সবার পরিচিত কবি ছড়াকার শিল্পী মহিউদ্দিন আকবর আমাদের ছেড়ে, পৃথিবীর মায়া ছেড়ে গত ৭ এপ্রিল চলে গেছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি নানা বিষয়ে লিখতেন। কিশোরকণ্ঠেরও তিনি নিয়মিত লেখক ছিলেন। তার অনেক গুণ ছিল। লেখালেখির বাইরে তিনি ছিলেন একাধারে শিল্পী, কার্টুনিস্ট, বই সঙ্কলনের প্রচ্ছদশিল্পী, ভেতরের ছবি যাকে বলে ইলাস্ট্রেশন সেগুলো আঁকতেন, ব্যানার লিখতেন, পোস্টার লিখতেন, ডিজাইন তৈরি করতেন, ভালো দেয়াল লিখন পারতেন। আর ছিল তার সাংগঠনিক দক্ষতা। তিনি নারায়ণগঞ্জে থাকা কালের অভিযাত্রী নামে একটি শিশু সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন যাতে আমিও ছিলাম। তখন আমি নারায়ণগঞ্জে থাকতাম। পরে তিনি স্কাউট, রোভার স্কাউট, সি স্কাউট ও জাতীয় শিশু সংগঠন চাঁদের হাটের সাথে যুক্ত ছিলেন। নারায়ণগঞ্জে চাঁদের হাট তারই গড়া সংগঠন। পরে তিনি ফুলকুঁড়ি আসরের সঙ্গেও যুক্ত হন। ফুলকুঁড়ি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। আমি একটানা আট বছর পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আরো আগে নারায়ণগঞ্জে ‘ইকড়ি মিকড়ি’ ও ‘অভিযাত্রী’ নামে দুটি ছড়াকার্ড আমরা প্রকাশ করতাম। সারাদেশ থেকে লেখা আসতো, ছাপার পর সেগুলো সারা দেশে পাঠাতাম ডাকযোগে। এর পর আমার সম্পাদনায় বের হয় ‘জিলিপি’ নামে ছড়া পত্রিকা। এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন লেখালেখির জগতে আমার গুরু বিশিষ্ট ছড়াকার মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার সেক্রেটারি। তার উৎসাহে ও সহযোগিতায় প্রকাশিত হতো ‘জিলিপি’। মান্নান ভাইও বেঁচে নেই। ‘জিলিপি’র সহযোগী সম্পাদক ছিলেন মহিউদ্দিন আকবর। দেশের বিশিষ্ট শিশুসংগঠক ও শিশুসাহিত্যিক রোকনুজ্জামান দাদাভাই আমাকে দিয়ে নারায়ণগঞ্জে জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন কচিকাঁচার মেলার শাখা করাতে চেয়েছিলেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ায় নারায়ণগঞ্জ থেকে ক্লাস করতে যেতাম বলে সময় দিতে পারিনি। পরে সলিমুল্লাহ হলেই চলে যাই, ফলে কচিকাঁচার মেলা আর গঠন করা হয়নি। কথাটা বলা এ কারণে যে আমি কচিকাঁচার শাখা গঠন করতে পারিনি, মহিউদ্দিন চাঁদের হাটের শাখা করতে পেরেছিলেন। আমি এর আগে নারায়ণগঞ্জে জাতীয় শিশুসংগঠন খেলাঘরের সাথে কিছু দিন যুক্ত ছিলাম। কেন্দ্রীয় পরিচালক ছিলেন বজলুর রহমান ভাইয়া, এর কেন্দ্রীয় অফিস ছিল ঢাকার হোসেনী দালান রোডে। সেখানে বহু সাহিত্য সভায় অংশ নিতাম। মাঝে মাঝে মহিউদ্দিন আকরবও যেতেন। সে সময় আমার বেশ কিছু লেখা দৈনিক ‘সংবাদে’র খেলাঘর পাতায় ছাপা হয়। বজলুর রহমান পরে সংবাদের সম্পাদক হন। দৈনিক ইত্তেফাকের ছোটদের পাতা ‘কচি কাঁচার আসরে’ও দাদাভাই আমার অনেক লেখা ছেপেছেন। তারা দু’জনও আর বেঁচে নেই। এভাবেই লেখক হয়ে উঠি। তো মহিউদ্দিন বহু গুণে গুণান্বিত ছিলেন বলে তার কাজ বিভিন্ন অঙ্গনে ভাগ হয়ে যায়। লেখালেখিটা সে সময় প্রাধান্য পায়নি। তবে পরে বেশ লিখেছেন।
২.
মহিউদ্দিন আকবরের জন্ম ১৯৫৬ সালের ২৪ মার্চ মাদারীপুরে নানাবাড়িতে। পিতার নাম আলহাজ্ব মো. আবদুর রব এবং মায়ের নাম জাহানারা বেগম। তারা সপরিবারে নারায়ণগঞ্জ থাকতেন। মহিউদ্দিনের এক ভাই ও চাচা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। তিনি ছিলেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। এর জন্য তার ভেতরে কোনো অহংকার দেখিনি। তিনি এত কিছু শেখার পরও হোমিও ডাক্তার হওয়ার জন্য ঢাকার ডিএইচএমএস এ পড়ালেখা করেন। হোমিওপ্যাথি করতেন তবে মূল পেশা ছিল প্রকাশনা বিষয়ক কাজ ও সাংবাদিকতা। তিনি প্রকাশক, অভিনেতা, নাট্য পরিচালক, আবৃত্তিকার, উপস্থাপক, নজরুল গবেষকও ছিলেন।
১৯৭৪ সালে তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। তিনি দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিকে কাজ করেছেন ও সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশনায় জড়িত ছিলেন। ৪৭টি গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। এ ছাড়াও তাঁর সম্পাদিত কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো গোলাবারুদের ঝোলা, কাটুস কুটুস, দলের নেতা টিকটিকি, টুয়েল ফুয়েল, বনপশুদের ছড়া, ইলিকশনের ছড়া, মা যে আমার হীরার চেয়ে দামী , লাইলী আমার ফার্স্ট লাভ, টুটুন মনি, গফুর চৌধুরী এক চলমান ইতিহাস, এক সমুদ্র শোকগাঁথা (ছাদ থেকে পড়ে মারা যাওয়া তার দ্বিতীয় কন্যাকে নিয়ে লেখা), শ্রাবণ রাতের বন্দিশে, নজরুলকে নিবেদিত কবিতা গুচ্ছ, স্কাউটদের সামনে চলার মন্ত্র, ছোট মণিদের অংক শিক্ষা, সময়ের কাছে হৃদয়ের কাছে, পিটি স্যারের ধোলাই, রোবট গোয়েন্দা, এ্যারোস্পেস রহস্য, তানিজিং গ্রহের আগন্তুক, মিশন টু আয়রনম্যান, লজ্জাবতী, গ্রেট কানেকশান, সুন্দরবনে তিন দিন, দাগাদাগি আঁকা আঁকি, মহিউদ্দিন আকবরের শিশু-কিশোর সমগ্র-১, আঁকা শেখার সহজপাঠ-৪ খণ্ড এবং সংকলিত গ্রন্থের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের ছড়া, দেশপ্রেমের ছড়া, শ্রমের ছড়া, আধ্যাত্মিক ছড়া কবিতা গান, ফররুখ আহমদকে নিবেদিত পঙ্ক্তিমালা ইত্যাদি। তিনি বাংলা একাডেমির সদস্য, সাহিত্য ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান, জাতীয় ছড়া উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান, ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশনসহ বহু সাহিত্য সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি ১৫ বছর স্কাউটস এর ডেপুটি কমিশনার ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি পবিত্র হজ পালন করেন। ঢাকায় চলে আসার পর রাজধানীর সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর সর্বত্র বিচরণ সবার মাঝে তাঁর একটি স্থায়ী আসন করে দিয়েছিল। তিনি জাতীয় আধ্যাত্মিক কবিতা পরিষদ, নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র, ম্যাজিক লণ্ঠনসহ বহু সাহিত্য সংগঠন পরিচালনা করতেন। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে থেকে ফেসবুক ছড়া সাময়িকী ‘মুখচ্ছবি’ সম্পাদনা করতেন। জুলাই ২০১৮ সালে বের হয় এর ১৫তম সংখ্যা। তিনি কবি নজরুল পুরস্কার স্বর্ণপদক-১৯৮৮, নবাব ফয়জুন্নেছা ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক-২০০৮ ও ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন পুরস্কার-২০২০সহ বহু প্রতিষ্ঠান থেকে পদক ও সম্মাননা লাভ করেন। তিনি স্ত্রী, ছেলেমেয়েসহ বহু আত্মীয়স্বজন রেখে গেছেন।
৩.
আমরা নারায়ণগঞ্জে এক সময়ে বেড়ে উঠেছি। আমাদের বন্ধুত্বও অটুট ছিল আজীবন। তাদের বাসা ছিল মিশনপাড়ায়। আমাদের নিজস্ব বাড়ি (আমার বড় ভাই সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল ও বিশিষ্ট চিকিৎসক প্রফেসর ডা. মো. মজিবুর রহমানের বাড়ি, আমি সেখানে থাকতাম) ছিল মিশন পাড়ার পরের রাস্তা খানপুর ডন চেম্বার রোডে। আমরা পরস্পরের বাসায় মিলিত হতাম। আমি, মহিউদ্দিন, লেখক ছড়াকার সৈয়দ মূসারেজা আমরা একসাথে কাজ করতাম। বাচ্চাদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করতাম, পুরস্কার দিতাম, সেমিনার পিকনিক ইত্যাদি করতাম। মহিউদ্দিন এসব কাজের অনেকখানি চমৎকারভারে আনজাম দিতেন। পরে আমরা ‘জিলিপি’ নামে একটি ছড়া পত্রিকা করি, যেটা বেশ নাম করেছিল। আমাদের পেছনে ছিলেন পৌরসভার সেক্রেটারি মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ভাই, তিনি সেই সময়ের একজন সেরা ছড়াকার ছিলেন। তার হাত ধরেই আমার লেখালেখি শুরু। আমি লেখা শুরু করে মিলাতে পারতাম না, মান্নান ভাই শেষ একটা দুটো লাইন যোগ করে দিয়ে অপূর্ব ছড়া বানিয়ে ফেলতেন। এসব কথা আগেই বলেছি। পৌর চেয়ারম্যান আলী আহমদ চুনকাও (বর্তমান মেয়র আইভীর বাবা) আমাদের সহযোগিতা করতেন। চুনকা সাহেব মহিউদ্দিনকে খুবই স্নেহ করতেন, তাকে কাছে ডাকতেন, তাকে দিয়ে অনেক কাজ করাতেন, সাথে আমিও থাকতাম।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে চলে আসার পর একটু ছেদ পড়েছিল, তবে সম্পর্ক যোগাযোগ জিলিপি পত্রিকা, ইকড়ি মিকড়ি ছড়া কার্ড তখনো বের হতো। এভাবে কেটে যাচ্ছিল বছরগুলো। তিনিও পরে ঢাকায় চলে আসেন। মাঝে মাঝে দেখা হতো। আরামবাগে বাসা ছিল, একটি প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। সেখানে তার কাছে গিয়েছিলাম কি একটা কাজে, করে দিয়েছিলেন। সে সময়ই তার মেয়ের মৃত্যুর কথা জানতে পারি। আগে কি পরে মনে নেই একবার তাকে দেখে বেশ স্বাস্থ্যবান মনে হলো। অবাক হলাম। বললেন ওষুধ খাওয়ার ফল। হেসে আরো বললেন, ইকড়ি ভাই আসলে ভালো নেই। ইকড়ির কথায় পরে আসছি।
আরো পরে রোগ বাসা বাঁধে তার শরীরে। প্রয়োজন দেখা দেয় বাইপাস সার্জারির। ঢাকায় এ নিয়ে আমরা আলোচনা করি। নারায়ণগঞ্জের শফিউদ্দীন ভাই আমাদের দু’জনেরই সুহৃদ ছিলেন। বর্তমানে কানাডা প্রবাসী। বছরখানেক আগে দেশে এসে আমাকে খবর দিলেন। নারায়ণগঞ্জে গিয়ে দেখা করলাম। তিনি আমাকে ৩০ হাজার টাকা দিলেন, বললেন এটা দিয়ে শুরু করো, মহিউদ্দিনের অপারেশনের জন্য আড়াই লাখ টাকা লাগবে, আশা করি বাকিটাও সংগ্রহ হয়ে যাবে। তার কথা মতো শফি ভাইয়ের আরেক ভক্ত ও সুন্দর মনের মানুষ, শিল্পপতি, তোলারাম কলেজে আমার ক্লাস মেট শফিউদ্দীন বাদল ভাইয়ের কাছে মহিউদ্দিনকে নিয়ে ইউনুস সেন্টারে তার অফিসে হাজির হলাম। এত দিন বাদে আমাদেরকে পেয়ে বাদল ভাই খুব খুশি হলেন। মহিউদ্দিন আকবরের বিষয়টা তিনি জানতেন। হাসি মুখেই বললেন, টোটাল যা খরচ লাগে অর্ধেক আমি দেবো। আমরা খুবই আপ্লুত হলাম। হিসাব করে দেখলাম সোয়া লাখ টাকা হয়। তিনি বললেন, আপনারা যে দিন বলবেন সে দিনই দিয়ে দেবো। বাদল ভাই বড়ো মনের মানুষ। তিতুমীর স্কুলের জন্য জমি টাকাসহ অনেক কিছু দিচ্ছেন। স্কুলটা দিন দিন ভালো চলছে। আমি আমার বই তিতুমীরের জীবনীতে তাদের স্কুলের নাম যোগ করে দিলাম। শফি ভাই বাদল ভাই দু’জনেই খুশি হলেন। এরপর আরো কিছু টাকার প্রতিশ্রুতি পেলাম। কিন্তু বেঁকে বসলেন মহিউদ্দিন, তিনি আর রাজি হন না। এলো করোনা, আরো পিছিয়ে পড়লাম। একদিন ফোনে বললেন, আত্মীয় স্বজন অনেকেই রাজি না অপারেশনে, কি করি ইকড়ি ভাই। প্রসঙ্গত তিনি আমাকে মতি ভাই এবং ইকড়ি ভাই, আর আমি তাকে মিকড়ি ভাই ডাকতাম, আমাদের ‘ইকড়ি মিকড়ি’ পত্রিকার নামের সাথে মিলিয়ে। পরে অনেকেই ডাকতেন এ নামে। আমরা মজাই পেতাম। তাকে মহি ভাইও ডাকতাম , কারণ আর্ট করে নিচে স্পষ্ট কালিতে তিনি এক কোনায় নাম লিখতেন মহি। অবলিগ দিয়ে দিতেন সাল। লেখা বা স্বাক্ষরের অবস্থা দাঁড়াত মহি/৮১, মহি/ ৯৭ এরকম। আমি মাঝে মাঝে মহি/৮১ ভাই, মহি/৮৭ ভাই এ রকম নামে ডাকতাম। কিন্তু তিনি রাগ করতেন না। এতে হতো কি বছর শেষে নাম পাল্টে যেত। নারায়ণগঞ্জে মতি আর মহি এ দু’জন বলতে গেলে অনেক দিন রাজত্ব করেছি। আমাদের অনেকে মানিকজোড়ও বলতেন।
যাই হোক, অপারেশন বিষয়ে তার কথায় মুষড়ে পরলাম। শফি ভাইকে জানালাম। তিনি শুনে গম্ভীর হলেন। দু’দিন পরে বললেন, এই অপারেশন কানাডায় তেমন কিছু না, যাক সে যখন রাজি না, কি আর করা। যে টাকা তোমার কাছে আছে তাকে দিয়ে দাও কিছুটা কাজে লাগুক। আমি করোনার মধ্যেই বৃষ্টি ভেজা এক দিনে মহির সাথে ফোনে কথা বলে আমার বনশ্রীর বাসা থেকে সিপাহীবাগ পর্যন্ত গেলাম, মহি ভাইকে বললাম, ছেলেকে একটু পাঠান আমরা মাঝখানে এক স্থানে মিলিত হয়ে লেনদেনটা সারব। ছেলে বাসাবোর বাসা থেকে এলো। টাকাটা তার হাতে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাসায় ফিরলাম। এত বৃষ্টি, রিকশা পাচ্ছিলাম না। বাসায় পৌঁছতেই মহি ভাই ফোন দিল, ছেলেও টাকা নিয়ে বাসায় পৌঁছেছে। নিশ্চিন্ত হলাম। বললাম, ভালো থাকুন মহি ভাই। তিনি আমাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিলেন। বললেন, বৃষ্টির মধ্যে আসার দরকার ছিল না, পরে দিলেই তো হতো। তার সৌজন্যবোধ প্রখর ছিল।
অপারেশন না করেই এই ঘটনার বছর খানেকের আগেই মহি পাড়ি জমালেন আল্লাহর সান্বিধ্যে। ডিইউজে সেক্রেটারি মো. শহিদুল ইসলামের কাছ থেকে ফোনে দুঃসংবাদটা পেয়ে খারাপ লাগলো। কয়েক দিন আগে গেল আহমদ আখতার, এবার মহি। যাই হোক সব আল্লাহর ইচ্ছা, আমাদের হাতে তো কিছু নেই। জানাজায় যোগ দিলাম। মনে মনে বললাম, ঘুমান মহি ভাই। দুঃখ একটাই অপারেশনটা করাতে পারলাম না। অপারেশন করাতে পারলে মহিউদ্দিন আকবর কি আরো কিছু দিন বেঁচে থাকতেন? জানি না। এ কথার উত্তর একমাত্র আল্লাহর কাছেই আছে। ইউনুস সেন্টারে তার সাথে আমার শেষ দেখা। তবে ফোনে মাঝে মাঝে কথা হয়েছে। করোনাকালে স্বাভাবিক যোগাযোগ ও দেখা সাক্ষাৎ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ২০১৯ এর বইমেলায় ঘন ঘন দেখা হতো। আমি আমার বই প্রকাশকদের তিনটি স্টলে সময় ভাগ করে বসতাম, অটোগ্রাফ দিতাম। এর একটা স্টলের সামনে মহি বন্ধু বান্ধব নিয়ে নিয়মিত আড্ডা দিতেন। ফলে সেই স্টলে বসার সুবাদে প্রতিদিনই দেখা হতো।
৪.
ছড়া জিনিসটা মহিউদ্দিন আকবর ভালো রপ্ত করেছিলেন। একটু ভিন্ন চিন্তা, সমাজ সমালোচনা, তির্যক দৃষ্টিভঙ্গি, বিষয় বৈচিত্র্য তার মাঝে ছিল। এক সময়ে সায়েন্স ফিকশন নিয়েও তিনি কাজ করেছেন, এগুলো প্রকাশিতও হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি লিখেছেন। তবে তার হাতে শিশুসাহিত্যই প্রাণ পেয়েছে। কারণ তার ভেতরে একটি শিশুমন বাস করতো। তার প্রকাশ ঘটেছে তার লেখায়। তিনি সত্য সুন্দরের কথা লিখতেন।
মহিউদ্দিন আকবর ছিলেন একজন প্রতিবাদী ছড়াকার। ১৯৮২ সালে মার্চে ‘রাজপথের ছড়া’ নামে একটি ছড়া সংকলন বের হয়। সাংবাদিক কলামিস্ট মাসুদ মজুমদার ও কবি ছড়াকার আসাদ বিন হাফিজ সম্পাদিত এই সঙ্কলনে তার ১০টি ছড়া স্থান পেয়েছে। এ সঙ্কলনে ১০টি করে ছড়া লিখেছিলেন আবু সালেহ, সাজজাদ হোসাইন খান, মাহবুবুর রহমান মোরশেদ, মতিউর রহমান মল্লিক, সৈয়দ মূসা রেজা, আহমদ মতিউর রহমান, ইসমাইল হোসেন দিনাজী, ফারুক হোসেন, খন্দকার নজরে মাওলা, বুলবুল সরওয়ার, মহিউদ্দিন আকবর ও আসাদ বিন হাফিজ। ‘আপন জন’ সংস্থা প্রকাশিত এ সংকলনটি সে সময় নাম করেছিল। মহিউদ্দিন আকবর তারই একটি ছড়াতে লেখেন-
সত্য এবং ন্যায় বিচারের
ফের যদি হয় হেরফের
আমরা তবে বুঝিয়ে দেব
‘ঝুট’ কারে কয় ঢের ঢের।
টের পাওয়াবো বিচারপতি
অন্যায়ে আর ভাত নেই
বিপ্লবীদের আদালতে
উপর তলার হাত নেই
জনগণের ‘ধোলাই’র কাছে
জাত ও অভিজাত নেই
(বুঝিয়ে দেব, পৃ- ৬৯)
সাজ্জাদ বিপ্লব সম্পাদিত ছড়ার ছোট কাগজ ‘লিমেরিক’ এর ২য় সংখ্যায় (মে ১৯৯৭) একটি ছড়ায় মহিউদ্দিন লেখেন-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা
নয়কো কারো দয়ার দান,
স্বাধীনতা আনতে দেশের
ঝরে গেছে লক্ষ প্রাণ।
খুন দিয়েছি প্রাণ দিয়েছি
কিন্তু তবু দেইনি মান,
‘ডিপ্লোমেসি’ করবি যদি
কেড়ে নেব আস্ত জান।
(কেড়ে নেব, পৃ- ৮)
দুটি লেখাতেই তার বিশ্বাস, আদর্শবোধ ও একজন সাচ্চা ছড়াকারের উপস্থিতি মেলে। তিনি স্পষ্টবাদী ছিলেন। ছোটদের জন্যও অনেক ননসেন্স ভার্স তিনি লিখেছেন। লেখা বড়ো হয়ে যায় বলে উদ্ধৃতি আর দিচ্ছি না।
মহিউদ্দিন আকবর বেশ কয়েকটি সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন। এই সময়ের কিশোররা এগুলো পড়তে ভালোবাসে। তার একটি সায়েন্স ফিকশন ‘মিশন টু আয়রনম্যান’। এর গল্প অবশ্যই ব্যতিক্রমী। এর জন্য লেখককে কল্পনাশক্তি ও মেধা খাটাতে হয়েছে। এই বই থেকে একটি উদ্ধৃতি দেই- বিস্তৃত বলয় সৃষ্টি করে তীব্রগতিতে বম্বারগুলো আয়রনম্যানের ব্ল্যাকহোলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দুই স্তরের অগ্রবর্তী বাহিনীর নেতৃত্বে আছেন এলিয়েন জেনারেল রাফসান হাদিসা। এদিকে আলাদা আলাদা ফটোবায়োনিক ব্যারেল গান অ্যাসেম্বল করা সুপার স্পেসশিপে ছুটছেন রিসোলেটিং প্রভিন্সের প্রধান বিজ্ঞানী ডেকেটর দারুদ গোরিয়ান বার্দে এবং মানববিজ্ঞানী আসিফ আরমান।’
যুদ্ধের একটা প্রস্তুতি দেখছি, চরিত্র হিসেবে আছে এলিয়েন। ভাষা শুনেই বুঝা যায় এ এক নতুন জগৎ। এটা লেখকের কল্পনাশক্তিরই প্রকাশ। তিনি নিজেও গল্পের চরিত্র মানববিজ্ঞানী আসিফের মতোই, একথা বলাই বাহুল্য। মহিউদ্দিনের লেখায় মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা দুটিই ফুটে উঠেছে। এ জন্যই তিনি এই সময়ে প্রাসঙ্গিক। তার আঁকা ছবি ও ক্যালিগ্রাফির মূল্যায়ন হয়নি। তবে তার আঁকা প্রচ্ছদগুলো বই আকারে পাঠকের হাতে হাতে কিছু হলেও আছে। তার শিল্পকর্মের মূল্যায়ন করা গেলে ভালো হতো।
৫.
শেষে ক’টি কথা বলে লেখা শেষ করবো। ষাটের সামান্য কিছু বেশি বছর মহিউদ্দিন বেঁচেছেন। আরো কিছু দিন বেঁচে থাকলে হয়তো তার কাছ থেকে আরো কিছু সাহিত্য শিল্পকর্ম আমরা পেতাম। মৃত্যুর ওপর তো কারো হাত নেই, আল্লাহ ছাড়া। তার পরও বলি মহি ভাই যেখানেই থাকুন, আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন। আপনার জন্য দোয়া করি। পরিবারের সদস্যদের বলবো ধৈর্য ধারণ করতে। আরেকটি কথা। তার ভালো ভালো বইগুলো সম্ভবত বাজারে আর নেই। এগুলো খণ্ড খণ্ডভাবে বা সমগ্র আকারে প্রকাশিত হলে তাকে এই সময়ের ছেলে-মেয়েরা জানার সুযোগ পাবে। প্রকাশনা সংস্থাগুলোর কাছে আবেদন রইল এ ব্যাপারে।