Home খেলার চমক স্টিভ স্মিথ সেরাদের সেরা । আবু আবদুল্লাহ

স্টিভ স্মিথ সেরাদের সেরা । আবু আবদুল্লাহ

স্টিভ স্মিথ সেরাদের সেরা । আবু আবদুল্লাহলেগ স্পিনার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক, প্রথম দিকে ব্যাট করেছেন ৮ নম্বরে; কিন্তু ৫ বছর পরে তাকে যখন দলের অধিনায়ক ঘোষণা করা হয় তখন তিনি বিশ্ব ক্রিকেটের এক নম্বর টেস্ট ব্যাটসম্যানের জায়গা দখল করে আছেন। এরপর আবার সাফল্যের চূড়ায় থাকা অবস্থায় বিতর্কে জড়িয়েছেন- হারিয়েছেন অধিনায়কত্ব, হয়েছেন নিষিদ্ধ; কিন্তু সেই কঠিন সময় পেছনে ফেলে ফিরেছেন বীরদর্পে।
এমনই নানা ঘটনা আর বাঁক পরিবর্তনের খেলা স্টিভেন স্মিথের ক্যারিয়ার জুড়ে। সংক্ষেপে স্টিভ স্মিথ নামেই তিনি পরিচিত। অনেক দিন ধরেই বিশ্ব ক্রিকেটে সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন স্মিথ। বিরাট কোহলি, কেন উইলিয়ামসন আর জো রুটের সাথে তার লড়াই অনেক দিনের। তবে এবারের অ্যাশেজ সিরিজের পর ক্রিকেট বোদ্ধারা আর কোন রাখ-ঢাক না রেখেই স্মিথকে সেরাদের সেরা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন।
স্টিভ স্মিথের ক্যারিয়ারের চিত্রটাই ব্যতিক্রম। স্পিন জাদুকর শেন ওয়ার্নের বিদায়ের পর অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচকরা মরিয়া হয়ে খুঁজছিলেন একজন লেগ স্পিনার। সেই সূত্রে দলে ডাক পান স্মিথ, কিন্তু লেগ স্পিনার হয়ে এসে এক পর্যায়ে হয়ে ওঠেন বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান। স্মিথ এখন দলের সেরা তারকা, কিন্তু সেটা ব্যাট হাতে কারিশমা দেখিয়ে। আর অস্ট্রেলিয়া আজো খুঁজে ফিরছে একজন যোগ্য লেগস্পিনার।
স্টিভ স্মিথ সেরাদের সেরা । আবু আবদুল্লাহসিডনিতে অস্ট্রেলিয়ান বাবা ও ইংরেজ মায়ের ঘরে ১৯৮৯ সালের ২ জুন জন্ম তার। ১৭ বছর বয়সে ইংল্যান্ডে চলে যান ক্রিকেট খেলার উদ্দেশ্যে। সেখানে থার্ড ডিভিশন ক্রিকেটে খেলার মাধ্যমে কাউন্টি দলগুলোর নজর কাড়েন। তবে কিছুদিন ইংল্যান্ড ছেড়ে পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। মায়ের সূত্রে তার নাগরিকত্ব আছে ইংল্যান্ডেরও; কিন্তু জাতীয় দল হিসেবে স্মিথ বেছে নেন পিতৃভূমি অস্ট্রেলিয়াকেই। ২০০৮ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে শুরু অস্ট্রেলিয়া জুনিয়র দলের হয়ে। ওই টুর্নামেন্টে অলরাউন্ড নৈপুণ্য দেখিয়ে ৪ ম্যাচে ১১৪ রান করার পাশাপাশি শিকার করেন ৬টি উইকেট। ওই বছরই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক নিউ সাউথ ওয়েলস দলের হয়ে। এরপর ঘরোয়া ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই দারুণ খেলতে থাকেন। স্মিথের পরিচিতি হয়ে ওঠে এমন- যে কিনা লেগ স্পিনের পাশাপাশি দলের প্রয়োজনে ব্যাটও করতে পারেন।
২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেলবোর্নে পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন স্মিথ। একই মাসে শুরু হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ। সেখানেও ডাক পান স্মিথ। একই মাঠে ৫০ ওভারের ম্যাচেও অভিষেক। আর টেস্ট অভিষেক হয়েছে সে বছরই জুনে লন্ডনের লর্ডসে পাকিস্তানের বিপক্ষে। সে বছরই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে অনুষ্ঠিত টি-টোয়ন্টি বিশ্বকাপে রানার্স আপ হয় অস্ট্রেলিয়া। টুর্নামেন্টে লেগ স্পিন করে ১১ উইকেট পেয়েছিলেন স্মিথ। তবে এরপর বোলিংয়ে আর সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেননি।
ফলস্বরূপ ২০১১ সালের অ্যাশেজ সিরিজের পরই বাদ পড়েন টেস্ট দল থেকে। ওয়ানডে দলে জায়গা পেলেও তেমন সুনাম কুড়াতে পারেননি। তবে দুই বছর বিরতির পর ২০১৩ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ দিয়ে আবার ফেরেন টেস্ট দলে। তবে এবার ভিন্নরূপে। এই প্রত্যাবর্তনের পরই তিনি হয়ে ওঠেন ভিন্ন স্মিথ। খেলতে শুরু করেন পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান হিসেবে। মোহালিতে প্রথম ইনিংসেই ৯২ রানের ইনিংস খেলে জানান দেন এবার তিনি নতুন কিছু করতে এসেছেন। দুই মাস পরে জায়গা হয় অ্যাশেজের দলেও। ওভালে অপরাজিত ১৩৮ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ব্যাটিং অর্ডারে চারে উঠে আসেন। হয়ে ওঠেন দলের নিয়মিত সদস্য। ওয়ানডেতে পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পেতে কিছুটা সময় লেগেছে। ২০১৪ সালে ৩৯তম ইনিংসে প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরির দেখা পান। ওই বছরইটাই দারুণ কেটেছে তার।
এর পরের সময়টুকু শুধু নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। দিনের পর দিন নিজেকে নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়। ২০১৫ বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে তার বড় অবদান। ওই আসরে অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রান এসেছে তার ব্যাট থেকেই। টেস্টেও একের পর এক দারুণ ইনিংস উপহার দিতে থাকেন। ‘ফেবুলাস ফোর’ নামে পরিচিত সেরা চার ব্যাটসম্যানের (স্মিথ, কোহলি, রুট, উইলিয়ামসন) একজন হয়ে ওঠেন। ওয়ানডেতে বিরাট কোহিল তার চেয়ে এগিয়ে থাকলেও টেস্টে স্মিথ ক্রমশই চলে যেতে থাকেন অন্যদের চেয়ে ওপরে।
২০১৫ বিশ্বকাপ জিতে অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক অবসরে গেলে ওয়ানডে অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয় স্মিথকে। পরের বছর অধিনায়ক হন সব ফরম্যাটে। ২০১৭ সালে ভারত সফরে তিনটি টেস্ট সেঞ্চুরি করেন, একই বছর অ্যাশেজ সিরিজেও তার ব্যাট থেকে আসে ৩টি সেঞ্চুরি। তার ব্যাটে ভর করেই ৪-০তে অ্যাশেজ জেতে অজিরা।
স্টিভ স্মিথ সেরাদের সেরা । আবু আবদুল্লাহতবে এরপরই ক্যারিয়ারে লাগে কলঙ্কের দাগ। ২০১৮ সালের মার্চে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে কেপটাউন টেস্টের সময় অজি বোলার ক্যামেরন ব্যানক্রফট সিরিষ কাগজ দিয়ে বল ঘষে টেম্পারিং করেন। টিভি ক্যামেরায় বিষয়টি ধরা পড়ার পর স্মিথ স্বীকার করেন তার ও সহ অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নারের পরামর্শে ক্যামেরন ওই কাজ করেন।
ওই ঘটনার পর অন্ধকার নেমে আসে তিনজনের ক্যারিয়ারে। ঘটনার পর দোষ এড়ানো বা অস্বীকার করার কোন চেষ্টা করেননি স্মিথ। সরাসরি স্বীকার করেছেন বোলারকে বল টেম্পারিংয়ের পরামর্শ তিনিই দিয়েছিলেন। বিষয়টি জানতেন সহঅধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নারও। ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন জাতির কাছে। এ ঘটনায় লঘু পাপে গুরুদণ্ড দেয় অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড। আইসিসির আইনে বল টেম্পারিংয়ের শাস্তি এক বা একাধিক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা ও জরিমানা; কিন্তু অস্ট্রেলিয়া বোর্ড দলের ইজ্জতহানির বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। তারা তিনজনকেই নিষিদ্ধ করে।
স্মিথের আর দলে ফেরা সম্ভব হবে কি না সেটি নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ ছিলো। যেখানে অস্ট্রেলিয়ার মতো চূড়ান্ত পর্যায়ের পেশাদারি দল থেকে একবার বাদ পড়লেই আর ফিরে আসার সম্ভাবনা কম সেখানে এক বছরের নিষেধাজ্ঞার পর ফেরার আশা কেউ করেনি। সেই স্টিভ ওয়াহ যুগ থেকেই দেখা গেছে দলটির পাইপলাইনে এত প্রতিভাববান খেলোয়াড় যে কেউ দলে সুযোগ পেলেই স্থায়ী জায়গা করে নেন।
তবে হাল ছাড়েননি স্টিভ স্মিথ। নিষেধাজ্ঞার সময়টিতে বসে থাকেননি। নিয়মিত প্র্যাকটিসের পাশাপাশি খেলেছেন অপেশাদার ক্রিকেটে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের গত আসরেও খেলেছন আইনি বাধা না থাকায়। গত বছরের মার্চে শেষ হয় নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু এর কিছুদিন পর পাকিস্তানের বিপক্ষে ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে জায়গা হয়নি। দল থেকে বলা হয়েছে, আইপিএলে পারফরম্যান্স দেখে বিশ্বকাপের দলে বিবেচনা করা হবে।
ডেভিড ওয়ার্নার আইপিএলে ভালো করলেও স্মিথ পারেননি; কিন্তু তবু বিশ্বকাপ দলে দু’জনকেই রাখলেন অস্ট্রেলিয়ার কর্মকর্তারা। এর দু’টি কারণ প্রথমত, সর্বশেষ এক বছরে অস্ট্রেলিয়া দলের খারাপ পারফরম্যান্স, দ্বিতীয়ত বিশ্বকাপের মতো বড় আসরের স্মিথের অভিজ্ঞতার ওপর ভরসা রাখা। অতীতে দেখা গেছে বিশ্বকাপে কিংবা অন্য যে কোন হাইভোল্টেজ ম্যাচে নতুনদের তুলনায় অভিজ্ঞরা সবসময়ই ভালো করে। তাই তো স্মিথকে দলে নিতে বাধ্য হয় অস্ট্রেলিয়া।
তাদের চিন্তায় যে কোন ভুল ছিল না সেটিও প্রমাণিত হয়েছে। মে মাসে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অনানুষ্ঠানিক তিনটি প্রস্তুতি ম্যাচে ২২, ৯১* ও ৮৯* রানের ইনিংস খেলে বিশ্বকে জানান দেন- ‘আমি আসছি’। এই ফর্মটাকেই টেনে নিয়ে যান ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে। আসরে দলের ব্যাটিংয়ের মূল স্তম্ভ ছিলেন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বিপর্যয়ের মুহূর্তে ৭৩, পরের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ৬৯, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৭৩ রানের তিনটি মূল্যবান ইনিংস খেলেছেন। এরপর সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাটিং বিপর্যয়ের মূখে ৮৫ রানের ইনিংস খেলে এনে দিয়েছেন লড়াই করার মতো পুঁজি।
এরপর অ্যাশেজ সিরিজে খেলতে নেমে প্রথম ম্যাচেই জোড়া সেঞ্চুরি। বার্মিংহামে প্রথম ইনিংসে ১৪৪ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে করেন ১৪২ রান। পরের ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ৯২ রান করার পর ইনিংস পেসার জোফরা আর্চারের বাউন্সারে আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়েন। যার ফলে খেলা হয়নি তৃতীয় টেস্ট। চতুর্থ টেস্টে মাঠে ফিরেই আবার দেখান সেই একই ঝলক। এবার ডাবল সেঞ্চুরি প্রথম ইনিংসে, এরপর আবার দ্বিতীয় ইনিংসে ৮২ রানের ইনিংস। যেন রান করার নেশায় পেয়ে বসেছিল এই রান মেশিনকে।
পঞ্চম ও শেষ টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৮০ আর দ্বিতীয় ইনিংসে ২৩ রান করে আউট হন। পুরো সিরিজে মাত্র ওই একবারই হাফ সেঞ্চুরির নিচে আউট হয়েছেন স্মিথ।
স্টিভ স্মিথ সেরাদের সেরা । আবু আবদুল্লাহএই এক অ্যাশেজে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন স্মিথ। বিরাট কোহলিকে টপকে আবারো ফিরেছেন টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে। কিংবদন্তি ডন ব্রাডম্যানের পর দ্বিতীয় দ্রুততম (১২১ ইনিংসে) ২৬ টেস্ট সেঞ্চুরির কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। এ ছাড়া অ্যাশেজের কোন ম্যাচের দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করা পঞ্চম অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের নাম লেখান স্মিথ।
সব মিলে এবারের অ্যাশেজে রান করেছেন ৭৭৪। এর আগের দু’টি অ্যাশেজে ২০১৫ সালে ৫০৮ ও ২০১৭ সালে ৬৭৮ রান করেন তিনি। টানা তিন অ্যাশেজে পাঁচ শতাধিক রান করার রেকর্ড ডন ব্রাডম্যানেরও নেই। টেস্টে ব্রাডম্যানের অবিশ্বাস্য ৯৯.৯৪ গড়ের পর স্মিথই এখন বিশ্বসেরা। তার টেস্ট গড় ৬৪.৫৬। ৭৯ টেস্ট খেলা বিরাট কোহলির গড় ৫৩।
তাই তো অনেক ক্রিকেট বোদ্ধা স্মিথকে একালের ব্রাডম্যান হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। ওয়ানডেতে অবশ্য স্মিথ কিছুটা পিছিয়ে আছেন। ১১৮ ওয়ানডেতে ৪৪ গড়ে রান প্রায় চার হাজার, সেঞ্চুরি ৮টি। যদিও কোহলির তুলনায় তিনি ওয়ানডে ম্যাচও খেলেছেন অর্ধেকেরও কম। তবে সেঞ্চুরি সংখ্যা দিয়ে নয়, স্টিভ স্মিথকে বিচার করতে হবে তার ম্যাচ জেতার দক্ষতা, প্রয়োজনে ইনিংস মেরামত আর দ্রুত রান তোলার হিসাব দিয়ে।

SHARE

Leave a Reply