আজ ২৯ রমজান। যদি এ বছর রোজা ৩০টা পূর্ণ না হয় তাহলে আগামীকালই ঈদুল ফিতর। এ নিয়ে চিন্তিত রিক্শা চালক রমজান আলী। রমজান আলী হতদরিদ্র একজন রিক্শা চালক। প্রতিদিন রিক্শা চালিয়ে যা আয় করে তা দিয়ে তার সংসার চলে। স্ত্রী আর এক মেয়ে মিলিয়ে তিনজনের সংসার। রমজান আলীর গ্রামের বাড়ি রংপুরে। ঢাকায় একটি বস্তিতে ছোটো একটি রুম নিয়ে কোনো রকম মাথা গুঁজার ঠাঁই করে নেয় রমজান আলী। প্রতিদিন রিক্শা চালিয়ে যা পায় তা দিয়ে বাজার সদাই করলে সংসারে দু’মুঠো ভাত জোটে, না হয় অনাহারে উপবাসে কাটতে হয় তাদের। রমজান আলীর ফুটফুটে একটি মেয়ে। বয়স ৫ কিংবা ৬ বছর। মেয়ের আজ বাবার কাছে আবদার-
– কালতো ঈদ। বাবা, তুমি আমার লাইগা ঈদের নতুন জামা কিন্না দিবা না।
– মা, তোমার জন্য আজ আইতে একটি নতুন লাল ফুটফুটে জামা নিয়ে আইবো।
এতে মেয়ে আনন্দে লাফাতে লাফাতে চলে গেল। রমজান আলী রিক্শা নিয়ে বের হবে এমন সময় স্ত্রী এসে বললো-
– ঘরে তো চাল, ডাল, আলু কিছুই নাই। তুমি আহনের সময় নিয়ে আইলে রান্না করমু।
রমজান আলী আশ্বাস দেয়, সে আসার সময় বাজার সদাই নিয়ে আসবে। আর মেয়ের জন্যও নতুন জামা নিয়ে আসবে। রমজান আলী রীতিমতো রিক্শা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আজ আবহাওয়ার তাপমাত্রা খুবই বেশি। প্রচণ্ড গরম পড়ছে। রোজার দিনে রিক্শা চালানো খুবই কষ্ট হচ্ছে রমজান আলীর। তারপরও যাত্রীর জন্য বসে থাকে। সারাদিন শেষে বিকেল ঘনিয়ে এলো। কিছুক্ষণ পরই ইফতারের সময় হবে। পুরো দিন রিক্শা চালিয়ে ১৫০ টাকা আয় করেছে। বাসায় ফিরবে চিন্তা করে আবার থমকে দাঁড়ায়। বাজার সদাই না নিলে চুলায় রান্না জুটবে না। আবার মেয়ের কথাও বারবার মনে পড়ে তার। বাসা থেকে বের হওয়ার সময়তো মেয়েকে কথা দিয়েছিল নতুন জামা নিয়ে যাবে। হঠাৎ করে ফুটপাথে ভ্যানে করে জামা কাপড় বিক্রয় করতে দেখা গেল। পাশে রিকশা রেখে এগিয়ে গেল একটা নতুন জামা কিনতে। একটা লাল জামা পছন্দ হলো। দোকানদার বললো,
– নিলে একদাম ২৫০ টাকা লাগবে।
রমজান আলী পকেট থেকে বের করে দেখে ১৫০ টাকা আছে। সে বলে,
– ভাই ১৫০ টাকায় দেওয়া যায় না।
দোকানদার বলে ওঠে,
– ঐ মিয়া নিলে নেন না হয় দূর হন। বিরক্ত করবেন না।
রমজান আলী কোনো কিছু না ভেবে জামাটা শার্টের ভিতরে নিয়ে ফেলে। পাশ থেকে লোকজন দেখে চোর চোর বলে চিৎকার করতে থাকলে, সবাই রমজান আলীকে মারধর দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায়।
থানায় পুলিশ অফিসার হায়দার হোসেনের সামনে বসে আছে রমজান আলী। একটু পরই ইফতারের সময় হবে। পুলিশ অফিসার রমজান আলীর কাছ থেকে বিস্তারিত শুনে এবং কনস্টেবলকে রমজান আলীর রিকশাটা সন্ধান করতে পাঠায়। ইফতারের সময় হয়ে গেল পুলিশ অফিসার হায়দার হোসেনের স্ত্রীর পাঠানোর ইফতার বক্স খুলে ইফতার করা শুরু করে। এসময় রমজান আলী বলে ওঠে,
– স্যার আমাকে এক গ্লাস পানি দিবেন। রোজাটা ভাঙবো।
– কী বলো তুমি রোজা রাখছো। রোজা রেখে চুরি করছো।
– জি স্যার আমি রোজা রেখেই চুরি করছি। আমি রোজাদার চোর। স্যার ধরা খেয়ে ভালোই হলো আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে না হয় জামাটা আমার জন্য হারাম হয়ে যেতো।
পুলিশ অফিসার রমজান আলীর কথা শুনে তাকে নিজের টেবিলে বসিয়ে ইফতার ভাগ দিলো। আর ভাবলো সে স্বভাবের চোর নয়, অভাবের চোর। একটু পর পুলিশ কনস্টেবল দু’জনের প্রবেশ।
স্যার রিকশাটাতো পাইলাম না। কেউ মনে হয় নিয়ে গেছে।
রমজান কান্নার স্বরে বলে,
– স্যার কী বলেন এসব। আমার রিকশা হারিয়ে গেলে মহাজন আমাকে মেরেই ফেলবে। আমি এত টাকা কোথা থেকে পরিশোধ করবো।
রমজান আলী হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে। পুলিশ অফিসার কনস্টবলকে লক্ষ্য করে বললো,
– যে করেই হোক ওর রিকশাটা খুঁজে বের করে আনো।
অফিসার নিয়মিত কাজ করছে। রমজান আলি বসে আছে। রাত যতই বাড়ছে রমজান আলীর চিন্তাও তত বেড়ে যাচ্ছে। ঐদিকে মেয়ে আর স্ত্রী না খেয়ে আছে।
স্যার, আমার একটু বাসায় যাইতে দেন। আমি গিয়ে কিছু খাবার কিনে বাসায় দিয়ে আবার চলে আমু। স্যার, আমায় বিশ্বাস করেন। আমি সত্যি সত্যি চলে আমু স্যার।
ঘড়ির কাঁটায় রাত ১০টা ছুঁই ছুঁই। হায়দার সাহেব ফাইলপত্র গুছিয়ে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রমজান আলীকে সাথে নিয়ে নিজ বাসার দিকে যাচ্ছে। স্ত্রীকে ফোন করে বলে, আমি আসছি সাথে একজন মেহমানও আছে তুমি খাবার রেডি করো।
ডাইনিং টেবিলে হায়দার হোসেন তার স্ত্রীসহ বসে আছে। রমজানকে রাতের খাবার দিলো। কিন্তু রমজান প্রথম লোকমাতে থমকে দাঁড়ায়। খাবার মুখে দিতে গিয়ে তার মেয়ে ও স্ত্রীর কথা মনে পড়ে যায়। সে বলে ওঠে,
– স্যার এই খাবারগুলো আমি বাসায় নিয়ে যাই। আমার ছোট্ট মেয়েটা না খেয়ে আছে সারাদিন।
হায়দার সাহেবের স্ত্রী বলে উঠলো,
– আপনি এই খাবারটা খেয়ে নিন। আপনার বাসার জন্য খাবার রেডি আছে, যাওয়ার সময় নিয়ে যেতে পারবেন। রমজান আলী মনে মনে কিছুটা খুশি। সে তাড়াহুড়ো করে খাবার খেয়ে রওয়ানা দিলো। হায়দার সাহেব তার হাতে খাবারের বক্সটি তুলে দিয়ে বললো,
– কাল ঈদ হচ্ছে না। এ বছরও ৩০ রোজা পূর্ণ হবে। তুমি খাবারগুলো বাসায় নিয়ে যাও।
রমজান আলী খাবারগুলো নিয়ে দৌড়িয়ে বাসার দিকে যাচ্ছে। পথিমধ্যে দেখা তার প্রতিবেশী রিকশা চালক ইদ্রিস মিয়ার সাথে। – কী ব্যাপার রমজান ভাই সারাদিন কোথায় ছিলে। আর তোমার রিকশা চুরি হয়েছে শুনে মহাজন তো তোমার স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে আটকে রাখছে।
এ কথা শুনে রমজান আলীর মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।
– বলো কি ইদ্রিস ভাই। এখন আমার কী হবে? আচ্ছা তুমি খাবারগুলো নিয়ে আমার মেয়ে আর বৌকে দাও। আমি আসছি।
রমজান আলী সোজা পুলিশ অফিসার হায়দার আলীর বাসায়।
– স্যার ও স্যার দরজা খুলেন স্যার।
হায়দার হোসেন বেরিয়ে আসলো।
– স্যার আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমার রিকশা চুরি হয়েছে শুনে গ্যারেজ মালিক আমার বৌ আর মেয়েকে নিয়ে আটকে রাখছে।
এ কথা বলার সাথে সাথে পুলিশ অফিসার বললো
– চলো।
বাসা থেকে বের হওয়ার সময় কনস্টেবল দু’জন হাজির।
– স্যার রিকশাটি পাওয়া গেছে। একজন চোরসহ রিকশাটিকে আমরা থানায় নিয়ে আসছি। এখন থানায় আছে। এই খবরটা দেওয়ার জন্যই আসলাম।
– আচ্ছা ঠিক আছে তোমরা এখন আমার সাথে চলো।
পুলিশ অফিসার কনস্টেবল দু’জনসহ রমজান আলীকে নিয়ে সোজা মহাজনের গ্যারেজে চলে আসলো। এসে দেখে মেয়েটি কান্নাকাটি করছে। পাশেই বসা মহাজন। পুলিশ অফিসার বললো,
– এই গ্যারেজের মালিক কে?
মহাজন বললো-
– জি সার আমি।
রমজান আলীর স্ত্রী আর মেয়েকে উঠিয়ে আনছে কে?
মহাজন,
জি স্যার আ…মিই ..
পুলিশ অফিসার-
– কাজটা ঠিক করেননি। আপনাদের জন্যই সমাজের আজ এই অবস্থা। আপনাদের মাঝে কোনো দয়া-মায়া নেই। শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ইনকাম করতে পারলেই চলে। এই কাজটা ভালো করেননি।
– রমজান আলী, তুমি তোমার স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে বাসায় যাও। আর সকাল সকাল থানায় চলে এসো।
মহাজনকে উদ্দেশ করে বলেন
– আপনিও একবার থানায় আসবেন।
সকাল ১০টার আগেই রমজান আলী থানায় হাজির। হায়দার হোসেন রমজান আলীকে তার রিকশা বুঝিয়ে দিয়ে বললো
– কালতো ঈদ, তুমি তোমার মেয়ে স্ত্রীসহ আমার বাসায় দাওয়াত থাকলো। চলে আইসো।
রমজান আলী পুলিশ অফিসার হায়দার হোসেনের কাজকর্ম এবং কথাবার্তা শুনে রীতিমতো অবাক হচ্ছে। সে ভাবে পুলিশ অফিসার এতো ভালো হয় কীভাবে? ওর মতো যদি সবাই সৎ এবং ভালো মনের হতো দেশে কোনো চুরি, ছিনতাই, খুন-মারামারি, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি হতে পারতো না! আমাদের দেশটা সোনার দেশে পরিণত হতো।
ঠিক আছে স্যার কালকে আমুনি। আমি এহন যাই স্যার।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আজ সেই বহু প্রতীক্ষিত ঈদের দিন। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। রমজান আলী তার মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে পুলিশ অফিসারের বাসায় হাজির। এদের পেয়ে পুলিশ অফিসার ও তাঁর স্ত্রী দু’জনই খুশি। কারণ তারা গরিব দুঃখী ও অসহায় মানুষের পাশে থাকে সবসময়। এজন্য অসহায়দের জন্য কিছু করতে পারলে এরা খুশি হন। ওনারা রমজান আলী ও তার মেয়ে স্ত্রীকে ভালোভাবে খাওয়ালেন। খাওয়া শেষে হায়দার হোসেনের স্ত্রী ১২ হাজার টাকা রমজান আলীর হাতে তুলে দিয়ে বললো-
– এ টাকা দিয়ে কিছু একটু করো, যাতে তোমার পরিবার আর কষ্ট না পায়। এগুলো আমার টিউশনির টাকা। প্রতি বছর ঈদের পর আমরা বেড়াতে যাই। এবার করোনার কারণে কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। তাই ভাবলাম এই টাকাগুলো তোমাদের দিলে কাজে লাগবে।
টাকাগুলো পেয়ে রমজান আলী ও তার স্ত্রী খুবই খুশি হলো।
এক বছর পর-
রমজান আলী এবং তার মেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে তারা আজ পুলিশ অফিসার হায়দার হোসেনের বাসায় আসলো। ওরা এখন আগের চেয়ে অনেকটা পরিপাটি। পোশাক-পরিচ্ছদে আগের চেয়ে কিছুটা স্বাবলম্বী মনে হচ্ছে। দরজা খুলেই হায়দার হোসেন ও তার স্ত্রী ওদের দেখে খুশি হলেন। ভেতরে নিয়ে গেলেন। হায়দার হোসেন-
– কী ব্যাপার বলো এখন কেমন যাচ্ছে তোমাদের সংসার।
– জি স্যার আলহামদুলিল্লাহ। এখানে ১২ হাজার টাকা আছে এই টাকা ফেরত দিতে আসছি।
পুলিশ অফিসার হায়দার হোসেনের স্ত্রী-
– কী বলো, এই টাকা ফেরত দিতে আসছো মানে? দানের টাকা কেউ ফেরত নেয় নাকি?
– ম্যাডাম আমরা এখন স্বাবলম্বী। গত বছর আপনি যে টাকাটা দিয়েছেন ওই টাকা দিয়ে আমরা একটা সেলাই মেশিন কিনেছি। দুইজনে ইনকাম করে কিছু দিন আগে একটা কাপড়ের দোকানও দিয়েছি। এবার রমজান মাসে আমাদের ভালো ইনকাম হয়েছে। আমরা এখন সুখেই আছি। তা ছাড়া এই টাকা আপনারা অন্য কাউকে দান করলে সে উপকৃত হবে।
ওদের কথা শুনে পুলিশ অফিসার হায়দার হোসেন ও তার স্ত্রী মহা খুশি। আর ভাবলো, যাই হোক আমাদের উসিলায় একটা পরিবার স্বাবলম্বী হতে পেরেছে। এবারও আমরা বেড়াতে না গিয়ে এই টাকাটাসহ এমন কাউকে খুঁজে বের করে দান করবো, যাতে করে তোমাদের মতো আর দুটো পরিবার স্বাবলম্বী হতে পারে।