Home খেলার চমক ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ভালো মন্দ

ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ভালো মন্দ

ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট বলা হয়, যে টুর্নামেন্টে দলগুলোর মালিকানা থাকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে। একে করপোরেট ক্রিকেটও বলা যায়। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রচলনের পর এই ধারার ক্রিকেটে রীতিমতো বিপ্লব হয়ে গেছে। সারা বিশ্বেই এখন ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের জোয়ার। এর ফলে ক্রিকেটের উপকার ও ক্ষতি দুটোই হয়েছে। ক্রিকেটে যেমন দর্শক বেড়েছে, খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক বেড়েছে, এর বিপরীতে কখনো কখনো খেলার মূল স্পিরিট হারিয়ে সেখানে জায়গা করে নিয়েছে অর্থ।

শুরুটা যেভাবে
ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের শুরুটা হয়েছিল বিদ্রোহী লিগ নামে পরিচিত ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ-আইসিএল দিয়ে। ২০০৭ সালে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সাথে দ্বন্দ্বের পর জি এন্টারটেইনমেন্ট গ্রুপের (জি টিভি, জি সিনেমা, জি বাংলা) আয়োজনে শুরু হয় আইসিএল। ভারত ছাড়াও পাকিস্তান ও বাংলাদেশের দু’টি দল অংশ নিয়েছিল সেই টুর্নামেন্টে।
ওই টুর্নামেন্ট আইসিসির অনুমোদন পায়নি। যে কারণে দু’টি আসরের পর কর্তৃপক্ষ সেটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। তবে ওই টুর্নামেন্ট ঘিরে দর্শকদের আগ্রহ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। পাশাপাশি তাদের ছিল আইসিএলকে মোকাবেলা করার উদ্দেশ্য। যে কারণে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ বা আইপিএল নামে টুর্নামেন্ট আয়োজন করে বিসিসিআই।
প্রথম আসরেই বাজিমাত করে আইপিএল। বড়ো বড়ো তারকা খেলোয়াড়দের দলে ভেড়ায় দলগুলো। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো টাকার বস্তা নিয়ে হাজির হয় আইপিএলে। ভারতীয় টুর্নামেন্টটির সফলতা দেখে অন্য দেশগুলোও আগ্রহী হয়। বাংলাদেশে বিপিএল, ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিপিএল, শ্রীলঙ্কায় এসএলপিএল, পাকিস্তানে পিএসএল, অস্ট্রেলিয়ায় বিগ্য ব্যাশ নামের টুর্নামেন্ট শুরু হয়। শুরু হয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের নতুন জোয়ার।

জমজমাট ম্যাচ আর গ্যালারি ভরা দর্শক
ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট চালু হওয়ার সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটি হলো মাঠে গ্যালারি ভরা দর্শক। অল্প সময়ের মধ্যে খেলা শেষ হওয়া আর দেশ বিদেশের তারকা ক্রিকেটারগণ অংশ নেওয়ায় ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট দেখতে মাঠে দর্শকদের ঢল নামে। ঢাকার মাঠে ক্রিস গেইল, শহীদ আফ্রিদি, শোয়েব মালিকদের খেলা দেখার লোভ দর্শককে টেনে নিয়ে যায় মাঠে। টিভির সামনেও দর্শকরা টান টান উত্তেজনায় ভরপুর ম্যাচ দেখে বিনোদন লাভ করেন।
এই ক্রিকেটের আরেকটি ভালো দিক হচ্ছে স্থানীয় ক্রিকেটারদের মানসম্মত ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলার সুযোগ। ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে প্রতিটি দলে বিদেশী ক্রিকেটার থাকে। মানসম্পন্ন বিদেশী ক্রিকেটারদের সাথে একই দলে খেলতে পারার কারণে স্থানীয় ক্রিকেটারদের যে অভিজ্ঞতা হয়, তা অন্য কোনো উপায়ে অর্জন করা সম্ভব নয়। বিদেশী ক্রিকেটারের সাথে খেলা, প্র্যাকটিস কিংবা ড্রেসিং রুম শেয়ার করা নতুন ক্রিকেটারদের জন্য বড়ো সুযোগ হয়ে আসে।
এ ছাড়া ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে মাঠ, পিচ, অনুশীলন সুবিধাসহ সব কিছুই থাকে আন্তর্জাতিক মানের। সাধারণত অন্য ঘরোয়া ক্রিকেটে এই সুবিধাটা পাওয়া যায় না। যেটি স্থানীয় ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। যার ফলে নতুন ক্রিকেটার গড়ে তুলতেও ভূমিকা রাখে ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে।

মুদ্রার উল্টোপিঠ
ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট যেমন দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে তেমনি এই ক্রিকেট নিয়ে অনেক বিতর্কও তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বড়ো যে সমালোচনা হয়েছে তা হলো, অনেক ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চেয়ে এই টুর্নামেন্ট খেলতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল। গত ১০ বছরে এই দলটি দুইবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছে (২০১২ ও ২০১৬)। কিন্তু এই দলটিকে ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ^কাপ ও ২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাছাইপর্ব খেলতে হয়েছে।
বেশির ভাগ ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ মনে করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের এই অবস্থার জন্য দায়ী ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের দিকে ক্রিকেটারদের অতিরিক্ত ঝোঁক। এই দলটির ক্রিকেটাররা টাকার জন্য জাতীয় দল বাদ দিয়ে ‘খেপ’ খেলতেই বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। গত ৭-৮ বছরে সারা বিশে^র যেখানেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট হয়েছে, সেখানেই দেখা গেছে ক্রিস গেইল, ড্যারেন স্যামি, কাইরন পোলার্ডদের। ফলাফল আইসিসির র‌্যাঙ্কিংয়ে দলটির অবস্থান টেস্ট ও ওয়ানডেতে ৮ নম্বরে, আর টি-টোয়েন্টিতে ৭ নম্বরে।
অনেক ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আইপিএল জমজমাট টুর্নামেন্ট হলেও এটি ভারতীয় ক্রিকেটের ক্ষতি করছে। ক্রিকেটাররা সব ফরম্যাটে ভালো ক্রিকেটার হয়ে ওঠার বদলে শুধু টি-টোয়েন্টিতেই মনোনিবেশ করছে। এ প্রসঙ্গে অনেকে ভারতীয় দলের সাম্প্রতিক অর্জনের কথা তুলে খোঁচা দিয়ে থাকেন। ২০১১ সালে ওয়ানডে বিশ^কাপ জয়ের পর ভারত গত ১১ বছরে আর কোনো বড়ো টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতেনি।
২০২২ সালের এশিয়া কাপে দলটি পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে গ্রুপ পর্ব থেকেই। একই বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও সেমিফাইনালে যেতে পারেনি ভারত। ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ^কাপেও দলটি সেমিফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয়। সবচেয়ে জমজমাট ফ্রাঞ্চাইজি লিগের আয়োজন করে ভারতের যদি এই পারফরম্যান্স হয়, তাহলে সেই লিগের অর্জন কী এমন প্রশ্ন উঠেছে।
এ ছাড়া ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের সাথে জুয়া ও ফিক্সিংয়ের সম্পর্কও অনেক বেশি। আইপিএলে একাধিক ক্রিকেটার ম্যাচ পাতানোর অভিযোগে বহিষ্কার হয়েছেন, শুধু খেলোয়াড় নয়- দল নিষিদ্ধের ঘটনাও ঘটেছে। চেন্নাই সুপার কিংস দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। বিপিএলেও ফিক্সিংয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে একাধিকবার। মোহাম্মাদ আশরাফুলের ওপর নিষেধাজ্ঞা তো আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে। এ ছাড়া মাঠের বাইরে মহল্লায় মহল্লায় কিংবা অনলাইনে জুয়ায় কোটি কোটি টাকা হাতবদল হয় ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটকে ঘিরে।
ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট ও বাংলাদেশ
বাংলাদেশে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের সবচেয়ে খারাপ প্রভাবটি পড়েছিল এই ক্রিকেট শুরুর সাথে সাথেই। ২০০৮ বাংলাদেশের এক ঝাঁক ক্রিকেটার জাতীয় দল থেকে পদত্যাগ করে বিদ্রোহী লিগ হিসেবে পরিচিত ভারতীয় আইসিএলে যোগ দেয়। হাবিবুল বাশার সুমনের নেতৃত্বে ঢাকা ওয়ারিয়র্স নামের সেই দলে ছিলেন মোহাম্মাদ রফিক, অলক কাপালি, শাহরিয়ার নাফিস, আফতাব আহমেদের মতো তারকা ক্রিকেটার।
এক সাথে এতগুলো ক্রিকেটার জাতীয় দল ছেড়ে যাওয়ায় বড়ো ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট। শুধুমাত্র টাকার লোভেই তারা জাতীয় দল ছেড়ে যায়। এই কারণে সবাইকে বিভিন্ন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। আইসিএল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ পূর্ণ করে দু’একজন আবার জাতীয় দলে ফিরতে পারলেও তাদের পুরনো ফর্ম আর ফেরেনি। যার ফলে আফতাব আহমেদ, শাহরিয়ার নাফিসের মতো সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার হারিয়ে গেছেন অকালেই।
২০২১ সালে সাকিব আল হাসান আইপিএল খেলার জন্য জাতীয় দল থেকে ছুটি নিলে বিষয়টি নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়। টানা এক দেড় মাস ধরে টুর্নামেন্ট খেলার ধকল পেসার মোস্তাফিজুর রহমানের শরীর নিতে পারেনি বলে অনেকে মনে করেন। তার খারাপ পারফরম্যান্সের জন্যও কিছু ক্ষেত্রে দায় আছে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ-বিপিএল চালু হয়েছে ২০১২ সাল থেকে। এক দশক বয়স হলেও এই টুর্নামেন্টের আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক অভিযোগ আছে। বছর বছর দলের নাম পরিবর্তন, অধিনায়ক পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে বিপিএল অনেকটা নামকাওয়াস্তে টুর্নামেন্টে পরিণত হয়েছে। যেমন- ঢাকার দলটিই কখনো ঢাকা গ্লাডিয়েটরর্স, কখনো ঢাকা ডায়নামাইটস, কখনো ঢাকা প্লাটুন নাম ধারণ করেছে। এমনি করে সব দলেই বছর বছর নাম কিংবা মালিকানায় বদল এসেছে। খেলোয়াড়দেরও কোনো স্থায়িত্ব নেই।
অথচ আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংস মানেই হলুদ জার্সি আর মহেন্দ্র সিং ধোনি কিংবা মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স মানেই নীল জার্সিতে রোহিত শর্মা। আবার কলকাতা নাইটরাইডার্স মানেই শাহরুখ খানের দল। এর ফলে একটা দলের স্থায়ী ইমেজ তৈরি হয়, তৈরি হয় স্থায়ী সমর্থক গোষ্ঠী; কিন্তু বিপিএল দশ বছরেও সেটা করতে পারেনি।
এ ছাড়া বিপিএলে বিভিন্ন সময় ফিক্সিং ও শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগও উঠেছে। টুর্নামেন্টের ফরম্যাট নিয়ে বিতর্ক কিংবা মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বও ছিল। আবার এত বছর টুর্নামেন্টে আয়োজন করে তা থেকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য কোনো খেলোয়াড় পায়নি। আমাদের জাতীয় দলের টি-টোয়েন্টি পারফরম্যান্স তো সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে!

SHARE

Leave a Reply