শীতকালে শীতের হাত থেকে বাঁচতে যেসব পাখি অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলে চলে আসে তাদেরকে বলা হয় অতিথি পাখি বা পরিযায়ী পাখি। প্রতি বছরের মতো এবারও জেঁকে বসেছে শীত। এসেছে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি। তাদের কলকাকলিতে ভরে উঠেছে বাংলাদেশের নানা প্রান্তরে হাওড়, খাল, বিল, লেকসহ অসংখ্য জলাশয়। বালিহাঁস, বাটুল, চখাচখি, শামুক খোল, খোপাডুবুরি সহ অন্যান্য পাখির চঞ্চল ওড়াউড়ি মুগ্ধ করে যেকোনো মানুষকে।
হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এসব পাখি আসে আমাদের দেশে একটু উষ্ণতার জন্য। অথচ এক শ্রেণির অসাধু চক্র শুধু অর্থের লোভে নির্মমভাবে শিকার করছে এসব অতিথি পাখি। ওরা আসে মূলত হিমালয়ের পাদদেশ আর রাশিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে।
এগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনই গায়ে বাহারী রং।
ওদের দেখলে মন ভরে যায়।
পাখিদের আকাশে কোনো সীমান্ত রেখা নেই। তারা অনায়সে উড়ে বেড়ায় অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে।
প্রতি বছর শীতকালে এলে জলাশয় বিল, হাওড়, পুকুর ভরে যায় নানা রঙবেরঙের নাম না জানা পাখিতে। আদর করে আমরা সেগুলোকে বলি অতিথি পাখি। নাম অতিথি পাখি হলেও এই পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে আমাদের দেশে হাজির হয় নিজের জীবন বাঁচাতে।
খাদ্যের সন্ধানে ব্যস্ত থাকে তারা। বিচিত্র তাদের সন্ধান পালন, ভাষা তৈরির কৌশল। ঝড়-বৃষ্টি, তুষারপাতসহ প্রকৃতি হাজারো প্রতিকূলতা থেকে বাঁচতে তারা পাড়ি জমায় হাজার হাজার মাইল দূরের দেশে।
প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে উপমহাদেশের ২১০০টি প্রজাতির পাখি আছে। তবে এর মধ্যে প্রায় ৩৫০ প্রজাতির পাখি হিমালয় পেরিয়ে আমাদের দেশে চলে আসে। এরা শীতের অতিথি পাখি। সাধারণত সেপ্টেম্বর অক্টোবরে দল বেঁধে আসতে শুরু করে এসব পাখি। মার্চ এপ্রিল পর্যন্ত এরা কলকাকলিতে আমাদের প্রকৃতিকে ভরিয়ে তোলে। এরপর শুরু হয় নিজ দেশে ফিরে চলা।
পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে ডিসেম্বর জানুয়ারি এই দুই মাসে সবচেয়ে বেশি পাখি এদেশে আসে। বাতাসে শীতের আমেজ লাগলে আমাদের হাওর, বিল, চরাঞ্চলে দেখা যায় হাজার হাজার অতিথি পাখি। ইংল্যান্ডের নট হেমশায়ার সাইবেরিয়া কিংবা এন্টার্কটিকার তীব্র শীত থেকে থেকে বাঁচতে এরা পাড়ি জমায় দক্ষিণের কম শীতের দেশে।
এ পাখিদের শারীরিক গঠন খুব মজবুত। এরা সাধারণত ৬০০ থেকে ১৩০০ মিটার উঁচু দিয়ে উড়ে যায়। ছোটো পাখিদের ঘণ্টায় গতি ৩০ কিলোমিটার। দিনে রাতে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার উড়তে পারে। বড়ো পাখিরা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার অনায়াসে উড়তে পারে। আশ্চর্যের বিষয় এসব পাখি তাদের গন্তব্য স্থান সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে এসব পাখির রয়েছে বংশগত সূত্রে পাওয়া বিশেষ দিকনির্ণয় ক্ষমতা। শীত মৌসুমে এদেশে আসা পাখিদের মাঝে সোনা জঙ্গ, কুন চুষি, বাতারণ, জলপিপি, লেঞ্জার, হরিয়াল, দুর্গা, টুনটুনি, লালবন মোরগ, তিলে ময়না, রাম ঘুঘু, জঙ্গি বটের, হলদে খঞ্চনা ইত্যাদি প্রধান। গ্রীষ্মকালের সুমেরুতে বাস করে এমন পাখি শীতকালে বাংলাদেশে আসে। লাল বুকের ক্লাই কেশার পাখি আসে ইউরোপ থেকে। আর অন্য সব পাখি আসে পূর্ব সাইবেরিয়া থেকে। এসব পাখির মধ্যে বাংলাদেশের অতি পরিচিত অতিথি পাখি নর্দার্ন পিনটেইল।
এ ছাড়া স্বচ্ছ পানির খয়রা চোখাচোখি, কার্লীয়, বুনোহাঁস পাখি, হিরণ, নিষাদরন, ডুবুরি পাখি অন্যতম। এসব পাখির মধ্যে অনেক প্রজাতি বছরে একটি নির্দিষ্ট দেশে চলে যায়। শুধু ইউরোপে আর এশিয়ায় আছে প্রায় ৬৭৫ প্রজাতির পাখি। মৌসুমি অতিথি পাখির কলরব আর গুঞ্জনে এদেশের অন্যতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস মুখরিত। প্রশাসনিক ভবন সংলগ্ন লেকসহ এখানকার বিভিন্ন লেকে প্রায় ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির পাখি আছে। তবে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পাখি হচ্ছে জেন্ডার সিগ্লাস জারানিক বা সরালি হাঁস।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুসারে অতিথি পাখি শিকার ও বিক্রয় দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু এ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই বলে এই মৌসুমে পাখি শিকারিদের দৌরাত্ম্য চলে। শুধু পেশাদার নয়, অনেক শৌখিন শিকারি অতিথি পাখি শিকার করেন। প্রতিদিন মারা পড়ছে শত শত অতিথি পাখি। এতে এক দিকে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে জৈব বৈচিত্র্য, বাড়ছে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের প্রকোপ, যার কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের স্বার্থে অতিথি পাখি রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। আসুন, আমরা অতিথি পাখি শিকার বন্ধ করি। পরিবেশের বাস্তুতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার জন্য সামান্য হলেও সবাই অবদান রাখি।