কনকনে কুয়াশায় ঢাকা শীতের সকাল। শরীরে গরম কাপড় পরে বিদ্যালয়ের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে শতেক শিক্ষার্থী। একটু পরে অ্যাসেম্বলি শুরু হবে। অন্যদের সাথে রাতুলও অ্যাসেম্বলির লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। সে ক্লাস সেভেনে পড়ে। পড়াশুনায় তেমন একটা ভালো নয়। এইতো আগের ক্লাসেই বার্ষিক পরীক্ষায় এক বিষয়ে ফেল করেছিলো। বাবার অনুরোধে কর্তৃপক্ষ তাকে ক্লাস সেভেনে পড়ার সুযোগ দেয়। তবে শর্ত বাঁধা ছিলো অনেক। যদি ক্লাস সেভেনের কোনো পরীক্ষায় ফেল করে তাহলে আর কোনো অনুরোধ কাজে আসবে না। রাতুলের বাবা শর্তগুলো নিঃসঙ্কোচে মেনে নেওয়াতে তার ক্লাস সেভেনে পড়ার সুযোগ হয়। কিন্তু ক্লাস সিক্সের বার্ষিক পরীক্ষার চেয়ে আরো এক বিষয়ে বেশি মানে ক্লাস সেভেনে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় দুই বিষয়ে ফেল করেছে। এবার তো আর উপায় নেই। প্রধান শিক্ষকের পরিষ্কার কথা- রাতুলকে আর বিদ্যালয়ে রাখা যাবে না। কিন্তু প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির ছেলেও ফেল করে। যার কারণে তার ছেলেকে সুযোগ দেয়ার খাতিরে সবাইকে সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব করেন।
সেজন্য রাতুলও সেই সুযোগে পার পেয়ে যায়। বার বার ফেল করা আর এইভাবে রিকুয়েস্ট করে পাস করা তার কাছে খারাপ লাগতো। কিন্তু ওর এইসব পড়াশুনা ভালো লাগে না। তাই এই সব খারাপ লাগা সাময়িক হয়েই থাকে। প্রথম সাময়িক পরীক্ষার পর দেখতে দেখতেই তিনটি মাস চলে গেলো।
আজ ওর দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে। ফলাফল কী হবে সে জানে না। তাই আনমনে অ্যাসেম্বিলিতে দাঁড়িয়ে আছে। শপথবাক্য পাঠ করিয়ে প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য শেষে অ্যাসেম্বলি শেষ হলো।
সবাই নিজ নিজ ক্লাসে চলে গেলো।
রাতুল ক্লাসে এসে চুপ করে বসে আছে। কারো সাথে কথা বলে না। আগের মতো বন্ধুদের সাথে মিশে আড্ডাও দেয় না। তার বন্ধুরাও চিন্তা করে পায় না ক্লাসের এতো দুষ্টু ছেলে কেমন করে এতো নীরব হলো। আর কী জন্যই বা এতো আনমনা? বন্ধুরা উত্তর খুঁজে পায় না। তাই তার বিষয় নিয়ে আর কেউ মাথাও ঘামায় না।
ক্লাস শুরু হলো। ক্লাস টিচার এসে সবার রোল কল করলেন। রোল কল করে সবার উদ্দেশে বললেন,
‘আজ তো ফলাফল প্রকাশ হবে। তো কী অনুভূতি তোমাদের?’ কেউ কথা বলছে না। তাই স্যারই উত্তর দিয়ে বললেন, আচ্ছা কথা বলার দরকার নেই। নেক্সট ক্লাসে শামীম স্যার এসেই তোমাদের ফলাফল দিয়ে যাবেন। তখন দেখা যাবে কে কী করেছো। কথাটা শেষ করেই স্যার একটু রহস্যময় ভঙ্গিতে রাতুলকে দাঁড় করালেন। দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাস করলেন,
‘আচ্ছা রাতুল কী খবর তোমার? এইবার নিয়মিত পাস করবে তো?’
– জানি না স্যার।
– দ্বিতীয় ক্লাসেই তো ফলাফল দেবে। তোমার জন্য হয়তো খারাপ সংবাদ আসতেছে।
রাতুল চুপ করে বেঞ্চে বসে পড়লো। স্যারও কথা বাড়ালেন না। ক্লাস শুরু করলেন।
প্রথম ক্লাস শেষ হলো। একটু পরে শাহীন স্যার এলেন। ফলাফল ঘোষণা করতে লাগলেন। প্রথমেই তিনি যারা দুই বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে তাদের নাম ঘোষণা করেলন। কিন্তু এখানে দু-একজনের নাম থাকলেও রাতুলের নাম নেই। এবার এক বিষয়ে অকৃতকার্যদের নাম ঘোষণা হলো। এখানেও অনেক জনের নাম এলো। কিন্তু রাতুলের নাম নেই। অনেকেই ধারণা করে নিয়েছিলো রাতুল হয়তো দুই বিষয়ের বেশি বিষয়ে ফেল করেছে। তাই ফলাফল তালিকায় তার নাম আসেনি। এবার শাহীন স্যার ৩৯ জন নিয়মিত পাসকৃতদের নাম ঘোষণা করতে লাগলেন। স্যার প্রথমে চতুর্থ থেকে ৩৯তম রোল প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর নাম ঘোষণা করে আবার তৃতীয় থেকে উলটো ফল দিতে লাগলেন। তৃতীয় হয়েছে জান্নাত আফরিন। দ্বিতীয় হয়েছে জাহেরা আহমদ তানজি এবং প্রথম হয়েছে রাতুল নাওয়াজ। রাতুল এটা শুনে আনন্দে চমকে উঠলো। কিন্তু ক্লাসের সবাই তখন অবাক হয়ে বসেছিলো। কেউ বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে রাতুল প্রথম হয়েছে। স্যার ফলাফল ঘোষণা শেষ করে ক্লাস করাতে লাগলেন।
এভাবে করে বেলা তিনটা পর্যন্ত ক্লাস চললো। রাতুলও আনন্দমনে ক্লাস করলো।
বিদ্যালয় ছুটি হয়েছে। ব্যাগ পিঠে নিয়ে খুশিতে সে বাড়ি ফিরলো। কিন্তু বাড়ি ফিরে তার মন খারাপ হয়ে গেলো। আজ সে প্রথম হয়েছে। সেই খুশিটা যার কাছে প্রকাশ করবে তা হলো তার বাবা। কিন্তু তার বাবা গত দুই মাস আগেই মারা গেছেন। রাতুলের মা তার বয়স যখন ছয় তখনই তাকে রেখে চলে যান না ফেরার দেশে। তখন থেকেই তার বাবা তাকে মায়ের স্নেহ দিয়েই বড় করেন। তাই তার কাছে বাবা মানে শুধু বাবা নয় ছিলেন তার মায়েরও প্রতিচ্ছবি। আর এই আনন্দঘন মুহূর্তে বাবাকে বাড়িতে দেখতে না পেয়ে তার খুশির চেয়ে কষ্ট দ্বিগুণ হয়ে যায়। তাই ঘরে ঢুকে কাপড় বদল করেই রাতুল এক দৌড় দিয়ে ছুটে এলো নদীর ধারে। নদীর পানি স্তব্ধ হয়ে আছে। শীতের কুয়াশা জমা দৃশ্যের সাথে পুরনো কথাগুলোও চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। বাবার স্নেহ, আদর, শাসন মনে হতে হতে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আর কিশোর মনে একা একা বলতে লাগলো, বাবা তুমি কি দেখতে পারছো আমি আজ বিদ্যালয়ে প্রথম হয়েছি? আর কখনো তোমাকে আমার জন্য অনুরোধ করতে হবে না বাবা। তুমি যখন অসুস্থ ছিলে তখন আমায় বলছিলে না, আমি মন দিয়ে পড়াশুনা করতে? বিশ্বাস করো বাবা আমি এখন নিয়মিত মন দিয়ে পড়াশুনা করি। তুমি বলেছিলে না আমি আর দুষ্টুমি না করতে? হ্যাঁ বাবা আমি আর দুষ্টুমি করি না। এখন খুব শান্ত হয়ে গেছি বাবা। কী বাবা? তুমি আসবে না? আমার ফলাফল শুনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বুকে জড়িয়ে নেবে না? রাতুল চিৎকার করে কথাগুলো বলতে লাগলো। যে কথাগুলো কোনো প্রত্যুত্তর নেই। তাই সে প্রশ্নগুলো মুক্ত বাতাসে উড়ো চিঠির খামে করে অচিন ঠিকানায় বাবার কাছে পাঠিয়ে দিলো।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলো। সবাই নিজ নিজ গৃহে ফিরে আসতে শুরু করলো। রাতুলও ফিরলো। তবে সেই ফেরাটা অন্য দিনের মতো নয়। এই ফেরাটা শত আনন্দের মাঝে হাজারো কষ্ট বুকে নিয়ে ফেরা। যার পুরোটাই জুড়ে ছিলো বাবার স্মৃতি।