Home গল্প মাদার্স ডে -নুর আঙ্গেজ

মাদার্স ডে -নুর আঙ্গেজ

দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিতেই সকালের মিষ্টি রোদ এসে ঘরটায় আলোময় করে দিলো। জানালার নিচের দিকে চোখ দিতেই দুদোল দেখে বেশখানিকটা খালি জায়গায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দুটো নারকেল গাছ। কয়েকটি পেঁপে গাছের কাছেই। কাগজিলেবু গাছটায় অনেকগুলো লেবু ধরে আছে। বাউন্ডারির কাছঘেঁষেই দোতলা বাড়ির খোলা বারান্দায় টবে লাগানো পাতা বাহারের কাছেই, গোলাপ গাছে অঁাধফোটা কলির সাথে ফুটন্ত গোলাপ। বন্ধ দুয়ার আর তার পাশের কপাট খোলা জানালায় বাহারি পর্দা ঝুলছে। খানিকটা সময় নিজের বরাদ্দ ঘরের বাইরে দৃষ্টি বুলিয়ে চেয়ারটা টেনে বসে দুদোল। গতকালের রাখা বইগুলো টেবিলে তেমনি পড়ে আছে ভাঁজে ভাঁজে রাখা কাপড়ের ব্যাগে।
কিনে আনা ব্রেডে মাখন আর চিনি লাগিয়ে দুদোলকে দিয়ে বাবা বললো।
দুপুরে আমি ফেরার সময় প্যাকেট লাঞ্চ নিয়ে আসবো। সেই সময়টুকুতে তুমি যতটুকু পার গুছিয়ে নাও।

একা তোমার ভয় করবে নাতো দুদোল?
অভ্যেস মানুষকে কত কিছু শিখায় বাবা। নিজ থেকেই নিজেকে বড়ো করে দেয়।
তোমার বদলির চাকরির সুবাদে কত জায়গা দেখার সুযোগ হলো। বদল হয় স্কুল। বন্ধু জুটতেও সময় হয় না। কেবলমাত্র বন্ধুত্বটা গাঢ় হতেই ছেড়ে আসতে হয়।
তোমার কাপে চা দেবো বাবা? ফ্লাস্কটা কাছে টেনে বাবার দিকে চায় দুদোল।
খালি গ্লাস টেবিলে নামিয়ে রেখে ওঠে দাঁড়ায় আসরাফ চৌধুরী।
হঁ্যা দাও। দু—একটা দিন একটু মানিয়ে নাও দুদোল। আর এর মাঝেই আমি ফটিককে দেশের বাড়ি থেকে আনিয়ে নেবো।
একা হলেই যেন মনের সাথে মনের কথা বলা। সেই যে বাবা সকালে চলে গেলো। তারপর থেকেই দুদোল একা। অচেনা এই বাসাটায় গতকালই তো এলো। সে যেখানেই যায় সংসারও সাথে যায়। এখানে সেখানে পড়ে থাকা জিনিসগুলোর কিছুটা গুছিয়ে নিজের পড়ার টেবিলে দুদোল। টেবিলের কাছে দখিনের জানালাটা খুব পছন্দ হলো দুদোলের।

পড়ায় যখন মন বসবে না। নিঃসঙ্গ সময়টা তখন আকাশকেই সঙ্গী করবে। বইখাতা গুছিয়ে কলম রাখে জায়গা মতো। কাজের সাথে সাথে ভাবনাও জুড়ে মনে। নতুন স্কুল কেমন হয় কে জানে। ছেড়ে আসা বন্ধুদের জন্যও মন কেমন করে। আয়ান, অভি, আহিল, আসাজ কেমন মন খারাপ করে ছিল। দুদোলেরও কী কম মন খারাপ। ইচ্ছে হলেই অবশ্য কথা বলা যায়। তবে দিনে নয়। কারণ ওদের কারও কাছে মোবাইলই নেই। ফোন করতে হয় আংকেলের নাম্বারে। বাবা তো দুদোলকে ফোন কিনে দিয়েছে প্রয়োজনে। একা থাকে তাই।
হঠাৎ দোতলা বাড়ির দিকে চোখ যেতেই দেখে জানালার ঝুলানো পর্দা দু’পাশে সরিয়ে চেয়ারে বসা তারই বয়সের একটি ছেলে। টেবিলে রাখা বইএর পাতা উল্টে হয়তো পড়া বের করছে। ঠিক এমনি সময়ে দুধের গ্লাস হাতে যিনি এলেন। নিশ্চয় অচেনা ছেলেটির মা হবে। নিজেকে ভুলে অবাক চোখে ওদের মা ছেলের কাণ্ড দেখে দুদোল। এত দূর থেকে কথা ভেসে আসার কথাও নয়। নিজ থেকেই কথা সাজায় দুদোল।

দুধ যেন গ্লাসে পড়ে না থাকে। সবটুকু খেয়ে নাও তো তাড়াতাড়ি।
আ—হা মা। দেখছো না ব্যস্ত আমি। রেখে যাও পরে খেয়ে নেবো।
মুখ ফিরিয়ে নিজের দিকে টেনে আনেন তিনি। এক হাতে দুধের গ্লাস ধরে, অন্য হাতে মুখটা তুলে ধরেন।
ভালো ছেলের মতো খেয়ে নাও তো। আমার বুঝি কাজ নেই!
অচেনা ছেলেটি গ্লাসের সবটুকু দুধ শেষ করে মা—য়ের দিকে তাকায়। এবার খুশি তো?
মৃদু হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন মা। খালি গ্লাস হাতে নিয়ে তিনি চলে যেতেই নিজের ভেতর ফেরে দুদোল।
মানুষ শূন্য ঘরটার মাঝে হঠাৎ করেই যেন নিজের মনটাই শূন্যতায় ভরে উঠলো। নিজের একাকিত্বের মাঝ আবার একাকিত্ব।
‘মা কেন এতো দূরে?’
স্কুল বন্ধ থাকলেই কাছে না থাকা মা যেন আরও বেশি কাছে আসে। গোসলের সময়, খাওয়ার সময়, এমনকি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময়ও। স্কুলে ছেলেদের ভিড় ভাট্টায় এতটা মনে না এলেও একটা হুল ফুটেই থাকে। সবাই কেমন বাসায় ফিরে মাকেই কাছে পায়। আর তাই আরও ছোট বেলায় বাবাকে প্রশ্নটা করেই ফেলে দুদোল।

বাবা, মা কেন নানুর কাছে? আমাদের সাথে নয় কেন?
ছেলের হঠাৎ প্রশ্নে আসরাফ চৌধুরী যেন চমকে ওঠেন। প্রশ্নটা যে আসবে জানাই তো ছিল। ভেবেছিলেন ছেলেকে কিছু একটা বলে বুঝিয়ে দেবেন। হুমাইরার এক তরফা জিদের কাছে, আসরাফ যেন হেরেই গেলো। এতো এতো করে হুমাইরাকে বুঝালো, ছেলের কথা বললো। কিছুতেই তার না কে হ্যঁা করাতেই পারলো কই। সেই কত আগে হৃদয়ে কেউ একজন টোকা দিয়েছিল। সেই কিনা এতো বছর পর ফোনে জানতে চায় আসরাফের সংসার জীবনের কথা। বাড়াবাড়িটা অবশ্য আসরাফও কম করেনি। নিজের আত্মসম্মানের কথা ভেবে দু’বছরের দুদোলকে শাশুড়ির জিম্মায় দিয়ে চলেই গেলো হুমাইরা।
বাবা চুপ কেন? বলো না বাবা।
তোমার মা আমার সাথে থাকতেই চাইছিল না। তাইতো চলে গেলো।
ছেলেকে কাছে টানে আসরাফ চৌধুরী। আদরমাখা চুমু কপালে দিয়ে বলে।
হ্যাঁরে দুদোল আমি কী তোকে আদর করি না? তোর বায়না মিটাই না? এরপরও তোর
মাকেই দরকার হলো।
অভিমানী ছেলের চোখ যেন বর্ষার নদী।
আমার খুব মাকে মনে পড়ে বাবা। কাছে পেতে ইচ্ছে হয়।
ছোট্ট দুদোলকে বুকের মাঝে চেপে ধরেন আসরাফ চৌধুরী। কষ্টের পাহাড় ভাঙে বুকে। ধরা গলায় বলেন।
স্কুল বন্ধের সময়টায় তুমি মায়ের কাছে থেকে এসো।
সেই থেকেই মায়ের সাথে যোগাযোগটা হলো।
আর একটা ঘটনা তো দুদোলকে এখনো কষ্ট দেয়। দাদি যখন মারা যায় মা এসে থেকেছিল চারদিন। প্রথম যেদিন মা এলো। দিনশেষে ক্লান্ত দুদোল মাশারির ভেতর ঘুমে কাদা। আধোরাতে একটা আদরমাখা হাত মাথায় বুলাতেই ঘুমটা ছুটে গেলো। জানালার বাইরে হালকা আলোয় চোখ মেলে চাইতেই দেখে কেউ একজন মশারির ভেতর বসে। হঠাৎ করেই বলে ওঠে দুদোল।
কে? কে আপনি?
আমাকে চিনতে পারছিস না খোকা?
দুদোল বাড়ির কেউ একজন হবে ভেবেই বলে ফেলে।
হ্যাঁ চিনেছি তো। বলেই চোখ বুজে।
সে রাতে মাকে চিনতে না পারলেও। পরে যে চারদিন মা বাড়িতে ছিল দুদোলকে কাছছাড়া করেনি। ছোট দুদোলের মন সেতো খেলার দিকে থাকবেই। সঙ্গীদের সাথে যেতে চাইলেই অমনি মা বলে উঠতো।
আমি যখন থাকবো না। তখন তুমি খেলতে যেও।
দূরে দেখা অচেনা মা—টা কেমন করে নিজের মাকেই মনে করিয়ে দিলো। কিছুতেই আর কোনো কাজে মন বসছিল না। দুদোল যখন প্রতি জায়গায় বাবার বদলির কারণে বাবার সঙ্গী হলো। ঠিক সেই সময়ে দু—এক বার চিঠি পেয়েছিল মায়ের। এখন অবশ্য মোবাইলেই কথা কখনো কখনো। আজ যেন মন মায়ের ছুঁয়া পেতে চাইছে। অনেক যত্নে তুলে রাখা চিঠিটার ভাঁজ খোলে দুদোল।

মায়ের লেখা প্রথম চিঠি।
‘স্নেহের দুদোল,
আমি তোর কাছ থেকে দূরে থাকলেও মনে রাখিস তুই সবসময় আমার মনের মাঝে আছিস। তোকে টেনে আদর, সোহাগ আর শাসনে বড়ো করতে না পারার আক্ষেপ আমারও কম নয়। আল্লাহর ইচ্ছের বাইরে তো কোনকিছুই হয় না। হয়তো তোকে এই কাছে না পাওয়াটাই তোর আর আমার ভাগ্যে ছিল। তবুও মনে রাখিস আমি সব সময় তোর সাথেই আছি। জানিস দুদোল পুকুরপাড়ে আমাদের সেই সিঁদুর আমগাছে অনেক মুকুল এসেছে। এবার গরমের ছুটিতে একবার আসিস। গাছ থেকে আম পেড়ে খাওয়ার আনন্দ কী শহরে বসে পাবি। আমি তোকে পাকা আমের রস বের করে দুধে ভাতে খাওয়াবো। পাকা আম খানিকটা গুড় দিয়ে জ্বাল করে জিরে আর শুকনো লংকা টালা দিয়ে খেয়ে দেখিস। তার স্বাদ জিভেই লেগে থাকবে। এই দেখ মনেই নেই। আতা গাছেও কিন্তু খুব আতা ফলেছে। তুই খেতে ভালোবাসিস। এই সবই তোর জন্যে তুলা রইলো।
হুম আর একটা কথা তো ভুলেই বসে আছি। তুই দেখেছিস না পুকুরে মাঝে মাঝে কেমন মাছ লাফিয়ে ওঠে। বর্ষায় যখন দিনভর বৃষ্টি পড়ে। পুকুরের মাছ তখন আরও বেশি লাফায়। আমি বড়শি কিনে রেখেছি। তুই এলে একসাথে মাছ ধরবো। খুব মজা হবে তাই না। আসিস কিন্তু। আমি পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে তোর আসার অপেক্ষায় থাকবো।
দুদোল আমার। আমি থাকলে তোকে যে কাজগুলোর করতে হতো না এখন হয়তো তোকেই করতে হয়। নাকি বাবা করে দেয়? দেখ দুদোল বাবা আর কতদিন দেখবে বলতো? এখন কি আর তুই ছোটটি আছিস। নিজের কাজগুলো নিজেই করে নিস। অভ্যেস হয়ে গেলে পরনির্ভরশীল হবি না কখনো। ঘুমুতে যাওয়ার আগে বিছানা ঝেড়ে নিতে ভুলে যাবি না। রাতে দাঁত ব্রাশ না করে ঘুমালে পোকা কিন্তু দাঁতে বাসা বাঁধবে। গোসলের পর ভিজে তাওয়াল রোদে মেলে দিবি। প্রতিদিন দুধ খেতে কি অনীহা করবি? আমি তবে খুব করে বকে দেবো। দেখ সোনা মাকে কষ্ট দিস না। ইচ্ছে না হলেও খেয়ে নিস কেমন। জানিস এই যে তোকে লিখছি। মনে হচ্ছে যেন আমি তোর সাথেই কথা কইছি। কলম থামলে মনে হয় তুই বুঝি হারিয়ে রইলি। আমার অগোচরে তোর বড়ো হওয়াটা দেখতেই পেলাম না। তবুও রাখি, রাখতে হয়। ভালো থাকিস।
তোর মা।’

চিঠি পড়ার পর একটা ঘোরের মধ্যে থাকে দুদোল। কতক্ষণ খেয়াল নেই। রাস্তায় ফেরিআলার ডাকে চমক ভাঙে।
লেইস ফিতা। এই লেইস ফিতা।
মোবাইলে সময় দেখে দুদোল। দেড়টার কাছাকাছি সময়। সর্বনাশ এখনই গোসলে না গেলেই নয়। বাবা আসার সময় হলো। দুয়ার খুলতে হবে যে।
দেখতে দেখতেই চলে যায় আট দশ দিন। দেশের বাড়ি থেকে ফটিকদা আসাতে দুদোলের একাকিত্বটা একটু কম। এর মাঝেই নতুন স্কুলে আসা যাওয়া। ক্লাসে এমন কারও সাথে তেমন ভাব হয়ে ওঠেনি। তবে স্কুলটা দুদোলের খুব পছন্দ। স্কুলের স্যারেরাও খুব আন্তরিক। নতুন অফিসে বাবার ব্যস্ত সময়। ছুটির দিন ছাড়া বাবার সাথে খুব একটা কথা হয় না। শুধুমাত্র পড়ার টেবিলটা দুদোলকে কেন যে এতো টানে। অচেনা ছেলেটি আর তার মা। খোলা জানালায় তৃষ্ণার্ত নয়নে পড়ার ফাঁকে চোখ যাবেই। একদিন তো অবাক কাণ্ডটায় ঘটে গেলো। পড়ার ভেতর এতটাই ডুবে ছিল অন্য দিকে খেয়ালই ছিল না। হঠাৎ জানালার বাইরে তাকাতেই যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। পলকহীনভাবে ছেলেটি তাকিয়ে আছে তার দিকে। দুদোলের চোখে চোখ পড়তেই মিষ্টি হাসি উপহার দিলো হাত নেড়ে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো দুদোল। হাত নেড়ে প্রতি—উত্তর জানালো। এতো দূর থেকে কথা ভেসে আসার কথাও নয়। হাত ইশারায় শব্দহীন কিছু কথার আদান প্রদান হলো। সম্বিত ফিরে ফটিকদার কথায়।
দুদোল এই ম্যাগি নুডলসটুকু খেয়ে নাও তো। কোন সকালে নাস্তা খেয়ে পড়তে বসেছো।
তুমি আবার এইসব করতে গেলে কেন ফটিকদা। দুপুরে একবারে ভাত খেয়ে নিলেই হতো।
সেতো খাবেই। পড়া সারবে, গোসল করবে তারপরেই তো খেতে আসবে। আসার সময় খালাম্মা বারবার বলে দিয়েছে।
ফটিক তুই যাচ্ছিস তাই ভরসা পেলাম মনে। দুদোলের দিকে খেয়াল রাখিস। সময় মতো খাওয়ার দিকে নজর রাখতে ভুলবি না। ফটিকদা আরও কত কথা বলে যাচ্ছে। দুদোল ততক্ষণে অর্ধেক নুডলস খেয়ে শেষ। আহ্ কতদিন পর অসময়ে খাওয়া। দুদোলের এখন আর ভাবতেই হয় না কোনো কিছু নিয়ে।
দুদোল চল কোথাও ঘুরে আসি। এখনে আসার পর তো কোথাও যাওয়া হয়নি। আসরাফ চৌধুরী সকালে নাস্তার পর পেপারে চোখ রেখে দুদোলের উদ্দেশ্য কথা ছোড়ে।
দুদোল ফোনে তাহমিদের সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে। বন্ধুদের খবর নেই অনেকদিন। রিং হচ্ছে ধরার কোন লক্ষণই নেই।
কোথায় যাবো বাবা? ফোন রেখে বাবার কাছে জানতে চায় দুদোল।
কিছু কিনাকাটা করবো। তোর জুতোজোড়াও তো বেশ পুরানো। জুতো আর তোর পছন্দের টিশার্ট নিবি।
দুদোল যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কত দিন পর মুক্ত বিহঙ্গে পাখা মেলে ধরা। হাঁফিয়ে উঠেছিল দুদোল একা একা নিজের মতো সময় কাটাতে। বাবাকে বলে আজ বাইরেই খেয়ে ফিরবে।
শপিংমলে আলো ঝলমল হাজারো বাতিতে হেঁটে হেঁটে কেনাকাটা করতে বেশ লাগছিল দুদোলের। সামনেই বইঘরটা চোখে পড়তেই ভাবলো। একটা গোয়েন্দা কাহিনি কিনলে ভালোই হয়।
বাবা চলো তো ঐ লাইব্রেরিতে যাই। বাবার কথার জবাব না খুঁজে নিজেই চলে আসে বইঘরে। তাকে তাকে সাজানো কতসব বই। ভ্রমণ কাহিনি, গোয়েন্দা সিরিজ, উপন্যাস আরও কত রকমের বই। নিজের পছন্দের বই নিয়ে পড়ে পড়ে দেখছিল দুদোল। দুটো বই হাতে নিয়ে বললো।
বাবা এই বই আর বলপেন নিতে হবে।
দাম মিটিয়ে বেরোতে যাবে। আর একবার তাকে সাজানো বইগুলোর দিকে চোখ পড়তেই দেখে। তাদের ঠিক পিছনেই সেই অচেনা ছেলেটি আর তার মা। দুদোলের মনের ইচ্ছেটা কোনো বাধাই মানলো না। একটি বার কথা বলার লোভ তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করলো। বাবার হাতে বইয়ের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো।
বাবা তুমি এখানেই থাকো। আমি আসছি।
ছেলেটি তখনও বইতেই ডুবে ছিল। অনেকটা কাছে গিয়ে দুদোল বললো।
কী বই দেখছো? ভ্রমণ কাহিনি, নাকি গোয়েন্দা। হাসিমুখে দুদোলের প্রশ্ন।
অচেনা ছেলেটির অবিশ্বাস চোখ। খুশিমনে হাত বাড়িয়ে বললো।
আমি রাফসান। রহস্য খুঁজতে আমার খুব ভালো লাগে। তাই গোয়েন্দা বইগুলো দেখছি।
আমি দুদোল। কিছুদিন হলো এসেছি। প্রতিদিনই তোমাকে দেখি। তোমার সাথে ভাব করার ইচ্ছে হলেও, সুযোগ আসেনি। আজ তোমাকে এখানে দেখে লোভটাই সামলাতে পারলাম না। কিছু মনে করোনি তো?
তোমার সমবয়সী বন্ধুত্ব হতেই পারে। কাছে দাঁড়ানো আন্টির কথায় নিজের ভেতর ফিরে দুদোল। সালাম দিয়ে বলে।
আন্টি আমি নতুন আসায় তেমন করে কারও সাথে পরিচয় হয়নি। তবে পড়ার ফাঁকে প্রতিদিন আপনাদের দুজনকেই দেখি আমি। আমার মা তো আমার কাছে থাকে না। তাই আপনাকে দেখলেই আমার মায়ের কথা মনে হয়।
তাই বুঝি, সময় করে বাসায় এসো একদিন কেমন।
একদম তাই। রাফসান যেন খুশি হলো কথাটায়। তুমি আসলে আমারও খুব ভালো লাগবে। আমিও মাকে নিয়ে একা থাকি। কথা জমবে, গল্প হবে।
সে—ই যেদিন থেকে কথা হলো। ভাব হলো। বন্ধুত্ব হলো যেন আরও বেশি। রাফসানের বাবা দেশের বাইরে থাকেন নতুন সংসার নিয়ে। দুই তিন মাস পর পর খরচ বাবদ টাকা পাঠান। আন্টি নিজের বুটিকশপ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। দুদোল মাঝে মাঝে খুব ভাবে। এই যে ওরা চারজন মানুষ। বাবা আর দুদোল। আন্টি আর রাফসান। যতই কথায়, কাজে আনন্দে মেতে থাকুক না কেন। কোথায় যেন এক একজন আলাদা আলাদা মানুষ। একা হলেই একাকিত্ব জুড়ে বসে মনে। হঁ্যা আরও একজন আছে। তার মা। দুদোলের অবুঝ বয়সে তেমন করে মায়ের অভাব অনুভব না হলেও। এখন কেমন যেন প্রতিদিন একটু একটু করে বড়ো হওয়ার সাথে সাথে মায়ের অভাবই বেশি অনুভব হয়। সবসময় কাছে পেতে মন চায়। নিজের ছোট্ট বুকটায় যে কত ব্যথা জমে আছে।
ঝালমুড়ির ওপরে ধনেপাতা ছড়িয়ে দেওয়ায় স্বাদ যেন বেড়ে গেলো আরও দ্বিগুণ। বেশ লাগছে খেতে। কয়দিন থেকেই ভাবছিল দুদোল রাফসানের সাথে কথাটা শেয়ার করবে। বিকেলে তাই ফটিকদাকে বলে দুদোল রাফসানের বাসায়। আকুপাকু করা মন বারবার ভাবছিল। কথাটা কীভাবে বলা যায়।
একমুঠো মুড়ি হাতে নিয়েই রাফসান দুদোলের দিকে চায়।
দুদোল মুখে কথা নেই কেন? কী এমন ভাবা হচ্ছে?
হঠাৎই দুদোল বললো।
হ্যাঁ রে রাফসান তোরা যেন কবে চিটাগং যাবি বলছিলি?
এখন আর ওদের তুমি নয়। কোনো অসতর্ক মুহূর্তে তুমি থেকে তুইতে নেমে এসেছে।
কেন জানতে চাইছিস? আমরা চিটাগং বেড়াতে গেলে তোর খুব ফাঁকা লাগবে? একা মনে হবে।
না আমি অন্য কিছু ভাবছিলাম রাফসান।
কী বল্ না।
মাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। বাবার সাথে কথা বলে যদি আমিও তোদের সঙ্গী হই। অফিস তো বাবাকে এখন ছুটি দেবে না। আমাকেও একা ছাড়বে না।
তাহলে তো বেশ হয় দুদোল। মা বলেছিল এবার আমাকে কাপ্তাই বেড়াতে নিয়ে যাবে। তুই যদি সাথে থাকিস আনন্দটাই অন্য রকম হবে। আমি মাকে নিয়ে আসি। তুই বস। রাফসান এক লাফে বিছানা ছেড়েই দরজার বাইরে।
শূন্য ঘরে দুদোলের মন বলে যেভাবেই হোক বাবাকে রাজি করাতেই হবে। এবারের ‘মাদার্স ডে’ সে মাকে সামনে নিয়েই পালন করবে। প্রতি বছর এই দিনটায় ওর খুব মন খারাপ হয়। ফোন করে মাকে, তবুও তৃষ্ণা যেন মেটে না। এবার মায়ের কোলে মাথা রেখে বলবে- ‘মা’ আমাকে আদর দাও। খুব আদর। আর ভালোবাসার কথা তো কোনদিন বলাই হয় না। এবার বলবে। আমি তোমাকে খুব মিস করি মা। খুব ভালোবাসি।
ছেলের বায়না শুনে আসরাফ চৌধুরী খানিকটা সময় একটু আনমনা হয়। একা ছেলেকে কখনো ছাড়েননি তিনি। সামান্য পরিচয়ে ছেলেকে কি পাঠানো ঠিক হবে। দুমনা মনেই ভাবতে থাকেন। দুদোল আবার তাড়া দেয়।
বাবা আমি যাবো তো?
আংকেল একদম টেনশন করবেন না। আমাদের বাড়ি হয়েই আমরা দুদোলের নানার বাড়ি যাবো। রাফসান বলে ওঠে।
কোনো অজুহাতই আর টিকে না। অবশেষে দুদোলেরই জয় হয়। সেই যে খুশিমনে নিজের রুমে এসে ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত দুদোল। এটা সেটা নেওয়ার পর এবার আসল জিনিসটায় হাত রাখে। যে কারণে চিটাগং যাওয়া। একটা শাড়ি। রাফসান আর দুদোল দুজনেই একদিন ঠিক করে। এবার ‘মাদার্স ডে’ তে মাকে উপহার দিয়ে অবাক করে দেবে। মাদের জন্যে শাড়ি কিনতে গিয়ে সেদিন দুজনেরই মনে হয়েছিল। ওরা আর ছোটটি নেই। নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
ট্রেন চিটাগং প্লাটফর্মে আসতেই, দুদোলের মনে হলো। আহ কতদিন পর এই অতি চেনা জায়গায় পা রাখা। বাবার সাথে কত জায়গায় তো ঘুরেছে। মনে কোনো অনুভূতিই আসেনি। আজ যেন অন্যে রকম।

রাফসানের বাড়ি ঘুরে ওরা এখন দুদোলদের নানার বাড়ি রাউজান। দুদোল আগে থেকেই মাকে জানিয়ে রেখেছিল। তাই আপ্যায়নের কোনো অসুবিধেই হয়নি। খাওয়া দাওয়ার পর চারজনই এখন আড্ডায়। যে কারণে সব বাধা ডিঙিয়ে এখানে আসা। জীবনে একটা কিছু মাকে দেওয়া। দুজনেরই পরামর্শে এখনো গোপন শাড়ি দুটো। আগামীকালই মাদার্স ডে। দুজন একসাথেই তাদের মাকে দেবে।
আপা সকালের নাস্তার পরই কিন্তু আমাদের রেডি হতে হবে। নইলে অনেক দূরের পথ। সময় হাতে নিয়ে না গেলে কিছুই দেখা হবে না। এক টুকরো পুডিং মুখে দিয়ে সাবিহা আহমেদ দুদোলের মা হুমাইরা চৌধুরীর উদ্দেশে কথা বলে।
একদম ঠিক বলেছেন আপা। কাপ্তাই যাওয়া চাট্টিখানি কথাতো নয়। আবার ফেরার ব্যাপারও আছে। হুমাইরা চৌধুরী খালি কাপ প্লেট ট্রেতে তুলে। কেন যেন মনে ভাবনায় আসে। জীবন স্রোতে বওয়া নদী। রাফসানের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে বলেই দুদোলকে বছরের মাঝেই আবার দেখতে পেলো। সাবিহা আহমেদ এর কষ্ট অন্য জায়গায়। স্বামী থেকেও নেই। একমাত্র ছেলেকে বাবা আর মায়ের আদর মিশিয়ে বড়ো করা। আর দুদোল বাবাকে সবসময় কাছে পায়। কিন্তু মা—শূন্য ঘর কি দুদোলের খালি খালি মনে হয় না। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনো সমস্যা নিয়েই বসবাস করে। মানুষ কখনো পরিপূর্ণভাবে কিছুই পায় না। অভাববোধ থাকেই।

সকাল ফুটেছে খুব সুন্দর হয়ে। ব্রেকফাস্ট শেষে সবাই ব্যস্ত। দুদোল আর রাফসান আগলে রাখা প্যাকেট দুটো বের করে। আজ তাদের দেওয়া শাড়ি পরেই তাদের মা বেড়াতে যাবে।
দুদোল রুমে এসে মাকে বলে।
মা দেখোতো শাড়িটা কেমন হয়েছে?
শাড়ি? দুদোলের মা অবাক চোখে প্যাকেটের দিকে তাকায়।
এটা কোথা থেকে আনলি?
আমি কিনেছি মা। নিজের টাকায়। আজ তো মাদার্স ডে। এই শাড়িটাই তুমি পরো মা।
তুই নিজের টাকায় কিনেছিস?
হ্যাঁ মা। বাবা হাত খরচের যে টাকা দেয়। সেখান থেকেই জমিয়ে আমি আর রাফসান তোমাদের জন্য মাদার্স ডে গিফট কিনেছি। মা দেখোনা খুলে। তোমার পছন্দ হবেতো।
শাড়িসহ ছেলেকে কাছে টানে হুমাইরা। বুকে জড়িয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়।
পৃথিবীর কত বিস্ময় যে অপেক্ষা করে মানুষের জন্য। কাপ্তাই লেকের এই ভ্রমণে না এলে অজানাই থেকে যেতো। দুপাশে সবুজ আর সবুজ ঘন গাছপালা মসৃণ রাস্তায় ছুটে চলা গাড়ি। শহরের কোলাহল আর বড়ো বড়ো অট্টালিকা, শপিংমল ফেলে। চোখ জুড়িয়ে যাওয়া এই সুন্দর যেন মন ভরিয়ে দেয়। লেকের কাছে গাড়ি থামতেই যেন অবাক চোখ সকলের। কী সুন্দর সাজানো লেক। দু’পাশে সবুজের সমারোহে মাঝে বয়ে যাওয়া নীল হ্রদ। কাপ্তাইয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আছে পানির ওপরেই কাচঘর। এখানে মানুষ অপেক্ষা করে ওপরে যাওয়ার জন্য। পাড়ঘেঁষেই আছে ছোট জেটি আর ইঞ্জিন চালিত বোট। এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর ওরা চলে আসে কাপ্তাই বাঁধের কাছটায়। বাঁধের ওপর থেকে প্রবল বেগে পানি নদীতে পড়ে কী সুন্দর স্রোত হয়ে আবার তা ছোট ছোট ঢেউ। দুদোল আর রাফসান যেন আনন্দে আত্মহারা। হঠাৎই প্রশ্ন করে দুদোল।
মা। তুমি যে বলো কাপ্তাই বাঁধ গেইট দিয়ে বন্ধ থাকে। এখানে কয়টি গেইট আছে?
ঐ যে দেখছিস, ওখানে মোট ষোলটি গেইট আছে। কখনো কখনো কী হয় জানিস? প্রবল বর্ষায় পানি যখন একশো নয় ফুট উচ্চতায় ওঠে। তখন কিন্তু ওরা মেশিনের সাহায্যে কয়েকটি গেইট খুলে দেয়।
রাফসান অবাক হয়।
গেইট খুলে কী পানি বের করে দেয় আন্টি?
হঁ্যা রাফসান দিতে হয়। নইলে যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষতি হবে। আর জানো এই পানির কারণে তলিয়ে যায় কত গ্রাম, ক্ষেত খামার, খাল, বিল, রাস্তা। সব এক হয়ে পানির নিচে। যেন চতুর্দিকে সমুদ্র। ঘর ছাড়া, ভিটেছাড়া হয় কত মানুষ।
মা। বিদ্যুৎ কীভাবে উৎপাদন হয়? দুদোলের প্রশ্ন।
তুমি যাবে দেখতে? তাহলে তো অনুমতি নিয়ে আসতে হয়।
চেষ্টা করে দেখোনা মা। এতদূর এসে এটা না দেখে যাবো।
রাফসানের মারও একই মত। আপা চেষ্টা করে দেখাই যাক না।
অনুমতি নিয়ে ওরা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভেতরে যায়। কী বিকট শব্দে টারবাইন ঘুরছে। টারবাইন হলো একটি মেশিন। যার মাধ্যমে জেনারেটর দিয়ে পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। আসলে তাপ বিদ্যুৎ আর পানি বিদ্যুৎ একইভাবে উৎপাদন হয়। তাপ বিদ্যুৎ এর ক্ষেত্রে কয়লা পুড়িয়ে পানি ফুটিয়ে বাষ্প করে টারবাইন ঘুরানো হয়। পানি বিদ্যুৎ পানির প্রবাহকে কাজে লাগায়। সবচেয়ে দরকারি কথা কি জানো তোমরা? বিদ্যুৎ এর চাহিদা সবসময় মানুষের থাকে। দিনে যেভাবে বিদ্যুৎ খরচ করা হয়। রাতের বেলায় কিন্তু কম তাই না? বাসাবাড়ি, কলকারখানা, শপিংমল, হাসপাতাল সব জায়গাতেই প্রয়োজন। রাতে তুলনামূলকভাবে কম। তাই অনেক সময় বিদ্যুৎকেন্দ্রে রাতে বিদ্যুৎ জমিয়ে দিনে সরবরাহ করে মানুষের চাহিদা মিটায়।
আপা এখানে বেড়াতে না এলে এই অজানা তথ্য অজানাই থেকে যেতো।
রাফসানের মায়ের কথায় মৃদু হাসে দুদোলের মা। চোখ তুলে বলে।
একদম ঠিক আপা। আর মাঝে মধ্যেই এভাবে কোথাও ঘুরে এলে সৌন্দর্য উপভোগের সাথে সাথে মনও কিন্তু ভালো থাকে।
আরও বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে অস্ত যাওয়া সূর্যের নরম আলো গায়ে মেখে ওরা গাড়িতে উঠে। ছুটে যাওয়া গাড়িতে এক এক জনের মনের ভাবনা এক একরকম।

দুদোল ভাবে। আবারও কত অপেক্ষার পর মাকে কাছে পাবে। রাফসান ভাবে ফিরে যাওয়া মানে আবারও একই রুটিনে জীবন চলা। রাফসানের মা ভাবে ছেলেকে সুন্দর কিছু সময় উপহার দেবে নিজের ভালোলাগা। আর দুদোলের মা! ভাবনার দুয়ারটাই যেন খুলে যায়। এই যে সঙ্গ। কতগুলো মুহূর্ত। নিজের একাকিত্বের মাঝে নিজেকে ভুলে ব্যস্ত কিছুটা সময়। এই মুহূর্তগুলো শুধু স্মৃতি ধরে রাখা কিছু সময়। ওরা চলে গেলেই আবার শূন্যতায় নিজের ভেতর ডুবে থাকা। আবার অপেক্ষা ছেলেকে কাছে পাওয়ার।

SHARE

Leave a Reply