Home ভ্রমণ নাপিত্তাছড়া ঝরনার অপারসৌন্দর্য -আজহার মাহমুদ

নাপিত্তাছড়া ঝরনার অপারসৌন্দর্য -আজহার মাহমুদ

ভ্রমণপ্রিয় মানুষের জন্য ছুটির দিন মানেই আনন্দের দিন। একটু জলপ্রপাত, পাহাড়, সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতে তারা সবসময় অপেক্ষা করে ছুটির দিনের জন্য। ছুটির দিন মানে তাদের জন্য ভ্রমণের দিন। ঠিক তেমনি এক ছুটির দিনে আমরা ৫ বন্ধু মিলে চলে গেলাম চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের অতি পরিচিত একটি ঝরনাতে। ঝরনার নাম নাপিত্তাছড়া ঝরনা। নাম শুনলে হয়তো একটু অদ্ভুত মনে হতে পারে। তবে এই অদ্ভুত নামের ঝরনাটিতে পাবেন চমৎকার ট্রাকিং আর প্রকৃতি দেখার সুযোগ। নাপিত্তাছড়া ঝরনার সৌন্দর্য উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম বন্ধুরা মিলে। এই ভ্রমণে সঙ্গী হতে বোয়ালখালী থেকে ২ বন্ধু এবং একজন বড়ো ভাই এসেছেন। আর চট্টগ্রামে আমরা দুই বন্ধু তো আছিই। সর্বমোট ৫ জনের এই গ্রুপটি সকাল ৮টায় চট্টগ্রামের একে খান থেকে রওনা দিলাম মিরসরাইয়ের নয়দুয়ারি হাটের উদ্দেশে। চট্টগ্রাম নগরীর একে খান থেকে ঢাকা-কুমিল্লাগামী বাসে উঠে নয়দুয়ার বাজার/হাট বললেই নামিয়ে দেবে। জনপ্রতি ৫০-৬০ টাকা করে নিবে।
যাইহোক বাসে উঠলাম, প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছালাম নির্দিষ্ট স্থানে। অর্থাৎ নয়দুয়ারি হাটে। গাড়ি থেকে নেমে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দিবে ঝরনা দেখতে যাওয়ার রাস্তা কোনটা। চাইলে ওই গ্রাম থেকে একজন গাইড নিয়ে নিতে পারেন, ৪০০-৫০০ টাকার মতো নেবে ৪-৫ ঘণ্টার জন্য। আমরাও একজন গাইড নিলাম। ভদ্রলোকের নাম আব্দুল করিম। আমরা করিম ভাই বলেই ডাকছি তাকে। ৪০০ টাকায় তার সাথে দফারফা হলেও পরে তাকে আবার চা-নাস্তা খাওয়াতে হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায় গাইডের পেছনে ৪৫০ টাকা ব্যয় হয়েছে।
এরপর পাহাড়ি অরণ্যে ঝিরিপথ বরাবর চলা শুরু করলাম করিম ভাইয়ের পেছন পেছন। করিম ভাই বলেন, এখানে মোট ৪টি ঝরনা আছে- টিপরাখুম ঝরনা, কুপিটাকুম ঝরনা, মিঠাছড়ি ঝরনা ও বান্দরখুম ঝরনা। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ এবং প্রচণ্ড গরম আমাদের কিছুটা ক্লান্ত করেছে। তবে যত যাচ্ছি প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখে মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। বড়ো বড়ো পাথর আর পানি তো আছেই।
সাথে আছে বিশাল বিশাল পাহাড়ের খাদ। ভয়ঙ্কর কিন্তু অসম্ভব সুন্দর। দুইপাশে পাহাড় আর মাঝখানে সরু রাস্তা। রাস্তা বলতে এটা সহজ রাস্তা নয়। কখনও বড়ো বড়ো পাথর পাড়ি দিতে হবে, কখনও ছোটো ছোটো পানির গর্ত পাড়ি দিতে হবে আবার কখনও উঠতে হবে পাহাড়ে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির দেখা মিলবে এই পথে যাওয়ার সময়। তবে ঝরনায় যাওয়ার এই রাস্তাটির প্রতিটি অংশই অদ্ভুত সুন্দর। এভাবেই আমাদের গাইড করিম ভাই আমাদের নিয়ে চলে আসলেন ঝরনার কাছে। ঝরনা ৪টি বেশি দূরে নয়। আমরা প্রথম ঝরনাটির সামনে চলে এলাম। তবে এই টিপরাখুম ঝরনার পানি ততটা স্বচ্ছ নয়। কিন্তু বাকি ঝরনাগুলোর চাইতে এই ঝরনাটি সবার আগে। তাই অনেকে ক্লান্ত হয়ে এখান থেকেই ফিরে যায়। এর প্রায় ১০-২০ মিনিট যাওয়ার পর দ্বিতীয় ঝরনা কুপিকাটাকুম পেয়ে যাবেন। অনেক সুন্দর একটা ঝরনা। ঝরনাতে পানির পরিমাণও ভালো। ঝরনাটির সামনের পানির অংশটি কিছুটা গভীর। তাই একেবারে ঝরনার সামনে যেতে হলে আপনাকে সাঁতার কেটে যেতে হবে। সেইসাথে ঝরনার পানি বেশ ঠান্ডা। সূর্যের এই তাপের মাঝেও একটুখানি প্রশান্তি পাওয়া যায় এই ঠান্ডা পানিগুলো দিয়ে মুখ ধুয়ে নিলে। পানিগুলো পানও করা যায়।
যাইহোক ঝরনার পানি পান করলাম, ছবি তুললাম, নাস্তা করলাম এবং হালকা বিশ্রাম নিলাম। এরপর তৃতীয় ঝরনা মিঠাছড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। মিঠাছড়ি ঝরনাতে যাওয়ার সময় ছোটো একটি পাহাড়ের প্রায় খাড়া একটি ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে হবে। এটা বেশ ভয়ঙ্কর। তাই যাদের ট্রাকিং করার অভিজ্ঞতা কম তাদের এসময় কিছুটা সতর্ক থাকতে হয়। ঝরনাটি বেশ কাছেই। ২০ মিনিটের মধ্যেই মিঠাছড়ি ঝরনাতে পৌঁছে যাবেন। ঝরনাটির উচ্চতা বেশ। ওপর থেকে পানি পড়ার সময় অর্ধেকটা অংশ পার হওয়ার পর দুই ভাগ হয়ে দুই দিকে পানি পড়ে। নিজের চোখে না দেখলে দৃশ্যটি সত্যি বলে বুঝানোর মতো নয়। বিশেষ করে বর্ষার সময় এই ঝরনাটি খুব সুন্দর দেখায়।
মিঠাছড়ি ঝরনাতে কিছুক্ষণ থাকার পর সর্বশেষ ঝরনা বান্দরকুম বা বান্দরিছড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট ঝিরি পথ বরাবর হাঁটার পর ঝরনাটি পেয়ে যাই। এই ঝরনাটিও বেশ সুন্দর। বাকি ৩টি ঝরনার চাইতে এই ঝরনাটির উচ্চতা সবচেয়ে বেশি। ঝরনাতে যাওয়ার ঝিরি পথটা অনেক সুন্দর। তেমন কোনো ভয়ঙ্কর রাস্তাও ছিল না। তবে এই ঝরনাগুলো দেখতে বর্ষার সময় আসাটাই সবচেয়ে ভালো সময়, তাহলে ঝরনার সর্বোচ্চ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।
দীর্ঘ সময় ঝরনার মনোরম দৃশ্য উপভোগ করলাম। এবার ফেরার পালা। রওনা দিলাম গাইড করিম ভাইয়ের পেছন পেছন। ৪-৫ ঘণ্টা বললেও আরও বেশি সময় লেগেছে আমাদের। প্রায় সন্ধ্যা নামতে শুরু করছে। আর বেশি সময় থাকা যাবে না।
গাইড নেওয়ার সুবিধাটা উপলব্ধি করলাম আমরা শেষ সময়ে। যেদিক দিয়ে এসেছিলাম সেদিক দিয়ে সবাই যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যখন ফিরে যাচ্ছি তখন ভিন্ন পথ দিয়ে যাচ্ছি। এই ভিন্ন পথে যাওয়ার কারণটা হচ্ছে সহজ রাস্তা। আর এই সহজ রাস্তাটা গাইড থাকার কারণেই চেনা। ঝরনার পাশেই পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতে হবে। এরপর অল্প হেঁটেই পাহাড় দিয়ে শুধু নামলেই চলবে। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা নেমে গেলাম। গাইড না থাকলে এমন সহজ পথ আছে কেউ জানত না। তবে পাহাড় বেয়ে উঠা যেমন কষ্ট নামাও তেমন কষ্ট। এটা নাপিত্তাছড়া ঝরনা ভ্রমণে না আসলে বুঝতে পারতাম না।
পুরো ভ্রমণের সার্থকতা খুঁজতে চাইলে প্রথমেই বলতে হবে ট্রাকিংয়ের কথা। বড়ো বড়ো পাথর আর পাহাড়ের গহিনে যাওয়াটা সহজ বিষয় না। এছাড়াও পরিবেশ প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার স্বাদ তো পাবেনই। তবে ঝরনার কাছাকাছি চলে আসলে দূর হয়ে যাবে আপনার সকল ক্লান্তি। নিজের চোখে জলপ্রপাত দেখার এই অপূর্ব অনুভূতি একমাত্র যিনি দেখেন তিনিই জানেন।

কীভাবে যাবেন?

ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো বাসে উঠে নয়াদুয়ারি বাজারে নেমে যেতে হবে। ট্রেনে করে আসলেও সীতাকুন্ড নেমে নয়াদুয়ারি বাজার আসা যায়। চট্টগ্রামের একে খান থেকে নয়াদুয়ারি বাজার আসতে পারবেন বাসযোগে।

কোথায় থাকবেন?

এই ভ্রমণ একদিনের তাই থাকার দরকার পড়বে না তবু নিতান্তই রাতে থাকতে চাইলে মিরসরাই বা সীতাকুন্ডে হোটেল পাবেন। ভালো হোটেলে থাকতে চাইলে চট্টগ্রাম চলে যেতে হবে।

খাবেন কোথায়?

ট্রেইলে যাবার পথে একটা ছোটো হোটেল আছে, সেখানে যাওয়ার আগে কী খাবেন তার অর্ডার দিয়ে যেতে হবে। তাহলে রান্না করে রাখবে, ফিরে এসে খাওয়া দাওয়া করতে পারবেন। এছাড়াও ভালো মানের খাবার খেতে চাইলে মিরসরাই, সীতাকুন্ডে ভালো মানের রেস্তোরাঁ রয়েছে।

SHARE

Leave a Reply