Home স্বাস্থ্য কথা ব্রণ এক কৈশোরিক বিড়ম্বনা -ডা. এহসানুল কবীর

ব্রণ এক কৈশোরিক বিড়ম্বনা -ডা. এহসানুল কবীর

কিশোর বয়সে এ যেন এক দারুণ বিড়ম্বনা। মূলত এই বয়সেই কিশোর-কিশোরীরা সৌন্দর্য সচেতন হতে শুরু করে। আর এই সময়েই মুখের ওপর বাসা বাঁধে ব্রণ নামের মহাযন্ত্রণাটি। কী যে এক বিরক্তিকর অবস্থা! লজ্জায় যেন মুখ দেখাতে ইচ্ছে করে না কাউকে। কাজেই বয়সের এই নিশ্চিত পরিণতিকে সহজেই মেনে নিয়ে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে যথাসম্ভব বেঁচে থাকাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

কেন এমন হয়?
কিশোরবেলার এই সময়টাতে মনের মধ্যে যেরূপ পরিবর্তন আসে, তদ্রƒপ দেহের ভেতরও শুরু হয় জৈবিক কিছু পরিবর্তন। তারই একটি বাহ্যিক রূপ হচ্ছে ব্রণ, যাকে এড়িয়ে যাবার কোনো সুযোগ নেই। মূলত এই বয়সে বিশেষ হরমোনের উদ্দীপনার কারণে এই ব্যাপারগুলো ঘটতে থাকে। এর ফলে ত্বকের নিচে সেবাসিয়াস নামক গ্রন্থি থেকে সেবাম নামক এক প্রকার সাদা জেলির মতো পদার্থ নিঃসৃত হয়। এই সেবাম ত্বকের নিচে অবস্থান করে বিধায় ব্রণগুলো উঁচু উঁচু ঢিবির মতো দেখায়। হরমোনের উদ্দীপনার কারণে যার যত বেশি সেবাম নিঃসৃত হবে তার ততোধিক মাত্রায় ব্রণ দেখা দেবে। এছাড়া ত্বকের নিচে এক ধরনের ইনফেকশনের কারণেও সেবাসিয়াস গ্রন্থির উত্তেজনা বেড়ে ব্রণ হতে পারে। তাছাড়া কিছু কিছু রোগের কারণেও ব্রণ দেখা দিতে পারে। যেমন- মোটা হয়ে যাওয়া, উচ্চরক্তচাপ, শরীরে লিপিডের ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি। আবার অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণেও ব্রণ হতে পারে। বংশগত কারণেও কারো কারো আবার ব্রণ খুব বেশি মাত্রায় হতে পারে। এছাড়াও অতিরিক্ত কসমেটিকস ব্যবহারে লোমকূপগুলো বন্ধ হয়েও ব্রণ হতে পারে। আবার কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত কারণে ব্রণ হতে দেখা যায়। সেরকম ওষুধগুলো হলো- স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ, খিঁচুনিনাশক ওষুধ, ঘুমের ওষুধ ইত্যাদি। এছাড়া চকোলেট, ক্যান্ডি, বাদাম, সফট ড্রিংকস, তৈলাক্ত বা মশলাযুক্ত খাবার ইত্যাদি গ্রহণের ফলেও ব্রণের আধিক্য দেখা দিতে পারে।

ব্রণের লক্ষণ কী?
কিশোর বয়সেই শুরু হওয়া ব্রণ সাধারণত মুখের ত্বকের ওপর উঁচু গোলাকার লাল লাল দানা দানা আকারে বের হয়। সংক্রমণের তীব্রতা ভেদে ব্রণকে সাধারণত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়- স্বল্পমাত্রার, মাঝারি মাত্রার আর মারাত্মক মাত্রার। ব্রণ সাধারণত শরীরের মুখমণ্ডলে, ঘাড়ে বা গলায়, বুকে-পিঠে, হাতে এমনকি সারা শরীরে দেখা যেতে পারে। ব্রণের কারণে কারো কারো মুখে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে, পুঁজ জমতে পারে। এছাড়া জ্বর অথবা হাত-পায়ের গিরায় গিরায় ব্যথাও হতে পারে।

পরিত্রাণের উপায় কী?
ব্রণের চিকিৎসার প্রথম কথা হলো, এটা কৈশোরিক সাময়িক বিড়ম্বনামাত্র। এই বয়সটা পেরিয়ে গেলেই এই ঝামেলা এমনিতেই বিদায় নেবে, দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বলাবাহুল্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্রণ স্বল্পমাত্রায় দেখা যায় এবং সেটা এমনিতেই নিরাময় হয়ে যায়। তবে মাত্র ৪০% ক্ষেত্রে কমবেশি চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। ব্রণের চিকিৎসা কয়েকটি উপায়ে করা যায়। ব্যক্তিবিশেষে ও সংক্রমণের মাত্রানুসারে যার জন্য যেটা প্রযোজ্য তা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন-
ক) কিছু অভ্যাস মেনে চলা
প্রথম ও পূর্বশর্তই হলো মুখটা সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা অর্থাৎ তৈলাক্ত ভাবটা দূর করা। সেজন্য দিনে অন্তত ৩/৪ বার সাবান দিয়ে মুখটা পরিষ্কার করতে হবে। মুখের ব্রণে যখন-তখন নখ দিয়ে খুঁটানো ঠিক নয়। কেননা এর ফলে মুখের ওপর কালো দাগ পড়তে পারে। তখন সুন্দর মুখশ্রীটা আরো বিশ্রী হয়ে যেতে পারে। এছাড়া বাইরে থেকে এসে বা খেলাধুলা শেষে ঘরে ফিরে এসে দ্রুত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া উচিত। ঘর্মাক্ত জামা কাপড় তাড়াতাড়ি খুলে শুকাতে দেওয়া উচিত। তাছাড়া প্রচণ্ড রোদের মধ্যে ঘোরাফেরা না করাই উত্তম।

খ) সঠিক খাদ্যাভ্যাস
এ সময় কিছু খাদ্যাভ্যাসও মেনে চলা দরকার। যেমন- ত্বকের শুষ্কতা কাটানোর জন্য এ সময় প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। এছাড়া সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাবারে অভ্যস্ত হতে হবে। বিশেষ করে শাকসবজি এবং ঋতু অনুসারে সহজলভ্য ফলমূল খাওয়া দরকার। হোটেল, বেকারির খাদ্যদ্রব্য পরিহার করে চলাই ভালো। এছাড়া আঁশযুক্ত যেকোনো খাবার ব্রণ কমাতে সাহায্য করে।

গ) মুখে মাখার ক্রিম বা লোশন
এটা নির্ভর করে মূলত ব্রণের তীব্রতা ও ত্বকের সংবেদনশীলতার ওপর। অ্যান্টিবায়োটিক ক্রিম বা লোশন ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে কোনটাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার না করাটাই উত্তম। এছাড়া সব ধরনের ত্বকের জন্য অবশ্যই দুই ঘণ্টা সানস্ক্রিন ব্যবহার করা ভালো।

ঘ) মুখে খাওয়ার ওষুধ
ব্রণের চিকিৎসায় ‘টেট্রাসাইক্লিন’ ‘ডক্সিসাইক্লিন’ বা ‘ইরাইথ্রোমাইসিন’ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়া ত্বক আর চুল ভালো রাখতে মধু যেমন বেশ উপকারী তেমনি ব্রণও সারিয়ে তুলতে মধু বেশ কার্যকর বলে ধারণা করা হয়। মধুর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ ব্রণ সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে প্রতি রাতে এক/দুই ফোঁটা মধু ব্রণের ওপর লাগিয়ে, সকালে উঠে ধুয়ে ফেলতে হবে।

ঙ) হরমোন চিকিৎসা
এটা খুবই অপ্রচলিত চিকিৎসা এবং ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে তা সীমাবদ্ধ।

চ) লেজার থেরাপি
বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসায় ব্রণ দূর করার জন্য লেজার ট্রিটমেন্ট জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কমিডন ব্রণ হলে ভ্যাকুয়াম ক্লিনজিং এবং আলট্রাসনিক ফেসিয়ালের মাধ্যমে মুখের ভেতরের কালো দাগ বের করা যায়। সংক্রমিত বা পস্টিউলার (পুঁজ) ব্রণ হলে অ্যান্টিবায়োটিক কেমিক্যাল পিলিং এজেন্ট ব্যবহার করা হয় ত্বকের ধরন বুঝে। যাদের ত্বকের একদম দাগ বা গর্ত হয়ে গেছে, তাদের জন্য আছে লেজার বা মাইক্রোনেডলিং ট্রিটমেন্ট। এর ফলে যেখানে গর্ত হয়েছে, সেখানে নতুন করে কোলাজেন নামক কোষ উৎপন্ন করা হয়। লেজার ট্রিটমেন্টের জন্য অবশ্যই চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

তো হলো তো? যারা ব্রণের অসহ্য যন্ত্রণায় অস্থির তাদের জন্য কথাগুলো মনে রাখা দরকার। প্রিয় মুখশ্রীটাকে সুশ্রী রাখতে ব্রণের ঝামেলাকে হেলাফেলা করার দিন শেষ।

SHARE

Leave a Reply