আজকে তোমাদের আমি ক্যামব্রিজের গল্প শোনাবো। শহরের নাম ক্যামব্রিজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও ক্যামব্রিজ। আসলে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এই শহর। কত দিনের পুরনো ইতিহাস জানো? শহরের ইতিহাস দীর্ঘ দু’হাজার বছরের আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস আট শ’ বছর! এত পুরনো কালের ইতিহাস এখানে জড়িয়ে আছে লতায়-পাতায়, পথ-ঘাট আর স্থাপনায়! ভালো কোন শ্রোতা পেলে বা উৎসুক কোন পরিব্রাজক এলে ইতিহাস তার সাথে খলবলিয়ে কথা বলে! মজার ব্যাপার হলো, এত পুরাতন হলেও ক্যামব্রিজ অব্যবহৃত ও বাসি হয়ে জাদুঘরে রেখে দেওয়ার মতো কিছু হয়ে যায়নি! ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় আজো বিশ্বের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সৌরভ ছড়াচ্ছে! যেতে চাও সেখানে পড়াশোনা করার জন্য? সেই স্বপ্ন বোনার আগে ক্যামব্রিজে আমাদের প্রথম দিনটি কেমন কেটেছিল সেই গল্প শোন।
আমরা ক্যামব্রিজ এসে পৌঁছুলাম, ২৫ অক্টোবর ২০০৮ তারিখ, শনিবার সন্ধ্যায়। পরদিন ছিলরোববার, সেদেশে সরকারি ছুটির দিন। ওটাই আমাদের প্রথম পূর্ণ দিবস এই প্রসিদ্ধ শহরে। সকাল ৯টার দিকে আমরা বেরুলাম হোটেল থেকে।যথারীতি আমাদের নিয়ে আসা হলো কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শহর ঘুরে দেখার জন্য। বলা যায়, ক্যামব্রিজের সাথে আমাদের পরিচয় শুরু হলো।
হোটেল থেকে দু’টি গাড়িতে চড়ে আমরা এসে নামলাম কিংস কলেজের সামনে।‘আমরা’ বলতে ঢাকা থেকে আসা আমরা পাঁচজন প্রিন্সিপালের একটি ছোট্ট দল। আমি তখনো মানারাত ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, ঢাকার প্রিন্সিপাল। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সৌজন্যে ও সিআইইয়ের (ক্যামব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল এক্সামিনেশনস) আমন্ত্রণে আমরা এসেছি ক্যামব্রিজ পরিদর্শনে।কিংস কলেজের সামনে যখন পৌঁছালাম তখনও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ভীষণ ঠাণ্ডা ও ভেজা ভেজা দিন! এখানেই আমাদের তুলে দেওয়া হলো বয়স্কা একজন ট্যুর গাইডের হাতে। মহিলার নাম, মেভিস ড্রেইক। ছোটখাটো গড়নের হাসিখুশি মানুষ। এমন একজন গাইড পেয়ে আমি চটজলদি ভাব করে নিলাম তার সাথে। কারণ, গাইডের কাছে থেকেই ইতিহাসের নানা খুঁটিনাটি বিষয় জেনে নেওয়া যায়। আমি তার সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। কথায় কথায় তিনি বললেন, তার পূর্বপুরুষব্রিটেনে এসেছিলো বহু যুগ আগে স্পেন থেকে। মেভিস শব্দটি থেকেই একথা বুঝে নেওয়া যায়। এটি স্প্যানিশ ভাষার শব্দ। এর অর্থ পাখি। আর ড্রেইক বলতে বোঝায় পুরুষ হাঁসকে। হাসতে হাসতেই মেভিস বললেন, “মাদি হাঁসের আওয়াজ শ্রুতিমধুর নয়, পুরুষ হাঁসই বরং স্মার্ট!” আমি মুহূর্তের জন্য ভাবলাম, নবজাতকের জন্য সুন্দর ও অর্থবোধক নাম রাখার ব্যাপারে পিতা-মাতার চিরন্তন আগ্রহ এবং এ বিষয়ে কোন কোন জনপদের মানুষের সাংস্কৃতিক দীনতার কথা।
সহজভাবে বললে বলা উচিত,ক্যামব্রিজ হলো কলেজের শহর। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির অধীনে মোট কতগুলো কলেজ এই শহরে আছে আন্দাজ করে বলো দেখি?ভাবছো নিশ্চয় দু’চারটা অথবা বড়োজোর পাঁচ-সাতটা হবে আর কি!ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির অধীনে কলেজ আছে মোট একত্রিশটি।এর মধ্যে ১৬টিকে বলা হয় পুরাতন কলেজ (ঙষফ ঈড়ষষবমব) যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১২৮৪ সাল থেকে ১৫৯৬ সালের মধ্যে। আর, ১৮০০ সাল থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় বাকি ১৫টি কলেজ, যা নতুন কলেজ (ঘবি ঈড়ষষবমব) হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৫৯৬ সালের পর থেকে ১৮০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে ক্যামব্রিজে একটি কলেজও প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। ক্যামব্রিজের সবচেয়ে পুরাতন কলেজের নাম হলো:পিটারহাউস, ১২৮৪ সালে ধর্মশিক্ষার এই কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একজন বিশপের হাতে।আর সবচেয়ে নতুন কলেজের নাম হলো রবিনসন কলেজ, ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত।ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির যাত্রা শুরু হয় মূলত ১২০৯ সালে। সেবছর ব্রিটেনের প্রাচীনতম বিশ^বিদ্যালয় অক্সফোর্ডের শিক্ষকদের সাথে অক্সফোর্ড শহরবাসীর অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। ফলে, একদল শিক্ষক অক্সফোর্ড ছেড়ে ক্যামব্রিজে এসে অবস্থান নেন। শুরুতে খ্রিষ্টানদের ধর্মগুরু বা প্রিস্টদের জন্য একটি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, ধারণা করতে পারি, অনেকটা মক্তবের মতোই! এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১২৩১ সালে সরকারি অনুমোদন বা ‘রয়েল চার্টার’ লাভ করে। তখন ব্রিটেনের রাজা ছিলেন তৃতীয় হেনরি। ধীরে ধীরে উন্নত হতে হতে প্রথমে তা স্কুল এবং পরে কলেজের রূপ নেয়। শুরুটা শুধুমাত্র খ্রিষ্ট-ধর্মীয় পড়াশোনার (আমাদের উপমহাদেশে যেমন ইসলাম ধর্মশিক্ষার জন্য মাদ্রাসা আছে, তেমনইখ্রিষ্টান ধর্মের মাদ্রাসা বলতে পারো এগুলোকে!) মধ্য দিয়ে হলেওপরবর্তীকালে ধর্ম ছাড়াও নানা বিষয় সমন্বিত হতে থাকে এখানকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষাকার্যক্রমে, যেমন: সাহিত্য, অংক, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্পকলা, ইতিহাস ইত্যাদি। এখানে একটা তথ্য তোমাদের জানিয়ে রাখি: ১৫৩৪ সালে রাজা অষ্টম হেনরি ‘ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস’ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেন। বর্তমানে বিশে^র প্রাচীনতম এই ইউনিভার্সিটি প্রেসের প্রথম ছাপানো গ্রন্থ ছিল একটি বাইবেল। তখনকার শিক্ষার সাথে ধর্ম এতটাই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল! সে যাই হোক, ক্যামব্রিজে কালক্রমে বাড়তে থাকে শিক্ষার মান এবং কলেজের সংখ্যা।অবশেষে অনেকগুলো স্বায়ত্তশাসিত কলেজকে সংগঠিত করে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম হয়। এর মধ্যে কালের বিবর্তনে কোন কোন কলেজের নামে পরিবর্তন এসেছে। কোন কলেজ অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে নাম বদলিয়েছে অথবা পুরোপুরি হারিয়ে গেছে।ক্যামব্রিজ বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনস্থ ৩১টি কলেজ ছাড়াও ক্যামব্রিজ শহরে বেশ কয়েকটি কলেজ আছে শুধুমাত্র খ্রিষ্টধর্ম শিক্ষা ও গবেষণার জন্য। যেমন: ওয়েস্টকট হাউস, ওয়েস্টমিনস্টার কলেজ, রিডলে হল থিওলজিক্যাল কলেজ ইত্যাদি। ক্যামব্রিজে সবগুলো কলেজ মিলিয়ে ছাত্র-ছাত্রী আছে সর্বমোট প্রায় আঠারো হাজার।
ক্যামব্রিজে প্রথম স্থাপিত আধুনিক কলেজটি হলো ‘কিংস কলেজ’। এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাজা ষষ্ঠ হেনরি (হেনরি দ্য সিক্সথ)। সেই কিংস কলেজে আমরা এসে উপস্থিত হয়েছি। গেট দিয়ে ঢুকলেই একখানি বড়ো আকারের চতুষ্কোণ মাঠ। ডান পাশে কিংস চ্যাপেল। বাকি দুই পাশে তিন তলা দালান, কলেজের অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং।এই কলেজের আছে সুদীর্ঘ নিজস্ব ইতিহাস। গথিক স্থাপত্যকলার সর্বোত্তম ধাঁচে গড়া এই কলেজের চ্যাপেলটি এক অনিন্দ্য সুন্দর সৃষ্টি। এ ধরনের স্থাপত্য সমগ্র ইউরোপে আর দ্বিতীয়টি নেই বলে গথিক আর্কিটেকচারের ওপর যারা পড়াশোনা করে তাদের এই কিংস চ্যাপেলে আসতেই হয়। কিংস চ্যাপেলে ঐতিহ্যগতভাবেই শুধুমাত্র ছেলেরাই ধর্মীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকে, মেয়েরা নয়। ক্রিসমাসের উৎসবের সময় এই চ্যাপেলের ক্যারল সার্ভিস অনুষ্ঠান টিভি-রেডিওর মাধ্যমে প্রচার করা হয়ে থাকে। তাই, বলতে গেলে, সারা বিশ্বে রয়েছে কিংস চ্যাপেলের পরিচিতি।
এখানে একটি কথা বলে রাখি। চ্যাপেল হলো খ্রিষ্টানদের প্রার্থনাগৃহ। আমাদের যেমন এবাদতখানা, তেমনি। ছাত্রছাত্রীদের ধার্মিকতা রক্ষার জন্য সেকালে প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথেই চ্যাপেল নির্মাণ করা হতো। ক্যামব্রিজের প্রত্যেকটি কলেজেরই নিজস্ব চ্যাপেল আছে। কিংস কলেজের এই চ্যাপেলটিও নির্মাণ করিয়েছিলেন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা ষষ্ঠ হেনরি। রাজা পঞ্চম হেনরি নিহত হওয়ার পর মাত্র নয় মাস বয়সে ষষ্ঠ হেনরি ইংল্যান্ডের রাজা হয়েছিলেন। কলেজের প্রবেশ তোরণের ওপরের অংশে রাজার একটি মূর্তি নির্মাণ করে রাখা হয়েছে। রাজা ষষ্ঠ হেনরি প্রথমে উইনচেস্টার, তারপর ইটন স্কুল (যা এখন ইটন কলেজ নামে খ্যাত) এবং সবশেষে কিংস কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সেকালে নিয়ম ছিল ইটন স্কুল থেকে যারা পাস করবে কেবল সেসব ছাত্রই কিংস কলেজে ভর্তি হতে পারবে কোন রকম ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই। গাইড বললেন, এটা ছিল তাদের ‘প্রিভিলেজ’। বিগত শ’খানেক বছর থেকে এ নিয়ম আর নেই। অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের মতো ইটনের শিক্ষার্থীদেরও ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়।
চ্যাপেলের (রাস্তার দিক থেকে) নিকটবর্তী অংশটা তৈরি করা হয়েছে ছয় শত বছর আগে। বলা হয়ে থাকে যে, রাজা ষষ্ঠ হেনরি ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দে এখানকার সেই মধ্যযুগীয় ক্যামব্রিজ শহরের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। তিনি এখানকার পুরাতন কলেজ বিল্ডিং, চার্চ, ঘর-বাড়ি, দোকানপাট এমনকি গাছপালাও ধ্বংস করে ১৪৪১ সালে কিংস কলেজ এবং কিংস চ্যাপেল নির্মাণ করেন। পরে কলেজের আয়তনঅনেকগুণে বাড়ানো হয়। মাঠের অপর পাশের অ্যাকাডেমিক বিল্ডিংটি নির্মাণ করা হয় ১৭০০ সনে এবং (প্রবেশপথের) বাম পাশের বিল্ডিংটি ১৮০০ সনে। এভাবেই শত শত বছরব্যাপী সময়ে কিংস কলেজের বর্তমান রূপ অস্তিত্ব লাভ করেছে। গাইড বললেন, এর পেছনে অনেক বিখ্যাত লোকের অবদান রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন লন্ডনের বিখ্যাত চ্যাপেল স্কয়ারের কথা। সেই ইতিহাস না হয় পরে হবে।
আমরা ক’টি ছবি তুলে নিলাম। আজ রোববার বলে কলেজ ছুটি, তাই দর্শনার্থীরা আসছেন দলে দলে। কলেজ থেকে বের হতেই গেটের ডান পাশের লাল লেটার বক্সটি দেখিয়ে গাইড বললেন, এটি একটি ভিন্ন ধরনের লেটার বক্স। এটি চতুষ্কোণাকৃতির এবং অন্য সব লেটার বক্স গোলাকৃতির বলে এটি আলাদা ও একমাত্র নমুনা হিসেবে এখানে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। এন্থনি ট্রলার নামের এক ভদ্রলোক প্রথম এই লেটার বক্সের উদ্ভাবন করেন। তিনি ছিলেন একজননামকরা লেখক। প্রথম জীবনে তিনি পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন এবং পরে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। গাইডের মুখে শুনলাম যে, ব্রিটিশ সরকার হাজার হাজার লেটার বক্স ধ্বংস করে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। যেহেতু বর্তমান সময়ে লেটার বক্সের ন্যূনতম ব্যবহারও নেই তাই এই সিদ্ধান্ত। বাকি সব লেটার বক্স ধ্বংস করা হলেও এই ব্যতিক্রম আকৃতির লেটার বক্সটি সংরক্ষণ করা হবে। তিনি আমাকে লেটার বক্সটির গায়ে অঙ্কিত রাজকীয় চিহ্নটি দেখালেন।
এবার আমরাক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ট্রিনিটি কলেজের দিকে এগোলাম। পথে দু’টি গির্জা দেখিয়ে গাইড বললেন,
: এটি গ্রেট মেরিস চার্চ এবং এটি একটি পাবলিক চার্চ।
: পাবলিক চার্চ মানে?
: মানে হলো, এখানে শহরের যে কোন লোক যেতে পারবে, যেভাবে ক্যাথেড্রেলগুলোতে যাওয়া যায়। কিন্তু প্রাইভেট চার্চে নয়। যেমন, এখানকার কলেজ সংশ্লিষ্টচ্যাপেলগুলো প্রাইভেট চার্চ। তাই এগুলো সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়।খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের বৃহত্তম বিভাজন হলো- ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট। এখানে একটিই মাত্র ক্যাথলিক চার্চ এবং বাকি সবগুলো প্রোটেস্ট্যান্ট। গাইড আরো জানালেন,“এইক্যামব্রিজ শহরে মোট চৌদ্দটি ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত ধর্ম বিশ্বাসের লোক বাস করে, যদিও ওরা সকলেই খ্রিষ্টান। চল্লিশটি ভাষার লোকজন বাস করে এই ক্যামব্রিজে।” টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। তাই ছাতার ব্যবহার নিয়ে কথা হলো। ছাতা ব্রিটিশ পোশাকের অংশ বলা যায়। বললাম, “প্রয়োজন যতটাই হোক ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার জন্য আমার ছাতা হাতে নেওয়ার উপায় নেই!” একথার মানে অনুধাবন করতে পেরে প্রবীণ এই মহিলা গম্ভীর মুখে আমার দিকে তাকালেন। আমার হাসি মুখ দেখে তিনি স্বস্তি বোধ করলেন।
বামপাশে ‘গনভাইল অ্যান্ড কেইআস’ কলেজ। সেখানে ঢোকার কোন উপায় নেই আজ। আমরা ট্রিনিটি স্ট্রিট ধরে এগোচ্ছি। এই রাস্তার পাশেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কলেজগুলোর অবস্থান বলে মনে হলো। একটি দোকান দেখিয়ে গাইড বললেন, “এটা হলো এই তল্লাটের সবচেয়ে পুরাতন শপ এবং এর মালিক হলো গনভাইল অ্যান্ড কেইআস কলেজ। দোতলা দোকানের ওপরের তলার রুমগুলোতেছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।” অর্থাৎ এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে ছাত্রাবাস হিসেবে।রাস্তার দু’পাশে সারি সারি দোকান। বড়োজোর দোতলা পর্যন্ত দোকান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তার ওপরের ফ্লোরগুলো আবাসিক এবং কোন না কোন কলেজের কিনে নেওয়া। গাইড বললেন, “বাজারে ঘর না কিনলে এই ছোট্ট শহরে আঠার হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে কোথায় থাকতে দেবে! তাই বাজার এলাকায়ও হোস্টেলগুলো ছড়িয়ে আছে।”
গতকাল থেকে হঠাৎ আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেছে সমগ্র ব্রিটেনে। আজ বেশ ঠাণ্ডা পড়ছে এবং সামনে আরো বেশি ঠাণ্ডা পড়বে বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। ইংল্যান্ডে এখন শীতকাল। কোথাও কোথাও বরফ পড়া শুরু হয়ে গেছে। এখন অবশ্য কলেজগুলোতে হাফ-টার্ম চলছে; তাই অনেক শিক্ষার্থী শহরের বাইরে চলে গেছে। সে কারণে পথে-ঘাটেও মানুষের চাপ কম, বললেন গাইড।তিনি জানালেন, তার নিজের নাতি এই অল্প ছুটিতে চলে গেছে স্কটল্যান্ড। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে সেখানে গত কয়দিন ধরে মারাত্মক খারাপ আবহাওয়া চলছে, প্রচণ্ড তুষারপাত হচ্ছে। আমি একজন মমতাময়ী দাদীর চিন্তাক্লিষ্ট মুখ দেখতে পেলাম! যেখানেই পারিবারিক সম্পর্ক আছে সেখানেই মায়া-মমতার চাদর জড়িয়ে রাখে মানুষকে।
আমাদের আজকের গাইড এইক্যামব্রিজ শহরে বাস করছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। তিনি বললেন, “জার্মানরা আমাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল!” আমি বললাম, “আপনি এ নিয়ে কিছু লিখেছেন?”তিনি জানালেন, প্রফেশনাল ট্যুর গাইড হওয়ার জন্য যে ডিগ্রি নিতে হয়েছে তাতে থিসিস জমা দেওয়ার জন্য সামান্য কিছু লিখেছেন। দক্ষিণ লন্ডনের ইংলিশ চ্যানেলের পাড়ে তাদের পৈতৃক নিবাস। পড়াশোনা করেছেন লন্ডনে। তবে তার নিজ পরিবারের লোকেরা বেশির ভাগই অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে। তাই তিনি ছুটি কাটাতে যান অস্ট্রেলিয়ায়। তাঁর মেয়েদের বিয়ে হয়েছে অস্ট্রেলিয়ান ছেলেদের সাথে। তাই তাঁর নাতিরা হবে অস্ট্রেলিয়ান, তারা আর ইংরেজ থাকবে না। তাঁর স্বামীর বয়স একাশি আর তাঁর চুয়াত্তর। তাঁর ক্যান্সার হয়েছিল, ব্রেস্ট ক্যান্সার। এখন ভালো। বললেন, এজন্যই আমি সারাক্ষণ হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করি! হালকা পাতলা গড়নের ছোটখাটো এই প্রবীণার দিকে আমি প্রশংসার চোখে তাকালাম। চুয়াত্তর বছর বয়সে ক্যান্সার থেকে বেঁচে ওঠা এই মহিলা কেবলমাত্র বার্ধক্যের জরাগ্রস্ততাকে জয় করার জন্যই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন ‘ট্যুর গাইডে’র মতো ছুটাছুটির কাজে এবং সারাক্ষণ থাকেন হাসিখুশি ও খোশ মেজাজে। ভাবলাম, তাঁর বয়সে কি আমিও এতটা স্বচ্ছন্দ থাকতে পারবো! অভিজ্ঞতাটা জীবনের শিক্ষা নেওয়ার মতোই। তোমরাও ভেবে দেখো তো একবার!
কথা বলতে বলতে আমরা ট্রিনিটি কলেজের গেটে এসে গেলাম। বিশ্ব বিখ্যাত এই কলেজে স্যার আইজ্যাক নিউটনের মতো অতিশয় বড়ো মাপের বিজ্ঞানী শিক্ষকতা করেছেন। কলেজের গেট দিয়ে ঢোকার আগেই ডান পাশের খোলা জায়গায় একটি গাছ দেখিয়ে গাইড বললেন,
: এটি একটি আপেল গাছ। এর বয়স চুয়ান্ন বছর। নিউটনের বাগান থেকে একে এখানে আনা হয়েছে। মাত্র আট-নয় ফুট উচ্চতার গাছটি দেখে আমার অবিশ্বাস্য ঠেকলো। দেশের কেউ হলে হয়তো বলেই ফেলতাম, চাপা মারার আর জায়গা পাও না! সে রকম কোন ভাবও প্রকাশ না করে আমি হাসতে হাসতেই বয়োঃবৃদ্ধ মহিলাটিকে বললাম,
: এটা কি বনসাই করা আপেল গাছ? তা নইলে এত বছর পরও এত ছোট রইলো কেমন করে? এবার তিনি কৌতুক করে বললেন,
: অনেকে বলেন, এটা সেই মূল আপেল গাছ যার নিচে বসে চিন্তা-ভাবনা করার সময় নিউটনের মাথায় এসেছিল মধ্যাকর্ষণ শক্তি সম্পর্কিত বিষয়াদি। ওরা বলে, এই গাছের বয়স প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছর। আসলে তা নয়। মাত্র ৫৪ বছর আগে ১৯৫৪ সালে স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে লিঙ্কনশায়ারের উলসথর্পস্থ নিউটনের বাড়ির আপেল বাগান থেকে এটাকে এখানে এনে লাগানো হয়। হয়তো বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েই একে খুব বাড়তে দেওয়া হয়নি।
কোন কথা আসল আর কোন কথা নকল তা নিয়ে বিব্রত হওয়ারবা বাদানুবাদ করার ইচ্ছে আমার নেই! আমি ভাবছিলাম একজন বিজ্ঞানীর কথা। যিনি একটি আপেল গাছের নিচে চিন্তামগ্ন। এই সময় গাছ থেকে একটি আপেল ঝরে নিচে এসে তাঁর মাথায় পড়লো আর তিনি ভাবতে লাগলেন নানা কথা!
‘আচ্ছা, বোঁটা থেকে ছেঁড়ার পর আপেলটা তো খোলা জায়গাতেই ছিল। সে তো ডানে-বাঁয়ে বা ওপরেও যেতে পারতো। তা না করে সে নিচের দিকেই ছুটে এলো কেন?’
শুধুমাত্র এই চিন্তা এবং এর পরম্পরা থেকেই জ্ঞানের বিশাল রহস্য-জগতের দ্বার উন্মোচিত হয়ে গেল মানবজাতির সম্মুখে। মহান আল্লাহর বিশাল সৃষ্টি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা সহজ হয়ে গেল মানুষের জন্যে!সে যুগেও কেউ কেউ বিজ্ঞানী নিউটনকে‘পাগল’, ‘মাথাখারাপ’, ‘বিপথগামী’ ইত্যাদি বলতে দ্বিধা করেনি! তবে, মানবজাতির সৌভাগ্য বলতে হবে যে, কেউ তাঁকে ‘জিনের আছর’ ছাড়ানোর জন্য জোর করে কোন ওঝার কাছে নিয়ে যায়নি, অথবা তাঁর হাত-পা শেকল দিয়ে বেঁধে তাঁর অকাল মৃত্যুর পথ সুগম করেনি!। এ ধরনের কুসংস্কার সেকালের ব্রিটেনেও কম ছিল না। মূলত এই যে আপেল গাছটি আমরা দেখতে পাচ্ছি তা শুধুমাত্র বিজ্ঞানী নিউটনের কর্মের প্রতি সম্মান ও স্বীকৃতির চিহ্ন হিসেবেই এখানে রাখা হয়েছে, বুঝে নিলাম।
এ সময় দু’জন ভদ্রলোক আমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তাদের দেখিয়ে আমাদের গাইড বললেন,
: এরা হলেন ‘পোর্টার’। পোর্টাররা কলেজের সে সকল বিশ্বস্ত কর্মচারী যারা গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় কাগজ-পত্র আনা-নেওয়ার দায়িত্বপূর্ণ কাজটি করে থাকেন। এটাই একমাত্র কলেজ যেখানে পোর্টাররা মাথায় ‘বোলার হ্যাট’ পরেন। গাইডের কথা শুনে আমি লক্ষ করলাম দু’জনের মাথায় কালো রঙের হ্যাট। সন্দেহ দূর করার জন্য বললাম,
: দেখে তো ইহুদি রাবাইদের হ্যাটের মতোই লাগছে! মেভিস চট করে উত্তর দিলেন,
: না! এটা রাবাইদের হ্যাট নয়। বরং এটাকে‘টপ হ্যাটে’র অর্ধাংশ বলা যায়। নিয়ম হলো যতক্ষণ একজন পোর্টার কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরে থাকবেন ততক্ষণ তিনি মাথা থেকে হ্যাট নামাতে পারবেন না। মনে মনে উচ্চারণ করলাম, ‘আহা রে! ব্রিটিশ ট্র্যাডিশন।’
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোর মধ্যে ট্রিনিটি কলেজই সবচেয়ে বড়ো। এই কলেজে আছেনএকজন প্রিন্সিপাল, প্রায় ১৬০ জন ফেলো, (ফেলোদের অধিকাংশই শিক্ষকতার সাথে যুক্ত); প্রায় ৩২০ জন পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট এবং প্রায় ৬৫০ জন আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট। এদের নিয়েই এই বিখ্যাত কলেজ। ঐতিহ্যগত ভাবেই প্রিন্সিপালকে বলা হয় ‘দ্য মাস্টার’, জানালেন গাইড!
: কেন? আমি প্রশ্ন করলাম। অবাক কণ্ঠে মেভিস বললেন,
: অমা! তাকে মাস্টার বলবে না তো আর কাকে বলবে! তিনিই তো এই কলেজের সব কিছুর মালিক-মোক্তার!”
: তার মানে? তিনি কি প্রিন্সিপাল হিসেবে চাকরি করেন না?
: অবশ্যই তিনি চাকরি করেন। কিন্তু কেউ যখন পাঁচ বছরের জন্য প্রিন্সিপাল নির্বাচিত হন তিনি সেই সময়ের জন্য সর্বময় ক্ষমতা লাভ করেন। তাঁর ওপর কেউ খবরদারি করতে পারে না। তাঁর সিদ্ধান্ত কেউ টলাতে পারে না। তিনিই সর্বোত্তম সম্মান প্রাপ্ত হন। অনেক সম্মান ও গর্বের সাথে মেভিস কথাগুলো বললেন। আমি তখন ভাবছিলাম অন্য কথা! আমার মনে হলো, দ্য মাস্টারের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান দেখানোর কারণেই হয়তো পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিকে বলা হয় ‘মাস্টার্স ডিগ্রি’। এটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ধারণা।পরে জেনেছি, এখানকার কলেজগুলোর প্রধান ব্যক্তিকে ঐতিহ্যগতভাবেই ভিন্ন ভিন্ন পদবিতে অভিষিক্ত করা হয়, যেমন: মাস্টার, প্রেসিডেন্ট, ওয়ার্ডেন, প্রিন্সিপাল, প্রভোস্ট প্রভৃতি। এখানকার সবগুলো কলেজ স্বায়ত্তশাসিত এবং তারা নিজ নিজ ঐতিহ্য ও নিয়ম অনুসরণ করেই চলে। আমাদের দেশ হলে কবে এসব ওলটপালট হয়ে যেত! কারণ হয়তো ঐতিহ্য সম্পর্কে অসচেতন আর নিয়ম না-মানতে আগ্রহী লোকেরাই আমাদের দেশে ক্ষমতার দণ্ড আঁকড়ে ধরে থাকে! তোমাদেরকেই এ ব্যাপারে সচেতন ও সাহসী হতে হবে।
ট্রিনিটি কলেজের ইতিহাস অতি প্রাচীন। সেই ১৩১৭ সাল থেকেইক্যামব্রিজের কিছু ধর্মগুরু জ্ঞান-সাধককে রাজা ২য় এডওয়ার্ড সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। তাই এদের চিহ্নিত করা হতো ‘কিংস স্কলার’ হিসেবে। তারাই ‘কিংস হল’ নামে একটি কলেজ সংগঠিত করে। পরবর্তী রাজা ৩য় এডওয়ার্ড এই কলেজকে কয়েকটি বিল্ডিং তৈরি করে দেন এবং ১৩৩৭ সালে কিংস হল কলেজকে সরকারি চার্টার প্রদান করেন। ওই দিকে ১৩২৪ সালে রাজা ২য় এডওয়ার্ডের ‘চ্যান্সেলর অব দ্য এক্সচেকার’ (বা অর্থমন্ত্রী) মি. হার্ভে ডি স্ট্যানটন ‘মিখাইল হাউস’ নামে কিংস হলের পাশেই অপর একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কিংস হল এবং মিখাইল হাউস নামের পৃথক কলেজ দু’টি আর কিছু ছোট ছোট হোস্টেলকে একীভূত ও সুসমন্বিত করেন রাজা অষ্টম হেনরি ১৫৪৬ সালে এবং এই প্রতিষ্ঠানের নাম দেন “ট্রিনিটি কলেজ”। এখানে বলে রাখা ভালো, কিংস হল ও কিংস কলেজ পৃথক দুটি প্রতিষ্ঠান এবং কিংস হল প্রতিষ্ঠা লাভ করে কিংস কলেজের অনেক আগে।
‘ট্রিনিটি’ শব্দের একটি বিশেষ অর্থ আছে। এটা হলোখ্রিষ্টান ধর্মের ত্রিত্ববাদ। অর্থাৎ যিশু, মেরি ও গড এই তিন মিলে এক অবিভাজ্য সত্তা এবং সেই সত্তারই উপাসনা করা হবে। স্রষ্টার সাথে সরাসরি অংশীদারিত্ব। ইসলামে একেই বলা হয়েছে ‘শিরক’ এবং একাজ সুস্পষ্টভাবে হারাম। সে যাই হোক, ‘ট্রিনিটি’ খ্রিষ্টানদের ধর্মবিশ^াস। ট্রিনিটি স্ট্রিট ও কেম নদীর মাঝখানে বিশাল এলাকাজুড়ে ট্রিনিটি কলেজ। খ্রিষ্টান-বিশ্বে ট্রিনিটি কলেজ একটি নয়, বহু। ক্যামব্রিজ ছাড়াও অক্সফোর্ডে, ডাবলিন এবং মেলবোর্নে ‘ট্রিনিটি কলেজ’ নামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে।
কলেজের প্রবেশপথে ট্র্যাডিশনাল স্টাইলের সুউচ্চ তোরণ। ওরা বলে ‘দ্য গ্রেট গেট।’ ট্রিনিটি কলেজ প্রতিষ্ঠার পূর্বেই কিংস হলের অংশ হিসেবে এই তোরণ নির্মাণ করা হয় ১৫৩০ সালের দিকে। কাঠের তৈরি বিশালাকৃতির দরোজা দুটো তৈরি করা হয়েছে আরো আগে, ১৫২৩ সালে। বাম পাশের দরোজাটি অপেক্ষাকৃত বড়ো। তোরণের ওপরের অংশে এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা অষ্টম হেনরির প্রস্তর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। উচ্চতায় দেড়-দুই মিটারের বেশি হবে না। এটা অবশ্য স্থাপন করা হয়েছে রাজার মৃত্যুর অনেক পরে, ১৬১৫ সালে। আমাদের গাইড মেভিস রাজার মূর্তিটিরদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন,
: রাজার হাতে তো রাজদণ্ড থাকার কথা। দেখো, রাজার মূর্তির হাতে কিন্তু সে রকম কিছু নেই। যা ধরা আছে দেখতে পাচ্ছো তা কিন্তু রাজদণ্ড নয়, ওটা একটা ভাঙা চেয়ারের পায়া! আমরা সবাই খেয়াল করে দেখলাম। তাইতো! রাজদণ্ড উঁচিয়ে ধরার ভঙ্গিমায় রাজ-মূর্তির হাতে যা ধরা আছে তা একটা সাধারণ চেয়ারের ভাঙা পায়া। অবাক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে আমরা হো হো করে হেসে উঠলাম।
: এমনটা কীভাবে হলো? একসাথে প্রায় সবারই প্রশ্ন! গাইড জানালেন,
: অনেকদিন আগে এই কলেজের একজন আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট দুষ্টুমি করে রাজমূর্তির হাত থেকে রাজদণ্ডটি সরিয়ে সাধারণ চেয়ারের একটি পা সেখানে ধরিয়ে দিয়ে যায়। এরপর থেকে এমনটিই চলছে। আমি বললাম,
: চেয়ারের পা’টা ফেলে দিয়ে একটি রাজদণ্ড আবার স্থাপন করলেই তো হয়ে যায়! গাইড হাসতে হাসতে বললেন,
: তা কেন হবে? এটাই তো একটা মজার বিষয়; এটাই তো ‘ফান’! এটাতো ক্যামব্রিজের অন্যতম জনপ্রিয় ‘ফান’ এবং খুবই মুখরোচক বিষয়- “হেনরিস চেয়ার লেগ।” বলতে বলতে বৃদ্ধা সজোরে হেসে উঠলেন; সাথে আমরাও। তিনি আরো জানালেন, এরকম সাধারণ চেয়ারের পা দিয়ে কলেজের একটি স্টোর ভর্তি করা আছে, যাতে একটি নষ্ট হয়ে গেলে আরেকটি ‘চেয়ারের পা’ স্থাপন করতে দেরি না হয়। আমি আবার মনে মনে উচ্চারণ করলাম, ‘ব্রিটিশ ট্র্যাডিশন!’
ট্রিনিটি কলেজে ঢোকার জন্য আমরা পা বাড়ালাম। গেটের সামনের পেইভমেন্ট পাথর দিয়ে ঢাকা। খুব যে সাজিয়ে গুছিয়ে একই আকারের পাথর দিয়ে ঢাকা হয়েছে তা নয়। সেকেলে ধরনের ব্যাপার। নানা আকারের ও নানা বর্ণের পাথর চেপে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে খুব ছোট পাথরের সুরকির ওপর। এর মধ্যে মাঝারি আকারের একটি পাথরের দিকে গাইড আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। প্রায় গোলাকৃতির লালচে ধরনের পাথরটির ব্যাস তিন ইঞ্চির বেশি হবে না। নেম প্লেটে নাম লেখার মতো পাথরটির ওপর খোদাই করে লেখা আছে তিনটি ইংরেজি অক্ষর- টিসিএন।
: মানে কী? আমি প্রশ্ন করলাম। গাইড বললেন,
: এটা জনৈক ব্যক্তির নাম। ট্র্যাভেলিয়ন চার্লস নিকোলাস, সংক্ষেপে ‘টিসিএন’। তিনি ছিলেন এই কলেজের একজন পার্সার। এক সময় তিনি স্ব-উদ্যোগে কলেজের অর্থে ট্রিনিটি কলেজের জন্য একটি মাঠ কিনে রেখেছিলেন। তখন অন্যরা এর সমালোচনা করেছিল অর্থের অপচয় করা হচ্ছে বলে। এখন নদীর পাড়ের ওই মাঠে ডক তৈরি করার কারণে এখন প্রতি বছর কলেজের আয় হচ্ছে চল্লিশ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি। তাই তাঁর এই কৃতিত্বকে স্বীকৃতি জানানোর জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গাইড আরো জানালেন,
: মেমোরিয়াল হিসেবে ব্যবহারের জন্য এই ‘কপার স্টোন’ আনা হয়েছে নরওয়ে থেকে। অনেকটা গল্পের মতো, তাই না? অবাক হওয়ার মতো বিষয় বটে। অবশ্য এই ব্যবস্থা আমি লন্ডনেও দেখেছিলাম। বাকিংহাম প্যালেসের সামনের পার্কের ‘ওয়াক-ওয়ে’ এবং এ ধরনের অন্যান্য জায়গায় অনেকটা ম্যানহোলের ঢাকনার মতো স্টিল প্লেটে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্মরণের উদ্দেশ্যে তাদের নাম লেখা আছে। ডায়ানার মৃত্যুর পর তাঁর নামেওনতুন একখানা প্লেট তারা লাগিয়েছে, দেখেছিলাম।
আমরা গেলাম ট্রিনিটি কলেজের ক্যাম্পাসের ভেতরে। আজ কারো ভেতরে যাওয়ার কথা নয়। আমাদের গাইড গেটে একজন দায়িত্বশীল লোকের সাথে কথা বলে আমাদের ভেতরে যাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা করলেন। গাইডকে আমরা ধন্যবাদ জানালাম। কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকতেই পশ্চিম পাশে দেখলাম তিনটি মূর্তি রাজা প্রথম জেমস, তাঁর স্ত্রী অ্যান অব ডেনমার্ক এবং তাঁদের পুত্র চার্লস (পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লস)। সামনে বর্গাকৃতির খোলা মাঠ ‘দ্য গ্রেট কোর্ট’। বিপরীত প্রান্তে ‘হল’ এবং ‘মাস্টারর্স লজ’। ‘দ্য মাস্টার’ হচ্ছেন কলেজের প্রধান কর্ণধার বা প্রিন্সিপাল, একথা আগেই বলেছি। অত্যন্ত সম্মানিত পদ এটি। বিখ্যাত লোকেরাই এই কলেজের এই পদে আসীন ছিলেন। গ্রেট কোর্টের প্রায় মধ্যখানে একটি পানির ঝর্ণা, গোলাকৃতির ঘর তৈরি করা সেখানে। এটি প্রথম তৈরি করা হয় ১৬০১-২ সালে এবং মূল নক্সা মোতাবেক পুনঃনির্মাণ করা হয় ১৭১৫-১৬ সালে। ক’বছর আগেও এর পানি আসতো কলেজের দেড় মাইল পশ্চিমের এক প্রাকৃতিক ঝরনা থেকে। ১৩২৫ সালে ক্যাথলিক খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীদের বাসস্থানে পানির ব্যবস্থা করার জন্য রোমানরা যে নালা তৈরি করেছিল এই ঝরনার জন্য সেই নালাই ব্যবহার করা হতো। জানা যায়, সেইন্ট ফ্রান্সিসের অনুসারী এসব রোমান সন্ন্যাসীকে বলা হতো ‘ফ্রায়ার’। তারা খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারের জন্য ঘুরে বেড়াতেন এবং সংসারহীন এসব পুরুষ অন্যের কাছে খাবার ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করতেন।
গ্রেট গেটের ডান পাশে কলেজের চ্যাপেল। খ্রিষ্টান ধর্মের প্রার্থনার স্থান। এখানকার প্রতিটি কলেজের এক অনিবার্য অংশ হচ্ছে ‘চ্যাপেল’, একথা আগেই বলেছি। রাজা অষ্টম হেনরির কন্যা মেরি রানী হওয়ার পর এই চ্যাপেলের নির্মাণকাজ শুরু হলেও শেষ হয় রানী প্রথম এলিজাবেথের রাজত্বকালে, ১৫৬৭ সালে। প্রথমে আমরা প্রবেশ করলাম চ্যাপেলের এন্টে-রুমে। ঢুকেই নিউটনের মুখোমুখি। রুমের পশ্চিম প্রান্তে একটি উঁচু পাটাতনের ওপর স্যার আইজ্যাক নিউটনের শ্বেতপাথরের মর্মর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। এতে লেখা আছে : “ছঁর মবহঁং যঁসধহঁস রহমবহরড় ংঁঢ়বৎধারঃ.” (ঐব ংঁৎঢ়ধংংবফ ঃযব ৎধপব ড়ভ সধহ রহ ঁহফবৎংঃধহফরহম). বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী, অঙ্কবিশারদ ও দার্শনিক স্যার আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭) এই কলেজে শিক্ষকতা করেছেন বহু বছর। তিনি ছাত্র হিসেবে ট্রিনিটিতে আসেন ১৬৬১ সালে এবং গ্র্যাজুয়েট হন ১৬৬৫ সালে। ১৬৬৭তে তিনি এখানেই ফিরে আসেন শিক্ষক হিসেবে এবং ১৬৬৯ সালে অঙ্ক শাস্ত্রের প্রফেসর হন। চিরকুমার এই জ্ঞানসাধক বাস করতেন গ্রেট গেট ও চ্যাপেলের মধ্যবর্তী ঘরটির দোতলায়। সেই ঘরের সম্মুখের বাগানেই আপেল গাছটি লাগানো হয়েছে, যার কথা আগেই বলেছি। ১৭০১ সালে তিনি ক্যামব্রিজ থেকে অবসর গ্রহণ করেলন্ডন চলে যান স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য। ১৭২৭ সালে মৃত্যুর পর তাঁকে ওয়েস্টমিনস্টার এবে-তে সমাহিত করে সম্মানিত করা হয়। স্যার আইজ্যাক নিউটন ট্রিনিটি কলেজের অঙ্কশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে যে সম্মানজনক পদটিতে ছিলেন, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সম্মানিত সেই পদে২০০৮ সালে আসীন ছিলেন এযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস। তিনি পরের বছর এই ‘চেয়ার’ থেকে অবসর নেন।
এন্টে-চ্যাপেলের উত্তর ও দক্ষিণ অংশে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির মর্মর মূর্তির সারি। এরা সবাই এই কলেজের ফ্যাকাল্টি-মেম্বার ছিলেন। ঐতিহাসিক লর্ড ম্যাকাউলি, কবি লর্ড টেনিসন, কুইলেলমি হোয়েওয়েল, ফ্রান্সিস বেকন এবং আরো অনেকে।
আসলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক থেকে এইসব প্রতিষ্ঠানের অবস্থান অনেক উঁচুতে। কথা প্রসঙ্গে গাইড জানালেন, এই কলেজ থেকে (২০০৮ সাল পর্যন্ত) নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মোট একত্রিশ জন এবং পুরোক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন মোট একাশি জন। পৃথিবীর আর কোন কলেজ বা অন্য কোন শহরের এককভাবে এমন রেকর্ড নেই। এই কলেজের যেসব সদস্য ২য় মহাযুদ্ধে নিহত হন তাদের নামের তালিকা শ্বেতপাথরে খোদাই করে রাখা হয়েছে পশ্চিম দেয়ালে। সেখানে দেখা গেল একটি নামের জায়গা খালি। কেন? ভুলক্রমে একজনের নাম লেখা হয়, যিনি যুদ্ধের পর দেখা গেল বেঁচে আছেন। তাই নামটা মুছে ফেলা হয়। সত্য ও সঠিক ইতিহাস রচনা ও সংরক্ষণের ব্যাপারে ইংরেজরা এতটাই সতর্ক! অথচ আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসংখ্য ভুয়া-মুক্তিযোদ্ধার পদচারণায় কালিমালিপ্ত! আশা করি তোমরা, আজকের কিশোর-তরুণরা, সতর্ক ও কষ্টসাধ্য গবেষণার মাধমে এই মহান জাতির ইতিহাসকে কালিমামুক্ত করবে। একইভাবে পূর্ব দেয়ালে লেখা আছে প্রথম মহাযুদ্ধে নিহত কলেজ সদস্যদের নাম।
পূর্ব দেয়ালের দরোজা দিয়ে আমরা চ্যাপেলে প্রবেশ করলাম। কাঠের কাজগুলো কয়েকশ’ বছরের পুরনো। বেদির ওপরের চিত্রটা অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত মার্কিন শিল্পী বেঞ্জামিন ওয়েস্ট-এর আঁকা। এই চিত্রটিতে দেখানো হয়েছে, সেইন্ট মিখাইল শয়তানকে পাকড়াও করে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলছেন।
ট্রিনিটি কলেজের কিছু ব্যতিক্রমী বিষয় সম্পর্কে জানতে পারলাম। জানতে চাও সেগুলো কী? শোন তাহলে, কয়েকটা বলছি। এই কলেজে তিন বা চার বছর পড়াশোনা করার পর ছাত্রছাত্রীরা ‘ব্যাচেলর অব আর্টস’ বা বিএ ডিগ্রি লাভ করে, বিজ্ঞানে লেখাপড়া করলেও। আমাদের দেশে তো সায়েন্স হলে ‘বিএসসি’, আর আর্টস হলে ‘বিএ’। ট্রিনিটিতে সকলেই বিএ!শুধু ট্রিনিটি নয়,ক্যামব্রিজের কলেজগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নিয়মমাফিক কোন ধরাবাঁধা লেকচার বা ক্লাসের ব্যবস্থা নেই। মাঝে মধ্যে কোন লেকচারের ব্যবস্থা যদি করা হয়ও তাতে উপস্থিতির বাধ্যবাধকতা থাকে না। প্রত্যেক শিক্ষার্থী একজন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকে। তিনি তার সুপারভাইজার। শিক্ষক সামান্য গাইডেন্স দিয়ে পড়ার কাজ দেন, আর শিক্ষার্থীকে অনেক বই ঘাঁটাঘাঁটি করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে কাজ শেষ করে শিক্ষককে সন্তুষ্ট করতে হয়। শিক্ষার্থীকে হতে হয় কর্মঠ ও মেধাবী। সিলেবাস শেষ করার জন্য আপন তাগিদেই সারা বছর অনেক পরিশ্রম করতে হয়। কারণ, শিক্ষার্থীরা একথা ভালোভাবে জানে যে, পরীক্ষায় ফেল করা মানেই এই মর্যাদাসম্পন্ন কলেজে পড়াশোনার সুযোগ হারানো। ক্যামব্রিজের নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষার ফলাফল, কলেজের অভ্যন্তরে নয় বরং, টাঙিয়ে দেওয়া হয় পাবলিক প্লেসে, কিংস কলেজের পাশের সিনেট হাউজে। যেন, কার রেজাল্ট কি হয়েছে তা সাধারণ মানুষেরাও এসে দেখতে পারে। এই কারণে এখানে ফেল করা বড্ড লজ্জার, কারণ এখবর শহরের সবাই জেনে যায়! তাই, এখানে ফেল করে খুব কম ছাত্র-ছাত্রী। গাইড জানালেন, “যোগ্য ছাত্র সংগ্রহের জন্য লন্ডনের ভালো স্কুলগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখা হয়। তবে প্রত্যেকব্রিটিশ আন্ডারগ্র্যাজুয়েটকে তিন হাজার একশ’ পঁয়তাল্লিশ পাউন্ড খরচ হিসেবে জোগাড় করতে হয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) শিক্ষার্থীদের জন্যও একই খরচ। কিন্তু আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া বা বাংলাদেশ থেকে কেউ এলে তার খরচ হবে অনেক বেশি, প্রায় বিশ হাজার পাউন্ড। থাকা-খাওয়ার জন্য আরো ছয়-সাত হাজার পাউন্ড। এদেশের শিক্ষার্থীরা সরকারি ঋণসুবিধা পায়। পাস করার পর চাকরি করে এই ঋণ শোধ করার কথা। তবে যতদিন কেউ বছরে আঠারো হাজার পাউন্ডের বেশি আয় করতে পারবে না ততদিন তাকে এই ঋণ শোধ করতে হবে না। এটাই নিয়ম। এ নিয়ম করা হয়েছে দরিদ্র কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার জন্য। তবে, আঠার হাজার পাউন্ড শিক্ষিত ব্রিটিশ নাগরিকদের জন্য অত্যন্ত কম আয়। এখানকার একজন গ্র্যাজুয়েট কমপক্ষে পঁচিশ-ত্রিশ হাজার পাউন্ড সহজেই আয় করার কথা।”
কথায় কথায় গাইড আরো জানালেন যে, এখানকার গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট ও ডিপার্টমেন্টগুলোতে খুবই ভিড় হয়। বুঝিয়ে বলার জন্য তিনি তার নিজ নাতনির উপমা পেশ করলেন। সে নাকি চেয়েছিলক্যামব্রিজে ভেটেরিনারি পড়তে। কিন্তু দশ হাজার আবেদনপত্রের ভেতর টিকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত সাইকোলজি পড়েছে।কলেজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে গাইড জানালেন, “এখানকার কোন কলেজই কারো মালিকানাধীন নয়। নো বডি ওনস্ এ কলেজ। কলেজ বলতে এখানে বোঝায় একজন মাস্টার, অনেক ফেলো ও অনেক কর্মচারী। কলেজের প্রধান হচ্ছেন ‘দ্য মাস্টার’। তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কলেজের সকল বিষয়ে তিনিই সর্বেসর্বা; যদিও এটি তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। আগেকার দিনের নিয়ম ছিল মাস্টার তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পর ওই পদে আসীন থাকতেন আমৃত্যু। গাইড হাসতে হাসতে বললেন, “অনেকটা রাজাদের মতো! মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত পরিবর্তন নেই। এখন নিয়ম হচ্ছে, মাস্টার অবসরে যান সত্তর বছর বয়সে।” ফেলোরা হলেন পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ, যাঁরা কলেজে শিক্ষকতার কাজে নিয়োজিত থাকেন। তাঁরা অবসরে যান সাতষট্টি বছর বয়সে। এছাড়া পোর্টার, ক্লার্ক, মালী, দরোয়ান, পাচক এরা হলো কলেজের কর্মচারী। ড্রেইক বললেন, “কলেজের চাকরি সত্যিকার অর্থেই ‘নাইস’, যদিও বেতন কিছুটা কম!” ট্যুর গাইড হিসেবে ড্রেইক কাজ করেন সিটি কাউন্সিলের অধীনে। এ বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েই তার কাজ শেষ হয়নি। প্রতি পাঁচ বছর পর পর তাকে পরীক্ষা দিয়ে আপন যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়। প্রফেশনাল এক্সামিনেশন। একথা আমি জেনেছিলাম ব্রিটেনের শিক্ষকদের সম্পর্কেও। প্রত্যেক শিক্ষককেই ‘বাইঅ্যানুয়েল টেস্ট’ দিতে হয় প্রতি দুই বছর পর পর। ট্যুর গাইড হিসেবে যে এভাবে পেশাগত যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয় তা জেনে আমি অবাকই হলাম। এভাবে ব্রিটিশরা সকল ক্ষেত্রেই উন্নত পেশাগত মান ধরে রাখে। তোমরাই ভেবে দেখো, আমাদের দেশেও এ ধরনের ব্যবস্থা কীভাবে করা যায়! আজ হয়তো নেই, ভবিষ্যতে মানোন্নয়নের নিয়ম করতে অসুবিধা কোথায়? আমাদেরও তো এগোতে হবে!
ক্যামব্রিজ শহরে প্রায় ত্রিশ হাজার বাইসাইকেল চলাচল করে। স্থানীয় নাগরিক, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সকলকেই সাইকেলে অথবা হেঁটেচলাফেরা করতে হয়। এতে ঝক্কিও কম নয়। অনেকে আগে কখনো সাইকেল চালায়নি। ফলে দুর্ঘটনা প্রায়শ ঘটে বলে জানালেন মেভিস ড্রেইক। গাড়ির অনুমতি অত্যন্ত সীমিত। কারণ, অবাধ গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া হলে এত ছোট্ট শহরের রাস্তা-ঘাটে গাড়ি রাখার জায়গাও হতো না, চলাচলও করা যেতো না। হাঁটতে হাঁটতে আমরা সেইন্ট জনস কলেজে চলে এলাম। গাইড বললেন, এটি ট্রিনিটিরও আগেকার কলেজ। এটি প্রতিষ্ঠা করেন রাজা অষ্টম হেনরির দাদী। একজন মহিলা এর প্রতিষ্ঠাতা হলেও শুরুর দিকে শুধুমাত্র পুরুষরাই এই কলেজে পড়াশোনা করতে পারতেন; মহিলাদের কোন প্রবেশাধিকার ছিল না। ১৯৪৮ সালের আগে কোন মহিলা এই কলেজের সদস্য হতে পারেননি। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ক্যামব্রিজে দুইটি কলেজ আছে যাতে শুধু মেয়েরাই পড়তে পারে। এরমধ্যে একটি কলেজ শুধুমাত্র দরিদ্র মেয়েদের জন্য। গাইড অত্যন্ত তৃপ্তির সাথে বললেন, “এর ফলে আমারও সুযোগ হয়েছিল ক্যাভেন্ডিস কলেজে যাওয়ার।” গাইডের কাছেই জানলাম : রাজা অষ্টম হেনরির দাদী লেডি মার্গারেটের বিয়ে হয়েছিল চারবার, তবে তিনি মাত্র একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।
আমরা কলেজের ভেতরের এলাকায় বিচরণ করছিলাম। চারতলার একটি রুমের দিকে নির্দেশ করে গাইড বললেন,
: এখানে বিখ্যাত কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ বাস করতেন।বলতে বলতে তার ডেফোডিলস ও অন্যান্য বিখ্যাত কবিতার কথাও বলে গেলেন গাইড। ‘ডেফোডিলস’ কবিতাটি আমাদের স্কুলপাঠ্যসূচিতে ছিল। অপূর্ব সুন্দর কবিতা। তোমরাও পড়ে দেখতে পারো। মনে হবে, তোমার চোখের সামনেই ডেফোডিল ফুলগুলো হাওয়ায় দুলছে! ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত কবি হয়ে ওঠার আগে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থক্যামব্রিজের সেইন্ট জনস কলেজের ছাত্র ছিলেন। তাঁর বিভিন্ন কবিতায় ক্যামব্রিজ এলাকার চিত্রও ফুটে উঠেছে। দোতলার একটি রুম দেখিয়ে গাইড জানালেন,
: এটি হলোক্যামব্রিজের দীর্ঘতম হলরুম। তৈরি করা হয়েছে ১৫৯৯ সালে। আমরা একটি চত্বর হেঁটে পার হলাম। কলেজের ভেতরের একটি দালানের গেটে একজন মহিলার মূর্তি দেখে আমি জানতে চাইলাম,
: ইনি কে? বলা হলো,
: তিনি ‘কাউন্টেস অব সেইলসবারি’। তাঁর অর্থায়নে এই বিল্ডিংটি তৈরি করা হয়েছিল। এর স্বীকৃতি হিসেবেই তাঁর মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল। তবে শেষকালে আপন কৃতকর্মের জন্য তিনি জেলখানায় বন্দী হন। গাইড আরো বললেন,“ক্যামব্রিজের সবগুলো কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাজা-রানী ও অভিজাতদের অর্থে, শুধুমাত্র ‘কর্পাস ক্রিস্টি কলেজ’ ছাড়া, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শহরবাসীর চাঁদার টাকায়। ঈগল পাব-এর কাছে এই কলেজ। ক্যামব্রিজে এখনো পুরাতন কিছু পাব (বা মদ্যশালা) আছে, যদিও পুরো ইংল্যান্ডে এর সংখ্যা দিন দিন কমছে।”
সেইন্ট জনস কলেজের অনেকগুলো বিল্ডিংই ১৫৯৯ সাল বা সমসাময়িককালের। ইটের আকার দেখেই একথা বুঝা যায়। পুরাতন ইটগুলো কিছুটা ছোট আকারের। এসব ইট আসতো তখনকার দিনে হল্যান্ড থেকে।
কলেজের পেছনের পথে সীমানা দেয়াল থেকে বেরুতেই আমরা কেম নদীর পাড়ে হাজির হলাম। আমার মনে হলো, নদীটা বড়োজোর ষাট ফুট চওড়া হবে। আমরা কেম নদীর ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। কেম নদীতে নৌকা চলছে। অনেকটা স্পিড বোট আকৃতির বিশেষ ধরনের নৌকা। এর নাম ‘পান্ট’। নৌকাগুলো দাঁড় দিয়ে চালানো হচ্ছে না, বরং লগি দিয়ে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পান্টকে। একে বলা হয় পান্টিং। দেশী-বিদেশী পর্যটক ছাড়াও স্থানীয়দের অনেকেই পান্টে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। নীরবে নিঃসর্গের স্বরূপ আস্বাদন!অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা কয়েকটি পান্টকে ভেসে যেতে দেখলাম। গ্রীষ্মে নাকি আরো বেশি পান্ট চোখে পড়ে।
আমরা যে ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছি, এটি কলেজের নিজস্ব ব্রিজ। এটা সেই ব্রিজ নয় যার জন্য ‘ক্যামব্রিজ’ নামকরণ করা হয়েছে এই এলাকার। ওটা এখান থেকে খানিক দূরে একটি পুরাতন ব্রিজ। তবে ওটা পাবলিক ব্রিজ অর্থাৎ সেই ব্রিজের ওপর দিয়ে জনসাধারণের গাড়ি চলাচল করে। কিন্তু আমরা যে ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছি তা কলেজের নিজস্ব সম্পদ বলে এর ওপর দিয়ে কোন গাড়ি-ঘোড়া চলাচলের নিয়ম নেই। ব্রিজের ওপাশে সুন্দর মাঠ ও প্রাকৃতিক দৃশ্য। দুই হাজার বছরের পুরনো শহরে আটশত বছরের পুরাতন এই শিক্ষায়তন। অথচ আজো এটি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সেরা পাদপীঠ। পুরাতন বলে ফুরিয়ে যায়নি বা এর প্রতি অবহেলার কোনো ছাপ নেই। নদীপথে চলাচলের সুযোগ নিয়ে রোমানদের হাতে ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে পত্তন হয়েছিল এই শহরের। দুই হাজার বছরের পুরনো ‘মার্কেট টাউন’ ক্যামব্রিজ। আজ তার একমাত্র পরিচয় একটি অনন্য ও বিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে, বিশ্বজোড়া খ্যাতি নিয়ে।
এরপর আমরা হাঁটতে হাঁটতে গেলাম সেইন্ট জনস্ কলেজের চ্যাপেলে। চ্যাপেলের মুখেই একপাশে একজন পণ্ডিতের(ঝপযড়ষধৎ) শবদেহের প্রতিকৃতি। একখানা দোতলা খাটের নিচের অংশে রাখা প্রতিকৃতিটা একটি বস্ত্রহীন শবদেহের আর ওপরের অংশে রাখা হয়েছে পোশাক সজ্জিত মৃতদেহের প্রতিকৃতি। পাশের একখানি শিলালিপিতে লেখা আছে : উৎ. ঐঁময অংযঃড়হ, ফরবফ ১৫২২. অৎপযফবধপড়হ ড়ভ ডরহপযবংঃবৎ, অৎপযফবধপড়হ ড়ভ ঈড়ৎহবিষ, অৎপযফবধপড়হ ড়ভ ডবংঃ জরফরহম, ণড়ৎশংযরৎব.ঈযধহপবষষড়ৎ ড়ভ উঁৎযধস.জবপঃড়ৎ ড়ভ এৎধংসধৎপ, ডবংঃসড়ৎষধহফ.অ ঋবষষড়ি ধহফ মৎবধঃ নবহবভধপঃড়ৎ ড়ভ ঝঃ. ঔড়যহ’ং ঈড়ষষবমব. ঈড়সঢ়ঃৎড়ষষবৎ ঃড় খধফু গধৎমধৎবঃ ইবধঁভড়ৎঃ.অ হধঃরাব ড়ভ খধহশধংযরৎব.ইঁৎরবফ রহ ণড়ৎশ গরহংঃবৎ.
মিস ড্রেইক আমাদের কাছে ‘এশটন’ নামের ব্যাখ্যা তুলে ধরলেন। ওই শবাধারে আঁকা ছবি ও প্রতিকৃতির মাধ্যমে কীভাবে অংয এবং ঞড়হ বোঝানো হয়েছে তা তিনি ব্যাখ্যা করলেন। খাঁটি ইংরেজের অর্ধ-উচ্চারিত ভদ্র-জনোচিত ইংরেজি শুনে সব কথা সঠিকভাবে বুঝাও কঠিন। তবু একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা জানা গেল কথা প্রসঙ্গে। তা হলো: অতীতকালে সাধারণ মানুষের অক্ষর-জ্ঞান ছিল খুবই কম। আম-জনতা শুধু নয় ব্রিটেনের অনেক শিক্ষিত লোকও হিব্রু ভাষায় লেখা বাইবেল পড়ে অর্থোদ্ধার করতে পারতো না। তাছাড়াও ধর্মীয় বিষয়াদি সাধারণত ল্যাটিন ভাষায় লেখা হতো বলে এসব ছিল সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। তাই যৌক্তিক কারণেই সাধারণ মানুষকে ধর্ম বোঝানোর জন্য গির্জাগুলোর দরোজা-জানালার কাচে এবং দেয়ালে বা ছাদে নানা ছবি এঁকে ও প্রতিকৃতি তৈরি করে রাখা হতো। বাদবাকি পুরো ধর্মটাই ছিল পাদরিদের ব্যাখ্যানির্ভর। আমরা ধীরে ধীরে সেইন্ট জনস কলেজ থেকে বের হয়ে এলাম।
রাতে ডিনারের পর হোটেল থেকে বের হলাম একা একা রাস্তায় হাঁটার জন্য। বেশ শীত পড়ছে। কানটুপিটা সাথে ছিল বলে রক্ষা। এটা কিনেছিলাম ২০০৩ সালে চীনের বরফ-পড়া ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্য বেইজিং থেকে। হোটেল থেকে বেরিয়ে বাঁয়ে গেলে চৌরাস্তা। সেখান থেকে ডানের পথ নিলাম। এর নাম রিজেন্ট স্ট্রিট। খানিক এগোলেই একপাশে রিজেন্ট হোটেল। রাস্তার নামে হোটেল নাকি হোটেলের নামে রাস্তা বুঝতে পারলাম না। এখন তো সাথে কেউ নেই যে জিজ্ঞেস করবো!পাশেই পিজা হাট এবং এর বিপরীতে ডাউনিং কলেজ। মাঝে মাঝে ছেলেমেয়ের দল (এখানকার ছাত্রছাত্রীই হবে!) গল্প আর হাসাহাসি করতে করতে আমাকে অতিক্রম করছে। কোন কোন দল পাব থেকে বেরুচ্ছে আর কোনটা প্রবেশ করছে। দু’পাশে অনেক আলো ঝলমলে বিল্ডিং। অফিস বা দোকানপাট সবই বন্ধ, পাবগুলো ছাড়া। এই রাস্তাতেই চার্লি-চ্যান এবং ফাউন্টেন ইন। পার হলাম ইমানুয়েল কলেজ। আরেকটু এগিয়ে ডান পাশে পেলাম ইমানুয়েল চার্চ এবং তার প্রায় পাশাপাশি সেইন্ট কুলাম্বস চার্চ।
নতুন কোন জায়গায় এলে আমার ইচ্ছে হয় জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখি, লোকদের সাথে কথা বলি। কিন্তু এখন এই রাত্রি বেলা আমি একা একা হাঁটছি এবং কদাচিৎ যাদের দেখা পাচ্ছি তাদের সাথে আমার বয়সের তারতম্য অনেক। গায়ে পড়ে কারো সাথে কথা বলা শোভন হবে না। তাই দু’পাশের বাড়িঘর এবং পরিবেশ দেখছি। এই এলাকায় আকাশচুম্বী তো নয়ই খুব উঁচু কোন বিল্ডিংও চোখে পড়লো না। বামপাশে একটি নিরিবিলি গলি দেখে সেপথে হাঁটতে থাকলাম। কিছুদূর গিয়েই গলিটা শেষ হয়ে গেল। মনে হলো বিল্ডিংগুলোর পেছনের দিক এটা। তবু বেশ ছিমছাম ও গুছানো; গাদাগাদি ময়লা পড়ে নেই কোথাও। বাড়িগুলোর গড়ন দেখে বুঝা যায় অনেক পুরনো আমলের তৈরি। একটা গেটে সাইন বোর্ড দেখলাম ‘সেইন্ট কুলাম্বস হল’। প্রায় প্রতিটি গেটেই সিসিটিভির ক্যামেরা বসানো। কাছাকাছি যেতেই আলো জ্বলে উঠছে। আবার প্রধান সড়ক ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। আধা কিলোমিটার হাঁটলেই এই রাস্তা সিটি সেন্টারে গিয়ে যুক্ত হয়। সেদিকে কিছু বড়ো বড়ো শপিং মল আছে। আমি আর ওদিকে গেলাম না, হোটেলের দিকে ফিরতে শুরু করলাম। একই পথে না ফেরার জন্য রাস্তা থেকে সরে এসে পার্কের পাশ ধরে হেঁটে সোজা হোটেলে চলে এলাম।