Home বিজ্ঞান ও বিশ্ব সমুদ্রের পানি লবণাক্তের কারণ – আবির হাসান

সমুদ্রের পানি লবণাক্তের কারণ – আবির হাসান

সমুদ্রের পানি লবণাক্তের কারণ - আবির হাসানপৃথিবীর তিন ভাগ পানি আর এক ভাগ মাটি। খাল-বিল, পুকুর, হ্রদ- সব জায়গায়ই থাকে পানি। কিন্তু এসব জায়গার পানি সাধারণত লবণাক্ত হয় না। সমুদ্রের পানি সবসময়ই লবণাক্ত।
সাধারণ খাদ্যলবণের আণবিক গঠন, সোডিয়াম ও ক্লোরাইড আয়ন মিলিত হয়ে তৈরি হয় সোডিয়াম ক্লোরাইড লবণ। বৈজ্ঞানিক ভাষায়, সাধারণ খাদ্য লবণ হলো সোডিয়াম ক্লোরাইড; সোডিয়াম ও ক্লোরিন দুটোই বিষাক্ত পদার্থ, অথচ দুই বিষ মিলে তৈরি করছে অতি প্রয়োজনীয় লবণ। লবণ ছাড়া তরকারি কিংবা খাবারের কথা যেমন কল্পনা করা যায় না, সমুদ্রকেও লবণ ছাড়া কল্পনা করা যায় না। সমুদ্রের পানিতে লবণ আছে বলেই সমুদ্র এত সৌন্দর্য ধারণ করে আছে যে বারে বারে আমাদেরকে কাছে টেনে নিতে পারে।
সমুদ্রের পানির ভেতরে লবণ আসে মূলত ডাঙা বা স্থলের পাথর থেকে। বৃষ্টিপাতের সময় বৃষ্টির যে ফোঁটাগুলো ডাঙায় পড়ে সেগুলোতে আশপাশের বাতাস থেকে কার্বন-ডাইঅক্সাইড মিশে যায়। কার্বন-ডাইঅক্সাইড আর পানি মিলে তৈরি করে কার্বনিক অ্যাসিড, যার ফলে বৃষ্টির পানি একটু অ্যাসিডিক হয়ে যায়।
এই বৃষ্টির পানি যখন পাথরের গায়ে পড়ে, তখন এর ভেতরের অ্যাসিড পাথরের গা বেয়ে নামে এবং আয়ন তৈরি করে। এই আয়নগুলো আবার গড়িয়ে পড়ে নদী বা হ্রদের পানিতে। সেখান থেকে গিয়ে মেশে সমুদ্রের পানিতে।
এভাবে বিভিন্ন রকম আয়ন সমুদ্রের পানিতে থাকে। এগুলোর মধ্যে কিছু সামুদ্রিক জীব খাদ্য উৎপাদন ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করে এবং সমুদ্রের পানি থেকে সরিয়ে ফেলে। বাকিগুলো সমুদ্রের পানিতেই মিশে থাকে।
দীর্ঘ সময় এভাবে সমুদ্রের পানিতে থেকে আয়নগুলোর পরিমাণ বাড়তে থাকে। এসব আয়নের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় সোডিয়াম ও ক্লোরিন। সমুদ্রের পানিতে এই দুটোর পরিমাণ ৯০ শতাংশ। এ জন্যই সমুদ্রের পানি লবণাক্ত হয়।
আমরা সবাই জানি যে পৃথিবীর যতসব ময়লা-আবর্জনা রয়েছে, সবকিছু নদী ঘুরে সমুদ্রেই পতিত হয়। মানবজাতির শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত ময়লার পরিমাণ নিশ্চয়ই কম নয়, এত এত আবর্জনা সমুদ্রে গিয়ে পতিত হয়, তবুও সমুদ্র তার সৌন্দর্য ধরে রাখে। দূষিত হয়ে যায় না সমুদ্র, যেমনটি হয় নদী কিংবা খালের পানি। এর কারণ লবণ। লবণের উপস্থিতির কারণেই সমুদ্রে ময়লা-আবর্জনা জমে না থেকে সমুদ্রকে দূষণমুক্ত রাখে।
সমুদ্রের এই লোনা পানিতে হাবুডুবু খেলে কেমন অনুভূতি তৈরি হবে একবার ভাবুন তো! মুহূর্তের মাঝে তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার অবস্থা হবে, সেই সাথে সাধারণ পানির জন্য তীব্র আকাক্সক্ষাও তৈরি হবে। কিন্তু সমুদ্রের লোনা পানি পানে কেন আমাদের এত তৃষ্ণা পায়! আসলে অতিরিক্ত লবণাক্ত সমুদ্রের পানি খেয়ে নিলে আমাদের শরীরে প্রধানত যা ঘটে সেটি হলো ডিহাইড্রেশন অর্থাৎ পানিশূন্যতা। সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়ে হঠাৎ করে কয়েক ঢোক পানি গিলে ফেললেন, সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড তৃষ্ণা পায়।
লবণাক্ত স্বাদের কারণ তো আছেই, সেই সাথে দেহের অতিরিক্ত লবণকে ছেঁকে বের করবার দায়িত্ব পেয়ে যায় শরীরের বৃক্কদ্বয়। অতিরিক্ত লবণকে বের করে দিতে হলে পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় বের করতে হবে, সে ক্ষেত্রে শরীরে পানির পরিমাণ কমে আসে। তাই মস্তিষ্কের প্ররোচনায় আমাদের এমন দৈত্যাকার তৃষ্ণা পায় লবণাক্ত পানি পানের পর।
সমুদ্রের পানি লবণাক্তের কারণ - আবির হাসানমানবদেহের কোষগুলো একটি পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে যাকে সেল মেমব্রেন অথবা কোষঝিল্লি বলা হয়। দেহে যখন লবণ প্রবেশ করে তখন সেই লবণ যাতে কোষের অভ্যন্তরে ঢুকতে না পারে সেই ব্যাপারটি নিশ্চিত করে কোষঝিল্লি। এমন নয় যে, আমাদের শরীরে লবণ উপস্থিত নয়, একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত লবণ আয়নিত অবস্থায় বিরাজ করে। শরীরের হোমিওস্ট্যাসিস ব্যবস্থা সর্বদা সাধারণ অবস্থা বজায় রাখতে চেষ্টা করে ফিডব্যাক মেকানিজমের মাধ্যমে। কিন্তু শরীরে যখন লবণের উপস্থিতি বেড়ে যায়, তখন আর সেটা সামলানো সম্ভব হয় না। কোষঝিল্লি অর্ধভেদ্য পদার্থের হওয়াতে যদিও যুগপৎভাবে কোষের ভেতরে এবং বাইরে সহজেই কোনো কিছু যাতায়াত করতে পারে না, কিন্তু কোষের বাইরে থেকে ভেতরে পানি প্রবেশ করতে পারে সহজেই। কোষের বাইরে যখন লবণের ঘনত্ব বেড়ে যাবে, সেই ঘনত্ব কমিয়ে আনতে শরীর যখন পর্যাপ্ত পানি পাবে না, তখন কোষঝিল্লি ভেদ করে কোষের সাইটোপ্লাজমে উপস্থিত পানি বেরিয়ে আসতে শুরু করবে যা আমাদের শরীরের জন্য খুব একটা সুখকর ঘটনা নয়। এমনটি হলে কোষগুলো পানি হারিয়ে ধীরে ধীরে চুপসে গিয়ে কোষের জৈবিক কার্যাবলি ব্যাহত হবে। পুরো ঘটনাটি ঘটছে কোষের বাইরে লবণ-পানির ঘনত্ব কোষের ভেতর থেকে বেড়ে যাওয়ায়। অর্ধভেদ্য কোষঝিল্লি দিয়ে কম ঘনত্ব থেকে বেশি ঘনত্বের দিকে অসমোসিস প্রক্রিয়ায় ছুটে আসছে পানি, দুই পাশের ঘনত্বকে সমান করতে। এই অবস্থা এড়াতে হলে অবশ্যই প্রচুর পরিমাণে মিঠাপানি পান করতে হবে। তাহলেই সঙ্গে সঙ্গে দেহে লবণের ঘনত্ব স্বাভাবিক হয়ে এসে কোষের অভ্যন্তরীণ ঘনত্বের তুলনায় কমে যাবে। আর আমরা যখন মিঠাপানি পান না করি, শরীর নিজেই তখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে বৃক্কের মাধ্যমে পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় আয়নিত লবণকে বের করে দিতে শুরু করে। আমরা যেটুকু পানি পান করি, তার থেকে অধিক পরিমাণ পানি শরীর থেকে মূত্রের মাধ্যমে বেরিয়ে যায় তখন। ফলে শরীরে দেখা দেয় পানিশূন্যতা কিংবা ডিহাইড্রেশন। সামান্য লবণাক্ত পানি পানে হয়তো মারাত্মক কোনো অবস্থার সৃষ্টি হবে না, কিন্তু সেই পানকৃত পানির পরিমাণ যদি অত্যধিক হয় যা শরীরের পক্ষে সামলে ওঠা ভার, আর আপনিও যদি মিঠাপানি পানের মাধ্যমে তৃষ্ণা নিবারণ না করেন, তাহলে শরীরে স্বাভাবিক কার্যাবলিতে বড় ধরনের এক পরিবর্তন আসে। শরীরের অতিরিক্ত পানিশূন্যতাকে সামাল দিতে শরীর তখন হৃৎপিণ্ডের গতিকে ত্বরান্বিত করে তোলে। সেই সাথে রক্তনালিগুলোকে তুলনামূলক ছোট করে ফেলে, যার দরুণ রক্তচাপ এবং প্রধান প্রধান অঙ্গগুলোতে রক্তের প্রবাহ কমে যায়। এই অবস্থা যদি বিরাজমান থাকে তবে বিষয়টি আর সহজ পর্যায়ে থাকবে না। অন্য অঙ্গগুলোর কথা বাদ দিয়ে কেবলমাত্র মস্তিষ্কের কথা বলি। মস্তিষ্কে যদি অক্সিজেন না পৌঁছায়, খুব দ্রুতই মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটতে পারে। মস্তিষ্ক নিজের জন্য যে পরিমাণ অক্সিজেন জমা রাখে তা দিয়ে প্রায় ৮ সেকেন্ড চালানো সম্ভব। অক্সিজেন যদি পরিমিত পরিমাণে না পায় মস্তিষ্ক, একজন মানুষ খুব দ্রুতই কোমায় চলে যেতে পারে। ফলে শরীরের অন্য সব অঙ্গের কার্যাবলি ব্যাহত হতে পারে। এ জন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

SHARE

Leave a Reply