মুশফিকুর রহীম বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অনেক বছর ধরে বাংলাদেশের মিডল অর্ডারের স্তম্ভ হয়ে আছেন বগুড়ায় জন্ম নেওয়া সদা হাস্যোজ্জ্বল এই ক্রিকেটার। শুধু যে ক্রিকেটেই তিনি সেরা তেমনটি নয়। একই সাথে লেখাপড়ায়ও মুশফিক সেরাদের একজন। দেশের নামকরা বিশ^বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল করেছেন। সদাচরণ, শৃঙ্খলা-নিয়মানুবর্তিতাতেও মুশফিক যেকোনো কিশোর-তরুণের জন্য আদর্শ। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক এই অধিনায়কের সম্পর্কে এবার জানাবো তোমাদের।
১৯৮৭ সালের ৯ মে বগুড়া শহরেই জন্ম তার। পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনদের কাছে ডাক নাম মিতু। শৈশব থেকেই ঝোঁক ছিল ক্রিকেটের দিকে। স্থানীয় এক ক্লাবে খেলতেন নিয়মিত। বগুড়া জিলা স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় সাভারের বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- বিকেএসপিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে টিকে যান মুশফিক। সেখানেই পড়াশোনার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিকেট শেখার সূচনা। বিকেএসপি থেকেই বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ পান। জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে তিনটি যুব টেস্ট ও ১৮টি যুব ওয়ানডে খেলার পর জাতীয় দলের রাডারে ধরা পড়েন ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার এই ব্যাটসম্যান।
২০০৫ সালে ‘এ’ দলের সাথে জিম্বাবুয়ে সফরে পাঠানো হয় তাকে। সেখানে দারুণ একটি সেঞ্চুরি করার পর বাংলাদেশ দলের প্রথম ইংল্যান্ড সফরে তাকে দলভুক্ত করা হয়। সেই সিরিজে মুশফিককে নেওয়া হয়েছিল বিকল্প উইকেটরক্ষক হিসেবে। অর্থাৎ নিয়মিত উইকেট রক্ষক খালেদ মাসুদ পাইলট ইনজুরিতে পড়লে তাকে খেলানো হবে। মূল একাদশের জন্য তাকে চিন্তায় রাখেনি টিম ম্যানেজমেন্ট; কিন্তু সেই সফরে টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে দুটি তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচে সুযোগ দেওয়া হয় মুশফিককে। সেখানে কাউন্টি ক্লাব সাসেক্সের বিপক্ষে ৬৩ ও নর্দাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে বসেন। এরপর তাকে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে লর্ডসে সিরিজের প্রথম টেস্টের একাদশে রাখা হয়।
টেস্ট অভিষেকের দিন তার বয়স ছিল ১৬ বছর ২৬৭ দিন। দুই ইনিসে যথাক্রমে ১৯ ও ৩ রান করেন। পরের টেস্টের আগেই টিম হোটেলের সিঁড়িতে পা মচকে তাকে ফিরে আসতে হয় দেশে। মুশফিকের ওয়ানডে অভিষেক ২০০৬ সালের জিম্বাবুয়ে সফরে হারারেতে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ দলের নিয়মিত সদস্য। এরই মধ্যে ২০০৬ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ^কাপে বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেন।
২০০৭ সালের পর খালেদ মাসুদ পাইলটের বদলে হয়ে যান জাতীয় দলের নিয়মিত উইকেটরক্ষক। এক পর্যায়ে নিজেকে নিয়ে যান বাংলাদেশ মিডল অর্ডারের সেরা ব্যাটসম্যানের স্থানে। নিয়মিত পারফর্ম করতে থাকেন দলের হয়ে। দলের ভরসা হয়ে ওঠার কারণে ভক্তরা ও সংবাদমাধ্যম তাকে ডাকতে শুরু করে মিস্টার ডিপেন্ডেবল নামে।
মুশফিক তার টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরির (১০১) দেখা পান ২০১০ সালের চট্টগ্রামে ভারতের বিপক্ষে। সেটি ছিল তার ক্যারিয়ারের ১৭তম টেস্ট। তবে প্রায় নিয়মিতই বাংলাদেশের জার্সিতে মাঝারি মানের ইনিংস খেলতেন। যতই সময় গড়িয়েছে তার পারফরম্যান্সের গ্রাফ ততই ওপরে উঠেছে। টেস্টে এখন পর্যন্ত ৩টি ডাবল সেঞ্চুরি আছে তার। প্রথমটি ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গল টেস্টে (২০০)। দ্বিতীয়টি ২০১৮ সালের নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে (২১৯*) আর তৃতীয়টি একই ভেন্যুতে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে (২০৩*)। সব মিলে ৭৫ টেস্টে ৭ সেঞ্চুরি আর ২৩ হাফ সেঞ্চুরিতে করেছেন ৪৬৯৬ রান। টেস্টে তার ব্যাটিং গড় ৩৭ প্রায়।
ওয়ানডেতে মুশফিকের ব্যাটিং গড় ৩৭ এর সামান্য বেশি। ২২৭ ম্যাচ খেলে ৮ সেঞ্চুরি আর ৪০ হাফ সেঞ্চুরিতে করেছেন ৬৫৮১ রান। ওয়ানডেতে তার উল্লেখযোগ্য ইনিংস ২০১৪ এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে ১১৭, ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মিরপুরে ৭৭ বলে ১০৬, কিম্বার্লিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অপরাজিত ১১০, ২০১৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৯৭ বলে অপরাজিত ১০২ রান। তবে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারতকে হারানোর ম্যাচে তার অপরাজিত ৫৬ রানের ইনিংসটি ভক্তদের মনে বিশেষভাবে দাগ কেটেছিল। ওই ম্যাচের পরই তরুণ মুশফিককে নিয়ে দেশের ক্রিকেটে শুরু হয় আলোচনা।
চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন ৯১টি। সেখানে তার হাফ সেঞ্চুরি আছে ৫টি। ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ দলকে ৩৪ টেস্ট, ৩৭ ওয়ানডে ও ২৩টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন মুশফিক। তার সময়ে বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলেছে। টেস্টে হারিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কাকে।
২০২১ সালের মে মাসে আইসিসির প্লেয়ার অব দ্য মান্থ নির্বাচিত হয়েছেন। মুশফিকই বিশে^ প্রথম, যিনি উইকেটরক্ষক হিসেবে খেলতে নেমে দুটি ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন। টেস্টে বাংলাদেশিদের পক্ষে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানও তার।
এতো গেল মাঠের শ্রেষ্ঠত্বের কথা। খেলার বাইরে পড়াশোনাতেও মুশফিক আছেন সেরাদের কাতারে। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র হিসেবে তার পরিচিতি আছে। ক্রিকেট তার ধ্যান-জ্ঞান হলেও কখনো পড়াশোনা বাদ দিয়ে খেলার মাঠে যাননি। বিশে^র অনেক ক্রিকেটারই যেখানে খেলার জন্য পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছেন, মুশফিক সেখানে দুটোই চালিয়েছেন সমান তালে। বিকেএসপি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। সেখান থেকে প্রথম শ্রেণিতে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এখন তার পরবর্তী লক্ষ্য পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা।
শৈশব থেকেই সদা হাস্যোজ্জ্বল মুশফিক আচার-আচরণেও অনেকের চেয়ে আলাদা। ক্রিকেট মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে সবার সাথে তার আচরণ প্রশংসার দাবি রাখে। বগুড়া ও বিকেএসপিতে তার বন্ধুরা জানান, মুশফিক সহজে রাগ করেন না। মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে কোন কাজ করেন না। তাই তো এত বছর ক্রিকেট খেলেও তেমন কোনো বিতর্ক তাকে ছুঁতে পারেনি। ছোটবেলা থেকেই নামাজসহ ধর্মীয় বিষয়গুলোর প্রতি আন্তরিক তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনে এক পুত্রসন্তানের জনক মুশফিক। ২০১৪ সালে মানিকগঞ্জ শহরের সেওতা এলাকার বাসিন্দা জান্নাতুল কিফাইয়াত মন্ডির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বাংলাদেশ দলের আরেক ক্রিকেটার মাহমদুউল্লাহ রিয়াদ তার ভায়রা ভাই। রিয়াদের স্ত্রী জান্নাতুল কাওসার মিষ্টি মুশফিকের স্ত্রীর বড়ো বোন।