গত বছর যখন প্রথম করোনা আপদ দেখা দেয়, সে সময়ের কথা। মাসখানেকের মধ্যেই রাজধানী ঢাকা শহর ফাঁকা হয়ে গেলো। দিনের বেলায়ও ঢাকা শহর ভূতুড়ে নগরী। দু’ একটি রিকশার টুং টাং শব্দে নীরবতা ভাঙতো কেবল।
প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর আসতে লাগলো। স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেলো। সবাই লকডাউনে। কোয়ারেন্টিনে। আমাকে বের হতেই হতো। খবরের কাগজে চাকরি। নিউজ ডেস্কের ছুটি নেই। রীতিমত পিপিই পরে অফিসে যাতায়াত করি। একদিন এক রিকশাওয়ালা অফিসে নামিয়ে দিয়ে বলল, স্যার কয়েকটা টাকা বেশি দিবেন। প্যাসেঞ্জার নেই। আয়-রোজগার কম, সংসার আর চলে না। ঠিকইতো। সেদিনই বুঝলাম পরিস্থিতি ভয়াবহের দিকে যাচ্ছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। মানুষের কাজ নেই, ক্ষুদ্র ব্যবসা সব বন্ধ। মানুষ কী খাবে, কীভাবে চলবে।
সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরছি। দেখলাম মহল্লার রাস্তার পাশে ‘লালচান’ দাঁড়িয়ে আছে। হ্যাঁ লালচান। উনি জুতো সেলাই করেন- মুচি। আমাকে দেখে সালাম ঠুকলো। কী ব্যাপার লালচান! এখানে যে; দোকান বন্ধ বুঝি! লালচান ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। মনে হলো কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু বলতে পারছে না। আমার বুঝতে বাকি থাকলো না। পকেট থেকে এক শ’ টাকা বের করে হাতে দিলাম। লালচানের ঠোঁটের রেখায় হরিষে-বিষাদ ধরনের একটি হাসি খেলে গেল।
বাসায় ঢুকতেই সবাই আমাকে ওয়াস রুমে ঢুকিয়ে দিলো। গিন্নি দূরে দূরে। ছেলে-মেয়েরা রুম থেকে বের হচ্ছে না। কী আশ্চর্য! আপনজনও পর হয়ে যাচ্ছে। ওদিকে আবার মসজিদে যেতেও মানা। আমার রোজ হাশরের কথা মনে হলো। সেদিন কেউ কারো থাকবে না। সবাই নিজেকে বাঁচাতে ব্যাকুল হয়ে পড়বে। আল্লাহ কী আমাদের সেই নিশানাই দেখাচ্ছেন।
: তুমি তো কোনো বাজার-ঘাট করলে না। পাশের বাড়ির ভাবীরা নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র বেশি বেশি করে কিনে রাখছে। সংকট নাকি হতে পারে।
: মজুদদারির কথা বলছো। আমি তা করবো না। সাধারণ মানুষের যা হবে আমাদেরও তাই হবে। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো।
আমার ছোট মেয়ে তিন্নি বললো, আব্বু! করোনা তো আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ না করে আমরা করোনাকে ভয় পাচ্ছি কেন? আমি মেয়ের কথায় সায় দিলাম। মনে মনে ভাবলাম এতটুকু একটা মেয়ের ঈমানের কাছে আমরা পানসে হয়ে যাচ্ছি।
রাতে আর ভালো ঘুম হলো না। শুধুই ভাবছি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জন্য কী করা যায়। কিছু একটা করতে হবে। সকালে স্থানীয় ক্লাবের সদস্য হিসাবে সভাপতিকে ফোন দিলাম। এ বিষয়ে মত বিনিময় করলাম। তিনি একমত হলেন। শিগ্গির একটা উদ্যোগ নিবেন বলে জানালেন।
দেখতে দেখতে রোজার ঈদ এসে পড়লো। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ড্রয়িং রুমে বাচ্চাদের আনাগোনা। গিন্নিকে জিজ্ঞেস করলাম, ওদিকে কী হচ্ছে।
: গিয়েই দেখে এসো।
রুমের দরজায় দাঁড়াতেই চোখ ছানাবড়া! আমার দুই ছেলে-মেয়ে তামিম ও তিন্নি। সাথে ওদের বন্ধুরা। ওদের অনেকেই আমার চেনা। সবার মুখে মাস্ক, চোখে চশমা। কেউ আবার পি.পি.ই পরেছে। সবাই বসেছে দূরে দূরে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে। বললাম, এসব কী হচ্ছে! তামিম বললো, আব্বু! আমরা বন্ধুরা একটু বসেছি। সামনে ঈদ আসছে। আমরা গরিব দুস্থ শিশুদের জন্য কিছু একটা করতে চাই। করোনার জন্যতো সবার অবস্থাই খারাপ।
: আমিও তোমাদের সাথে থাকতে চাই; আমাকে নিবে?
: অবশ্যই নিব। তোমার পরামর্শ আমাদের খুব প্রয়োজন।
সেদিন আমার বিশ^াস আরো বেড়ে গেল; এই আপদ বেশি দিন থাকবে না। এই পরীক্ষার একদিন শেষ হবে। যখন মানুষ মানুষের জন্য এগিয়ে আসে তখন আল্লাহর রহমত নেমে আসে।