সহনীয় শীতের মতো শীতল সোনামণিরা আমার, তোমরা ভালো আছো নিশ্চয়ই। রেলগাড়ির মতো লম্বা সময় পর তোমাদের জন্য আবার লিখছি শীতের সিংহাসনে বসে। আজকের লেখাটি লিখবো শীত নিয়ে। সম্ভবত তোমাদের ভালো লাগবে।
চলমান ২০২৩ সাল আমাদের জন্য বেশ কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। এ বছর বিশ্বে ভয়ঙ্কর খাদ্যসঙ্কট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসঙ্ঘ। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থার প্রধান ডেভিড বিস্লের মতে- খাদ্যের অভাব এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শুধু দুর্ভিক্ষই হবে তা নয়- বরং এর জেরে বিভিন্ন দেশে বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। যা হোক প্রথমে লিখিত ছড়াটির মাধ্যমে তোমাদের সচেতন করে যার যার অবস্থান থেকে আশঙ্কাকৃত ঝুঁকি মোকাবেলা করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।
শিশিরভেজা গোলাপ কলির মতো ¯িœগ্ধ বন্ধুরা- তোমরা জানো আমাদের ছয়টি ঋতুর মধ্যে শীত ঋতুটি একটি অনন্য জায়গা নিয়ে আছে আমাদের প্রকৃতিতে। আমাদের হৃদয় ও মনে। এ জায়গা থেকে শীত কখনোবা কোনদিনও বঞ্চিত হবে না। আর সেটা পারা সম্ভবও নয় আমাদের, যে কারণে আমাদের প্রকৃতির মধ্যে যে বসবাসরীতি আছে সেখানে শীত অনিবার্য।
অ্যান ব্র্যাডস্ট্রিট বলেছেন- আমাদের যদি শীত না থাকে তাহলে বসন্ত এত সুন্দর হবে না। মাঝে মাঝে প্রতিকূলতার স্বাদ না পেলে সমৃদ্ধি এতো মজাদার হয় না। শীতের রিক্ততা রুক্ষতা প্রকৃতির ধূসর বর্ণ আমাদেরকে প্রতিকূলতার মুখোমুখি করলেও আমরা শহর নগর ও গ্রামীণ পরিবেশে শীতকে আলিঙ্গন করি, শীতকে বরণ করি নানা আয়োজনে। শীতকে জয় করি বসন্তকে ধারণ করি। আমি মনে করি প্রতিটি সুন্দরের ভেতরে অসুন্দর লুক্কায়িত থাকে। শীতের মধ্যেও প্রকৃতির যে অসুন্দর বিষয় উঁকি দিয়ে উঠে বলে দৃশ্যমান হয় এটা আসলে শীতের বাইরের রূপ কিন্তু ভেতরের রূপটি খুব নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর। বন্ধুরা আমরা কিন্তু সেটাই দেখি। এ বিষয়ে এডিথ সাইডওয়েলের একটি মন্তব্য তোমাদের কাছে তুলে ধরছি। তিনি বলেছেন, শীতকাল হলো আরামের, ভালো খাবার, এবং উষ্ণতার জন্য, বন্ধুত্বপূর্ণ হাতের স্পর্শের জন্য, আগুনের পাশে আলাপ করার সময়, সময়টি একান্ত বাড়ির জন্য।
মেহমেট মুরাত ইল্ডান বলেছেন- শীত এলে আগুন রাজা হয়ে যায়।
তাহলে আমরা হয়ে যাই আগুনের প্রজাসাধারণ। শীতের রাত কিংবা শীতের সকালে আগুনের সুমিষ্ট উত্তাপ নেওয়ার জন্য আমরা অনেকেই মুখিয়ে থাকি। তবে বেশির ভাগ মুখিয়ে থাকে এদেশের অভাবী নিরীহ তোমাদের মতো বা আমাদের মতো ছোটো বড়ো বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মানুষগুলো। তাদের গরম কাপড় থাকে না, কেনার সামর্থ্য থাকে না। তাদের চোখে গ্রামীণ হাটবাজার বা শহরের শপিংমলগুলোতে ফাঁসির মতো ঝুলে থাকা নানা রঙের উলের জ্যাকেট, জামপার, বাহারি রঙের রেশম কম্বল, হাতমোজা, পায়ের মোজা শুধু স্বপ্নের মতো যা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসব মানুষগুলোর বুকের পাঁজর শীতে বেঁকে যায় ধনুকের মতো। এ অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য আগুন নামক রাজার প্রজা হয়ে মিষ্টি উত্তাপ নিয়ে কোনোরকমে শীত নামক প্রতিকূল দৈত্যটাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। কেউ কেউ আবার এ আগুনের উত্তাপ নিতে গিয়ে প্রতি বছর পরনের শাড়ি বা লুঙ্গিতে হঠাৎ আগুন লেগে গিয়ে মারাত্মক আহত হয় আবার কেউ কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে যা খুবই দুঃখজনক। অন্য দিকে এ সময় শুরু হয় নানা প্রকার শৈত্যপ্রবাহ যা শীতের কষ্টকে বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দিয়ে জনজীবনকে বাধাগ্রস্ত করে তোলে। আবহাওয়া অধিদফতরের ক্যাটাগরিতে শৈত্যপ্রবাহকে চার ভাগে দেখানো হয় আর তা হলো- আট থেকে দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, ছয় থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ, চার থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ, আর চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে গেলে তাকে অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলে। শীতের সকালে যাদের তেমন কোনো কাজ নেই, অফিসের তাড়া নেই, পরীক্ষার বালাই নেই তাদের ঘুম ভাঙে অনেক দেরিতে আবার ঘুম ভাঙলেও আলসেমিতে গরম নরম লেপ বা বর্ণিল রঙের কম্বল গায়ে জড়িয়ে মাথা মুড়িয়ে শুয়ে থাকে ফুটবলের মতো কেউ বা সটান আবার কেউ বা হাঁটু ভাঙা ‘দ’ এর মতো করে। কিছু মনে করো না- তোমাদের তো আবার হাতে হাতে অ্যান্ড্রয়েড নামের স্মার্টফোনের ইঁদুর অবাধ করে দেওয়া হয়েছে ফলে তোমাদের অনেকেই বাতি বন্ধ করে লেপ বা কম্বলে মাথা মুড়িয়ে কত ধরনের খেলাই না দেখতে থাকো তার শেষ নেই। তোমাদের এতে বারণ করলে অনেকেরই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। পশ্চিম আকাশে ঝড় মেঘের সৃষ্টি হয়। শীতের এই ঝড় বৃষ্টিহীন সময়েও। নেতিবাচক ফলাফল নিয়ে বেশি লিখতে চাই না শুধু এটুকুই বলবো এখন তোমাদের বয়সের ছেলেমেয়েরা যত কাচের বোতলের তলার মতো মোটা চশমা পরছো আমাদের সময়ে সত্যি কিন্তু এমনটা দেখা যেত না। বুঝতে পেরেছো সবাই- আমি আসলে কী বলতে চেয়েছি। তবে তোমাদের পাশাপাশি বড়রাও কিন্তু পিছিয়ে নেই? বীরদর্পে সবাই স্মার্টফোন মিছিলের সামনে ইউটিউবের স্লোগান তোলে সীমা ছাড়াবার মতো করে। সে থাক তবে পেটের ইঁদুর যখন পেটের নাড়িভুঁড়িতে দাঁত বসায় তখন গরম লেপ বা সোহাগে কম্বলকে বড়ই অসহায়ের মতো আলতো করে নামিয়ে দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বাইরে বের হতে হয়। কনকনে ঠান্ডা? বাইরের ঘন কুয়াশা প্রকৃতিকে গ্রাস করে রাখে যেন। দিনের বেলায়ও রাস্তায় কুয়াশার কারণে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করে সকল ধরনের গাড়ি। কখনো কখনো দিকভ্রষ্ট হয়ে হয় এক্সিডেন্ট। এতে অনেক মানুষ আহত বা নিহত হয়। কৃষকের খুঁজে পেতে কষ্ট হয় নিজেরই ক্ষেতটা। লাঙল জোয়াল কাঁধে নিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ তারপর হদিস পায় নিজ জমিখণ্ডের। সূর্য না দেখা দেওয়া পর্যন্ত এ অবস্থা চলতেই থাকে। সূর্যের দেখা মিললে সবার মধ্যে শান্তি ও স্বস্তির যেন শেষ থাকে না। একঝলক রেশম কমল মিষ্টি রোদের উত্তাপ যেন সবার কাছে কত ভালো লাগার আহা! সেটা যেন লিখে বুঝাবার নয়। ভোরবেলা অনেকের দেরিতে ঘুম ভাঙলেও যাদের কাজ থাকে, অফিস থাকে, পরীক্ষা থাকে তারাসহ যারা খেটে খাওয়া দিনমজুর কৃষক রিক্সাওয়ালা সবাই বেরিয়ে পড়ে কুয়াশা ভেদ করে নিজ নিজ কাজে।
আমাদের দেশে শীত শুরু হয় সাধারণত হেমন্ত তথা কার্তিক ও অগ্রহায়ণ থেকে তারপর শীতের আসল সময়
পৌষ ও মাঘ পেরিয়ে ফাল্গুন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। যেহেতু হেমন্তে শীতের শুরু তাই এ সময় আমন ধান উঠে কৃষকের ঘরে ঘরে। শুরু হয় নবান্ন পিঠাপুলির নানা উৎসব যা পুরো শীতের সময় ভরে চলে। অর্থাৎ নানারকম পিঠাপুলিতে মুখ মিষ্টির সময়কালই যেন শীতকাল। এসব পিঠার মধ্যে ভাপাপিঠা, চিতইপিঠা, কুলিপিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, দুধ পিঠা, তেলের পিঠা, কুসলি পিঠা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। শীতের পিঠাকে ঘিরে দেশের শহর নগরে শুরু হয় পিঠা উৎসব যেমন- ঢাকার বকুলতলায় বসে শীতের পিঠা উৎসব। এ উৎসব ঘিরে তৈরি হয় বিভিন্ন সব রকমারি রসনাতৃপ্ত করা পিঠা। এ আয়োজন এখন গ্রামগঞ্জেও শুরু হয়েছে। এসময় খেজুর রস ও খেজুর গুড়ের মিষ্টতা যেন প্রাণ ভরে দেয়। বেতের কাঠা করে মুড়ি নিয়ে পাটালি খেজুর গুড় ও ঝোলা গুড় দিয়ে সকালের মিষ্টি রোদে বসে খাওয়ার মজা ভোলার নয়। তোমরা যারা গ্রামে থাকো তারা এই বিষয়টা বেশি বুঝতে পারবে। যারা শহরে থাকো তারা এসময় গ্রামে গিয়ে মজা নিয়ে আসতে পারো। তবে আমরা যারা শহরে থাকি তাদের সবারই শিকড় আসলে গ্রামে তাই অনেকে শহরে থাকলেও এ মজা বুঝতে পারার কথা। শীতের এ সময়ে গ্রামের ক্ষেত খামার হলুদ সরষে ফুলে ফুলে ভরে উঠে। এদেশের প্রকৃতিকে নৈর্সগিক সৌন্দর্যে সাজিয়ে আমাদের চোখ জুড়িয়ে দেয়। মন ভরিয়ে দেয়। এর পাশাপাশি এ সময়ে ফোটে নানা বর্ণের নানা শুভাসিত গন্ধে নিঃশ্বাস আটকে আসা হরেক প্রজাতির ফুল। এসব ফুলের মধ্যে বড়ো ইনকা গাঁদা, ছোটো ছোটো চায়না গাঁদা, দেশি গাঁদা, রক্ত গাঁদা, হলদে লাল জাম্বো গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, কসমস, সিলভিয়া, সূর্যমুখী, ক্যালেন্ডুলা, পপি, গ্লাডিওলাস উল্লেখযোগ্য। এসব প্রজাতির ফুলে ফুলে হাট বসে রূপ ছড়ানো প্রজাপতিদের। একনজর ভালো করে তাকিয়ে দেখলে মহান সৃষ্টিকর্তার কথা যেকারো মনে পড়ে যায়। মৌমাছিদের গুঞ্জনে মুখরিত হয় চারপাশ। এসময়ে পাওয়া যায় একেক ফুলের একেক রকম মধু। যা খেলে আমাদের উপকারের যেন শেষ থাকে না। এ সময়ে বিভিন্ন ফলেরও কিন্তু কমতি নেই! এসব ফলের মধ্যে নারকেলকুল, আপেলকুল, বিভিন্ন ধরনের বরই, কমলালেবু, জলপাই, আমলকী, সফেদা, ডালিম, আপেল উল্লেখযোগ্য। এ সময়ে কিন্তু বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি আমাদের রসনাকে তৃপ্ত করে। এসব সবজির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, পালংশাক, লালশাক, মুলা, লালমুলা, শালগম, বেগুন, শিম, টমেটো, লাউ, ব্রোকলি, মটরশুঁটি, গাজর, ধনিয়াপাতা ইত্যাদি।
জ্ঞান সংগ্রহের রাজা আমার প্রিয় বন্ধুরা- শীতের সময় আমাদের দেশের শত শত প্রজাতির রঙবেরঙের অতিথি পাখিদের ঢল নামে। তাদের কিচিরমিচির শব্দ কলরবে বিল ঝিল হাওড় বাঁওড় বাঁশবাগান, শহরের শান্ত নিবিড় লেক সেজে ওঠে। এসব অতিথি পাখিদের মধ্যে বালিহাঁস, চোখাচখি, রাজহাঁস, মানিকজোড়, নারুদ্দি, চিনাহাঁস, ভোলাপাখি, হরিয়াল, বনহুর, বরলিহাঁস, পিয়াংচিনা, হট্টি-ট্রি, তিতির পাখি, বারহেড, গ্রাসওয়ার নাইবাল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব অতিথি পাখি মেহমানদের মেহমানদারি করার জন্য এদেশের প্রকৃতি যেন বুক পেতে রাখে।
তবে বন্ধুরা শীতের এসময়ে বাতাসের আর্দ্রতা কম থাকে। তাই শীত জুড়ে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে শীতজনিত অসুখ বিসুখের। এগুলোর মধ্যে সর্দি, জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, বা হাঁপানি, নাকের প্রদাহ, চোখওঠা, গলাব্যথা, মাথাভার বোধ হওয়া, আমাশয়, ডায়ারিয়া, নিউমোনিয়া, ঠোঁট ফাটাসহ বহুবিধ খোসপাঁচড়া উল্লেখ্যযোগ্য। এগুলোর ব্যাপারে তোমরা সতর্ক থাকবে যাতে তোমরা ভালো করে পড়ালেখা করে ভালো ফলাফল ঘরে নিতে পারো। এর মধ্যে মড়মড় করে বেজে ওঠে গাছের হলুদ বাদামি বয়স্ক পাতা ঝরার গান। এ গানে উপমা আছে- এ গানে আশা আছে। বয়স্ক হলুদ বাদামি পাতাগুলো একসময় কচি সবুজ ছিল। সেইসব পাতাগুলো আজ হলুদ বাদামি। বড়ই বিবর্ণ। সামান্য হিমেল বাতাস আর আর্দ্রতার কমতিতে এসব পাতাগুলো জীবনের উপমার গান বাজাতে বাজাতে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে। নতুন আগত পাতাদের জন্য ছেড়ে দেয় জায়গা। কী বুঝতে পারনি? অবশ্যই বুঝতে পেরেছ। এভাবেই চক্রাকারে নতুন ও পুরাতনের আশা যাওয়া ঘুরতে থাকে নাগরদোলার মতো। প্রকৃতির এ নিয়মের বাইরে আমরা কেউ না। কেউ এ বলয় বা বৃত্ত ভাঙতে পারে না। পারবেও না কোনদিন। একইভাবে আমাদের দেশে শীতও ছয়টি ঋতুর চক্রে বা বলয়ে ঘুরপাক খায়। শীত এসেছে, শীত যাবে আবার এক বছর পর আসবে এভাবেই শীত আমাদের কাছে বারবার আসবে অন্যান্য ঋতুর তুলনায় একটু বেশি আরাম নিয়ে, ভালো লাগার কোমল উত্তাপ নিয়ে, আলসেমি নিয়ে, মুখভরা মিষ্টতা নিয়ে, নবান্ন ও পিঠাপুলি নিয়ে আসবে রুক্ষতা, ধূসরতা ও কুয়াশার বায়োস্কোপ নিয়ে। আসবে সবুজ ঘাসে, ধানের পাতায়, ধানের ডগায় ও নানা রঙের ফুলের পাপড়িতে মুক্তোর মতো চকচকে শিশির বিন্দু নিয়ে।