Home বিশেষ রচনা শিশুতোষ ছড়ায় শিশুমনের সাথে একাত্ম হয়ে যেতেন কবি ফররুখ -মামুন মাহফুজ

শিশুতোষ ছড়ায় শিশুমনের সাথে একাত্ম হয়ে যেতেন কবি ফররুখ -মামুন মাহফুজ

কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন নজরুল-পরবর্তী সমকালীন কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শক্তিমান কবি। তিনি ইসলামী ঐতিহ্যের নবরূপকার হিসেবে সবমহলে সমাদৃত হলেও বাংলাসাহিত্যে তার বিশেষ অবদান হচ্ছে বিভিন্ন দেশের ভাষার স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার, যা আমাদের ভাষাকে করেছে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে তাঁর কবিতায় যেমন গভীর ভাব-ব্যঞ্জনা ছিল, ছিল সহসা বুঝে ‍ওঠার প্রবল প্রতিবন্ধকতাও। কিন্তু সেই তিনিই শিশু-কিশোরদের জন্য লিখলেন এমন সহজ আর সাবলীল ছড়া কবিতা! যা মুহূর্তেই শিশুহৃদয়কে জয় করে নিয়েছে।
ছোটদের জন্য লেখা ফররুখের শত শত ছড়া, কবিতা, গান ও হামদ-নাত আছে, যা পড়লে মনে হয় তিনি কবিতা লেখার সময় ঠিক শিশুটিই যেন ছিলেন। শিশুদের মনের কথাগুলো এতটাই সরল বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে যে তা শিশুহৃদয় জয় করে তাকে এনে দিয়েছে সর্বজন-প্রিয়তা।
তবে শুধু আনন্দ বিনোদন নয় বরং তার লেখার উদ্দেশ্য ছিল এটাই যাতে ছোটবেলা থেকে শিশু-কিশোররা তাদের আপন কৃষ্টি ও সভ্যতার আলোকে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
ছোটদের জন্য ফররুখের প্রথম বই-পাখির বাসা বের হয় ১৯৬৫ সালে। প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি।
পাখির বাসা লিখে কবি শিশু-কিশোরদের সাথে একাত্ম হয়ে গেলেন। তিনি তাদের নিয়ে গেলেন পাখির বাসা খুঁজতে-
আয় গো তোরা ঝিমিয়ে পড়া
দিনটাতে,
পাখির বাসা খুঁজতে যাব
এক সাথে।
কোন্ বাসাটা ঝিঙে মাচায়
ফিঙে থাকে কোন্ বাসাটায়
কোন্ বাসাতে দোয়েল ফেরে
সাঁঝ রাতে।
ঝিলের ধারে ঝোপের মাঝে
কোন্ বাসাটা লুকিয়ে আছে
কোন্ বাসাটায় বাবুই পাখির
মন মাতে।
নদীর ধারে নিরালাতে
গাঙ শালিকের বাস যেটাতে
রাত্তিরে সে থাকে, এখন
নেই যাতে॥
এই যে তিনি শিশুদের কিশোরদের ডাকলেন পাখির বাসা খুঁজতে, তারপর কী করলেন? এরপর তিনি পাখিদের জীবন নিয়ে দারুণ কিছু দর্শন তুলে ধরলেন। যা থেকে শিশুরা কিছু শিখতে পারে। আর সেটা যেন হয় জীবন থেকে শেখা। চড়–ই পাখির জীবন থেকে তিনি শিশুদের শেখাতে চাইলেন পরনির্ভরশীল হয়ে নয় স্বনির্ভর হয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচো।
চড়ুই পাখি চালাক তবু ভাই
নিজের বাসার ঠিক ঠিকানা নাই,
পরের দালান বাড়ি খুঁজে
থাকে সে তার মাথা গুঁজে
সবাই তাকে খারাপ বলে
বলে যে দূর ছাই।
পরের দয়ায় বাঁচতে যারা চায়,
দুঃখ তাদের ঘোচানো যে দায়॥
পরের কোঠায় চড়ুই পাখি
নিজেরে হায় দিল ফাঁকি,
পরের দয়ায় চড়ুই পাখি
গোলাম হলো তাই॥
ফররুখের পাখির বাসা প্রকাশের পরের বছরই এটি ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায়। এরপর ১৯৬৯ এ প্রকাশ পায় কবির দ্বিতীয় শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ নতুন লেখা। এই কাব্যের কবিতাসৌষ্ঠবে দেখা মেলে বাংলার প্রকৃতি, ঋতুবৈচিত্র্য, দেশপ্রেম, ভালো-মন্দের মানুষসহ প্রত্যক্ষ পরোক্ষ জ্ঞানের শত শত লাইন। প্রকাশের সালের সাথে মিলিয়ে কাব্যটিতে স্থান পায় ৬৯টি কবিতা। আবার ১৯৬৯ সালতো বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যখন বাংলার মানুষের মাঝে তীব্রভাবে অনুরণিত হচ্ছে স্বাধীনতার মন্ত্র। সে সময় কবি তার কবিতায় একদিকে বড়দের আগ্রহী করে তুললেন স্বাধীনতার প্রতি, আবার শিশুদের ডাকলেন দেশের ভালোবাসায় আত্মোৎসর্গের জন্য। তবে তিনি সতর্ক ছিলেন সাম্রাজ্যবাদীদের ব্যাপারেও। তবে শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ নতুন লেখায় তিনি কিছু মৌলিক শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। যেমন বন্ধু নির্বাচন কেমন হবে? শিশু-কিশোরদের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে তার বন্ধু নির্বাচন হতে হবে সঠিক, নয়তো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে ফুলের মতো শিশুটি।
বন্ধু নির্বাচন-
বন্ধু যদি বেড়াও খুঁজে
চিনবে তাকে চক্ষু বুজে।

লোকটা কেমন?
মন্দ কি আর
মন্দ শুধু স্বভাবটা তার
হর হামেশা বাইরে ঘরে
দ্বন্দ্ব-মানে ঝগড়া করে,
হিংসুটে আর কিপ্টে বেজায়
ফুর্তি শুধু পরের কথায়।
বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধ ও অভিজাত করে তুলতে কবি ফররুখ আহমদ একজন সৈনিকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাই অনেকেই তাকে ভাষাসৈনিক বলে সম্মান করেন। কবি ফররুখ মাতৃভাষা বাংলাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন। সেই ভালোবাসাকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বাংলার ঘরে ঘরে, প্রতিটি হৃদয়ে। তাই একদা সবার কণ্ঠে শোনা যেত কবি ফররুখ আহমদের মাতৃভাষার গানটি।
ও আমার মাতৃভাষা বাংলাভাষা
খোদার সেরা দান
বিশ্বভাষার সবই তোমার
রূপ যে অনির্বাণ।
মাতৃভাষা বাংলা চর্চা ও শেখার জন্য শিশুদের আগ্রহী করে তুলতেও তার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল। হরফের ছড়া লিখে তিনি সেই চেষ্টাকেই এগিয়ে নিলেন। ১৯৬৮ সালে হরফের ছড়া প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। প্রতিটি বর্ণ নিয়েই ছড়া লিখেন তিনি। ছোটদের মনে গল্পের স্বাদ এবং কৌতূহল এনে দিয়েছে সেই ছড়াগুলো।
ক য়ের কাছে কলমি লতা,
কলমি লতা কয় না কথা,
কোকিল ফিঙে দূর থেকে
কলমি ফুলের রঙ দেখে ॥

খ কে নিয়ে খেঁক শিয়ালী
যায় পালিয়ে কুমারখালি
পাখ-পাখালি খবর পেয়ে
খরগোশকে দেয় জানিয়ে॥

গ য়ের খেলা গোললাছুট
জিতলে চানা, হারলে বুট,
তোমরা খাবে কুটুর কুট,
আমরা খাব মুটুর মুট ॥

ঘ য়ে ঘোড়া এল যেই
খোঁড়া হল সকলেই,
কালো ধলো দুই ঘোড়া
দুয়ে মিলে এক জোড়া॥

ঙ জানে রঙ ঢঙ,
রঙ নিয়ে খেলা সঙ,
লিকলিকে সরু-ঠ্যাং
লাফ দেয় কোলা ব্যাঙ॥

চ য়ে চাঁদ চৌপর
জেগে রয় রাত ভর,
চড়–ইয়ের বাসাটায়
চাঁদ এসে ঘুরে যায়॥

ছ য়ে ছড়ার শহরে
সুর উঠেছে নহরে,
রং তামাশা হাজারে
ছড়া ছবির বাজারে॥
কবি ফররুখ শুধু কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন সত্যের প্রচারক। তাই প্রতিটি কাজে এবং লেখায় তিনি সবচেয়ে ধ্রুব সত্য স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। কবি ছোটদের জন্য যেসব কবিতা রচনা করেন সেসব কবিতায়ও তিনি আল্লাহর গুণগান প্রকাশ করেন।
বুলবুলি গো বুলবুলি
কোথায় যাবে সুর তুলি?
বুলবুলি কয়, খানে কা’বা-
কা’বা ঘরে যাই
চলার পথে খোদার হাম্দ;
নবীর তারিফ গাই॥
চিড়িয়াখানা নামক ছড়াটিতেও তিনি স্রষ্টার মাহাত্ম্য তুলে ধরেন।
দেখতে যাব কাজের ফাঁকে
প্রাণীর বাসা জগৎটাকে,
খোদার গড়া এই দুনিয়ায়
কেউ পানিতে, কেউ বা ডাঙ্গায়,
কেউ বা ঘোরে শূন্য হাওয়ায়,
দেখি আজব চিড়িয়াখানায়॥
পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে তারা উটের দিকে তাকিয়ে দেখে না যে, কীভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?- সূরা আল-গাশিয়াহ
উট নিঃসন্দেহে তার সৃষ্টি-রহস্যের অন্যতম। কবি ফররুখও তাই উটের চলাচলকে আল্লাহ তায়ালার রহমত বলে উল্লেখ করেন।

উট চলে ভাই ধূ ধূ বালু মরুভূমির পথ ঘুরে,
ভুখ পিয়াসে শান্ত থেকে দূরান্তরে যায় দূরে,
মাথার ওপর গনগনে রোদ আগুন যেন দেয় ঢেলে
মানুষ পিঠে নিয়ে তবু উট চলে দু চোখ মেলে,
খোদার রহম, মরুভূমির শ্রেষ্ঠ বাহন উট দেখি,
মরুর জাহাজ নাম হয় তাই, বন্ধু খাঁটি; নয় মেকি॥

১০ জুন কবির জন্মদিন। ১৯১৮ সালে মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলায় কবির জন্ম। মাগুরা তখন যশোর জেলার অন্তর্গত ছিল। কবির জন্মদিনে প্রত্যাশা থাকবে তার প্রতি যে অন্যায্যতা এক শ্রেণির মানুষ দেখিয়েছে তার অবসান হবে। তাকে নতুনভাবে জানার সুযোগ পাবে নতুন প্রজন্ম!

SHARE

Leave a Reply