Home ফিচার রসনার লিচু ও মধুফল আম -মুহাম্মদ নূরুল হুদা

রসনার লিচু ও মধুফল আম -মুহাম্মদ নূরুল হুদা

আবহমান বাঙালি সংস্কৃতিতে মধুফলের জন্য মধুমাস হিসেবে জ্যৈষ্ঠের যে খ্যাতি তা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না, বলে দিতে হয় না। স্থায়ী বাজার থেকে শুরু করে ফুটপাথ সর্বত্রই থরে থরে সাজনো ফলের পসরা। অলিতে গলিতেও অহরহ ফেরিওয়ালার হাঁক ‘আম চাই আম’ ‘জাম চাই জাম’। জ্যৈষ্ঠের মধুফলের রসালো আমেজ বাঙালি সংস্কৃতিতে জড়িয়ে আছে আবহমান কাল থেকেই। একসঙ্গে এতো বেশি ফল বাংলাদেশে জ্যৈষ্ঠ ছাড়া আর কোনো মাসেই হয় না। আম, জাম, কাঁঠাল, তরমুজ, জামরুল, কামরাঙ্গা, আনারস, কত রকমের ফলের আর নাম করা যায়। বাংলার গ্রামীণ জনপদের মানুষের কাছে খুবই প্রিয় এসব ফল। এসব ফলকে ঘিরে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন লোকাচারও। মধুমাসের মধু ফল আম দিয়ে আত্মীয় আপ্যায়ন, মেয়ে বাড়িতে আম-কাঁঠাল দেওয়া ইত্যাদির তো উল্লেখ করাই যায়।
গ্রীষ্মের মজাদার জনপ্রিয় জাতীয় ফল কাঁঠাল, ফলের রাজা আম এবং জামের মতোই সুস্বাদু লিচু সকলের প্রিয়। ফলের ভরা মৌসুমে লিচুর আয়ুষ্কাল মাত্র ১৫ দিন থেকে ২২ দিন পর্যন্ত। সুস্বাদু রসনার লিচু সহসাই আসে আবার অনেকের অজান্তেই বিদায় নেয়। রসালো লিচুর দাম বেশি থাকে বলে অনেকেরই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থাকে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, ভরা মওসুমেও লিচু অনেকের ভাগ্যে জোটে না। কেউ কেউ বহু কষ্টে মওসুমে একবার দুইবারই পরিবারের জন্য ক্রয় করতে সক্ষম হয়। এ ছাড়া চড়া দামের কারণে অনেকবারই আফসোস করে লিচুর মওসুম কেটে যায়।

বাংলাদেশে চাহিদার চেয়ে বড়ো কথা হলো এই ২০-২২ দিনের মধ্যে মাত্র কয়েকদিন সারা বাংলায় গায় লাল এবং গোলাপিসহ হালকা সবুজ মিশ্রিত লাল গোলাপির রসাল লিচু ছেয়ে যায়। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে রাজশাহীর লিচু বলে খ্যাত এই রসনার লিচুর চাহিদা থাকে প্রবলভাবে। মানুষ রাজশাহীর লিচু ছাড়া অন্য কোনো লিচুর কথা শুনতে চায় না তবে দেশের গ্রামাঞ্চলে একটু ভিন্ন প্রেক্ষাপট থাকে। গ্রামের হাটগুলোতে যেমন বলা হয়ে থাকে জমিদার বাড়ির লিচু, মঙ্গলবাড়ির লিচু, বোম্বাই লিচু, মুরশিদাবাদের লিচু ক্রয় করলাম।
গ্রামাঞ্চলে লিচু যা হয় তা দিয়ে এলাকার চাহিদা পূরণ হয় না, বরং বাইরে থেকে সরবরাহ হয়ে থাকে। বিচ্ছিন্নভাবে গ্রামাঞ্চলে কিছু কিছু লিচুগাছ থাকলেও তার তেমন যত্ন নেওয়া হয় না। এছাড়াও দেখা যায় এক বা দুই রাতের মধ্যে বাদুড় এসে লিচু সাবাড় করে দেয়। আর সে জন্যই লিচুগাছের মধ্যে কোনো ডালপালায় ঝুলন্ত টিন বেঁধে রশি দিয়ে একটু দূর অর্থাৎ ঘর থেকে রশি টেনে টেনে শব্দ করা হয় যাতে বাদুড় বসতে না পারে। এটা এক সময় খুব জোরেশোরেই প্রচলন ছিল। কিন্তু আজকাল সেই বাদুড়ও বিলুপ্তির পথে যা নাকি দুর্লভ প্রাণীতে পরিণত হতে যাচ্ছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কোনো এক সময় শুরু হয় লিচু চাষের প্রচলন। আর আমাদের দেশে লিচু আসে চীন থেকে। তাও বেশিদিন আগে নয় অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে চীন থেকে ভারত ও বাংলাদেশে লিচু আসে। তাই সে প্রেক্ষাপটে লিচু চাষের ইতিহাস মাত্র শতবর্ষের। শতবর্ষ হলেও লিচু দেশের সব জায়গায় সমভাবে চাষ হচ্ছে না। আগেকার দিনে জমিদার বাড়ি কিংবা ধনাঢ্য ব্যক্তির বাগানবাড়িতে লিচু চাষ করা হতো সখ বা বিলাসিতা করে। এর কোনো বাণিজ্যিক দিক ছিল না। সে হিসেবে মাটি উপযোগী ঈশ্বরদী, রাজশাহী, দিনাজপুর, যশোর ও কুষ্টিয়ায় সর্বাধিক চাষ করে প্রচুর লিচু পাওয়া যাচ্ছে। তবে ঈশ্বরদী, দিনাজপুর এবং রাজশাহীতে উৎপাদিত লিচুই দেশের চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ করে। এসব অঞ্চলে উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের লিচুর মধ্যে রয়েছে বোম্বাই, চায়না-৩, মঙ্গলবাড়ী, মজাফরপুরী ইত্যাদি।

লিচুর চাষ সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আরম্ভ করে ৩৫০০ ফুট উঁচু পার্বত্যাঞ্চলেও চাষ করা যায়। লিচু পানিবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। চুনাপ্রধান মাটিতে লিচুর চাষ ভালো হয়। এক হিসেবে ও তথ্যে জানা যায়, হেক্টরপ্রতি লিচুর ফলন ১৫ মেট্রিক টন এবং বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে জলবায়ু তা চাষের জন্য যথেষ্ট উপযোগী। লিচুর চারা রোপণ এবং কলম লাগানোর পর সেই অংশটুকু কেটে রোপণ করার পর থেকে মাত্র ৮-১০ বছরের মধ্যে ফল পাওয়া যায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এখনতো বিভিন্ন ফলের চারা ক্রয় করে রোপণ করার প্রবণতা আমরা দেখে থাকি। কিন্তু একদা স্মৃতিময় মধুর সময় এটাই ছিল জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে বাড়ির আঙিনায় যত্রতত্র আম, জাম, লিচু ও কাঁঠালের চারা প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেতো। তা থেকে অথবা ভালো জাতের আম, জাম, কাঁঠাল ও লিচুর বীজ মাটিতে পুঁতে রেখে তা থেকে চারা উঠিয়ে রোপণ করা হতো। এতে আমরা দেখেছি পরবর্তী গাছ থেকে ফল পাওয়া যেতো তা আগের গাছের ফল (মা গাছ) থেকে স্বাদে ও গন্ধে অনেক ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন প্রকৃতির হতো নতুবা মাটির গুণাগুণের কারণে ভিন্ন স্বাদের ও গন্ধের হয়ে থাকতো।

উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম গবেষণাগার স্থাপনে যে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে সে সাফল্যকে সামনে রেখে যদি লিচুর ওপর গবেষণা করার জন্য গবেষণাগার স্থাপন করা যায় তাহলে এতে প্রভূত ফল পাওয়া যাবে। এত রসনার লিচু চাষের সম্প্রসারণ ঘটবে সর্বত্র এবং চড়া দামে লিচু চাষের প্রতি অনেকেই আগ্রহ হবে। এ ছাড়া লিচু চাষের আদিস্থান চীন থেকে নিয়ে আসা প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে পারলে আরো স্বল্প সময়ে সুস্বাদু অধিক ফলনের লিচু পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু লিচুর চাষপদ্ধতি আধুনিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু উৎপাদনকারী জেলাগুলোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কিছু পদক্ষেপ নিলেও এর সুফল পাওয়া গেছে সামান্যই। তাই এ অবস্থায় লিচু গবেষণা ও উৎপাদন ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণের জন্য উল্লিখিত অঞ্চলে লিচু গবেষণা কেন্দ্র বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন প্রয়োজন।
আর ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা ও চাষাবাদ করা গেলে অন্যান্য মওসুমি ফলের মতো এর ওপর ভিত্তি করে উত্তরাঞ্চলে লিচু প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে উঠতে পারে, এসব শিল্পের মধ্যে চাটনি, মোরব্বা ও টিনজাতকরণ উল্লেখযোগ্য। লিচু স্বল্পস্থায়ী (দুই থেকে তিন সপ্তাহ) ফল হলেও তা রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। কারণ আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশে টিনজাতকৃত লিচুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

রসালো বা রসনার লিচু যাই বলি, এই লাল গোলাপি রঙের সুডৌল লিচুর প্রতি সকলেরই আকর্ষণ থাকে। সবারই খাওয়ার লোভ থাকে। সবারই তার পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনদের লিচু খাওয়ানোর একটা তীব্র আকর্ষণ থাকে। কিন্তু সাধ থাকলেও তা চড়া দামের কারণে অনেকেরই ক্রয় করার সাধ্য থাকে না। লিচু বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ফল, আমদানি করতে হয় না। তবে চোরাই পথে ভারত থেকে এসে বাজার সয়লাব করে ভারতীয় লিচু।
আমাদের আকাক্সক্ষা হবে এই রসনার লিচু সবাই খাবে। সেই মনোবৃত্তি ও প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে যদি আমরা সবাই যার যার বাড়ির আঙিনায় একাধিক লিচুগাছের চারা বা কলম রোপণ করি তাহলে আগামী ৮-১০ বছরে পরবর্তী বংশধরদের জন্য রসনার লিচু উপহার দিয়ে যেতে পারবো। এছাড়াও সরকারি পর্যায়েও ব্যাপক উদ্যোগ ও গবেষণা প্রয়োজন যাতে করে সবাই উৎসাহী হয় লিচু চাষে। অন্তত পরিকল্পিত স্থানগুলোতে এর ব্যাপক চাষ হতে পারে।

‘মধুফল’ বা ফলের রাজা ‘আম’ যেটাই বলি না কেন আমকে ঘিরে গ্রামবাংলায় যে স্মৃতিময় দিনগুলো আমরা কাটিয়েছি তা কোনদিন ফিরে আসবে না। গাছের কোলজুড়ে যে অসংখ্য আমের ছড়াছড়ি, একটি বৃন্তে কয়েকটি করে ঝুলে থাকা আম সবই যেন মায়ের মত করে আগলে রেখেছে গাছ। আমরা ছোট বেলায় দেখেছি, এই বুঝি গাছের ডালপালা ভেঙে আমগুলো পড়ে যাবে, কিন্তু না বোঁটাগুলোর যে ধারণক্ষমতা তাতে তা সামান্য বাতাসে বা সহজে পড়ার মত নয়। প্রচণ্ড কালবৈশাখী ঝড়ে বেশ কিছু আম আছড়ে পড়ে, কিন্তু তারপরও গাছের কোলজুড়ে আম থেকে যায়। আম পাকা গরম বলে গ্রাম বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে। সেই গরমের সময় কিছু পাকা আম দিনে রাতে ঢাসঢুস শব্দ করে মাটিতে পড়ে। অনেক আম ফেটে যায়, আবার অনেক আম মাটিতে পড়লেও কিছু অংশ বাদে বাকি অংশটা ভালো থাকে। ঠিক এই আমপাকা গরমে রাতভর আম কুড়ানোর স্মৃতিময় দিন রয়েছে অনেকেরই, পারিবারিক তো বটেই গ্রামের পাড়ার লোকদের মধ্যে সম্প্রীতির এক মধুর সম্পর্কও আমরা ছোটবেলায় দেখেছি। দেখা যেতো প্রায় শত বছরের পুরনো একটি গাছের আম কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা ভাগ করে নিতেন।

এই পরিবারগুলো অনেক বছর আগে একান্নবর্তী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সবচেয়ে মজা হতো উক্ত বিশাল গাছের আম পাড়ার সময় কয়েকটি পরিবারের অনেক সদস্য আমগাছতলায় সমবেত হতেন এবং ঝাঁকায় করে উঠোনে নিয়ে এসে আমের স্তূপ তৈরি করা হতো। এই কার্যক্রমে পাড়ার অন্যান্য ছোট ছেলে মেয়েরাও অংশ নিতো এবং তাদেরকে ঐ স্তূপকৃত আম ভাগ করার পূর্বে কিছু কিছু আম দিয়ে দেওয়া হতো। আর এরই মাঝে কত যে আম খাওয়া হতো তা বলাই বাহুল্য। এ ছাড়াও ঝড়ের আছড়ে পড়া কাঁচাআম বা জ্যৈষ্ঠের পরিণত সময়ে মেয়ের জামাইর বাড়ি বা অন্য কোন আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও মুরুব্বির বাড়ি আম দুধ পাঠানোর রেওয়াজ আমাদেরকে সোনালি দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বাড়িতে প্রায় প্রতিদিন সকালের নাস্তা আম মুড়ি এবং রাতের খাবারের পর আম দুধ খাওয়া হতো। পাড়ায় পাড়ায় এমন দেখা যেত যাদের আম গাছের সংখ্যা বেশি এবং পর্যাপ্ত আম রয়েছে তা থেকে তারা আশপাশে অনেকের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। আবার কাউকে কাউকে ডেকে আম মুড়ি বা আম দুধ খাইয়ে দেওয়া হতো। এমনও হতো গাছে আম কম এলেও প্রচলিত ধারা অনেকেই অব্যাহত রাখার চেষ্টা করতেন। এটা এক মধুর সম্প্রীতি ছিল পাড়ায় পাড়ায়। জানি না এই মধুমর দিনগুলো আজ বহমান কি না?

SHARE

Leave a Reply