Home স্বপ্নমুখর জীবন উন্নত চরিত্রের সন্ধানে -আমিনুল ইসলাম ফারুক

উন্নত চরিত্রের সন্ধানে -আমিনুল ইসলাম ফারুক

সততা, নৈতিকতা, সংবেদনশীলতা, বিশ্বাস, সাহস ও ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে গঠিত হয় মানুষের চরিত্র। আমাদের প্রতিটি কাজে ও ব্যবহারে চরিত্র প্রতিফলিত হয়। মানুষ যদি গরিবও হয় কিন্তু সে যদি উন্নত চরিত্রের অধিকারী হয় তবে তার সব আছে। কিন্তু টাকায় ভরপুর অথচ চরিত্রহীন তাহলে ঐ লোক সমাজের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। সেই অমূল্য সম্পদ চরিত্রকে ছোটবেলা থেকে গঠন করতে হয় এবং সারাজীবন মূল্যবান রতেœর থেকেও সযতেœ লালন করতে হয়। এই চরিত্র নিয়েই আজ তোমাদের কিছু কথা বলছি-
চরিত্রের কিছু অংশ মাতৃগর্ভ থেকে তৈরি হয়। কিছুটা তৈরি হয় শৈশবের পরিবেশ থেকে। ছোট বেলার স্কুল-মাদরাসার পরিবেশ, সঙ্গী-সাথী সবাই তোমার চরিত্র গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। বড় হতে গেলে চরিত্রের কিছু গুণ তো খুবই দরকার। যেমন : ধৈর্য, বিনয়, সহিষ্ণুতা, শিষ্টাচার ও লেগে থাকার ক্ষমতা। বাধা-বিপত্তিতে পিছিয়ে গেলে চলবে না বরং বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়েই যে এগিয়ে যাবে তার কৃতিত্বই সবচেয়ে বেশি। পরিশ্রমী হওয়া, নিয়মানুবর্তী হওয়া আর স্বাবলম্বী এই তিনটি গুণ যার চরিত্রে আছে তাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না, সে বড় হবেই।
ফরাসি দার্শনিক ও গণিতবিদ ব্লেইস পাস্কেলকে (১৬২৩-১৬৬২) একবার তাঁর এক অনুজ বলেছিলেন- ‘আপনার মতো আমার মেধা থাকলে আমিও ভালো মানুষ হতে পারতাম।’ পাস্কেল জবাব দেন- ‘আগে ভালো চরিত্রের মানুষ হও তাহলে তুমি আমার মেধা পাবে।’
আইনস্টাইন প্রায়শই তাঁর কলিগদের উৎসাহিত করতেন এই কথাটি বলে ‘Most people say that It’s the intellect which makes a great scientist; they are wrong, it’s character.’
আমেরিকার জাতির জনক ও প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৩২-১৭৯৯) তাঁর নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরবর্তী ভাষণে বলেছিলেন- ‘আশা করি আমার এমন দৃঢ়তা ও সদগুণ আছে যা দিয়ে আমি সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ও সৎ মানুষের চরিত্রকে রক্ষা করতে সমর্থ হবো।’ ওয়াশিংটন তাঁর জীবদ্দশাতেই আমেরিকাকে একটি সম্মানজনক জায়গায় পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন শুধু তাঁর চরিত্রের শক্তির বলে। নির্বাচন কিংবা জনমত নয়, নেতার উন্নত চরিত্রই একটি দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করে। যিনি নেতা হবেন সততার ব্যাপারে তার কোনো অস্পষ্টতা থাকা উচিত নয়। সাফল্যের পথে অনেক বাধা-বিপত্তি আছে। পদস্খলনের সম্ভাবনা রোধ করার জন্য চরিত্রের শক্তি এবং চেষ্টার প্রয়োজন হয়। অথচ চেষ্টা করতেও জ্ঞানের দরকার হয়। জ্ঞান তোমার ভেতরে শক্তি জোগাবে এবং উত্তম চরিত্র তোমাকে সম্মানিত নেতায় পরিণত করবে।
কেন বেশির ভাগ মানুষ সাফল্য পছন্দ করে কিন্তু সফল মানুষকে ঘৃণা করে? ঘৃণা এই কারণে করে যে, সফলতার শীর্ষে গিয়ে তারা অতীতের চরিত্র ভুলে যান এবং পারলে অধস্তন সব মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করেন। আবার এমন কিছু মানুষ আছেন যারা চরিত্রের বলে বলীয়ান হয়ে যখন গড়পড়তা মানুষের ওপরে উঠে যান তখন হিংসুক লোকেরা তাদেরকে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেন। এটি সব যুগে সবার সাথেই হয়ে আসছে। পাহাড়ের চূড়ায় যে ব্যক্তি উঠেছেন তিনি অনায়াসে সেখানে পৌঁছে যাননি। তাকে অনেক কষ্ট স্বীকার করে ও বাধা মোকাবিলা করেই ওপরে চড়তে হয়েছে। আমাদের জীবনও এর ব্যতিক্রম নয়। যে কোনো পেশায় সফল ব্যক্তিকে অসফল ব্যক্তিরা নিশ্চিতভাবে ঈর্ষা করে থাকেন। সমালোচনা যেনো তোমার লক্ষ্যে পৌঁছবার অনন্যচিত্ততাকে ক্ষুণœ করতে না পারে সেদিকে অবশ্যই নজর রাখবে। গড়পড়তা মানুষ সমালোচকদের সাথে সমালোচনায় জড়িয়ে পড়ে। অথচ দৃঢ় চরিত্রের মানুষেরা সমালোচকদের সাথে নিয়ে চলেন এবং তাদের ভালো কাজের প্রশংসা করেন। যে কোনো বিষয়ে সমালোচকদের চ্যালেঞ্জ জানাবার মতো ক্ষমতা রাখেন। তাদের ভালো দিকটি গ্রহণ করেন এবং খারাপ দিকটি ছুড়ে ফেলেন। তবে ব্যতিক্রম কিছু না করলে তোমার সমালোচনাও হবে না। যত বেশি লক্ষ্য সিদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে ততই সমালোচিত হবার ঝুঁকি বাড়বে। মনে হয় সাফল্য ও সমালোচনার মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে। সাফল্য যত বেশি সমালোচনাও তত বেশি। যারা প্রত্যেক বস্তুর দাম জানেন কিন্তু কোনো বস্তুরই প্রকৃত মূল্য জানেন না তারাই মূলত ক্রিটিক বা সমালোচক। কিন্তু প্রকৃত সমালোচক হচ্ছেন তারা যারা প্রত্যেক বস্তুর আসল দাম জানেন এবং সে অনুযায়ী তার মূল্যায়ন করতে পারেন।
দৃঢ় চরিত্রের মানুষ হবে কুসুমের মতো কোমল এবং বজ্রের মতো কঠোর। যা তিনি সত্য বলে বুঝবেন তার জন্য জীবন দেবেন। সত্যের জন্য তিনি সবকিছু ত্যাগ করবেন কিন্তু সব কিছুর বিনিময়েও সত্যকে ত্যাগ করবেন না। দৃঢ়চেতা মানুষের সামান্য দুঃখে তার চোখ ফেটে পানি আসবে। তিনি কোনো অবস্থাতেই মানুষের হৃদয়ে আঘাত দেবেন না। এরই নাম মহত্ত্ব। কত সাধারণ মানুষ এই মহত্ত্ব দেখিয়ে অসাধারণ মানুষে পরিণত হয়েছেন। মহত্ত্বের শক্তির বলে অমর হয়ে আছেন।
সেনাপতি ফিলিপ সিডনির (১৫৫৪-১৫৮৬) মহত্ত্বের কথা বলছি–
যুদ্ধক্ষেত্রে আহত ফিলিপ সিডনি পিপাসার্ত হয়ে যখন তার বোতলের পানি পান করতে যাবেন তখন দেখলেন, এক আহত সৈনিক তাঁর দিকে সতৃষ্ণ নয়নে চেয়ে আছে। সিডনি মুখে আর পানি গ্রহণ করতে পারলেন না। তিনি বললেন- ‘তোমার প্রয়োজন আমার চেয়ে বেশি’ এই বলে পানির বোতলটি তার দিকে ছুড়ে দিলেন। পানির অভাবে সেনাপতি ফিলিপ এর মৃত্যু হলো যুদ্ধক্ষেত্রেই কিন্তু তাঁর চারিত্রিক আদর্শ দেদীপ্যমান হয়ে জ্বলছে দ্বিপ্রহরের সূর্যের মতো।
উহুদ যুদ্ধক্ষেত্রের মহত্ত্বের চিত্র আরও বেদনাদায়ক, আরও হৃদয়স্পর্শী। মৃত্যুর পথযাত্রী একজন আহত সাহাবি যখন পানির পেয়ালা হাতে নিলেন তখনই দেখলেন পাশের আরেকজন মুজাহিদ ভাই পানির পিপাসায় মারা যাচ্ছেন। সাথে সাথে তিনি পানির পেয়ালাটি তাকে দিয়ে দিলেন। আবার দ্বিতীয়জন যখন পানি পান করতে যাবেন ঠিক তখনই দেখলেন তার পাশের আরেক ভাই পানি পানি বলে চিৎকার করছে। তিনি তৃতীয়জনকে পানির পেয়ালাটি দিয়ে দিলেন। এভাবে একটি পানির পেয়ালা ত্রিশ জন সাহাবির হাত বদল করেছিল। সবশেষে সেই পানি পান করার সুযোগ লাভ করে আহত এক কাফের সৈনিক। চরিত্রের কী অসাধারণ শক্তি! কী মহত্ত্বের পরিচয়! হৃদয় শিহরিয়া ওঠে। শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়। মহৎ চরিত্রের মানুষ কোনো অবস্থাতেই বদলায় না। শত্রুকেও সে ক্ষমা করে এবং তাদের প্রতি উপকারী মনোভাব পোষণ করে। সব অবস্থাতেই সকলের সাথে সমান ব্যবহার করে।
চরিত্রবান মানুষ হবে বিনয়ী মানুষ। বিনয় মানে নম্রতা, ভদ্রতা ও মানুষের সাথে ভালো আচরণ করা। হামবড়া বা অহংকারীকে কেউ পছন্দ করে না। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী না হলে বিনয়ী হওয়া যায় না। আর চারিত্রিক শক্তি অর্জিত না হলে বিনয়ী হয়েও তা বেশিদিন ধরে রাখা যায় না। প্রকৃত শিক্ষিত ব্যক্তি সর্বদা-ই বিনয়ী হয়ে থাকেন। তাদের কথাবার্তার মধ্য দিয়ে অহংকার ফুটে ওঠে না। তারা নিজেদের আত্মপরিচয় ও মূল্য জানেন এবং তার মান বজায় রেখে চলেন। মুখে বড় বড় কথা বলে তো লাভ নেই। প্রকৃত বিদ্বান জানেন, বিদ্যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। তাই বিদ্যার অহংকার করে লাভ নেই। বরং বিনয়ই বিদ্যাকে আরও ঝলমলে করে তোলে। বিনয়ীরা নিজে নত হয়ে বড় হন আর নির্বোধ ব্যক্তিরা নিজেকে বড় বলে অপদস্থ হন। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কেমন বিনয়ী ছিলেন তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি–
আইনস্টাইন একবার গেছেন প্যারিসের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানিক উপাধি নেবার জন্য। একটি পুরনো স্যুটকেস নিয়ে তিনি উঠেছেন একটি সাধারণ হোটেলে। তখন তাঁর নাম, যশ জগৎজোড়া। কিন্তু তিনি হোটেলে ওঠার আগে কাউকে এ কথা বলেননি যে, তিনিই বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন।
পরদিন এক ভদ্রলোক এসেছেন হোটেলে। হোটেলের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘আচ্ছা, বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কোন হোটেলে উঠেছেন বলতে পারবেন? ম্যানেজার বললেন- ‘বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন? নাতো! তিনি এখানে কোথা থেকে আসবেন? তবে আইনস্টাইন নামে একজন ভদ্রলোক গতকাল এসে উঠেছেন। মনে হচ্ছে ভদ্রলোক কোনো সেলসম্যান-ট্যান হবে।’ ভদ্রলোক খাতা খুলে বললেন- ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ইনিই তো সেই বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন।’ ম্যানেজারের কাছে কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাই কখনো কি হতে পারে? আইনস্টাইন কাউকে কিছু না বলে এভাবে একটি পুরনো স্যুটকেস নিয়ে সাধারণ মানুষের মতো ঘুরে বেড়াতে পারেন এবং সাধারণ একটি হোটেলে রাত্রিযাপন করতে পারেন?
কিন্তু আইনস্টাইনকে ডেকে ম্যানেজার যখন জিজ্ঞেস করলেন, তখন আইনস্টাইন মিটিমিটি হেসে জবাব দেন- ‘আমিই সেই বিজ্ঞানী।’ আইনস্টাইন এর মুখে এই কথা শুনে ম্যানেজার তখন বিস্ময়ে থ মেরে রইলেন।
বিনয়ী হওয়া তোমার নিজের ভালোর জন্যই দরকার। কারণ তুমি যত বেশি বিনয়ী হবে মানুষের কাছে তোমার গ্রহণযোগ্যতা তত বাড়বে। শিক্ষকেরা সেই ছাত্র-ছাত্রীকে বেশি ভালোবাসেন যে নাকি বিনয়ী। পিতা-মাতা সেই সন্তানকে বেশি স্নেহ করেন যে সন্তান বিনয়ী। কর্মীরা সেই নেতাকে বেশি শ্রদ্ধা করেন যিনি তাদের সাথে বিনয়ী আচরণ করেন। সতত যে কিছু না কিছু শিখতে চায় সে আত্মসমর্পণ করে অথচ আত্মমর্যাদা বিসর্জন দেয় না। শুধু তাই নয়, আল্লাহর কাছেও সেইসব অর্থশালীরা সবচেয়ে বেশি প্রিয় যারা ধনী হবার পরও গরিবের মতো বিনয়ী। তোমাদের মধ্য থেকে ভবিষ্যতে যারা শিক্ষক, বক্তা, ব্যবসায়ী কিংবা রাজনীতিক হতে চাও তাদের আরও বেশি বিনয়ী হওয়া দরকার। ছোটবেলা থেকেই জনসংযোগ করা প্রয়োজন। সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলার অভ্যাস গড়ে তোলো। বছরে কম করে হলেও দু’বার এলাকার সর্বস্তরের মানুষের সাথে কুশলাদি বিনিময় করো। ঈদগাহ কিংবা বিভিন্ন সামাজিক সভা-সমাবেশে বক্তৃতা রাখো। এর মধ্য দিয়ে তোমার সাহস, আত্মবিশ্বাস, ব্যক্তিত্ব ও পরিচিতি সবই বাড়বে।
বিনয়ী বেশি বয়সে হওয়া যায় না। কারণ এটি একটি অভ্যাস। অবশ্য এটি একটি মূল্যবোধও। বড় হলে স্বভাবের সাথে মূল্যবোধ মিশে যায় না। তখন সেটি হয় বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল। অনেকে কৌশল হিসেবে বিনয়কে নেয় এবং যেখানে দরকার সেখানে প্রয়োগ করে। কিন্তু আমি চাই বিনয় তোমার চরিত্রের অলংকার হয়ে সর্বাঙ্গে শোভাবর্ধন করুক। যাতে তুমি যেখানে যাবে সেখানেই মনের অজান্তে তা প্রতিফলিত হয়। তুমি ইচ্ছে না করলেও অনায়াসে দাম্ভিক কিংবা অহংকারী হয়ে যেতে পারবে কিন্তু বিনয়ী হওয়াটা অত সহজ নয়। কারণ বিনয়ী হতে হলে প্রয়োজন অসাধারণ আত্মসম্মান, উন্নত রুচিবোধ এবং মানসিক শক্তিমত্তার। আজ এ পর্যন্তই। সবাই ভালো থাকবে, সুস্থ থাকবে।

SHARE

Leave a Reply