[গত সংখ্যার পর]
‘বোকা, ইউ আর এ গ্রেড ফুল। নৌকা ডুবানোর জন্য ওকে আনবে নাকি? ভার কমানোর জন্যেই তো ওকে রেখে আসতে বলেছি।’
‘বুঝলাম। কিন্তু পরে ওকে ধরবে কিভাবে?’
‘হা হা’ করে হেসে উঠল ফিরোজ। কুৎসিত সে হাসি। হাসির চোটে মুখের দাঁত বশিত্রশটাই বেরিয়ে গেছে।
‘হাসছ যে বড্ড!’
‘হাসি পেলে হাসব না, তো কী করব?’ হাসতে হাসতেই বলল ফিরোজ। ‘ওকে তোমরা ভালো করে চেনো না। সে যাই হোক, পরে ও সম্বন্ধে আলোচনা করব।’
‘আচ্ছা ফিরোজ মামা,’ জিজ্ঞেস করল পিকমিক। ‘কালও কি লাল মিয়া থাকবে আমাদের সাথে?’
‘থাকবে। তবে কাল আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে।’
ভোর হয়ে এসেছে। চারদিক ফরসা হতে শুরু করেছে। দুই এক জায়গা থেকে আজান ভেসে আসছে।
বিপ্লবের এখনও জ্ঞান ফেরেনি। পড়ে আছে বাংলোর সামনে খোলা আকাশের নিচে।
একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ওর। তড়াক করে উঠে বসল। কিন্তু তক্ষুনি আবার শুয়ে পড়ল। মাথাটা ঘুরে উঠেছে। প্রায় আধা মিনিট ওভাবেই পড়ে রইল। ধীরে ধীরে মনে পড়ে গেল রাতের ঘটনাগুলো। এমনিতেই ডান হাতটা উঠে গেল মাথায়। চমকে উঠল- মাথায় ব্যান্ডেজ কোত্থেকে এলো?
মাথার একপাশে সাদা ব্যান্ডেজ ভেদ করে রক্তের লাল দাগ দেখা যাচ্ছে। ব্যান্ডেজের কথা পরে ভাবা যাবে। আগে আবিদ ও সুমির খোঁজ করতে হবে। কিন্তু তার আগে শব্দটার উৎস খুঁজে বের করতে হবে।
আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো। টলোমেলো পায়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাল। নদীর দিকে তাকাতেই ওটা দেখতে পেল। একটা মস্ত পাথর গড়িয়ে যাচ্ছে পানির দিকে। শুকনো ডাল-পাতা ভাঙার মৃদু শব্দ আসছে। প্রথম শব্দটা নিশ্চয়ই পাথরটার পতনের শব্দ ছিল। সেই শব্দই শুনেছে ও। কিন্তু কোথা থেকে এলো পাথরটা? কিভাবে?
‘হাই বিপু ভাইয়া, তুমি এখানে? আর আমি সব জায়গায় খুঁজে বেড়াচ্ছি।’ পরিচিত কণ্ঠ পেয়ে পেছন ফিরে তাকালে বিপু। বেশ চমকালেও সেটা প্রকাশ হতে দিল না। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল।
এ কী? তোমার মাথা তো ফেটে গেছে! কিভাবে হলো এটা?’ চমকে ওঠার ভান করলেও লাল মিয়ার অভিনয় ধরে ফেলল বিপ্লব।
বিপ্লব এবার সরাসরিই বলল, ‘আপনার জন্যই তো এ অবস্থা আমার। কাল রাতে শব্দটা শুনে আপনি চলে যান আমাকে একা ফেলে। আবিদের আলোর সঙ্কেত পেয়ে সেদিকে যাচ্ছিলাম। আপনি আমাকে ঠেকানোর জন্য মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। কিন্তু ভালোমত লাগেনি বাড়িটা। তারপর আপনি পালিয়ে যান, পাছে আমি আপনাকে চিনে ফেলি। কি, ঠিক কি না মিস্টার লাল মিয়া?’
‘তুমি পাগল নাকি? আমি তোমাকে মারতে যাবো কোন দুঃখে?’ রাতের ঘটনা ঢাকার চেষ্টা করল লাল মিয়া।
‘বোকা সাজবেন না আপনি। আসলে ঠিক কী চাইছেন বলুন তো আমাকে?’
‘তুমি এই এলাকা ছেড়ে চলে যাও।’ সোজাভাবে বলল লাল মিয়া। ‘আমাদের ভূতের পেছনে লেগেছ তুমি। ওরা তোমাকে ছাড়বে না। মাথার ব্যান্ডেজটা দেখে সেটা বুঝে নেয়া উচিত তোমার।’
‘আপনি কিন্তু আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন।’ বলল বিপ্লব। ‘কিন্তু আমি যে ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাবার ছেলে নই, এতক্ষণে আপনার সেটা বুঝে নেয়া উচিত ছিল।’ মাথাটা প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছে। ওষুধ খেতে হবে। মিস্টার লাল মিয়া, আমার বন্ধুরা কোথায়? কোথায় আটকে রেখেছেন ওদের?’
এবার বোধ হয় সত্যি সত্যি অবাক হলো লাল মিয়া। বলল, ‘আমি জানি না তোমার বন্ধুরা কোথায়।’ চারপাশটা একবার দেখে নিলো। চোখ আটকে গেল বিপ্লবের ডান পাশে, মাটিতে। ‘ওটা কী?’
‘কোন্টা?’ বলতে বলতে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল বিপ্লব। একটা কাগজ পড়ে থাকতে দেখল। নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিল ও। ভাঁজ করা কাগজটা খুলেলো। তাতে স্পষ্ট বাংলায় লেখা:
বিপ্লব,
আদর নাও। তোমাকে আমি স্নেহ করি। কারণ, গোয়েন্দাদের আমার খুবই পছন্দ। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই নয়। এই যেমন তুমি করছ। গোয়েন্দাগিরি করতে হলেও ভেবে চিন্তে করতে হয়। সব কেসই হাতে নেয়া উচিত না। তোমার ভাবা উচিত ছিল যে এ কেসটায় নামলে বিপদ আসতে পারে। এটা তোমাদেরই কথা। উত্তরে তুমি হয়ত বলবে, ‘আমি বিপদ জেনেই কাজটাতে নেমেছি। কেননা, তুমি হার মানতে রাজি নও। তার প্রমাণ আমি পেয়েছি। তোমার অতীত রেকর্ডও সেটাই বলে। যাকগে ওসব কথা। সময় কম। তাই এবার আসল কথাটা বলি। তোমার বন্ধু আবিদ এবং বোন সুমিকে আমি নিয়ে গেলাম। না না, চমকে উঠবে না। ওদের কোনো ক্ষতি আমি করব না, যথাসময়ে ছেড়ে দেব। তবে একটাই শর্ত- মন দিয়ে শোন। শর্তটা ঠিকমত পালন করলেই ওরা মুক্ত হবে। নইলে, চিরদিনের জন্য হারাবে। শর্তটা হচ্ছে- আগামী মঙ্গলবার রাত দশটা বেজে সতেরো মিনিটের সময় তুমি আসবে এই বাংলোর পশ্চিম পাশের কপোতাক্ষ নদীর ধারে। ছোট্ট একটা নৌকা দেখতে পাবে। ওটা থেকে নামবে একটা কাল আলখাল্লা পরা মূর্তির মত লোক। সে প্রশ্ন করবে, ‘তুমি কী চাও?’ জবাবে তুমি বলবে, ‘সবুজ পাখি। আবার শোনো, তুমি বলবে, সবুজ পাখি।’ লোকটা বলবে, ‘গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেবে?’ তুমি বলবে, ‘হ্যাঁ।’ লোকটা বলবে, ‘ওকে, সবুজ পাখিই পাবে তুমি।’
খবরদার! পুলিশ সঙ্গে আনবে না। তবে আনলেও ক্ষতি নেই। আমার লোক থাকবে সমস্ত দিকে। বহু লোক, সবার হাতে থাকবে উদ্যত রাইফেল। আর হ্যাঁ, ‘সবুজ পাখি’ মানে বুঝেছ তো? ওরা দুইজন- তোমার বন্ধু ও আদরের বোন। কোনো প্রকার গোলমাল কর চাই না আমি। যা বললাম, সেই অনুযায়ী কাজ করবে। একটু এদিকে ওদিক হলে বুঝতেই পারছ কী ঘটবে। সারাজীবন তার মাশুল দিতে হবে। যাক, আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি, আগামী মঙ্গলবার, রাত দশটা সতেরো মিনিট।
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল বিপ্লব। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছে। কিন্তু সামনে তাকিয়ে অবাক হলো। লাল মিয়া নেই। চলে গেছে কোন ফাঁকে। লোকটাকে আরও রহস্যময় মনে হতে লাগল।
চিঠিটা ভাঁজ করে প্যাকেটে রাখল ও। এখন কী করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। আবিদ ও সুমিকে ছাড়া বাড়ি ফিরবে কেমন করে?
পুরোপুরি সকাল হয়ে গেছে। পুব আকাশ চিড়ে উঠেছে থালার মত গোল বড় সূর্যটা। আলোক রশ্মি ছড়াচ্ছে চারদিকে। একবার বাংলোটার দিকে তাকালো বিপু। রাতের মত অমন ভুতুড়ে লাগছে না এখন আর। সাদা রঙের ওপর লাল আলো পড়ে কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
লোকজনের চলাচল শুরু হয়ে গেছে আশপাশে।
আপাতত নির্জন জায়গাটায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ওখানে বসে কিছু ভেবে তারপর যা করার করা যাবে।
নদীর দিকে মুখ করে নরম ঘাসের ওপরে বসল বিপ্লব। হাত ঘড়িটা দেখল একবার। কাচ ফেটে গেছে।
বিপ্লবের আহত মাথায় তখন নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কী করবে ও? চিঠি অনুযায়ীই কাজ করবে? নাকি গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে যাবে? তাতে সঙ্গীদের বিপদ হতে পারে। কিন্তু ওরা বিপদে পড়ার আগেই যদি ওদেরকে খুঁজে বের করা যায়? সে আশা অবশ্য খুবই কম। তাহলে? কী করবে ও?
আচ্ছা, ভাবল ও। লাল মিয়াকে কি সত্যিই সন্দেহ করা যায়? ও কি এই রহস্যের সাথে কোনোওভাবে জড়িত? লোকটা কি আদতে পুলিশের কেউ? নাকি গুণ্ডাদের চর?
কী এই বাংলোর রহস্য? লোকগুলো ওখানে কী করছে? কী উদ্দেশ্য তাদের? কেন অমন আর্তচিৎকারে মানুষের ঘুম নষ্ট করে? ভেতরে ভেতরে গোপন কিছু কি করছে ওরা? সে জন্যই লোকজনকে দূরে রাখতে ওই ব্যবস্থা? কিন্তু পুলিশ সমস্ত বাংলো ঘিরে ফেলার পরও কাউকে পাওয়া যায় না কেন?
এইসব কথা অগোছালোভাবে ভাবতে থাকে বিপ্লব। মাথাটা কেমন ঝিম ধরে আসে। গলা শুকিয়ে আসে। একটা ঢোক গিলে আবার ভাবতে থাকে।
কাল রাতে বিপ্লব কয়েকজন লোককে কিছু মাথায় করে বয়ে বাংলোর ভেতরে ঢুকতে দেখেছে। কিন্তু সেটা আবছাভাবে। গোয়েন্দাগিরিতে কোনো বিষয়কেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। ছোট বিষয় থেকেই অনেক সময় অনেক বড় রহস্যের সমাধান বেরিয়ে আসে। তাই ও বিষয়টা তলিয়ে ভাবতে লাগল। বিপ্লব ইতোমধ্যে জেনেছে বাংলোটার মধ্যে দুটো মাত্র ঘর। একটা ধসে গেছে। অর্থাৎ বর্তমানে একটা ঘর অক্ষত অবস্থায় আছে। স্পষ্ট মনে পড়ছে, গত পরশু রাতে কিছু লোককে ছোট বাক্স বয়ে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখেছে। তাহলে নিশ্চয়ই ওখানে কোনো গুপ্তঘর আছে।
বিপ্লবের এখন একটাই কাজ, বাংলোটা সম্পর্কে আরও বিশদ জানা। সেজন্য ওকে বই ঘাঁটতে হবে।
বিপ্লব সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো- বাংলো রহস্যের সমাধান না করে ও ফিরে যাবে না। তবে তার আগে সঙ্গীদের উদ্ধার করতে হবে। আজ রাতেই সঙ্গীদের খুঁজতে বের হবে। কিন্তু সারাদিনে ও বাংলোর ইতিহাসটা জানার চেষ্টা করবে সম্ভাব্য সব উৎস থেকে। সঙ্গীরা ততক্ষণ নিরাপদেই থাকবে বলে ওর বিশ্বাস।
পাবলিক লাইব্রেরিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো ও। কিন্তু এত সকালে নিশ্চয়ই খোলেনি। তাই নাস্তা সেরে তবেই লাইব্রেরিতে যেতে হবে। তার আগে ফুফুর কাছে একটা খবর পৌঁছাতে হবে। ফুফুকে কী বলবে তাও ঠিক করে ফেলল।
নয়.
সকাল ৮টা ২৫ মিনিট।
নির্জন রাস্তা। এমনিতেই যানবাহন খুব একটা চলে না এদিকে। তার ওপর সকালের এই সময়টাতে অল্প সংখ্যক যানবাহন চলছে। বাহনগুলোর মধ্যে একটি বিদেশী জিপ বেশি চোখে পড়ে। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে হাই স্পিডে চলছে লাল রঙের গাড়িটা। দুই ধারের ছোট ছোট দোকান আর বাড়ি-ঘর দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে পেছনে। মনে হচ্ছে গাড়ি নয়, ওগুলোই চলছে। তবে পার্থক্য এটুকু যে, ওগুলো পেছনে যাচ্ছে আর গাড়িটা যাচ্ছে সামনের দিকে।
ড্রাইভিং সিটে বসে জিপ চালাচ্ছে চিকমিক। পাশে ফিরোজ মামা। পেছনের ছিটে বসে পিকমিক এবং আবিদ ও সুমি।
লাল রঙের জিপটা এসে থামলো একটা একতলা বাড়ির সামনে। বাড়িটার চারিদিক ইটের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। আট ফিট পাঁচিলের ওপর তারের কাটা।
গাড়িটা এতক্ষণ পূর্ব-দক্ষিণ থেকে উত্তর-পশ্চিমে চলছিল। বাড়ির পাঁচিল লম্বায় আঠারো গজ হবে। তার মধ্যখানে লাল গেট। সেই গেটের সামনেই থেমেছে পাজেরোটা।
দরজা খুলে ড্রাইভিং সিট হতে লাফিয়ে নামল চিকমিক। গেটের তালা খুলে গেট ফাঁক করল। তারপর আবার এসে উঠল ড্রাইভিং সিটে। ইচ্ছে করেই গাড়ির দরজা খুলে রাখল সে।
কোন প্রকার শব্দ না তুলেই স্টার্ট নিলো গাড়ি, শাঁ করে ঢুকে গেল খোলা গেট দিয়ে। সবেমাত্র গেট পার হয়েছে, ঠিক তখনই ঘটল অঘটন।
গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল চিকমিক। ব্যস, খোলা দরজা দিয়ে বাইরে ছিটকে পড়ল সে। আর্তনাদ করে উঠল শক্তিশালী ইঞ্জিন। এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগল চাকা। এক্ষুনি কিছু করতে না পারলে অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাবে।
আবিদ আর সুমির মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে। খুবই ভয় পেয়েছে তারা।
পিকমিক পেছনের সিট থেকে লাফিয়ে স্টিয়ারিং ধরতে গেল। ‘থামো’ বলে থামিয়ে দিলো তাকে ফিরোজ। পাশের সিটে সরে এসেছে সে। দুই হাতে স্টিয়ারিং চেপে ধরল। আর মাত্র দশ ফিট সামনে ঘরের দেওয়াল। পা দিয়ে গায়ের জোরে ব্রেক চেপে ধরে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দিল বাম দিকে। শুকনো মাটিতে ঘষা লেগে কর্কশ আর্তনাদ করে উঠল টায়ার। পোড়া গন্ধ ছড়ালো। ঘ্যাচ করে গাড়ির সামনের দুই চাকা ঘুরে গেল বাম দিকে। কিন্তু তবুও শেষ রক্ষা হলো না। গাড়ির সামনের ডান পাশের কোণ দেয়ালে ঠেকল। আর্তনাদ করে থেমে গেল গাড়ি। সামনের সিটে হুমড়ি খেয়ে পড়ল আরোহীরা। সুমির ঠোঁট কেটে গেছে। পিকমিকের পাশে বসে ছিল আবিদ। তাই তার তেমন কোন আঘাত লাগল না। তাকে ধরে ঠেকালো পিকমিক।
মাত্র এক মিনিটের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাগুলো।
গাড়ি থামতেই দরজা খুলে লাফিয়ে নামলো পিকমিক। ভাইয়ের দিকে দৌড় দিল আহত কতটুকু হয়েছে তা দেখার জন্য।
আবিদ ব্যস্ত রইল সুমির ঠোঁট ঠিক করতে।
চিকমিক হাত নিচে রেখে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। উঠে বসার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু ব্যর্থ চেষ্টা, উঠতে পারল না। প্রচণ্ড ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল।
চিকমিককে উঠে বসতে সাহায্য করল পিকমিক। পাশাপাশি বসেছে দুই ভাই। চিকমিকের ডান হাতটা তুলে ধরল ভাই পিকমিক। হাতের একটা আঙুল ভেঙে গেছে। পাশে এসে দাঁড়াল আবিদ, সুমি আর ফিরোজ।
আবিদরা ভুলেই গেছে যে ওরা এখানে বন্দী। এমনকি, এখান থেকে পালাবার কথাও তাদের মনে নেই।
‘তেমন কোন অসুবিধা হয়নি তো?’ মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে প্রশ্ন করল আবিদ।
‘না, কেবল আঙুলটা।’ চিকমিকের জবাব। ‘গাড়ির ক্ষতি কতটুকু?’
‘আঘাত বেশি লাগেনি। আগেই সামলেছি। তবে…’ বলল পিকমিক।
পিকমিকের কাঁধে ভর দিয়ে এগুচ্ছে চিকমিক।
এলাকাটা বেশি নির্জন। মাত্র একটিই ঘর। পাঁচিলে ঘেরা। আশ্চর্য এখানকার সবকিছু। আশ্চর্য এদের স্বভাব। গাড়ির রঙ, পাঁচিলের রঙ, ঘরের দেয়ালের রঙ, সবই লাল। লাল টকটকে। কেমন যেন গা শিরশির করে ওঠে এমন পরিবেশে আবিদ আর সুমির।
দুটো রুমের একটাতে ঢুকেছে ওরা। দক্ষিণ ধারে একটা জানালা। ফুরফুর করে সকালের ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে ভেতরে। বাতাসে উড়ছে জানালার পর্দা। এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে ঘরের পাকা মেঝেয়। বড় রুমটার একপাশে একটা শোবার খাট।
খাটের ওপর দামি চাদর বিছানো। বড় একটা বালিশ এক পাশে।
ঘরের অন্য পাশে টেবিল চেয়ার। টেবিলের ওপর কিছু কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আর আছে একটা টেবিল-লাইট। তবে ঘরের বাইরের দেয়ালের মতো ভেতরের দেয়ালের রঙ লাল না করে সবুজ রঙ করা হয়েছে।
আবিদ আর সুমি খাটের ওপর পা নিচে ঝুলিয়ে পাশাপাশি বসেছে। তাদের পাশে দুই ভাই- চিকমিক ও পিকমিক।
এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে ঘরের জিনিসপত্র দেখছে দুই কিশোর-কিশোরী।
কাঠের ভারি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল ফিরোজ। চেয়ারে বসল এসে। ‘এ কী!’ চিকমিকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখনও ব্যান্ডেজ করনি?’
‘স্যরি, ফিরোজ মামা।’ বলে উঠে দাঁড়ালো পিকমিক।
ভাইকে নিয়ে ঘর হতে বেরিয়ে গেল।
ফিরোজ উঠে ঘরের ধরজার সিটকিনি লাগিয়ে দিল। বসল ওদের পাশে।
‘স্যরি, মাই ডিয়ারস।’ কোমল স্বরে বললো ফিরোজ। ‘এভাবে উঠিয়ে আনতে বাধ্য হলাম। এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।’
‘আমাদেরকে ছেড়ে দেবেন কখন?’ কাঁদো কাঁদো ভাবে জিজ্ঞাসা করল সুমি।
‘আজ রাত দশটা সতেরো মিনিটে।’
‘সত্যি।’
‘তিন সত্যি।’
‘ছেড়েই যদি দেবেন, তাহলে আমাদের কেন ধরে এনেছেন?’ আবিদের প্রশ্ন।
‘বলবো, সব বলবো। তবে এখন না, পরে।’ বলে একটু থামল ফিরোজ। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘এখন আমি প্রশ্ন করবো, তোমরা উত্তর দেবে।’
সুমির অবশ্য এদিকে খেয়াল নেই। কী যেন ভাবছে সে। লোকটার কথাগুলো কেমন পরিচিত লাগছে তার কাছে- সেটাই ভাবছে। কী একটা বিষয় মনে আসি আসি করেও আসছে না। কোথায় দেখেছে লোকটাকে সে? বাড়িতে? আব্বুর সাথে? কিন্তু সেই চেহারা…
‘এই সুমি, কী ভাবছ?’ আবিদের প্রশ্নে বাস্তবে ফিরে এলো সুমি। বলল, ‘না, কিছু না।’
‘তোমাদের আমি একবার মানা করেছিলাম বাংলোর ধারে কাছে ঘুরঘুর করতে।’ নিজের কথা বলতে শুরু করলো ফিরোজ। ‘আবার গিয়েছিলে কেন?’
আবিদ এ কথার কোনো জবাব দিল না। মুখ নিচু করে বসে রইল। সুমি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে।[চলবে]