শরৎ এলো কাশফুলেরই ছন্দ-তালে
শরৎ এলো ধানক্ষেতেরই শুকনো আলে
শরৎ এলো শাদা মেঘের ভেলায় চড়ে
শরৎ এলো তামাবিলে-পঞ্চগড়ে।
হ্যাঁ বন্ধুরা, শরৎ এসেছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া আর তামাবিল থেকে পঞ্চগড়ে। শরতের আনন্দ এখন সমগ্র বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। তোমরা হয়তো ভাবছো প্রকৃতির সৌন্দর্য আবার ঘরের ভেতরে যায় কী করে? শরতের পাকা তালের পিঠার কথা মনে নেই বুঝি? খুব খেতে ইচ্ছে করছে তো। শরৎ মানে কেবল কাশফুলের ছন্দ-তাল না, শরৎ মানে রসে টইটম্বুর পাকা তাল, বুঝলে! আম-কাঁঠালের মিষ্টির ঘ্রাণ শেষ হতে না হতেই তালের পিঠার গন্ধে ভরে যায় গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘর।
বাংলাদেশকে বলা হয় ষড়ঋতুর দেশ। ছয় ঋতুর মধ্যে তৃতীয় ঋতুই হলো শরৎ। তোমরা তো জানোই, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ছয়টি ঋতু নেই। কিন্তু আমাদের দেশে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত এবং বসন্ত এই ছয়টি ঋতুর বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাকৃতিক দৃশ্য রয়েছে। বাংলা সনের হিসাব অনুযায়ী গ্রীষ্মকাল আসে বছরের শুরুতেই। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গরম পড়ে ভীষণ রকম। এসময় আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরে। গ্রামের ধানচাষের জমিও তখন ফেটে যায় প্রচণ্ড রোদের তাপে। এ কঠিন অবস্থা থেকে মুক্তি দিতেই ছুটে আসে দ্বিতীয় ঋতু বর্ষা। আষাঢ়-শ্রাবণ এ দু’মাসে শুরু হয় অবিরাম বর্ষণ। প্রচণ্ড গরমে যেমন অতিষ্ঠ হয়ে যাই আমরা তেমনি অতিরিক্ত বৃষ্টিতেও! এজন্যই বর্ষাকালের ভারী বর্ষণ আর বন্যা থেকে বাঁচাতে বাংলার প্রকৃতিতে সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে আসে শরৎ। শরৎ মানেই কাশফুল, স্বচ্ছ নীল আকাশ আর সবুজ মাঠ। স্বচ্ছ নীল আকাশে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায় শরৎকালে। প্রকৃতিতে নেমে আসে এক অপরূপ সৌন্দর্য! এত সুন্দর করে প্রকৃতিকে সাজানো কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব না। এটা কেবল তিনিই করেন যিনি এ প্রকৃতিকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন আমাদেরকেও। আমাদের জন্যই এত সুন্দর প্রকৃতি উপহার দিয়েছেন মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ। শরতের পর আবার হিম-কুয়াশার চাদরে ঢেকে যেতে থাকে প্রকৃতি। ঘাসের ডগায় ভোরবেলা দেখা যায় শিশিরের বিন্দু। প্রকৃতিতে শীতের আভাস দেখা দেয়। ভাদ্র-আশ্বিন এ দু’মাসে বাংলার চতুর্থ ঋতু হেমন্ত আসে আরও মধুর পরিবেশ নিয়ে। গ্রামের মাঠে মাঠে সবুজ ধানক্ষেতগুলো হলুদ হয়ে যায় এসময়। নবান্নের উৎসব শুরু হয় তখন বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে। গ্রীষ্ম এবং বর্ষাকালে কিছুটা কষ্ট এবং যন্ত্রণা থাকলেও শরৎ কিংবা হেমন্তে এরকম কিছু দেখা যায় না। কেবল হাসি-গান আর আনন্দ। কবির ভাষায়-
গ্রীষ্মকালে গরম জ্বালায়
বর্ষাকালে বৃষ্টি
শরৎ এবং হেমন্তকাল
নেয় কেড়ে নেয় দৃষ্টি!
আমরা কথা বলছিলাম শরতের সৌন্দর্য নিয়ে। কাশফুল ছাড়া শরতের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। নদীর তীরে কিংবা বিলের ধারে কাশফুলের সমারোহে মুগ্ধ না হয়ে থাকা যায় না। এসময় গাছে গাছে হাসনাহেনাসহ নানা রকম ফুল ফোটে। বিল-হাওরে দেখা যায় জাতীয় ফুল শাপলা। দীঘির শান্ত পানিতে ভাসতে দেখা যায় পদ্মফুল। পুকুরপাড়ের লম্বা লম্বা একপায়ে দাঁড়ানো তালগাছগুলো থেকে তাল পড়তে দেখা যায়। শিশু-কিশোরদেরকে এসব তাল কুড়িয়ে নিতে দেখা যায়। আবার কখনও কখনও খালের পানিতে ভেসে যেতে দেখা যায় পাকা পাকা তাল। আমরা যারা শহরের চার দেয়ালে বন্দি জীবনযাপন করছি তাদের জন্য আফসোস! গ্রামবাংলার এসব সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি সবাই। আমার ছোটবেলা গ্রামে কেটেছে। শৈশবের পুরো সময়টাই গ্রামে কাটিয়েছি বলেই না শরতের বর্ণনা দিতে পারছি। কৈশোরের শেষদিকে শহরে আসার পর থেকে এখন আর শরতের দেখা পাই না। শুধু শরৎ কেন? বড়ো বড়ো ভবনের ভেতর থেকে তো বাইরে রোদ না বৃষ্টি সেটাই অনুমান করা যায় না। দিনেরাতেই জ্বালাতে হয় বৈদ্যুতিক আলো!
একসময় গ্রামে ছিলাম। ছিলাম বললে ভুল হবে, আমি একদমই গেঁয়ো শিশু ছিলাম। খাল-বিল নদী-নালায় ছুটে বেড়াতাম। বড়শি হাতে পুকুরের ঘাটে বসে থাকতাম। ধানক্ষেতের আল দিয়ে হেঁটে যেতাম, ধানের নিচে ঢাকা পড়তো শরীর। এখন শহরের বাসিন্দা হয়েছি বলে অনেক সময় টেরই পাই না শরতের কথা। তবুও কাজের অবসরে খুঁজে বেড়াই শরৎ, খুঁজে ফিরি গ্রামের সেই নবান্ন উৎসব কিংবা তালের পিঠা। তোমরা যারা গ্রামে আছো খুব ভালো করেই বুঝতে পারছো আমার কষ্টটা। কারণ তোমরা তো ঘর থেকেই শুনতে পাও পুকুরপাড়ের তাল পড়ার শব্দ। তালের পিঠার গন্ধে তোমাদের মন ভরে ওঠে শরতের সন্ধ্যায়। মায়ের হাতের বানানো তালের পিঠার স্বাদই অন্যরকম, তাই না বন্ধুরা? সবকিছু মিলিয়ে অসাধারণ এক ঋতু শরৎ। আর তাইতো শরৎকে বলা হয় ঋতুর রানি। শহরের বন্ধুরা, শরতের আনন্দ উপভোগ করতে একদিনের জন্য হলেও গ্রামে যাও। গ্রামে গিয়ে কাশফুল, পরিষ্কার নীল আকাশ আর সবুজ মাঠে ঘুরে বেড়াতে কেমন লাগে তা উপভোগ করে আসো।