Home ভ্রমণ মেঘ ছুঁয়ে দেখা -নোমান আল মামুন

মেঘ ছুঁয়ে দেখা -নোমান আল মামুন

বিজয়ের গানে মুখরিত এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার পাঁচশ সত্তর বর্গকিলোমিটারের এক টুকরো সবুজে ঘেরা জান্নাত। সেই জান্নাতের বয়স আজ পঞ্চাশ বছর পেরিয়েছে। লাল সবুজের সেই পতাকার দিকে যখন তাকাই বইয়ের পাতায় পড়া বীরত্ব গাথা ইতিহাস যেন আমাকে নব জাগরণের ডাক দেয়। মগজে গাঁথা ভবঘুরে আমিটা যেন বলেই বসে লাল-সবুজকে ছুঁয়ে দেখাও এবার মেঘ।
এবারের গন্তব্য আমাদের বান্দরবানের আলীকদমে অবস্থিত মিরিঞ্জা রেঞ্জের একটি পাহাড় মারাইথং। এর উচ্চতা প্রায় ১৬৪০ ফুট। অনেকে এ পাহাড়কে মারায়ন তং বা মারায়ন ডং নামেও ডেকে থাকেন। পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় রয়েছে এক বৌদ্ধ মন্দির। এ উপাসনালয়টির চারপাশ খোলা এবং মাথার ওপরে চালা দেওয়া। এ বৌদ্ধ মন্দিরে আছে বুদ্ধের এক বিশাল মূর্তি। সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি এ স্থানটি। দর্শনীয় স্থান হিসেবেও স্থানটি মনোরোম এবং দৃষ্টিনন্দন। মারাইথং পাহাড়ের ওপর থেকে যত দূর দৃষ্টি যায়, দেখতে পাবেন শুধু পাহাড় আর পাহাড়। আর এসব পাহাড়ের ফাঁকে রয়েছে আদিবাসীদের ছোটো ছোটো ঘরবাড়ি, রাস্তা, ফসলের জমি। এ ছাড়াও নিচে সাপের মতো এঁকে-বেঁকে বয়ে চলেছে মাতামুহুরী নদী। সব মিলিয়ে স্থানটি বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতি সৃষ্টি করবে। মারাইথংয়ে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হলো আগস্ট থেকে অক্টোবর মাস।
ঢাকা থেকে আলীকদম সরাসরি বাস যায় কিন্তু আমরা ভ্রমণকে আরো প্রাণবন্ত করতে আমরা যাবো ট্রেনে। আমরা ছিলাম ৯ জন এবারের মারাইথং অভিযানে।
যথাসময় গড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমাদের ট্রেনের খোঁজ নেই এদিকে স্টেশনের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে যখন প প করে ট্রেন আসছে তখন অবুঝ বালকের মতো ভাবছি এটা বোধ হয় আমাদের ট্রেন কিন্তু না। অবশেষে সাঁইত্রিশ মিনিট দেরি করে আসলো বাছাধন ট্রেন।

ঝিক ঝিক করতে করতে ট্রেন আবার চলা শুরু করলো এবার তার গন্তব্য বন্দর নগরী চট্টগ্রামে মাঝে কোনো থামাথামি নেই। ইটপাথরের নগরী ছেড়ে ট্রেন এখন সবুজে ঘেরা তেপান্তর ভেদ করে চলছে আরবের ঘোড়ার মতো। ট্রেনের জানালা দিয়ে একটু ক্লান্তির নিশ্বাস ফেলতে মাথাটা বের করে দিলাম। যেন বাংলার ঘ্রাণ আমাকে মাতাল করে দিচ্ছে। আমার সামনের সিটে বসা তরুণ কবি মুনাওয়ার, কবির মনে উঠেছে স্রোত জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে একাকী মনে গেয়ে যাচ্ছেন গুনগুনিয়ে গান। সবার চেহারার মাঝে এক অন্য রকম আনন্দ। ট্রেন বন্দর নগরী চট্টগ্রাম এসে থামলো রাত ১০ টায়।
এখন আমাদের গন্তব্য চকরিয়া, ট্রেনে জার্নির পর শরীরে একটু আলসেমি ভাব বশ করেছে। শীত তখন পৌষ মাসের চাদরটা গায়ে জড়িয়ে টুপিটা মাথায় পেচিয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা কিন্তু চোখে যে ঘুম নেই। এদিকে আমাদের বাস যেন চলছে বাতাসের গতিতে। ধারালো তরবারির মতো কুয়াশাকে যেন ছেদ করে অবিরাম গতিতে চলছে আমাদের বাস। ঘড়ির কাঁটার শব্দ বাড়ার সাথে সাথে অনেকে চোখের পাতাও এক করেছে। আমি ফোনের নোট অপশনে কয়েক লাইন কবিতা লেখার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। বাসের সুপারভাইজার ডাক দিলো, চকরিয়া যারা নামবেন ওঠেন। নেমে পড়লাম চকরিয়া। রাত তখন ৩টা বাজে। চারিদিকে নিস্তব্ধ শুধু ঝিঁঝি পোকার ঝিঁঝি শব্দ। মাঝে মধ্যে শহরের রাস্তার কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে উঠে। এতো নির্জন রাত তারপর হিম শীতল বাতাস যেন শরীরের টগবগে রক্তকেও জমিয়ে ফেলবে। মহাসড়ক থেকে কিছুটা ভিতরে রায়তুশ শরফ হিফজ মাদরাসার গেটে গিয়ে পৌঁছলাম। গেটে তালা ঝুলানো, তাছাড়া এতো রাতে কে বা জেগে থাকবে? এখন মাদরাসা শীতকালীন ছুটি চলছে এজন্য বিভাগে সেই শেষ রাতের কুরআন তেলাওয়াতের আমেজ নেই।
লোকালয় ছাড়িয়ে যখন আমাদের চান্দের গাড়ি পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশ করে চারিদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়ের মাথায় মেঘের মেলা। চেকপোস্ট পাড়ি দিয়ে গাড়ি থামিয়ে সবাই গাড়ির ছাদে উঠে পড়লো আমি আর মেহেদী ভাই বাদে। পাহাড়ি রাস্তার আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলছি গন্তব্যের খোঁজে। ওপর থেকে উল্লাসের আওয়াজ আসছে মনে মনে আফসোস হচ্ছে কেন যে ছাদে উঠলাম না। কিছুক্ষণ পর গাড়ি থামলে আমিও উঠে গেলাম ছাদে। কিন্তু একটু আগে যে উল্লাসের শব্দ শুনে আফসোস করছিলাম এখন বুঝতেছি তারা আনন্দে নয় বরং তীব্র শীতের বায়ুর সুচে ফোটা আর্তনাদে চিল্লিয়েছি। আর এখন আমিও তাদের আর্তনাদের সাথী হই। কীভাবে আনন্দ আর শীতকে শীতের মতো উপভোগ করতে করতে চলে এলাম মারাইথং পাহাড়ের নিচে।
বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে আমরা প্রস্তুত পাহাড়ে উঠার জন্য। আমরা কয়েকজন সাথে লাঠি নিলাম। সমতল ভূমি থেকে পাহাড়ের চূড়াগুলো দেখে শুধুই মনে হচ্ছিলো কখন উঠবো। সমতল ছেড়ে এখন আমরা ধরেছি পাহাড়ি পথ। ব্যাগ ছাড়াও দুই লিটারের একটা করে পানির বোতল হাতে ধরিয়ে সেনাবাহিনীর অনুশীলন করাচ্ছে ক্যাপ্টেন আরিফ। কিছুদূর উঠার পর কিছু মানুষ বলছে কষ্ট করে পানি টানছেন কেন? ওপরে তো আছেই কিছু টাকা হয়তো বেশি পড়বে, কিন্তু টেনে নেওয়ার কোনো যুক্তি আসে না তখন যে কী পরিমাণ মেজাজটা গরম হচ্ছিলো।
পাহাড়ও দেখতে পারবেন আবার বিভিন্ন উপজাতিদের সঙ্গেও সাক্ষাতের সুযোগ পাবেন মারাইথংয়ে গেলে। প্রকৃতির অপার বিস্ময় লুকিয়ে আছে সেখানে। এ পাহাড়ের বিশেষত্ব হলো, এর চূড়া একেবারেই সমতল স্থানের মতো। এ কারণেই আদিবাসীরা স্থানটি তাদের বসবাসের জন্য বেছে নিয়েছেন। মারাইথং পাহাড়ে বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস। এদের মধ্যে ত্রিপুরা, মারমা ও মুরং অন্যতম। পাহাড়ের ঠিক নিচের অংশে বসবাস মারমাদের। পাহাড়ের বিভিন্ন খাঁজে মুরংদের পাড়া। পাহাড়ের ঢালে তারা বাড়ি বানিয়ে বসবাস করেন। মাটি থেকে সামান্য ওপরে এদের টংঘর। এসব ঘরের নিচে থাকে বিভিন্ন গবাদিপশু যেমন-গরু, ছাগল, শূকর, মুরগি। কখনো গবাদিপশুর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জ্বালানি কাঠও রাখা হয় স্তূপ করে।
মাঝ পথ পেরিয়ে একটা বিশাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পড়লাম যেন আমার পা আর চলছেই না। আমি, তাহমিদ ও মুনাওয়ার ভাই। মুনাওয়ার ভাই বললেন আপনারা আসেন আমি যাই। আমরা দু’জন অলস কচ্ছপের মতো চলতে শুরু করলাম আবার। কিছুটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মারাইথংয়ের চূড়া, শরীরে যেন গ্লুকোজ এনার্জি ফিরে এলো। লাল-সবুজের পতাকা বের করে লাঠির সাথে বেঁধে আল্লাহু আকবার বলে সাবমিট করলাম মারাইথং ট্রেকিং।
পশ্চিম আকাশে সবুজের বুকে ঢলে পড়েছে ক্লান্ত সূর্য যেন বিশাল একখানা প্রকৃতির আদলে গড়া লাল-সবুজের পতাকা। আমরা যখন পাহাড়ে উঠেছি তখন হাতেগোনা কয়েকটি তাঁবু, ভাবলাম আজ হয়তো বেশি মানুষ হবে না। কিন্তু সময় যেতে না যেতেই পিপীলিকার সারির মতো শূন্য পাহাড়ের ভূমিটুকু ভরে গেলে রঙবেরঙের তাঁবুতে। রক্তিম সূর্য হারিয়ে গেছে পাহাড়ের গহিনে, পৃথিবীর বুকে নেমে এলো সন্ধ্যা। এখান থেকে আজানের ধ্বনি শোনাও সম্ভব না আমরা ফোনে সালাতের সময় দেখে আদায় করে নিলাম সালাত। তাঁবু থেকে বের হয়ে দেখি কেউ কেউ ইতোমধ্যে আগুন জ্বেলে তার চারিপাশে বসে আড্ডা দিচ্ছেন আবার।
আমরাও ফায়ার ক্যাম্প করি নিচ থেকে সাথে আনা মুরগিগুলোকে প্রয়োজনীয় মশলা মাখিয়ে করে ফেলি বারবিকিউ। কিছুক্ষণের জন্য নিজেদের ডিসকভারি চ্যানেলের ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ডের বিয়ার গ্রিলসের মতো লাগছিল।

পাহাড়ের মাথায় সাদা মেঘ রাশি যেন কি এক পরম মমতায় লেপটে আছে। মেঘ যেন ছুঁয়ে দেখার স্বপ্নটা পূরণ হয়েই গেল আজ। কবিমনে ছন্দে ছন্দে গেয়ে উঠি:
মেঘের রাশি করছে খেলা
পাহাড়ের ঐ মাথায়,
সবুজ পাহাড় ঢেকেছে আজ
সাদা তুলার কাঁথায়।

SHARE

Leave a Reply