়া, ‘এই ছেলে, কী যা তা বলছো? আমি জানি মানে? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে খুনিরা আমাকে জানিয়ে খুন করেছে। শোনো, গোয়েন্দাগিরি করা তোমাদের শখ সেটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু সব বিষয় নিয়ে এমন ছোক ছোক করা ভালো না।’ শেষের কথাটা শাসানোর ভঙ্গিতে বলল।
‘দুঃখিত আঙ্কেল, খুনের পর নিখোঁজ হয়েছে একজন। তাই ওটা বলেছে। প্লিজ আপনি কিছু মনে করবেন না।’ বলল ফাহিম।
‘ঠিক আছে, কিছু মনে করিনি আমি।’ টিটকারির সুরে বলল কেরামত মিয়া, ‘এ পর্যন্ত কী কী উদ্ধার করলে শুনি।’
‘তেমন কিছু পাইনি, শুধু একটা চাবি….’ পায়ে ফাহিমের লাথি খেয়ে থেমে গেল সিয়াম ।
তড়িঘড়ি করে ফাহিম বলল, ‘এগোতে পারিনি, রহস্যের তালা খুলতে চাবিটা খুঁজছি।’
কথাটা নিজের কানেই বেখাপ্পা শোনালো ফাহিমের।
ভ্রু কুঁচকে ফাহিমের দিকে তাকালো কেরামত মিয়া। কী যেন ভাবলো। সাবধানে তদন্তের কাজ করতে বলে চলে গেল সে।
তিন.
‘দিলি তো সব ভন্ডুল করে।’ বিরক্তি ঝরে পড়ল ফাহিমের কণ্ঠে।
‘স্যরি, এবার থেকে মুখে টেপ মেরে রাখবো।’ মাথা নিচু করে বলল সিয়াম।
মুহূর্তকাল চুপ থেকে ফাহিম বলল, ‘কেরামত মিয়ার রেগে যাওয়া অস্বাভাবিক মনে হয়নি তোর কাছে?’
‘হুম, এ কারণে আবার তাকে সন্দেহ করছিস নাকি?
ওরাই করেছে, কথাটা মুখ ফসকে এমনিতেও বেরিয়ে যেতে পারে। টিভিতে দেখিসনি? বড়ো বড়ো নেতারাও এমন ভুলভাল বলে ফেলে।’
চুপ করে রইলো ফাহিম। বার তিনেক নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো।
খলিলের বাড়ি গিয়ে নিশ্চিত হলো দুই গোয়েন্দা। এ চাবি তাদের নয়। ওখান থেকে সোজা বাজারে চলে এলো ওরা। একটি মাত্র হার্ডওয়্যারের দোকান। ওখানেই চাবিরিং পাওয়া যায়। চাবি রিংটা নতুন। দোকানে খোঁজ নিয়েও কোনো লাভ হলো না। ছোটো জিনিসপত্র বিক্রির রেকর্ড খাতায় রাখে না দোকানি।
ঘোরাঘুরি করতে দুপুর হয়ে গেল। অগত্যা বাড়ির পথে হাঁটা ধরল দুই গোয়েন্দা।
দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নোট করতে বসলো সিয়াম। ফাহিম খলিলের সম্পর্কে আরো বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করল।
শেষ বিকেলে ছোটো কাকুর কাজে সাহায্য করল দুই গোয়েন্দা। রাতে খাওয়াদাওয়া করে বিছানায় শুতেই রাজ্যের ঘুম চেপে ধরলো ওদের। গতরাতে ভালো ঘুমাতে পারেনি সিয়াম। শেষ রাতে ফাহিমকেও জাগিয়ে দিয়েছিল। আজ দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ল দুজন। রাত বারোটার পর ঘুম ভেঙে গেল ফাহিমের। পাশে চোখ পড়তেই ধড়াস করে উঠল বুকের খাঁচা। হার্টবিট দ্রুত ওঠানামা করতে লাগলো ওর। রুমের মধ্যে পায়চারি করছে কালো একটা ছায়ামূর্তি। তড়াক করে উঠে বসলো সে। ছায়ামূর্তিটা ঘুরে তাকালো ওর দিকে। এমনকিছু দেখবে কল্পনাই করেনি ফাহিম। সাদা চোখের বীভৎস মুখ, ঠোঁট দুটো কাটা। বত্রিশটা দাঁতই বেরিয়ে আছে। যেন হরর মুভির কোনো ভূত টিভি ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওটা ফাহিমের দিকে। ভয়ে নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে ফাহিম। একেবারে থ হয়ে গেছে। ওকে ওভাবে রেখে চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল ছায়ামূর্তিটা। পরক্ষণেই খেয়াল করল ফাহিম, রুমের দরজা খোলা। দ্রুত লাইট অন করল সে। কিছু বুঝতে পারেনি সিয়াম। এখনো মড়ার মতো ঘুমাচ্ছে। সময় নষ্ট না করে টর্চ লাইট নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো ফাহিম। বাইরে সবকিছু ঠিক আছে মনে হচ্ছে। ছায়ামূর্তির কোনো চিহ্নও নেই। বাড়ির আশপাশে খুঁজেও ওটাকে পাওয়া গেল না। উঠানের গাছগুলো স্থির দাঁড়িয়ে বলছে, আমরা কিছু দেখিনি। হতাশ হয়ে ফিরে এলো সে। ধপ করে খাটের ওপর বসে পড়ল। যা ভেবেছিলো তাই। টেবিলে রাখা চাবিটা গায়েব।
জানালায় গ্রিল নেই। কপাটও খোলা রেখেছিল সে। ফ্রিতে ভয় দেখাতে মুখোশ পরে এসেছিল কেউ। খলিলের খুনি নয়তো?
নিজের ওপর রাগ হলো ফাহিমের। একটা সূত্র পেয়েও হাতছাড়া করে ফেলল সে।
পরদিন সকালে দরজায় ঠকঠক শব্দে ঘুম ভাঙলো দুই গোয়েন্দার। দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে পড়ল ফাহিমের কাজিন সজল। ওদের চেয়ে বয়সে এক বছরের বড়ো। দুই গোয়েন্দার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল সজল, ‘সেকি, তোরা এখনো শুয়ে আছিস? ওদিকে পুলিশ তোদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।’
‘মানে কী? আমরা চোর নাকি ডাকাত? পুলিশ কেন খুঁজবে?’ সিয়াম বলল।
‘শিগগিরই খুঁজবে, সাহায্যের জন্য। শুনলাম তোরা সার্লক হোমসকে টেক্কা দিচ্ছিস।’
‘সাত সকালে খোঁচা মারতে এসেছো?’ ফাহিম বলল।
‘সবাই বলাবলি করছিল, তোরা চাবি পেয়েছিস।’
মুখ চওয়াচাওয়ি করল দুই গোয়েন্দা।
‘সজল, অ্যাই সজল, কোথায় তুই?’ বাইরে থেকে ছোটো কাকু ডাক দিলো।
‘যাহোক, সাবধানে কাজ করিস। এখন আসি, হাটে যেতে হবে।’ চলে গেল সজল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল দুই গোয়েন্দা। সিয়ামকে সবকিছু খুলে বলল ফাহিম।
‘চাবির কথা কেরামত মিয়া রটিয়েছে। চাবির কথা কেবল তিনজন জানতো। পান্না ফুপু ও খলিলের বাবা এসব খেজুরে আলাপ করার অবস্থায় নেই।’ সিয়াম বলল।
‘চাবির কথা অনেকেই জেনে ফেলেছে, কে চুরি করল জানা সহজ হবে না।’ ফাহিম বলল।
‘চাবিটা সহজে হাতে পাওয়ার জন্য চোর এমন করতে পারে।’
জবাবে কিছু বলল না ফাহিম। মুখ খুললো একটু পর। ‘টনিকে খুঁজে বের করতে হবে। এ কাজে পলাশের সাহায্য লাগবে। ওর সাথে কথা বলে আসি।’
পলাশ ফাহিমের পুরনো বন্ধু। পলাশের সাথে দেখা করে সবকিছু বুঝিয়ে বলল ফাহিম। তদন্তের কাজে সাথে নেওয়ার জন্য খুশি হলো পলাশ।
চার.
রাত নয়টা বাজতেই গ্রামটা ঘুমিয়ে পড়েছে। বাইরে কেউ নেই। থমথমে পরিবেশ। এমনিতে গ্রামে সন্ধ্যার পর গভীর রাত নেমে আসে। আগে সন্ধ্যার পরও কিছু কিছু লোককে বাইরে দেখা যেত। খলিল খুন হওয়ার পর এখন আর কাউকে চোখে পড়ে না। উদ্ভট সব ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে গ্রামে। শুরু হয়েছে ভূতের উপদ্রব। শোনা যাচ্ছে ভূতের হাসি। আজ সকালে মতিন বাজারের রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। রাতে ভূত দেখেছে সে। ভূতের হাতে মার খেয়ে জ্ঞান হারায় বেচারা। ফাহিমের ঘরে যে ঢুকেছিল, ওটাকেই দেখেছে মতিন। মতিনের কাহিনি শোনার পর আতঙ্ক আরো বেড়েছে।
সিয়াম টনির বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। পলাশের সাথে বেরিয়েছে ফাহিম।
জ্যোৎস্না প্লাবিত রাতে লাইট ছাড়াই সবকিছু দেখা যায় বলে সহজে কারো চোখে পড়ে যেতে পারে। সতর্ক হয়ে পথ চলছে ওরা ।
সামনে বড়ো পুকুর। পুকুরপাড়ে বহু পুরনো চারটা আমগাছ। পাশে পায়ে হাঁটা রাস্তা। জ্যোৎস্নার আলো স্মান বানিয়ে দিয়েছে গাছের ছায়া। পশ্চিমে পিচঢালা সড়ক থেকে নেমে আসা রাস্তা চলে গেছে কেরামত মিয়ার বাড়ির দিকে। এদিকে আর কারো বাড়ি নেই। ওদিক দিয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটলে বিল পাওয়া যাবে। পুকুরের শেষ মাথায় চলে এসেছে ওরা, এ সময় পিচঢালা সড়কের দিকে দুটো মানুষের অবয়ব দেখতে পেল ফাহিম। এদিকেই আসছে। দ্রুত পাশের ঝোপে গা ঢাকা দিলো দুই কিশোর। লোক দুটো ওদের পাশ দিয়ে চলে গেল। পলাশ জানালো, এরা এ গ্রামের নয়, বহিরাগত। খুব সতর্কতার সাথে ধাপ ফেলছে লোক দুটো। ঘুমন্ত গ্রামে কীসের এত সতর্কতা? জানতে হবে।
নিঃশব্দে ওদের পিছু নিলো দুই কিশোর। কিছু দূর এগিয়ে ডানে আরেকটা রাস্তা চলে গেছে। ওদিকে চলে গেল লোক দুটো। বেশ অবাক হলো দুই কিশোর। একটু দূরেই গোরস্থান। গোরস্থানের পর আর রাস্তা নেই।
রাতে ঘোরাঘুরির সাহস আছে পলাশের। খুশি হলো ফাহিম। কবরস্থানে এসে থেমে গেল লোক দুটো। চার ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা কবরস্থানে কোনো পাহারাদার নেই। প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ল দুই কিশোর। এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘাসের ঝোপে ঢুকে পড়ল। বিশ মিটার সামনে আগন্তুক লোক দুটো দাঁড়িয়ে আছে। বাঁশঝাড়ের ছায়া মুখ ঢেকে দিয়েছে তাদের। মিনিট দুয়েক পর আরেকটা মানুষের অবয়ব স্পষ্ট হলো ওখানে।
‘কেরামত মিয়া! এখানে কী করছে?’
ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ থাকতে বলল ফাহিম।
কেরামতের হাতে বড়ো একটা ব্যাগ। আগন্তুক লোক দুটোর একজন ব্যাগটা নিয়ে নিলো। তাড়া দিয়ে বলল কেরামত মিয়া, ‘এখানে আর দেরি করা ঠিক হবে না। খলিল খুন হওয়ার পর গ্রামে পুলিশের আনাগোনা শুরু হয়েছে।’
কেরামতকে ধন্যবাদ দিয়ে গোরস্থানের প্রাচীর টপকে অদৃশ্য হয়ে গেল লোক দুটো। বাড়ির পথে হাঁটা ধরল কেরামত মিয়া। চলে যাওয়ার জন্য পিছু পিছু এগিয়ে গেল ফাহিম ও পলাশ।
বাঁশবাগানের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে ওরা। বাগানের অন্ধকার চোখে সয়ে এসেছে। নির্বিঘœ পথ চলতে পারছে। কেরামত মিয়া ওদের থেকে মাত্র দশ হাত দূরে। সহসাই পাশে খসখস শব্দে নিজের উপস্থিতি জানান দিলো কেউ। সতর্ক ছিল দুই কিশোর। গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিলো ওরা। ওদের আরো আড়াল করতেই যেন নাটকীয়ভাবে চাঁদটা মেঘের নিচে চলে গেল। ঘুটঘুটে আঁধারের পর্দা নেমে এলো বাঁশবাগানে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল ওরা।
চমকে উঠল ফাহিম। বিশ গজ সামনে থপ করে শব্দ হলো, দুই সেকেন্ড পর ভারী কিছু ঘাসের ওপর আছড়ে পড়লো। ওখান থেকে দৌড়ে পালালো কেউ একজন। টর্চ জ্বালিয়ে সামনে এগিয়ে গেল ওরা। এবার চমকে উঠল পলাশ। মাটিতে পড়ে আছে কেরামত মিয়া। জ্ঞান হারিয়েছে। মাথায় লেগে আছে রক্ত।
তাকে ধরাধরি করে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেল ওরা। নক করতে দরজা খুলে দিলো তার ভাগনে রুবেল। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। এখানেই থাকে। মামার ব্যাবসা দেখাশোনা করে। একটু বাদে কেরামতের জ্ঞান ফিরলো। সাহায্যের জন্য বারবার ধন্যবাদ দিলো দুই কিশোরকে।
[চলবে]