নিত্যদিনের মতো অর্মিতা আর সামি বিকেলে পার্কে গেল বেড়াতে। ভাই-বোন তারা। অর্মিতা বড়ো আর সামি ছোটো। অর্মিতা যায় স্কেটিং করে আর সামি সাইকেলে। প্রতিযোগিতায় হারজিৎ আছেই- কেউই প্রতিদিন জেতে না। পার্কের ভেতর মোজাইক করা আঁকাবাঁকা পথ ধরে তারা স্কেটিং করে, সাইকেল চালায়। বন্ধুরাও আসে। খেলাধুলা করে। শেষ বিকেলে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরে।
পার্কজুড়ে তুঁতগাছ, আনার গাছ ইত্যাদি ভরা। সামি মাঝেসাঝে সাইকেল ফেলে রেখে তুঁতগাছে উঠে ফল ছিঁড়ে খায়। গাছ থেকে ছিঁড়ে খেতেই পছন্দ তার-বাসায় গিয়ে খেতে চায় না। আবার সকল আনন্দ যেন ছেঁড়াতেই, খেতে নয়। হঠাৎ একটা পাখি সামিকে গাছে উঠতে দেখে পড়ে গেল নিচে। পড়েই ডাকাডাকি করে মাতিয়ে তুললো চারদিক। সামির দৃষ্টি তুঁত থেকে পাখির দিকে চলে গেল। অর্মিতাও লক্ষ করলো ব্যাপারটা।
দু’ভাই-বোন এবার পাখিটির সেবায় লেগে গেল। ভীষণ ডাকাডাকি করছে সে। ওরা ভেবেছিল পাখিটি ছোটো মানে শিশু। এখনও ভালো করে উড়তে শেখেনি, তাই পড়ে গেছে নিচে। মায়া হলো তাদের। পাখিটিকে নিয়ে বিকেলটাকে পার্কে রেখেই সোজা ফিরে গেল বাসায়। বড়ো বোন নায়েলা পাখির সঙ্গে ছোটোদের চেঁচামেচির শব্দ শুনে দ্রুত বাসার দরোজা খুলে দিলো। নায়েলার বয়স পনেরো। তিন ভাইবোনের বয়সে তিন-তিন বছরের দূরত্ব আছে। বাসায় পাখির আগমনে সবাই ভীষণভাবে পাখিপ্রেমিক হয়ে উঠলো। নায়েলা গুগল সার্চ করে করে করণীয় ঠিক করে নিলো। অর্মিতা আর সামি সমূহ আন্তরিকতার সাথে শুশ্রƒষায় মনোনিবেশ করলো। আমার মোবাইলে তার সচিত্র মেসেজ এলো। আমিও তখনই ফিরলাম বাসায়।
কে কার আগে পাখির বাচ্চার অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং চাঞ্চল্যকর গল্পটি বলবে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল ভাই-বোনদের মধ্যে। আমি তাদের কোলাজ গল্পটি একদিকে শুনছি আরেক দিকে শুনছি বাচ্চা পাখিটির ভয়ার্ত কূজন। থামেই না। পাখিটির গায়ে হাত দিলাম-উষ্ণতা আর কম্পন অনুভব করলাম। উপমা বললো : যদি সোলায়মান নবীর মতো পাখিটির কথা বুঝতে পারতাম তাহলে তো ওকে হেলপ করতে পারতাম। কী আশ্চর্য! বলতে না বলতেই পাখিটি কথা বলতে শুরু করলো উপমার সঙ্গে। সেই ভাষা অন্য কেউ শুনলো না।
উপমা চিৎকার দিলো : বাবা ও কথা বলছে আমার সঙ্গে।
– বলো কি!
সত্যি বাবা! ওর কথা আমি বুঝতে পারছি।
আশ্চর্য! আমি তো দেখছি ও আগের মতোই চেঁচিয়ে যাচ্ছে … আচ্ছা কী বলছে পাখি!
অর্মিতা আর সামি চিৎকার করে তাদের মাকে জানাচ্ছে খবরটা। তাদের চিৎকার শুনলে যে-কেউ ভাববে ঘটনা নয় মারাত্মক কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।
উপমাকে বললাম : তোমার সঙ্গে কী কথা বলছে ও…
হাতের ভঙ্গিতে বললো : চুপ করো! কথা বলো না …
উদ্ধৃত একটি হাত সবার ঠোঁটেমুখে আঠা লাগিয়ে দিলো। সবার কৌতূহলী চোখ আর বিমর্ষ দৃষ্টি নিবদ্ধ উপমার দিকে। পাখিটির চিৎকার কমে গেছে। উপমার হাতে বসে আছে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। উপমাও একদৃষ্টিতে পাখিটিকে দেখছে। তার চেহারায় সমবেদনার ছাপ ফুটে উঠছে।
– মা! কী হচ্ছে?
বলছি বাবা! একটু পরে।
অর্মিতার হাতে একটি পিরিচে রুটির ভাঙা কণা আর সামির হাতে প্লাস্টিকের ওয়ান-টাইম একটি বাটি। বাটিতে সামান্য পানি। ওয়ান টাইম ট্রে-তে সেগুলো পাখির সামনে ধরা হলো। পাখির ভ্রুক্ষেপটিও নেই সেদিকে। উপমা হাত থেকে পাখিটিকে ট্রে-তে নামানোর চেষ্টা করলো। কাজ হলো না। পাখি নামছে না। জোর করে নামিয়ে দিলো। তাতেও কাজ হলো না। পাখি এসে বসে পড়লো উপমার হাতে। এই হাত যেন তার জন্য পরম নিরাপদ।
সামির কণ্ঠ : কী বলেছে পাখি বলো না!
অর্মিতাও সুর মেলালো। সঙ্গে তাদের মা-ও
কৌতূহল আমারও আছে। তাই আমিও বললাম : হ্যাঁ মা বলো না?
– শোনো! পাখিটি বলেছে : সবেমাত্র সে উড়তে শিখেছে। তাই প্র্যাকটিস করতে করতে মার নিষেধের কথা ভুলে গিয়ে চলে এসেছে আমাদের পার্কে। এখন সে কীভাবে বাসায় ফিরবে জানে না।
– তুমি কী বললে? বাবা জানতে চায়?
বললাম : বাসা কোথায় ছিল?
সে বললো : বড়ো একটি পার্কের অনেক বড়ো একটি গাছের মগডালে। ওই পার্কে একটি লেকও আছে। ওখানে গেলেই সে চিনবে।
– বাবা! ন্যাশনাল পার্ক হবে। সামির কণ্ঠ।
– হ্যাঁ বাবা! ন্যাশনাল পার্ক। অর্মিতা বলছে। কারণ ওই পার্কের ভেতরে বড়ো বড়ো গাছও আছে, লেকও আছে।
সোহাগী-আমার স্ত্রী-আমার চোখে সম্মতির দৃষ্টি দিলো।
চলো চলো! দেরি করো না!
সবাই প্রস্তুতি নিয়ে পাখিটিকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। সামান্য পথ। সাঁই করে একটানে আমরা পৌঁছে গেলাম পার্কে। ন্যাশনাল পার্কের ভেতরে লেকের পাড়ে যেতেই উপমার হাত থেকে পাখিটি উড়ে গিয়ে বসলো বিরাট একটি গাছের মগডালে। একটানা ডেকে যেতে লাগলো পাখিটি।
– কী বলছে মা! জানতে চাইলাম উপমার কাছে।
– ও খুশিতে, আনন্দে গান গাইছে আর আমাদের ধন্যবাদ দিচ্ছে। আমি বললাম : এর পর কখনো আত্মভোলা হবে না! পথের ঠিকানা ভুলে যেও না! বাবা-মার কথা শুনবে। কেমন!
পাখিটি উড়ে এসে উপমার কাঁধে বসে বললো : কথাটা তোমরাও মনে রেখো!
– কেন? উপমা জানতে চাইলো।
পাখি বললো : তোমরাও কিন্তু একটি বাগান থেকে এখানে, এই পৃথিবীতে এসেছো! ওই বাগানে ফিরে যেতে হলে পথের ঠিকানা সবসময় মনে রাখতে হবে। তোমরা মানুষেরাও অনেক মনভোলা। সেজন্য দূতেরা আসেন তোমাদের হারানো পথের মানচিত্র বা জিপিএস নিয়ে। ওই জিপিএস যদি অনুসরণ না করো তাহলে তোমাদের পিতৃনিবাস-আদমের ঘর-রেখে ভুলে শয়তানের ঘরে গিয়ে উঠবে। বলেই ডাকতে ডাকতে উড়ে চলে গেল পাখি।
সবাই জানতে চাইলো : কী বলেছে পাখি?
উপমা বিস্তারিত জানিয়ে দিলো। সোহাগী এবার বললো : তোমরা কি জানো ‘জিপিএস’ কী?
– জানি। অর্মিতার জবাব। আব্বুর মোবাইলে আছে জিপিএস।
– হ্যাঁ, আমিও জানি। গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম। গুগল ম্যাপও আছে। সামির উত্তর।
ঠিক আছে। এগুলো হচ্ছে এই পৃথিবীর পথ চলার সফটওয়্যার। কিন্তু পাখি যে জিপিএসের কথা বলেছে সেটা হচ্ছে ‘কুরআন’! আর দূত হলো আমাদের নবী। ওই জিপিএস ফলো করা ছাড়া আমরাও পাখিটির মতো পথ হারিয়ে বসতে পারি।
নীরব দৃষ্টি বিনিময় করে একে অপরকে জানিয়ে দিলো এই ‘জিপিএস’ কতো গুরুত্বপূর্ণ!