তখনও আকাশে সূর্য উঠত, রাতের আকাশে জেগে থাকত চাঁদও। তবুও আরব দুনিয়া জুড়ে ছিল ঘনকালো আঁধারের উৎসব। না আসে সকাল, না হাসে জোছনার আলো।
মানুষগুলো মানুষ ছিল না!
কথা-কাজ, আচার-আচরণে তারা ছিল পশুর চেয়েও অধম। তাদের জীবনজুড়ে শুধুই অপরাধের দাগ, মূর্খতার দগদগে ক্ষত। কতটা অমানুষ হলে, নিজের মেয়েকে জীবিত কবর দিতে পারে কেউ! ভাবা যায়? যারা এমন কাজ করতে পারে, তারা আর কিই-বা করতে না পারে!
এক আল্লাহর ইবাদত ভুলে, তারা মাথা নোয়াতে শুরু করল মূর্তির সামনে। লাত-মানাত-ওজ্জা ছিল মূর্তিকুলের সর্দার। চারদিকে মূর্তি আর মূর্তি। ঘরে ঘরে, এখানে-সেখানে। এমনকি, মূর্তিতে ভরে উঠল পবিত্র কাবাঘরও!
বাতাসে বাতাসে ভেসে বেড়াত ব্যথার গুঞ্জরণ। আকাশ-জমিন যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত- কখন আসবে সুবহি সাদিক! কখন?
এলো এক সোনার শিশু
ঘন আঁধারের বুক চিরেই, একদিন পৃথিবীতে নেমে এলো এক সোনার শিশু, অবাক করা এক রাজপুত্র। তার প্রথম কান্নাতেই যেন ঝরে পড়েছিল পাপভরা পৃথিবীর প্রতি সমবেদনার সুর। প্রথম হাসিতে ফুটেছিল নতুন প্রভাতের অনাবিল আলো। মা আমিনা-ই বলেছেন, পৃথিবীতে আগমনের সাথে সাথেই তার শরীর থেকে ঠিকরে পড়েছিল নূর! সে নূরে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল শামদেশের মহল!
তিনি তো আলোর ফেরিওয়ালা! সুবহি সাদিকের নবী! মুহাম্মাদ (সা)!
তিনি নিজেই এক আলোর প্রদীপ! আল্লাহ বলেছেন- “হে নবী! অবশ্যই আমরা আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহবানকারী ও উজ্জ্বল প্রদীপরূপে।” (সূরা আল আহযাব ৪৬)
একদিন তিনি এই পৃথিবীকে জোছনায় ভাসিয়ে দেবেন, এ কথা বোঝার বাকি ছিল না কারোরই। অথচ তিনি ছিলেন ইয়াতিম! বাবা আবদুল্লাহ- তাঁর জন্মের আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। আর মা? মায়ের ছায়াও তাঁর মাথার ওপর বেশিদিন ছিল না। বয়স যখন ছয়, তখন মা-ও চলে যান ওপারে।
এক ইয়াতিমের ছোঁয়া পেয়ে এই পৃথিবীতে প্রাণ এলো!
এই ইয়াতিম ছেলেটির হাত ধরেই যেন নেমে এলো রহমতের শীতল হাওয়া। ভালোবাসার বিরল বৃষ্টি!
মক্কায় তখন তুমুল খরা। ফসল নেই, খাবার নেই। চাচা আবু তালেব বালক মুহাম্মাদকে নিয়ে বের হলেন। সোজা চলে গেলেন কাবাঘরের সামনে। আর তাঁর পিঠ লাগিয়ে দিলেন কাবার দেয়ালের সাথে! আকাশে মেঘের কোনো আনাগোনাই ছিল না। একটু পরেই শুরু হলো বৃষ্টি। বৃষ্টি তো বৃষ্টি, আকাশভাঙা বৃষ্টি!
ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন তিনি আল-আমিন। বিশ্বস্ত। হয়ে উঠলেন সত্যবাদিতা ও আমানতদারিতার প্রবাদপুরুষ।
পথে তাঁর কঠিন কাঁটা
বয়স তখন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না তাঁর। সে সমাজের রীতিনীতি, মানুষজনের সাথে তিনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেন না। তাঁর চিন্তার পবিত্রতা তাঁকে মিশতে দিচ্ছে না কারো সাথে। তাই তিনি একা হয়ে গেলেন। একেবারেই একা। হেরা পাহাড়ের গুহায় তিনি সময় কাটাতেন। স্ত্রী খাদিজা (রা) থাকতেন বাইরে, কাছাকাছি কোনো জায়গায়।
একদিন জিবরাঈল এলেন তাঁর কাছে। ফেরেশতা জিবরাঈল (আ)। বললেন- “পড়ুন! আপনার রবের নামে। যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে, জমাটবাঁধা রক্ত থেকে। পড়ুন! আর আপনার রব মহামহিম। যিনি কলমের সাহায্যে শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না।” (সূরা আল আলাক : ১-৫)
ওহি পেয়ে তিনি হয়ে গেলেন আল্লাহর নবী!
সর্বশেষ নবী। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী!
নবী হওয়া কোনো সহজ বিষয় নয়। মাথার ওপর যেন চেপে বসল পাহাড়ের পর পাহাড়!
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’- আল্লাহ ছাড়া ইবাদত পাওয়ার যোগ্য আর কেউ নেই! এমন ঘোষণা দেওয়া বড়ো কঠিন কাজ ছিল তখন। তাই প্রথম তিন বছর তিনি দাওয়াত দিতে থাকেন গোপনে, কাছের মানুষদের কাছে। তাঁর ডাকে সাড়াও দিয়েছেন অনেকে।
এরপর ঘোষণা এলো, “আপনাকে যে বিষয়ে আদেশ দেওয়া হয়েছে, তা সরাসরি প্রচার করুন এবং মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন।” (সূরা আল হিজর : ৯৪)
শুরু হলো বিপদের দিন।
শুরু হলো প্রতিরোধ।
তাঁকে বলা হলো পাগল। জাদুকর। মিথ্যাবাদী। পথভ্রষ্ট। (নাউযুবিল্লাহ)
দিকে দিকে শুধু উপহাস আর উপহাস!
এরপর নেমে এলো ভয়াবহ জুলুমের খড়গ। তাঁকে পাথর মারা হতো। সালাতে দাঁড়ালে গায়ে ছুড়ে মারত বকরির নাড়িভুঁড়ি! সিজদায় গেলে উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দিত পিঠের ওপর। এমনকি, নরপশুরা তাঁর মুখে থুথু মারতেও দ্বিধা করত না। একবার উবাই ইবনে খালফ পুরনো হাড় গুঁড়া করে রাসূলের গায়ে উড়িয়ে দিয়েছিল।
ওরা ভেবেছিল, তিনি থেমে যাবেন। যদিও পথে তাঁর কঠিন কাঁটা, তবুও তিনি হেঁটেই চলেছেন অবিরাম। সত্যের পথে, সাহসের পথে।
মূর্তিপূজারিদের জ্বালা আরও বাড়তে লাগল। সবশেষে তারা মিলিত হলো দারুন নাদওয়ায়। ইবলিসও হাজির হলো এক শায়খের বেশে। বলল, আমি নজদ থেকে এসেছি। তোমাদের কথা শুনতে চাই, দিতে চাই পরামর্শও! বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো, মুহাম্মাদকে হত্যা করতে হবে!
হ্যাঁ, হত্যাই!
এ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই!
এবার তাহলে কী ঘটতে চলছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের ভাগ্যে?
বাদশাহর বেশে মদীনায়
ওরা চেয়েছিল, রাসূলের জীবনপ্রদীপ চিরতরে নিভিয়ে দিতে। জিবরাঈল এসে তাঁকে জানিয়ে দিলেন সবকিছু। বললেন, আল্লাহ আপনাকে মদীনায় হিজরতের অনুমতি দিয়েছেন।
আল্লাহর পরিকল্পনায় যা ছিল, তা-ই তো হবে।
আঁধার রাত। ঘেরাও করা হলো তাঁর বাসভবন। আলী (রা)-কে বললেন, আমার এই সবুজ হাদরামি চাদর পরে আমার বিছানায়ই শুয়ে পড়ো। ওরা তোমাকে কিছুই করতে পারবে না।
এরপর বাইরে বের হয়ে এলেন আলোর সম্রাট। একমুঠো ধুলো নিয়ে ছুঁড়ে মারলেন ওত পেতে থাকা কাফিরদের প্রতি। আল্লাহ তাদের দৃষ্টিহীন করে দিলেন! অন্ধকারে তারা অন্ধ হয়ে পড়ে রইল! রাসূল (সা) তখন তিলাওয়াত করছিলেন- “আর আমরা তাদের সামনে ও পেছনে দেয়াল দিয়ে রেখেছি। তারপর তাদের আবৃত করেছি। ফলে তারা দেখতে পায় না।” (সূরা ইয়াসিন : ৯)
আবু বকর (রা)-কে সাথে নিয়ে অবশেষে তিনি পাড়ি জমালেন মদীনার পথে! পেছনে পড়ে রইল বহু ভালোবাসার জন্ম-মৃত্তিকা।
এদিকে রাসূলের আগমনের খবরে মদীনার আকাশে-বাতাসে দুলে উঠেছে খুশির সৌরভ। চারদিকে সাজ সাজ রব। আল্লাহর প্রশংসাধ্বনিতে মুখরিত পরিবেশ। আনসার শিশুরা গান গেয়ে গেয়ে মানবতার বন্ধুকে স্বাগত জানাল এভাবে-
‘তলায়াল বাদরু আলাইনা মিন সানিয়াতিল বিদা…’
দক্ষিণের পাহাড় থেকে আমাদের ওপর উদয় হলো চতুর্দশীর চাঁদ!
আর সে চাঁদকে নিয়েই কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল মদীনায়। কে কার ঘরে তুলবে তাঁকে- শুরু হয়ে গিয়েছিল মহাপ্রতিযোগিতা।
তিনি তো শুধু চাঁদ নন। চাঁদের চেয়েও জোছনাময়। জাবির ইবনে সামুরা (রা) বলেন, “এক পূর্ণিমা রাতে রাসূলকে দেখলাম- তাঁর গায়ে ছিল লাল চাদর। আমি একবার তাঁর দিকে, একবার চাঁদের দিকে তাকাতে থাকলাম। আমার কাছে মনে হলো, তিনি পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও সুন্দর।” (শামায়েলে তিরমিজি)
তাঁর পরশ পেয়ে মদীনা যেন বেহেশতের বাগান হয়ে উঠেছিল! এক নতুন সমাজের রূপরেখা দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি সেখানে। তাঁর দূরদর্শিতা দিয়ে সেখানে বসবাসরত জাতিসমূহের সাথে গড়ে তুলেছিলেন নিবিড় সম্পর্ক। তিনি হয়ে উঠলেন সবার মধ্যমণি, সবার প্রাণপ্রিয় নেতা।
মদীনা হলো ইসলামী রাষ্ট্র, আর তিনি হলেন সেই রাষ্ট্রের প্রধান!
এদিকে কুরাইশরাও থেমে থাকেনি। তাদের ষড়যন্ত্র চলছেই।
এরপর একে একে সংঘটিত হলো ছোটো-বড়ো বেশ কিছু যুদ্ধ।
ধীরে ধীরে ইসলামের আলোয় জগৎ উজালা হয়ে উঠল। এবার ফেরার পালা জন্মভূমির মাটিতে, মক্কায়! গোপনে নয়, প্রকাশ্যেই! তিনি কি তাহলে প্রতিশোধ নেবেন? যারা তাঁর জীবনকে বিষে বিষে নীল করে দিয়েছিল, তিনি কি তাদের ছেড়ে দেবেন? ক্ষমা করে দেবেন সবাইকে? এ-ও কি সম্ভব?
আজ কোনো অভিযোগ নেই
এক মহাবিজয়ের গৌরব নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন আমাদের মহানবী, অদ্বিতীয় মহাপুরুষ। মসজিদে হারামে গেলেন তিনি। চুম্বন করলেন হাজরে আসওয়াদ। তাওয়াফ করলেন কাবা। হাতের লাঠি দিয়ে সেখানকার মূর্তিগুলোকে গুঁতো দিচ্ছিলেন, আর বলছিলেন-
‘সত্য এসেছে।
অসত্য চলে গেছে।
অসত্য তো চলে যাওয়ার মতোই!’
তিনি বললেন, হে কুরাইশরা! আমি তোমাদের সাথে কেমন আচরণ করব? তোমাদের কী ধারণা? তারা বলল, ভালো আচরণ করবেন। আপনি দয়ালু! দয়ালু ভাইয়ের ছেলে! তিনি বললেন- আজ তোমাদের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই!
আল্লাহু আকবার!
আল্লাহু আকবার!
কাবার ছাদে, বিলালের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো আজানের সুর।
এভাবেই, একজন ইয়াতিম হয়ে উঠলেন দিনবদলের সেনাপতি। পৃথিবীর আকাশে উড়িয়ে দিলেন সত্য, সুন্দর ও ইনসাফের সবুজ পতাকা!
ডাক দিয়ে যাই
মুহাম্মাদ (সা)! রাসূল আমার আলোর জ্যোতি! তাঁর জীবনসমুদ্রে ডুব দেওয়া যায়। কিন্তু তাঁর কূল-কিনারা খুঁজে পাওয়া কঠিন। খুব কঠিন! তাঁর জীবনের একেকটি অধ্যায়ই তো একেকটি মহাসাগর। সে মহাসাগর থেকে এসো তুলে আনি বিরল বিরল মণি-মুক্তা।
এসো, তাঁর চরিত্রের উজ্জ্বলতায় আলোকিত হই। এসো তাঁর আদর্শেই আলোকিত হই। তাঁর মতো হাসি, তাঁর মতো কাঁদি। এসো, তাঁর দেখানো পথেই হেঁটে চলি জীবনের শেষ অবধি। এসো, তাঁকে ভালোবাসি-
জীবনের চেয়ে বেশি!
বাবা-মায়ের চেয়ে বেশি!
সকল মানুষের চেয়ে বেশি!